পটুয়াখালীর যুবক ক্বারী সাইয়্যেদ মুসতানজিদ বিল্লাহ রব্বানীর কোরআন তেলাওয়াতে মুগ্ধ যুক্তরাষ্ট্রবাসী
ইসলামি সভ্যতা ও সংস্কৃতি বিকাশে বাংলাদেশের অবদান অনস্বীকার্য। এদেশে ইসলামি সংস্কৃতি চর্চার ইতিহাস অনেক প্রাচীন।
মা’কে বেশি মনে পড়ছে। মা সবজি বাগানে হাঁটতেন। হাতে তসবি। ফজরের নামাজের পর ঘরের ভেতর সুর করে সুরা পড়তেন। এক পাল ছেলেমেয়ে। আমরা পড়তে বসতাম। গেরস্থ বাড়িতে কাজের লোকও অনেক। আরবী পড়তে পড়তে মাথার ঘোমটা টেনে মুগ্ধ চোখে তাকাতেন আমাদের পড়ার টেবিলের দিকে। ভোরে ফজরের নামাজ পড়ে মসজিদ থেকে বাবা ফিরতেন। অতপর সকালের খাবার। ছেলেদের পড়াশোনার আগ্রহ দেখে মা-বাবা মুগ্ধ। যেন সদ্য ফোঁটা রক্তজবা। বাড়ির কাজের লোকসহ সবাই খেতে বসেছি। সবার পাতে সমান মাছ-মাংস। কারো প্লেটে মাছ বা মাংসের টুকরো ছোট দেখলে নিজ হাতে তার পাতে তুলে দিতেন আরেকটি টুকরো। ১৯৭৪ সালের দুর্ভিক্ষের সময় চাটাই পেতে মাটিতে দু’বেলা পান্তা খেতে বসতাম। মা মাঝখানে বসে নিজেই ছেলেমেয়ে ও বাসার কাজের লোক সবার প্লেটে সমান করে পান্তাভাত দিতেন। এর মধ্যেই আবার কিছু পান্তা বাচিয়ে গোপনে আশপাশের গরীবদের দিতেন। নিজের ভাগের টুকু ছোট্ট ছেলে আমার জন্য তুলে রাখতেন। এমনকি যখন নিজেরা এক বেলা দু’বেলা খেতে পারতাম না; তখন দেখতাম গোপনে আধা কেজি চাল নিয়ে কলাগাছ দিয়ে খিচুড়ি বানিয়ে আশপাশের গরীব শিশুদের খাওয়াতেন। এক যুগ আগে ইন্তেকাল করা সেই মায়ের মুখচ্ছবি দেখলাম রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবিরে। মায়ের মুখের হুবহু প্রতিচ্ছবি। আমার মায়ের মুখচ্ছবির মতোই আছেন একজন নেত্রী যিনি বর্তমান সরকারের প্রভাবশালী মন্ত্রী। এই নেত্রীকে ষাটের দশকে অগ্নিকন্যা খেতাব দেয়া হয়েছিল। প্যারালাইসে আক্রান্ত হয়ে ১০ বছর বিছানায় থাকা আমার পরোপকারী মায়ের যে শরীরের অবস্থা হয়েছিল; ঠিক তেমন চেহারার এক বৃদ্ধা মহিলাকে দেখলাম এক ছেলে ও নাতির কাঁধে করে রাখাইনের দক্ষিণ মংডু থেকে এসে বালুখালি রাস্তার ওপর বৃষ্টিতে দাঁড়িয়েছে। বাকগোনা শরণার্থী শিবিরে তার আশ্রয় পাওয়ার কথা। মাকে ঘাড়ে রেখেই ছেলে মোঃ আমিনুল জানালেন, বার্মার মংডুতে চারদিন গুলির মধ্যেই জঙ্গলে পালিয়ে ছিলেন মাকে নিয়ে। সেখান থেকে মাকে ঘাড়ে করে সীমান্তের পথে পা বাড়ায়। খেয়ে না খেয়ে ৪ দিন ৪ রাত পাহাড় বনাঞ্চল পেরিয়ে বার্মার কুয়ানচি বং সীমান্ত পৌঁছেন। অতপর কাটাতারের বেড়া পার হয়ে বাংলাদেশের উলুবুনিয়ায় আসেন।
৮০ বছরের চলৎশক্তিহীন হিল্ল্যা বিবি ভেঙ্গে ভেঙ্গে কথা বলেন। তার কথা বোঝা গেল না। তবে দোভাষী বৃদ্ধার কথা তর্জমা করে জানালেন, তার সামনে কয়েকজন রোহিঙ্গা মেয়ের ওপর পৈচাসিকভাবে যৌন নিপীড়ন চালিয়েছে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী। ধর্ষিত তরুণীদের কয়েকজনকে আটকে রেখেছে আর কয়েকজনকে ছেড়ে দিয়েছে। হিল্ল্যা বিবি নামের ওই বৃদ্ধার নাতনিকে আটকে রেখেছে সুচির ধর্ষক মিলিটারীরা। বৃদ্ধার শব্দ করে কাঁদারও শক্তি নেই। নাতনির জন্য গুমরে কেঁদেছেন; নীরবে চোখের পানি ফেলেছেন; নাতনিকে ছেড়ে দেয়ার আকুতি জানিয়েছেন; কিন্তু শান্তিতে নোবেল পুরস্কার পাওয়া সুচির সেনাবাহিনীর ঘাতকদের পশুত্ব মন গলাতে পারেননি। হায় রে হিল্ল্যা বিবি! আমি আমার মায়ের মুখচ্ছবি আপনার মুখে দেখছি!! আপনি যদি আমার মা হতেন তাহলে আপনার এই করুণ পরিণতির কাঁটা কি আমার হৃদয়ে বিধতো না?
পাহাড়ি পথ; কিছুক্ষণ আগে বৃষ্টি থেমে গেছে। উঁচুনীচু কর্দমাক্ত পথে কচ্ছপ গতিতে এগিয়ে চলছে সিএনজি। বান্দরবান জেলার নাইক্ষ্যাংছড়ি উপজেলার ঘুমঘুম সীমান্ত। তমরু দক্ষিণ বিজিবি চেকপোষ্ট পেরিয়ে যেতে না যেতেই চোখ পড়লো একটি পাহাড়ে। খলিফা পাড়া সীমান্তে আমাদের বিজিবি’র দুই জওয়ান কাঁটাতারের বেড়ার দিকে ইশারা করে নাশাকা ক্যাম্প দেখানোর সময় এই পাহাড়ের যাওয়ার অনুরোধ করেছেন। সীমান্তের ওপারে দেখা গেল নাশাকা বাহিনী ঘুরাঘুরি করছে। আশপাশের গাছপালা পুড়ে ছাই। সীমান্ত কাঁটাতারের বেড়া ঘেষে ওই পাহাড়ের নো ম্যান ল্যান্ডে পলিথিনের কয়েকশ খুপড়ি। পাহাড় কেটে নতুন নতুন খুপড়ি করার ৮ ফুট বাই ৮ ফুট মাটি সমান করা হচ্ছে। সিএনজি থেকে নামতেই এক ভদ্রলোক এগিয়ে এলেন। ভদ্রলোক স্থানীয় তমরু সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক; নাম হামিদুল হক। পশ্চিম তমরু নো ম্যান ন্যান্ডে তার বাড়ি। দশ গ্রামের মানুষ শুধু নয়; বিজিবি এমনকি সীমান্তের ওপারে বার্মার মগের বিল, পৈইরপাড়া কচিদং, রচিদং এলাকার রোহিঙ্গা মুসলিমরাও তাকে চেনেন। স্থানীয় এক সাংবাদিক আগেই ফোন করেছিলেন হামিদুল হককে। ঢাকা থেকে আসা সাংবাদিকের জন্য তিনি রাস্তায় অপেক্ষা করছিলেন। প্রথমে বাসায় নিয়ে গিয়ে চা নাস্তার পর কাটাতারের বেড়া দেখাতে নিয়ে গেলেন। যেখান দিয়ে রাখাইনের মগের বিল, ফকিরপাড়া এব আশপাশের গ্রামগুলোর রোহিঙ্গা আবালবৃদ্ধাবনিতা প্রাণ বাঁচাতে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে।
হামিদুল হক নিয়ে গেলেন নো ম্যান ল্যান্ডে শরণার্থী শিবিরে। তার নিজের মালিকানাধীন ও লিজ নেয়া পাহাড়ে প্রায় ১৫’শ রোহিঙ্গা শরণার্থী পরিবার ঘুপড়ি ঘরে আশ্রয় নিয়েছে। পলিথিন ও বাশের বেড়া কয়েকটি ঘুপড়ি ঘরে দেখা গেল তরুণী ও যুবতিরা শুইয়ে রয়েছেন। সবাই অসুস্থ। এদের সবার বয়স ১২ থেকে ২৫ বছরের মধ্যেই। এমনিতে দেশ ছাড়া তার ওপর ভীতি আতঙ্ক। হামিদুল হক জানালেন, এদের সবার ওপর যৌন নিপীড়ন চালিয়েছে মিয়ানমার সেনাবাহিনী। কাঁটাতারের বেড়া ভেঙ্গে এরা যখন সীমান্ত পাড় হয়ে আসে তখন নারীদের অধিকাংশই হাটতে পারছিলেন না। প্রায় সবার শরীর দিয়ে রক্ত ঝড়ছিল। সু চিকিৎসা দেয়া হয়েছে। কিন্তু অনেক নাবালিকা মেয়ের রক্ত বন্ধ হতে ৫ দিন থেকে ১০ দিন সময় লেগেছে। কি ভয়ঙ্কর পৈচাসিকতা, যৌন নিপীড়ন চালিয়েছে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী রোহিঙ্গা মুসলিম শিশু-নারীদের ওপর। যে খুপড়িতে ঢুকেছি সেখানেই দেখেছি নির্যাতিতা তরুণী মেয়েরা স্থানীয় ওই শিক্ষকের হাত ধরে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদছেন। কয়েকজন তরুণী ও যুবতীর নাম টুকে নেয়া হলেও তাদের কারোই নাম প্রকাশ থেকে বিরত থাকা হলো। হামিদুল হক বলেন, ভাই, বর্মী সেনাবাহিনী, নাশাকা বাহিনী নাবালিকা মেয়েদের ওপর এমন পৈচাসিকভাবে যৌন নিপীড়ন চালিয়েছে রক্তাক্ত মেয়েদের করুণ চাহনির দৃশ্য দেখে কেউ চোখের পানি ধরে রাখতে পারেননি।
উলুবুনিয়া, কুতুপালং, তমরু নদ, পালংখালি, হোয়াইক্যাং, গিলাতলী, বিছামারা, সফিউল্লাহ কাটা, থ্যাংখালি বাজারসহ যতগুলো রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবিরে ঘুরেছি; প্রায় সবগুলো শিবিরে অনেক তরুণ, যুবতী এমনকি বয়স্কা মহিলা শুনিয়েছেন তাদের ওপর মিয়ানমার সেনাবাহিনীর পৈচাসিক যৌন নিপীড়নের ভয়ঙ্কর কাহিনী। অনেক সন্তান সম্ভাবা মহিলার ওপর পৈচাসিকত নৌ নিপীড়ন চালিয়েছে সুচির উর্দিপড়া বাহিনী। সন্তানের সামনে মা ধর্ষিত হয়েছেন, ছেলের সামনে মা, বাবার সামনে মেয়ে, স্বামীর সামনে স্ত্রী, ভাইয়ের সামনে বোন ধর্ষিত হয়েছে। ধার্ষিত অনেক সন্তান সম্ভাবা নারী শরণার্থী শিবিরের ঘুপড়ি ঘরে কাদা পানির ওপর শুয়ে রয়েছেন।
২৯ সেপ্টেম্বর দুপুরে কুতুপালং শরণার্থী শিবিরে এক মহিলা যখন তার ওপর যৌন নিপীড়নের মর্মান্তিক কাহিনী শোনাচ্ছিলেন তখন তার চেহারায় দেখে গেল আতঙ্কের ছাপ স্পষ্ট। নোবেল জয়ী অং সান সুচির প্রতি তাদের ঘৃর্ণা শেষ নেই। ধর্ষিত এসব নারীদের প্রায় সবাই জানান যে, তাদের ধর্ষকরা ছিল ইউনিফর্ম পরিহিত পুরুষ; যাদেরকে মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীর সদস্য হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। রক্ষণশীল মুসলিম সমাজে এসব অপ্রীতিকর ঘটনাকে সামাজিক কলঙ্কের দাগ হিসেবে দেখা হয়। এ জনই আশ্রয় হারানোর ভয়ে অনেক রোহিঙ্গা নারী ও কিশোরী তাদের ধর্ষণের কাহিনী চেপে রেখেছেন। শরণার্থী শিবিরে ৪ বছর বয়সী ছেলেকে শক্ত করে ধরে পাশে বসে থাকা এক নারী বলেন, মংডুতে তিনজন সৈন্যের সবাই আমাকে ধর্ষণ করেছে। আমার অবুঝ শিশু চেয়ে চেয়ে দেখেছে সে দৃশ্য। ধর্ষণের পর সুচির বাহিনী যখন চলে যায়, তখন আমি আমার তিন সন্তানকে সঙ্গে নিয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে এসেছি। রক্ত ঝড়ছে শরীরে প্রচন্ড ব্যাথা। তারপরও যেতে হবে। জীবন বাঁচাতে পালিয়ে আসা অন্যদের সঙ্গে বাংলাদেশের সীমান্তের দিকে হাঁটতে শুরু করি।
হোয়াইক্যাং, তমুরু, পালংখালি ও কুতুপালং শরণার্থী শিবিরে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গা নারীদের মিয়ানমার সেনাবাহিনীর হাতে যৌন নিপীড়নের শিকার হওয়ার গল্প প্রায় অদ্ভূতভাবে একই রকম। নির্যাতিতরা জানান, তাদের স্বামী কিংবা পুরুষ আত্মীয় যখন বাড়ির বাইরে থাকে ঠিক তখন বর্মি সেনারা তাদের বাড়িতে প্রবেশ করে তাদের সন্তানদের সামনেই ধর্ষণ করে। কক্সবাজারের লেদা শরণার্থী ক্যাম্পে জাতিসংঘের অভিবাসন সংস্থা কর্তৃক পরিচালিত একটি ক্লিনিকে কাজ করেন এমন জানান, তাদের ক্লিনিকে চিকিৎসা দেয়া বেঁচে যাওয়া অধিকাংশ নারীকেই ধর্ষণের আগে নিষ্ঠুর কায়দায় পেটানো হয়েছে। তিনি নারীদের দেহে আঘাতের চিহৃ এবং তাদের স্তন ও গোপনাঙ্গে কামড়ের দাগ দেখেছেন।
রোহিঙ্গা নারীদের ওপর পৈচাসিকতার ভয়াবহ চিত্র পেয়েছে জাতিসংঘের অনুসন্ধানী দলও। জাতিসংঘের এক অনুসন্ধানী দল জানিয়েছে, মিয়ানমারের রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর নারীরা ধারাবাহিকভাবে সে দেশের সেনাবাহিনীর সংঘবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হয়েছে এখনো হচ্ছে। ঘটনা তদন্তে কক্সবাজারের শরণার্থী শিবিরে গিয়ে সেইসব ভয়াবহ যৌন নিপীড়নেরা ঘটনা সম্পর্কে জানতে পেরেছে সহিংসতা ও যৌন নিপীড়ন ঘটনা তদন্তে গঠিত জাতিসংঘের অনুসন্ধানী দল। আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমেও তাদের সা¤প্রতিক প্রতিবেদনে রোহিঙ্গা নারী ও শিশুদের ধারাবাহিকভাবে সংঘবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হওয়ার কথা তুলে ধরা হয়েছে। জাতিসংঘের দুই কর্মকর্তা বলেছেন রোহিঙ্গাদের রাখাইন থেকে তাড়ানোর অস্ত্র হিসেবে সংঘবদ্ধ ধর্ষণকে ব্যবহার করছে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী।
যে রোহিঙ্গা নারীরা পৈচাসিকতার শিকার হয়েছেন তারা কারো মা, কারো বোন, কারো মেয়ে, কারো ফুফু-চাচি। কন্যা-জায়া-জননীরা মায়ের জাতি। তাদের প্রতি কেন এই পৈচাসিকতা? শান্তিতে নোবেল পুরস্কার পাওয়া অং সান সুচির সেনাবাহিনীর যে সদস্যরা রোহিঙ্গা নারীদের ওপর পৈচাসিকভাবে যৌন নিপীড়ন চালিয়েছে; তাদের কি কন্যা-জায়া-জননী নেই? তারপরও কেন তারা এতো পশুত্ব দেখাচ্ছে? প্রশ্ন হলো- এখন শুধু কি রোহিঙ্গা শরণার্থীদের ফিরিয়ে নেয়ার দাবিতেই আন্তর্জাতিক মহল ব্যস্ত থাকবে? জাতিসংঘসহ প্রভাবশালী দেশ ও আন্তর্জাতিক মহলকে এখন থেকে রোহিঙ্গা কন্যা-জায়া-জননীদের ওপর যে মিয়ানমার বাহিনী পাশবিক পৈচাসিক যৌন নিপীড়ন চালিয়েছে তাদেরও বিচারের দাবিতে আওয়াজ তুলতে হবে।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।