Inqilab Logo

সোমবার ১৮ নভেম্বর ২০২৪, ০৩ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১৫ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

রোহিঙ্গা সংকট : চাপের মুখে অর্থনীতি

নি ব ন্ধ

আবুল কাসেম হায়দার | প্রকাশের সময় : ৮ অক্টোবর, ২০১৭, ১২:০০ এএম

রোহিঙ্গা সংকট অর্থনীতিকে চাপে ফেলেছে। এই ইস্যুতে মিয়ানমারের সঙ্গে সম্ভাব্য দ্ব›দ্ব দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর সঙ্গে অর্থনৈতিক সম্পর্কোন্নয়নে বাংলাদেশের প্রচেষ্টাকে ব্যাহত করতে পারে। এ সংকটে পর্যটন খাত সরাসরি ক্ষতিগ্রস্ত হবে। বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিংয়ের (সানেম) এক পর্যালোচনায় এই পর্যবেক্ষণ তুলে ধরা হয়। এতে বলা হয়, বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাদের পেছনে বছরে চার হাজার কোটি টাকার বেশি খরচের ধারণা দেওয়া হয়েছে বিভিন্ন গবেষণা সংস্থার পক্ষ থেকে। এখন হয়তো বিশ্বের অনেক দেশই এগিয়ে আসছে। তবে দীর্ঘমেয়াদে এই সংকট নিরসন না হলে হয়তো বাংলাদেশকেই ব্যয়ভার বহন করতে হবে। পর্যালোচনায় রোহিঙ্গাদের জন্য ত্রাণের যথাযথ ব্যবস্থার পাশাপাশি নিরাপত্তার বিষয়গুলো গুরুত্বের সঙ্গে মোকাবেলার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। পর্যালোচনায় বলা হয়, এ ইস্যুতে বাংলাদেশের সামরিক ব্যয় বৃদ্ধির ঝুঁকি তৈরি হয়েছে। যদি সামরিক ব্যয় করতে হয় তাহলে তা উন্নয়ন কর্মকান্ডে নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে।

রোহিঙ্গা ইস্যু ছাড়াও চালের বাজার, বন্যা-পরবর্তী ব্যবস্থাপনা ও বৈদেশিক লেনদেনের ভারসাম্যের ওপর সানেমের নিজস্ব পর্যালোচনা তুলে ধরা হয়। রোহিঙ্গা সংকটে পর্যটন শিল্পে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে এমন আশঙ্কা প্রকাশ করে বলা হয়, রোহিঙ্গাদের কারণে এ খাত সরাসরি ক্ষতিগ্রস্ত হবে। আসছে পর্যটন মৌসুমেই তা স্পষ্ট হয়ে উঠবে। নিরাপত্তার সংকট তৈরি হলে পর্যটন কেন্দ্র কক্সবাজারে পর্যটক কমে যাবে। অন্যদিকে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সঙ্গে সংযোগ স্থাপনের মাধ্যমে বাণিজ্য বাড়ানোর একমাত্র পথ মিয়ানমার। রোহিঙ্গা ইস্যুতে দুই দেশের সম্পর্কের অবনতির জেরে এই সম্ভাবনাও ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এসব আশঙ্কার কথা বিবেচনায় রেখে পরিস্থিতি মোকাবেলা করতে হবে। এ প্রসঙ্গে ড. ফরাজী বিনতে ফেরদৌস বলেন, খাত অনুযায়ী ত্রাণ কার্যক্রম ভাগ করে দেওয়া উচিত। কেউ স্বাস্থ্য খাতের জন্য ত্রাণ দেবে, কেউ পোশাক দেবে কিংবা কেউ খাবার দেবে; এভাবে সমন্বয় করলে সুফল পাওয়া যাবে। না হলে বিশৃঙ্খলা তৈরি হবে।
এক বছর আগের তুলনায় মোটা চালের দাম ৪৪ শতাংশ বেড়েছে। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার অনুমান অনুযায়ী, আগামী দুই বছরে বাংলাদেশে চালের উৎপাদন কমবে। চালের দাম নিয়ন্ত্রণে বাজারে চালের সরবরাহ বাড়ানো প্রয়োজন। চাল আমদানি কার্যক্রম আরও জোরদার করা উচিত। অবৈধ মজুদদারির বিরুদ্ধে সতর্ক পদক্ষেপ থাকা উচিত; যাতে চালের সরবরাহ ব্যবস্থা ব্যাহত না হয়। খোলাবাজারে (ওএমএস) চালের কেজিপ্রতি দর ২০ টাকা নির্ধারণ করা উচিত। বর্তমানে ওএমএস ব্যবস্থায় চালের দাম দ্বিগুণ করে ৩০ টাকায় নির্ধারণ করেছে সরকার। এতে ওএমএস ভোক্তা সাধারণ মানুষ কিছুটা চাপে পড়েছে।
পর্যালোচনায় বলা হয়, সা¤প্রতিক বছরগুলোতে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি পর্যাপ্ত কর্মসংস্থান সৃষ্টি করতে পারেনি। শিল্প খাতে কর্মসংস্থান কমেছে। কৃষি খাতে অপরিবর্তিত আছে। সেবা খাতে বড় ধরনের কর্মসংস্থান হয়েছে; তবে প্রধানত তা অনানুষ্ঠানিক। আবার শিল্প খাতে নারীর কর্মসংস্থান কমে কৃষিতে বেড়েছে। কর্মসংস্থানের এই পরিস্থিতি মোকাবেলায় অর্থনৈতিক কর্মকান্ডে বৈচিত্র্য বাড়ানো এবং শ্রমঘন শিল্পে মনোযোগ বাড়াতে হবে।
চট্টগ্রাম এবং পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলে বিশেষত চট্টগ্রাম বন্দরে কয়েকটি বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল এবং প্রস্তাবিত গভীর সমুদ্রবন্দরসহ কিছু গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্প বাস্তবায়নের ওপর বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ অর্থনৈতিক উন্নয়ন নির্ভর করছে। তবে অর্থনৈতিক অঞ্চলগুলো প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে এক ধরনের অনিশ্চয়তা রয়েছে। এখন পর্যন্ত এ বিষয়ে কোনো রোডম্যাপ করা হয়নি। সানেমের বিবেচনায় চারটি বিষয়ের ওপর অর্থনৈতিক অঞ্চলগুলোর উন্নয়ন নির্ভর করছে। এগুলো হচ্ছে- ভূমি অধিগ্রহণ, সম্ভাব্যতা যাচাই, অবকাঠামো উন্নয়ন ও চূড়ান্ত বিনিয়োগ কার্যক্রম। এসব কার্যক্রমে অগ্রগতি খুবই কম।
রোহিঙ্গা সংকটে করণীয় : ১. প্রধানমন্ত্রী জাতিসংঘ সম্মেলন উপলক্ষে মুসলিম দেশ সমূহের ওআইসি বিশেষ কমিটির সম্মেলনে রোহিঙ্গা সংকট মোকাবেলায় ছয় দফা সুপারিশ বিশ্বের দরবারে তোলে ধরেছেন। বিশেষ করে মুসলিম দেশসমূহকে মিয়ানমারে মুসলিম নিধনের বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়ার আহ্বান জানান। রোহিঙ্গাদের নিজ দেশে ফেরত নেয়া, তাদের নাগরিকত্ব প্রদানসহ মানবিক দিকগুলোকে পালন করার জন্য মিয়ানমারকে বাধ্য করার জন্য মুসলিম উম্মাহকে এগিয়ে আসার আহ্বান জানান। রোহিঙ্গাদের আশু স্বাস্থ্য, খাদ্য, বাসস্থান, দেয়ার জন্য বিশ্বের ধনী দেশসমূহকে এগিয়ে আসার আহ্বান জানান। ইতোমধ্যে অনেক দেশ সাহায্য সহযোগিতা ও ত্রাণ নিয়ে এগিয়ে এসেছে। কিন্তু এই ত্রাণ খুবই নগণ্য। সরকারও এখন পর্যন্ত চাহিদা মোতাবেক ত্রাণ তৎপরতা পরিচালনা করতে পারেনি।
২. জরুরি ভিত্তিতে রোহিঙ্গাদের প্রথমে বাসস্থান, চিকিৎসা ও খাদ্য সরবরাহ করা প্রয়োজন। শিশু ও মহিলাদের সমস্যা সব চেয়ে বেশি। চিকিৎসা ও খাদ্যের অভাবে অনেক শিশু, নারী অসুস্থ হয়ে পড়ছে। খাদ্য ও চিকিৎসার অভাবে যাতে কোন মানুষকে মৃত্যু বরণ করতে না হয় সেই দিকে সজাগ থাকতে হবে।
৩. অবিলম্বে সেনা বাহিনীর মাধ্যমে রোহিঙ্গাদের কর্মস্থান, স্বাস্থ্য, খাদ্যের নিরাপত্তা বিধান করা প্রয়োজন। একটি সংস্থাকে পুরো দায়িত্ব না দিলে কাজে শৃংখলা ফিরে আসবে না। তাই সেনাবাহিনী এই ক্ষেত্রে বিশেষ ভ‚মিকা রাখতে পারবে। ভালো খবর হচ্ছে, ইতোমধ্যে সরকার ত্রাণ ও পুনর্বাসন কার্যক্রম সেনাবাহিনীকে দিয়ে পরিচালনা শুরু করেছে।
৪. রিলিফ তৎপরতাকে সুনিয়ন্ত্রিত করা প্রয়োজন। সকলে একই রকম ত্রাণ তৎপরতা চালাতে থাকলে উপকার পাবে না। তাই এনজিওগুলোর মধ্যে বিভাগ ভিত্তিক কাজ বা ত্রাণ তৎপরতা ভাগ করে দেয়া উচিত। ত্রাণ তৎপরতাকে প্রধানত খাদ্য, বাসস্থান, পানীয়, চিকিৎসা ও বস্ত্র এই ৫টি ভাগে ভাগ করে নেয়া যেতে পারে। কোথায় কে, কীভাবে, কীসের ত্রাণ তৎপরতা চালাবে তা সুনির্দিষ্ট করে দিতে হবে। তাতে কাজের সমন্বয় বিধান করা সহজ হবে। সুষ্ঠুভাবে ত্রাণ ও বণ্টন করা যাবে। সকলে উপকারও পাবে।
৫. পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে দিয়ে আন্তর্জাতিক যোগাযোগ বৃদ্ধির জন্য দ্রæত ব্যবস্থা নিতে হবে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে বৃহৎ শক্তিধর দেশ সমূহের রাষ্ট্র প্রধানদের সঙ্গে যোগাযোগ বাড়াতে সক্রিয় উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। বিশেষ করে ভারত ও চীনকে আমাদের পক্ষে আনার জন্য সকল ধরনের উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে।
৬. আর্ন্তজাতিক সাহায্য ও সহযোগিতা প্রয়োজন অনুযায়ী লাভ করার জন্য বিশেষ টিম গঠন করে দ্রæত কাজ শুরু করতে হবে। তা না হলে দীর্ঘমেয়াদি লক্ষ লক্ষ রোহিঙ্গার ভরন-পোষণ বাংলাদেশের জন্য কঠিন হয়ে পড়বে। আমাদের ক্ষুদ্র অর্থনীতিতে এর প্রভাব নেতিবাচক হবে।
৭. রোহিঙ্গা ইস্যুতে সকল রাজনৈতিক দলকে একই সুরে করা বলতে হবে। সরকার সকল রাজনৈতিক দলের মতামত গ্রহণ করতে পারে। প্রয়োজনে জাতীয় সম্মেলন করে সকল রাজনৈতিক দলের পরামর্শ গ্রহণ করা যেতে পারে। সরকাকে এই ব্যাপারে উদ্যোগী ভ‚মিকা পালন করতে হবে।
৮. রোহিঙ্গা সংকট দীর্ঘ মেয়াদি হলে নতুন নতুন নানা সমস্যা সৃষ্টি হতে পারে। তাই দ্রæত রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠানো আমাদের অর্থনীতি ও রাজনীতির জন্য খুবই জরুরি।
৯. দেশ একটি ক্রান্তিকাল অতিক্রম করছে। অন্যদিকে সরকারের বেশ কিছু মেগা প্রকল্প উন্নয়নের ধারা অব্যাহত রেখেছে। প্রতি বছর আমাদের প্রবৃদ্ধি বৃদ্ধি পাচ্ছে। মাথা পিছু আয়ও বৃদ্ধি পাচ্ছে। ২০২১ সালে মধ্যম আয়ের দেশে এবং ২০৪১ সালে উন্নত সমৃদ্ধ দেশে পরিণত হওয়ার টার্গেট নিয়ে সরকার কাজ করছে। মনে রাখতে হবে, রোহিঙ্গা সংকট যাতে আমাদেরকে উন্নয়নের রোড ম্যাপ থেকে দূরে সরিয়ে না দেয়।
১০. সরকারকে জাতিসংঘসহ সকল দেশ ও আর্ন্তজাতিক দাতা সংস্থার নিকট রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানের জন্য সাহায্য ও সহযোগিতা আনুষ্ঠানিকভাবে চাওয়া উচিত।

লেখক: সাবেক সহ সভাপতি এফবিসিসিআই, বিটিএমএ, বিজেএমইএ, প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান ইস্টার্ন ইউনিভার্সিটি



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: রোহিঙ্গা


আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ