Inqilab Logo

শুক্রবার ১৪ নভেম্বর ২০২৪, ৩০ কার্তিক ১৪৩১, ১২ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

রোহিঙ্গা ক্যাম্পে বার্মিজ দুই নারীর পরিণতি

নাফ নদের তীরে-৮

| প্রকাশের সময় : ৫ অক্টোবর, ২০১৭, ১২:০০ এএম

স্টালিন সরকার রোহিঙ্গা শরণাথী শিবির থেকে ফিরে : বান্দরবানের নাইক্ষ্যাংছড়ির ঘুমধুম সীমান্তের নো ম্যান ল্যান্ডে ছোট্ট খালের নাম তমরু নদী। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘ছোট নদী’র নদীর মতো শরতেই হাটু পানি। দুই তীর নো ম্যান ল্যান্ডে রোহিঙ্গা শরণার্থীরা পলিথিনের খুপড়ি ঘরে বসবাস করছে। ২৮ সেপ্টেম্বর দুপুরে দেখা গেল নদীর বাংলাদেশ অংশে সেনাবাহিনীর মেডিক্যাল ক্যাম্পে ঔষুধ বিলি করা হচ্ছে। খালি গায়ে থাকা শত শত শিশু পায়ে হেটে নদী পাড় হচ্ছে। নদীর (খাল) তীরে দাঁড়িয়ে গাইড সীমান্তের আশপাশের গ্রাম সম্পর্কে ধারণা দিচ্ছেন। দু’জন বিদেশী মহিলা সেচ্ছাসেবীকে দেখিয়ে গাইড জানালেন, এরা আন্তর্জাতিক সংস্থার লোক ত্রাণ কাজে এসেছে; এদের কেউ কেউ রোহিঙ্গা ক্যাম্পের খবর মিয়ানমারে পাচার করে দেয়। হঠাৎ চোখে পড়লো অদূরে মাটিতে পড়ে রয়েছে একটি ছেঁড়া পোষ্টার। ওটা কি? জানার আগ্রহ দেখাতেই নীরবে সেদিকে হাটা দিলেন গাইড। অবাক কান্ড! শান্তিতে নোবেল পুরস্কার পাওয়া গণতান্ত্রিক আন্দোলনের নেত্রী অং সান সুচির ছবির এই হাল!! ছবিতে দেখা গেল সুচির দুই গালে জুতার ছবি আঁকা হয়েছে। মানুষের থু থু-এ ভরা। গোটা বিশ্ব যাকে নিয়ে অহংকার করে সেই সুচির এই হাল? আর শরণার্থী শিবিরে থাকা রোহিঙ্গা মুসলমানরা তো তেমন শিক্ষিত নয়; তারা সুচির প্রতি এভাবে ঘৃর্ণা-প্রতিবাদ করছে? মনের মধ্যে হাজারো প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে।
সঙ্গী ইনকিলাবের কক্সবাজার প্রতিনিধি শামসুল হক শারেক ছবি তুলতে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। ডাকলাম পাশে দাঁগিয়ে থাকা এক তরুণকে। মোঃ হামিদুল নামের ওই তরুণ মাদ্রাসার ১০ ক্লাস পর্যন্ত পড়েছেন। বাড়ি রাখাইনের আকিয়াব জেলায়। ভাগ্যগুনে মিয়ানমার সেনা বাহিনীর হাত থেকে বেছে পালিয়ে এসেছেন। স্ত্রী, বৃদ্ধা মা ও দুই সন্তানকে নিয়ে তমরু নো ম্যান ল্যান্ডে নদী তীরে আশ্রয় নিয়েছেন। জানালেন, কুতুপালং থেকে কে বা কারা এই পোষ্টার নিয়ে এসেছেন। পোষ্টারে আনুষ্ঠানিক ভাবে ঘৃর্ণার থু থু দিয়েছেন তারা সবাই। অতপর রাস্তার পাশে সেটি ফেলে রেখেছেন। ওই পথে হাটাচলা করা যারাই সুচির ওই ছবি সম্বলিত পোষ্টার দেখেন তারাই থু থু দেন। হামিদুলের সঙ্গে কথা বলার সময় সেখানে জড়ো হয় আরো কয়েকজন রোহিঙ্গা বৃদ্ধ-বৃদ্ধা, নারী ও শিশু। তারা জানালেন, ঘুমধুম সীমান্ত ও তমরু নদীর ওপাড়ে (মিয়ানমার) মগের বিল, ফকির পাড়া, পৈইরপাড়া গ্রাম। আর সীমান্ত সংলগ্ন আকিয়াব, মংডু, কচিদং, রাচিদং জেলা। এ সব জেলায় রোহিঙ্গা মুসলিম জনগোষ্ঠির সংখ্যা ছিল বেশি। এ সব জেলায় দশম শ্রেণীর বেশি ক্লাস পড়া নিষিদ্ধ। তবে মাদ্রাসা, মসজিদ ছিল প্রচুর। এসব জেলায় রোহিঙ্গাদের বাড়িঘর জ্বালিয়ে দেয়ার সময় প্রায় তিনশ মসজিদ ও দুইশ মাদ্রাসা জ্বালিয়ে দিয়েছে মিয়ানমার সেনাবাহিনী। মোঃ ইউনূস নামের এক বয়স্ক শরণার্থী বললেন, আমরা অং সান সুচির মুক্তির দাবিতে বছরের পর বছর আন্দোলন করেছি। ওই সময় আন্দোলনের কারণে আমাকে মিয়ানমার সেনাবাহিনী গ্রেফতার করে কারাগারে দেয়। আমার মতো হাজার হাজার রোহিঙ্গা মুসলিম যুবক সুচির মুক্তির দাবিতে আন্দোলন করেছে। অথচ সেই সুচি ক্ষমতায় গিয়ে এখন সেনাবাহিনীকে খুশি করতে রোহিঙ্গা মুসলিমদের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে। যার পরিণতি দেখছেন জুতা গালে সুচির ছবিতে থু থু নিক্ষেপ করা হচ্ছে। আগের দিন উলুবুনিয়া, পালংখালি, বালুখালি, কুতুপালং, কারেংখালি, তুলাতুল, উঞ্চিপ্রাণ, হোয়াইং ক্যাং শরণার্থী ক্যাম্প ঘুরে বেড়ানোর সময় রাস্তার পাশে বেশ কয়েক যায়গায় জুতা গালে অং সান সুচির এই ছেঁড়া ছবি পড়ে থাকতে দেখা গেছে। মোহাম্মদ ইয়াসিন নামের এক যুবককে এ নিয়ে প্রশ্ন করলে তিনি যা বলেন তার অর্থ হলো সুচির জন্যই রোহিঙ্গাদের এই অবস্থা। সুচি যখন বন্দী ছিলেন তখন হাজার জাতিগোষ্ঠীর দেশ মিয়ানমারে রোহিঙ্গা মুসলিমরা সুচির মুক্তির দাবিতে সবচেয়ে বেশি সোচ্ছার ছিল। যা বার্মীজ সেনাবাহিনীর সরকার ভাল চোখে দেখেনি। এখন সেই সুচিই ক্ষমতায় গিয়ে বার্মীজ সেনাবাহিনীর পক্ষ্যে অবস্থান নিয়েছে। যার জন্যই সুচির প্রতি রোহিঙ্গাদের ক্ষোভের শেষ নেই।
দু’দিন পর টেকনাফের হোয়াইক্যাং শরণার্থী শিবির ঘুরে ঘুরে দেখার সময় চোখে পড়লো এক যায়গায় বেশ জটলা। সাধারণত ত্রাণ নেয়ার সময় শরণার্থীদের জটলা দেখা যায়। কিন্তু এমনিতেই এতো জটলা! কাদা পেরিয়ে এগিয়ে যেতেই চোখে পড়লো কয়েকজন শরণার্থী একটি পত্রিকায় বার্মিজ এক তরুণী ছবি দেখছে। বিরক্ত নিয়ে অন্য দিকে গেলাম। ১৯ থেকে ২০ বছর বয়সী বার্মিজ ওই তরুণী কে এবং এতো রোহিঙ্গা কেন জটলা করে ওই ছবি দেখছে জানার আগ্রহ তেমন হয়নি। কিন্তু ঢাকায় এসে পত্রিকায় ওই তরুণীর ছবিসহ খবর দেখে অবাক হতে হলো। হায় আল্লাহ! হোয়াইক্যাং শরণার্থী শিবিরে রোহিঙ্গারা ভীড় করে যে বার্মিজ তরুণীর ছবি দেখেছে সে মিয়ানমারের সেরা সুন্দরী। খবরে দেখলাম ১৯ বছর বয়সী এই বার্মিজ তরুণীর নাম শ্যে ইয়েইন সি। সে মিয়ানমারের সেরা সুন্দরীর খেতাব ‘মিস গ্র্যান্ড মিয়ানমার’ পেয়েছে। কিন্তু রাখাইন সহিংসতা তথা মিয়ানমার সেনাবাহিনীর রোহিঙ্গা নিধন নিয়ে ভিডিও প্রকাশ করার অপরাধে (!) তার সেরা সুন্দরীর খেতাব ‘মিস গ্র্যান্ড মিয়ানমার’ কেড়ে নেয়া হয়েছে। খবরে জানা গেল শ্যে ইয়েইন সি কয়েকদিন আগে রোহিঙ্গা নির্যাতনের চিত্র সম্বলিত একটি ভিডিও ক্লিপ অনলাইনে প্রকাশ করেন। এতে তিনি রাখাইন সহিংসতার জন্য রোহিঙ্গা জঙ্গিদেরকে দোষারোপ করেন। এতে ক্ষিপ্ত হয়ে উঠে মিয়ানমার সেনাবাহিনী। অতপর তাকে দেয়া ‘সেরা সুন্দরী’ খেতাব প্রত্যাহার করে নেয়া হয়। প্রতিযোগিতায় প্রথম হওয়া সুন্দরী হিসেবে তাকে দেয়া মুকুট, উত্তরীয়, পুরস্কারের অর্থ ও ট্রফি সবই ফেরত নেয়া হয়। মিয়ানমারের সুন্দরী প্রতিযোগিতার আয়োজকরা জানান চুক্তির শর্ত লঙ্ঘন করার কারণে শ্যে ইয়েইনের খেতাব প্রত্যাহার করে নেয়া হলো। তবে এ সময় তারা শ্যে ইয়েইনের ভিডিও ফুটেজের ব্যাপারে কোনো মন্তব্য করেননি। কিন্তু শ্যে ইয়েইন মুকুট হারানোর কারণ হিসেবে ওই ভিডিও ফুটেজের কথা উল্লেখ করেন। বোঝা গেল অশিক্ষিত-অর্ধ শিক্ষিত রোহিঙ্গা শরণার্থীরা কত রাজনীতি সচেতন। দেশ হারিয়েছেন; আশ্রয় নিয়েছেন ভিনদেশে। অথচ নিজ দেশের দুই নারীকে তারা নিজেদের মতো করেই মূল্যায়ন করছেন। একজন বিশ্বখ্যাত বার্মিজ নারীর মুখে থু থু নিক্ষেপ করছেন; আরেকজন বার্মিজ তরুণীর ছবি বুকে ধারণ করছেন।

 



 

Show all comments
  • Md Nurul Alam ৫ অক্টোবর, ২০১৭, ১:০৯ পিএম says : 0
    সুচির নোবেল পুরুষ্কার কেড়ে নেওয়া হোক।
    Total Reply(0) Reply
  • সম্রাট ৫ অক্টোবর, ২০১৭, ১:১৭ পিএম says : 2
    একই দেশের হলেও বার্মিজ এই দুই নারী সম্পূর্ন আলাদা। একজন মানবতার পক্ষে আরেক জন মানুষ হত্যা নির্যাতনসহ সকল ঘৃনিত কাজের সাথে জড়িত
    Total Reply(0) Reply
  • মানিক ৫ অক্টোবর, ২০১৭, ১:২৬ পিএম says : 0
    গণতান্ত্রিক আন্দোলনের নেত্রী অং সান সুচি এখন ইতিহাসের সবচেয়ে ঘৃনিত এবং নিকৃষ্ট মহিলা
    Total Reply(0) Reply
  • Nazim Uddin ৫ অক্টোবর, ২০১৭, ১:২৮ পিএম says : 1
    বিশ্ব মানবাধিকার আসলে তুমি কার? যে সংগঠন মানবতার সমস্যার সমাধান দিতে পারে না, সেই মানবাধিকার সংস্হা কি প্রয়োজন ?
    Total Reply(0) Reply
  • রাকিব ৫ অক্টোবর, ২০১৭, ১:২৯ পিএম says : 0
    লেখাটি খুব ভালো লেগেছে। লেখক স্টালিন সরকারকে অসংখ্য মোবারকবাদ
    Total Reply(0) Reply
  • লোকমান ৫ অক্টোবর, ২০১৭, ১:৩৩ পিএম says : 0
    স্টালিন সরকার ভাইয়ের কাছে অনুরোধ রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে বিশেষজ্ঞদের মতামতের আলোকে এখন বাংলাদেশ সরকারের কী কী পদক্ষেপ নেয়া উচিত-- সেরকম কিছু ধারাবাহিক নিউজ করুন। এতে রোহিঙ্গারাও উপকৃত হবে দেশও উপকৃত হবে।
    Total Reply(0) Reply
  • Abdul Khaleque Sarker ৫ অক্টোবর, ২০১৭, ১:৩৭ পিএম says : 0
    She should be declared as "Persona non grata" all over the world as she is not human being rather this woman is killer and enemy of humanity. Go to hell.
    Total Reply(0) Reply
  • Gourango Mondal ৫ অক্টোবর, ২০১৭, ১:৩৮ পিএম says : 0
    সুচি ও সেনাবাহিনীর সকল অভিযুক্তদের আন্তর্জাতিক আদালতের মধ্যমে ফাঁশি দাবি করছি।...
    Total Reply(0) Reply
  • Rajibul Haque Khan ৫ অক্টোবর, ২০১৭, ১:৪৪ পিএম says : 2
    তাকে নতুন খেতাব দেওয়া যেতে পারে গণহত্যাকারী বা লেডি হিটলার।আমার মাথায় আসে না একজন মানুষকে আমরা শান্তির দূত হিসাবে চিনি বাট তিনিই নিরব থাকে এবং প্রধান ভূমিকা পালন করে গণহত্যা সৃষ্টি তে মানুষ এতো অমানুষ হয় কিভাবে।
    Total Reply(0) Reply
  • Rafiqul Islam ৫ অক্টোবর, ২০১৭, ১:৪৫ পিএম says : 0
    সারা বিশ্বে তারে অবাঞ্ছিত ঘোষনা করা উচিত মানবাধিকার লঙ্গনের অপরাধে! কিন্তু সমস্যা একটা তিনি তো মুসলিমদের মেরেছেন!
    Total Reply(0) Reply
  • Abdur Rouf Chowdhury ৮ অক্টোবর, ২০১৭, ৫:১১ পিএম says : 0
    About Suu Kyi,John Simpson writes in Daily Telegraph '...a Burmese military prisoner or monster',Allan Jacobs writes in Khaleej Times '...a refugee of her personal political struggle'.Practically Suukyi is a puppet of Mayanmar's military leaders and has no power to say or do anything against them.
    Total Reply(0) Reply

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: রোহিঙ্গা


আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ