পটুয়াখালীর যুবক ক্বারী সাইয়্যেদ মুসতানজিদ বিল্লাহ রব্বানীর কোরআন তেলাওয়াতে মুগ্ধ যুক্তরাষ্ট্রবাসী
ইসলামি সভ্যতা ও সংস্কৃতি বিকাশে বাংলাদেশের অবদান অনস্বীকার্য। এদেশে ইসলামি সংস্কৃতি চর্চার ইতিহাস অনেক প্রাচীন।
‘পৃথিবী তোমার কোমল মাটিতে কেন এতো সংঘাত/ মানুষের বুকে মানুষেই হানে নিষ্ঠুর কষাঘাত/--/ এত বড় এই আকাশের নীচে রয়েছে কত না ঠাই/ চারিদিকে তবু বন্ধ দুয়ার কোন আশ্রয় নাই/ মানুষ কেন যে এত অসহায়/ আজ আছে কাল সকলই হারায়/--- করে যায় করাঘাত/ মানুষের বুকে মানুষেই হানে নিষ্ঠুর কষাঘাত’। রোহিঙ্গা শরণার্থীদের জীবনের পরতে পরতে যেন কণ্ঠশিল্পী আবদুল জব্বারের এই গানের বাণী-স্বরলিপি প্রতিধ্বনিত। তাদের ওপর পৈচাসিকতা নিষ্ঠুরতার যেন শেষ নেই।
২৭ সেপ্টেম্বর বিকেল। মেঘলা আকাশ গুঁড়িগুঁড়ি বৃষ্টি। হাজার হাজার শিশু-কিশোর-বৃদ্ধ কাদা মাখামাখি রাস্তায় ছাতা মাথায় দাঁড়িয়ে। কেউ ত্রাণের জন্য লাইনে কেউ বৃষ্টির পানি থেকে বাঁচতে ছাতা মাথায়। কোথাও দাঁড়ানোর ঠাই নেই। বৃষ্টি যেন দয়ামায়াহীন। বৃষ্টি এই থামছে তো কয়েক মিনিট পর আবার অঝোর ধারা। যাদের ছাতা নেই তারা মাথায় ছেঁড়া কাপড় কেউবা বৃষ্টিতেই দাঁড়িয়ে রয়েছেন ঠায়। পালং খালি শরণার্থী শিবিরের পাশে পুঁটিবুনিয়া সফিউল্লাহ কাটা শরণার্থী শিবিরে পলিথিনের খুপড়িতে বসে আছেন রহিমা খাতুন। বাইরে বৃষ্টি খুপড়ির ভিতরেও বৃষ্টির পানি পাহাড়ের ওপর থেকে নীচে চুইয়ে পড়ছে। পরনে ভেজা কাপড়, বাচ্চাদের বৃৃষ্টি থেকে বাঁচাতে মাথায় মোটা পলিথিন দিয়েছেন। সঙ্গে রয়েছে দু বছর, সাড়ে তিন বছর, পাঁচ বছর ও সাত বছরের চার কন্যা সন্তান। কাদা মারিয়ে খুপড়িতে প্রবেশ করতেই পা আটকে গেল কাদায়। মহিলা একদিকে কাপড় টেনে মাথা ঢাকার দেয়ার ব্যর্থ চেষ্টা করছে; অন্যদিকে আগুন্তক অতিথি ঘরে প্রবেশ করতে গিয়ে কাদায় আটকে যাওয়ায় বিবৃতকর অবস্থা। বৃষ্টির মধ্যেই চুলায় ভাত উঠিয়েছেন; মেয়েরা ভাত খাবে নুন দিয়ে। পাশের খুপড়ির মোকারা বেগম একটু শাক দিতে হাত বাড়িয়েছে। ছোট্ট মেয়ে মৈতুন শুধু নুন দিয়ে ভাত খেতে চায় না; তাই প্রতিবেশি (পাশের ঝুপড়ি) মোকারা দয়াপরবশত একটু সেদ্ধ শাক দিচ্ছে। খুপড়ির শুকনো যায়গাটুকু অতিথিকে বসতে দিয়ে কাদায় সরে গেলেন রহিমা খাতুন। তখনই জ্বলে উঠলো ক্যামেরা। ক্যামেরার ক্লিক ক্লিক দেখে হাউমাউ করে কেদে উঠলেন রহিমা। ‘স্যার ছবি তুলবেন না। ছবি তুললে ওরা আবার উঠিয়ে দেবে।’ কারা উঠিয়ে দেবে? প্রশ্ন শুনে চুপ করে গেলেন রহিমা। কেবল রহিমা নয়, এই অবস্থা শরণার্থী শিবিরে আশ্রয় নেয়া স্বামী সন্তান হারানো হাজার হাজার মহিলার। রোহিঙ্গাদের জন্য পাহাড়ে খুপড়ি ঘরে ঠাইয়ের ব্যবস্থা করা হয়েছে। লাখ লাখ রোহিঙ্গা পলিথিনের খুপড়িতে উঠেন। আবার সরকারি সিদ্ধান্তে সেখান থেকে তাদের নির্ধারিত যায়গায় নেয়া হয়। এই নতুন যায়গায় নেয়া এবং সেখানে ভাল যায়গার ঠাই করে দেয়ার নামেও প্রতারকচক্র অসহায় শরণার্থীদের কাছ থেকে টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে। ৫ শ থেকে ২ হাজার টাকা পর্যন্ত নিয়ে তাদের অন্যত্র ঠাই দেয়া হচ্ছে।
মিয়ানমার সেনাবাহিনীর নির্যাতন থেকে জীবন বাঁচাতে বাংলাদেশে আসার পর বান্দরবান ও কক্সবাজারের বিভিন্ন পাহাড়ে শরণার্থী শিবিরে মাথা গোজার ঠাঁই হয়েছে। কিন্তু এখানেও বিপদগ্রস্ত শরণার্থীদের নিস্তার নেই টাউট বাটপারদের খপ্পর থেকে। অথচ মিয়ানমারে রাখাইন রাজ্যে এদের ঘর-গৃহস্থালী ছিল। ছিল স্বামী সুখ আহলাদ। দেশছাড়া ছিন্নমূল হলেও এখনো ‘যন্ত্রণা’ পিছু ছাড়ছে না। মিয়ানমারের টাউটদের হাত থেকে জীবন বাঁচিয়ে বাংলাদেশে এসে এখানেও টাউটদের খপ্পর থেকে বাঁচতে পারছেন না।
শরণার্থী শিবিরে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গারা বাংলাদেশের পথঘাট কিছুই চেনে না। ভাষাও ভাল বোঝে না। রোহিঙ্গাদের এই দুর্বলতার সুযোগ নিচ্ছে কিছু পুরনো রোহিঙ্গা এবং স্থানীয় মানুষ। শরণার্থী শিবিরে আশ্রয় নেয়া অসহায় রোহিঙ্গাদের নিয়ে বাণিজ্যে মেতে উঠেছে ওই দালাল চক্র। তারা নতুন রোহিঙ্গাদের নানা ভাবে নিরাপদ স্থানে পৌঁছে দিচ্ছে। বিনিময়ে হাতিয়ে নিচ্ছে তাদের কাছ থেকে টাকা-পয়সা-সোনা রুপা। সীমান্ত পাড় হয়ে কৌশলে ঢুকে পড়া রোহিঙ্গাদের সেবাদানের প্রতিযোগিতার নামে ওই দালাল চক্রের পকেট মোটা-তাজা হচ্ছে। দালালচক্রের দৌরাত্ম্য বন্ধে সীমান্তে এবং শরণার্থী শিবিরে নজরদারী বাড়ানোর দাবি করা হলেও সুফল মিলছে না।
ভাতের মাড় ঢালতে ঢালতে রহিমা খাতুন জানালেন, তাঁর বাড়ি রাখাইনের মংডুর বুচিডং এলাকায়। তার ছেলে মোঃ ইসমাইলকে হত্যা করেছে বর্মী মিলিটারী। একসঙ্গে ১৫ জনকে হত্যা করে এলাকার ১০ জন যুবতি নারীকে ধরে নিয়ে যায়। রহিমা বলেন, আমরা একগ্রামে ছিলাম চারশ মুসলিম পরিবার। এদের মধ্যে দুইশ পরিবারের ছেলে-মেয়ে, বুড়োরা সীমান্ত পাড় হয়ে আসতে পেরেছে। অন্যদের বাড়িঘর পুড়িয়ে দেয়া হয়েছে এবং গুলি করে আগুনে পুড়ে হত্যা করা হয়। এক যায়গায় গণকর দিয়েছে দুই থেকে তিনশ নারী পুুরুষকে। এই নারীদের সকলের সঙ্গে বেইজ্জতি করার পর হত্যা করা হয়। ২০ থেকে ৩০ বছর বয়সী পুরুষকে কাউকে সীমান্ত পাড় হতে দেয়া হয়নি। এলাকার মসজিদ ও মাদ্রাসা আগুনে পুড়িয়ে দেয়া হয়েছে।
২৫ আগষ্টের ঘটনার একমাস আগ থেকেই ওরা (মিয়ানমার সেনাবাহিনী) মুসলমানদের গ্রামে গ্রামে তল্লাসী করে তরুণ-যুবকদের ধরে নিয়ে যায়। তাদের কাউকে হত্যা করে আবার কাউকে কারাগারে রাখে। মুসলমান পরিবার শুনলেই গুলি করে বাড়িতে আগুন ধরিয়ে দেয়। বয়স্কদের মসজিদে নামাজ পড়তে বাধা দেয়। আমার ছেলেকে হত্যা করলেও স্বামীসহ ২শ জনকে ধরে নিয়ে যায় দুই মাস আগে। তাদের ভাগ্যে কি জুটেছে এখনো জানিনা। সেদ্ধ শাক দিতে আসা মোকারা বেগম পালিয়ে আসার করুণ কাহিনীর বর্ণণা দিতে গিয়ে কেঁদে ফেললেন। সীমান্ত পেরুনোর পর নাফ নদ পাড় হওয়ার কাহিনী শোনাতে গিয়ে বললেন, নৌকায় উঠার আগে কথা ছিল মাথাপিছু এক হাজার করে টাকা নেয়া হবে (মিয়ানমারের টাকার নাম কিয়াট। মিয়ানমারের ১৬ কিয়াট বাংলাদেশের এক টাকার সমান)। কিন্তু নৌকায় উঠার পর মাথাপিছু বাংলাদেশী টাকায় ১০ হাজার এবং শিশুদের ৫ হাজার টাকা জোর করে নেয়া হয়। কারো গলা থেকে সোনার হাড় খুলে নেয়া হয়; কানের দুল খুলে নেয়া হয়; আবার কারো কাছ থেকে রুপার গয়না নেয়া হয়। যারা টাকা দিতে পারেনি তাদের কাউকে নাফ নদে ফেলে দেয়া হয়। যাদের বাবা-মাকে হত্যা করা হয়েছে তারা খালি হাতেই আমাদের সঙ্গে সীমান্ত পাড় হন। নৌকার মাঝিকে টাকা দিতে না পারায় তাদের অধিকাংশকেই নাফ নদ ও সাগরে ফেলে দেয়া হয়েছে। তবে কেউ কেউ সাগরে পড়ে লুকিয়ে নৌকার কোনায় ধরে আমাদের সঙ্গে এসেছেন। বাংলাদেশে আসার পরও টাকা দেয়ার যন্ত্রণা কমেনি; এখানেও নানা ভাবে হয়রানী করা হচ্ছে। স্যার, আমার পেটে বাচ্চা। অথচ আমাকে বেইজ্জতি করেছে ৩জন বর্মী মিলিটারী। আমার মতো কত মেয়ে যে ওদের হাতে বেইজ্জতি হয়েছে তার হিসেব নেই। শরণার্থী এই দুই মহিলা রাখাইন ও চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষায় কথা বলছিলেন। তাদের অধিকাংশ কথা বোঝাই যাচ্ছিল না। তাদের বক্তব্য তর্জমা করে দিচ্ছিলেন ১০ ক্লাস পড়া শিক্ষিত রোহিঙ্গা মোহাম্মদ সাব্বির। সাব্বির জানালো, বাংলাদেশের সীমান্তের উলুবুনিয়া বাজারের বিপরীতে মিয়ানমারের নাংচা দং, কুয়াংচি বং সীমান্ত। এ সব সীমান্ত দিয়ে যারা এসেছেন তাদের তেমন টাকা খরচ হয়নি। হোয়াংকো ইউনিয়নের মেম্বার আবদুল গফ্ফার ও তার লোকজন সীমান্ত পাড় হওয়া রোহিঙ্গাদের সহায়তা করে শরণার্থী শিবিরে নিয়ে গেছে। কিন্তু অন্য সব সীমান্তে টাকা লেনদেন হয়েছে।
গত ২৫ আগস্ট মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে সহিংসতার পর থেকে কক্সবাজারের কারেংখালি, নয়া বাজার, জীবন খালি, আঞ্চন পাড়া, উঞ্চিপ্রাণ, লম্বা বিল, হোয়াইক ক্যাং, উলুবুনিয়া, তুলতুল, বিজিবি চেক পোষ্ট, বান্দরবানের তুমরু, খলিফা পাড়া, ঘুমঘুম সীমান্ত দিয়ে বাংলাদেশে পালিয়ে আসতে শুরু করে নির্যাতিত রোহিঙ্গারা। এরপর গত ৫ সপ্তাহে বান্দরবনের ঘুমধুম, তমরু, জলপাইতলির পাশাপাশি টেকনাফের লম্বারবিল ও কাঞ্জরপাড়া সীমান্তসহ ২২টি পয়েন্ট দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে ৬ লাখের বেশি রোহিঙ্গা শিশু নারী পুরুষ বৃদ্ধ। শুধু তাই নয় টেকনাফের শাহপরীর দ্বীপ পয়েন্ট দিয়ে এখনো বাংলাদেশে ঢুকছে হাজার হাজার রোহিঙ্গা। তাদের পালিয়ে আসাকে কেন্দ্র করে মূল্যবান দ্রব্যাদির পাশাপাশি মোটা অংকের টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে একদল দালালচক্র।
বালুখালি শরণার্থী শিবিরে আশ্রয় নেয়া হিল্ল্যা বিবি জানান, ‘দরিয়া (সাগর) পাড় হতে আমদের থেকে টাকা আর অলংকার নিয়ে যায় নৌকার মাঝি আর কিছু লোকজন। না দিলে তারাও আমাদের মেরে ফেলার হুমকি দেয়। যুবতী মেয়েদের যারা টাকা ও গয়না দিতে পারেনি তাদের কারো কারো সঙ্গে সবার সামনে বেইজ্জতি করে মাঝিরা। উলুবুনিয়া রাস্তার মাথা বাজারে স্থানীয় নেতা মনসুর আলী জানান ‘রোহিঙ্গাদের সীমান্ত থেকে শরণার্থী শিবিরে পৌঁছে দিতে দালালেরা ১০-১২ হাজার টাকা পর্যন্ত নিচ্ছে। শুনছি কোথাও কোথাও ৫০-৭০ হাজার করেও টাকা নিচ্ছে। শুধু উলুবুনিয়া, তুলাতুল ও বিজিবি ক্যাম্প চেকপোষ্ট দিয়ে যে রোহিঙ্গারা বাংলাদেশে ঢুকেছে তাদের টাকা দিতে হয়নি। আর প্রতিটি সীমান্তে টাকা দিয়ে রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে প্রবেশ করতে হয়েছে।
প্রশ্ন হলো জীবন বাঁচাতে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গা শরণার্থী নারীদের প্রতি কেন এই পাশবিকতা! তারা কি মানুষ নয়? জন্মগতভাবে ধর্মে মুসলমান হওয়ায় তাদের প্রতি কি বাংলাদেশের তথাকথিত প্রগতিশীল বুদ্ধিজীবীদের মমত্ববোধ জাগছে না? দেশের বুদ্ধিজীবী, সুশীল সমাজ এবং কিছু রাজনীতিকের বচন শুনে মনে পড়ে গেল নির্মলেন্দু গুনের সেই বিখ্যাত কবিতা। ‘আমি হয়তো মানুষ নই, মানুষ হলে জুতো থাকতো/বাড়ি থাকতো, ঘর থাকতো/ ---/পেটের পটে আমার কালো শিশু আঁকতো/----/চোখের মধ্যে অভিমানের রাগ থাকতো/--/ ভালবাসার লোক থাকতো/ হঠাৎ করে মরে যাবার ভয় থাকতো---’। প্রশ্ন হলো শরণার্থী শিবিরে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গারা কি মানুষ নয়? তাদের সঙ্গে কেন এই নিষ্ঠুর পৈচাসিক আচরন?
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।