পটুয়াখালীর যুবক ক্বারী সাইয়্যেদ মুসতানজিদ বিল্লাহ রব্বানীর কোরআন তেলাওয়াতে মুগ্ধ যুক্তরাষ্ট্রবাসী
ইসলামি সভ্যতা ও সংস্কৃতি বিকাশে বাংলাদেশের অবদান অনস্বীকার্য। এদেশে ইসলামি সংস্কৃতি চর্চার ইতিহাস অনেক প্রাচীন।
‘যে শিশু ভূমিষ্ঠ হল আজ রাত্রে/ তার মুখে খবর পেলুম/ সে পেয়েছে ছাড়পত্র এক/ নতুন বিশ্বের দ্বারে তাই ব্যক্ত করে অধিকার/ জন্মমাত্র সুতীব্র চিৎকারে’ (সুকান্ত ভট্টাচার্য)। না! তাবৎ পৃথিবীর শিশুরা জন্মসুত্রে নাগরিকত্বের ছাড়পত্র পেলেও রাখাইনে রোহিঙ্গা মুসলিম শিশুরা ছাড়পত্র পায়নি; পাচ্ছে না। তাদের চিৎকার শোনার যেন কেউ নেই। হাজার হাজার রোহিঙ্গা শিশু জন্ম নিয়ে দেখছে তাদের স্বদেশ ভূমি নেই; চলে গেছে বিজাতীয় বর্বর বর্মী সেনা-মগদের দখলে।
আগুনের লেলিহান শিখা আতুর ঘর জ্বালিয়ে দিয়েছে। ধর্ষিত মা হয় আত্মহত্যা করেছে; নয়তো শান্তিতে নোবেল জয়ী সুচির মিয়ানমার সেনাবাহিনী মাটিচাপা দিয়েছে। বান্দরবানের নাইখ্যাংছড়ি, কক্সবাজারের উখিয়া ও টেকনাফ উপজেলা জুমের পাড়া, তাজনিয়ামার কোলা, পালং খালি, হাকিমপাড়া, কুতুপালং, হোয়াইংক্যাং, তমুরুসহ রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলো ঘুরে হাজার হাজার রোহিঙ্গা এতিম শিশুর বেসুমার চলাফেরা দেখে হতে হলো অবাক! এও কি সম্ভব!! হাজার হাজার এতিম শিশুর খালি গায়ে ঘুরে বেড়ানো দৃশ্য দর্শণার্থীদের হৃদয় কাঁপিয়ে দিচ্ছে। দৃশ্য দেশে অনেকেই চোখের পানি ফেলছেন। কিন্তু তাদের পাশে কে দ্বাড়াবে? মানবিক তাড়না থেকে যারা শরণার্থীদের ত্রাণ দিচ্ছেন এবং ত্রাণ নিয়ে শরণার্থী শিবিরগুলোতে কাজ করছেন তাদের অনেকের সঙ্গে কথা বললে সবার অভিমত; এখনই (একদিন দেরি না করে) সরকারি ভাবে এবং বেসরকারি পর্যায়ে প্রতিটি শরণার্থী ক্যাম্পেই এতিমখানা খোলা দরকার।
সেখানে নাম হীন, বাবা-মা হারানো ১ বছর থেকে ১০ বছর বয়সী শিশুদের আশ্রয় দিতে হবে। আন্তর্জাতিক অনেকগুলো সংস্থার পাশাপাশি দেশি বিদেশী এনজিও শরণার্থীদের নানাভাবে সহায়তা করছে। দেশের সাধারণ মানুষ এবং বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানও সহায়তা করছে। এনজিওগুলো যা করছে; তার চেয়ে মিডিয়ায় প্রচারণা হচ্ছে বেশি। এতিম শিশুদের শিক্ষা দূরের কথা থাকা খাওয়ার কোনো সংস্থান হচ্ছে না। মোটা দাগে গুনলে বান্দরবান ও কক্সবাজার জেলায় রোহিঙ্গা শরণার্থী ক্যাম্পের সংখ্যা ১২টি। ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে আরো অসংখ্য ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ক্যাম্প। এর মধ্যে রেজিষ্টার এবং আনরেজিষ্টার ক্যাম্প রয়েছে। কয়েকদিন ক্যাম্পগুলো ঘুরে যে কমন চিত্র দেখা গেল তা হলো শত শত শিশু খালি গায়ে উদ্দেশ্য বিহীন ঘোরাঘুরি করছে। নিজ দেশে জন্ম নেয়া হাজার হাজার এই রোহিঙ্গা শিশুরা স্বদেশ মিয়ানমার থেকে বিতারিত। বাপ-মা হারানো এসব এতিম শিশু ঘুরে বেড়াচ্ছে পাহাড়ের কাঁদাপানির মধ্যে। তাদের দেখার কেউ নেই, শাসন-আদর করার কেউ নেই, তাদের ভাষা বোঝার কেউ নেই, শিশু অধিকার দূরের কথা এই শিশুদের মানবাধিকার পাহাড়ের ঢালে বৃষ্টির পানিতে লুটোপুটি খাচ্ছে। আবার প্রতিদিন ১০ থেকে ১৫ জন করে নতুন রোহিঙ্গা শিশু ক্যাম্পগুলোতে জন্ম নিচ্ছে। মানবিক চিন্তা চেতনার মধ্য দিয়ে এসব শিশুর ভবিষ্যত বেড়ে ওঠার অবস্থা না করলে বিপর্যয় অবধারিত।
শরণার্থী ক্যাম্পগুলো ঘুরে দেখা গেল অসংখ্য দেশী বিদেশী সংস্থা-প্রতিষ্ঠানের ব্যানার রাস্তায় রাস্তায় টানিয়ে রাখা হয়েছে। কিছু কিছু সংখ্যা ত্রাণ সহায়তা দিলেও অনেকগুলো সংস্থা-প্রতিষ্ঠান কার্যত শুধুই প্রচারণার কৌশল নিয়েছে। দু’একদিন সামান্য ত্রাণ দিয়ে পয়সা খরচ করে মিডিয়ায় ফলাও করে প্রচার করেছে। জাতিসংঘের শিশু বিষয়ক সংস্থা ইউনিসেফ এবং ইন্টার সেক্টর কো-অরডিনেশন গ্রæপ (আইএসসিজি) নামের দুটি এনজিও শিশুদের নিয়ে কাজ করছে। তাদের তথ্য মতে এখনও পর্যন্ত বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া ০ থেকে ১৮ বছরের রোহিঙ্গা শিশু আছে দুই লাখ ৪০ হাজার। যাদের মধ্যে লক্ষাধিক শিশু এখনই স্কুলে যাওয়ার যোগ্য। আর ২০ থেকে ত্রিশ হাজার শিশু রয়েছে যাদের বাবা নেই (এতিম)। এদের বাবাকে মিয়ানমার সেনাবাহিনী হত্যা করেছে; কারো কারো বাবা সে দেশের কারাগারে। ইউনিসেফের দাবি, মিয়ানমার সেনাবাহিনীর নির্যাতনের শিকার হয়ে মিয়ানমার থেকে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে সাড়ে পাঁচ লাখ রোহিঙ্গা। এদের প্রায় ৬০ শতাংশই শিশু। এরা কক্সবাজারের কুতুপালং, উখিয়া, বালুখালি, লেদা, নাইখ্যাংছড়ির তমুরু অঞ্চলের বিভিন্ন ক্যাম্পে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। প্রচারণা রয়েছে শরণার্থী ক্যাম্পে আশ্রয় নেওয়া এসব রোহিঙ্গা শিশুদের শিক্ষা ও মানবিক বিকাশে কাজ করেছে ইউনিসেফ, আইএসসিজি, সেভ দ্য চিলড্রেন, ব্র্যাক, কোডেকসহ কয়েকটি সংস্থা ও এনজিও। এসব শিশুকে লেখাপড়া শেখাতে স্থায়ী ও অস্থায়ী ক্যাম্পগুলোয় লার্নিং সেন্টার, চাইল্ড কেয়ার ও প্রিস্কুলিং সেবা চালু করেছে। রোহিঙ্গা শিশুদের লেখাপড়া শেখাতে ও মানসিক বিকাশে কুতুপালং, উখিয়া, বালুখালি, টেকনাফের হোয়াইক্যাং, লেদা অঞ্চলে ১৭৩টি লার্নিং সেন্টার খোলা হয়েছে। এছাড়া এক লাখ রোহিঙ্গা শিশুর মধ্যে ১২ হাজার ৯শ ৩৪ জনকে তারা প্রিস্কুলিং সেবা দেবে বলে প্রচার করছে। তাদের ভাষায় চারটি অস্থায়ী কেন্দ্রে ৪১৩ জন শিশুকেও তারা সেবা দেবে। এর আগে প্রতি স্থায়ী কেন্দ্রে ৩৫ জন শিশুকে সেবা দেওয়া হতো। তবে এখন থেকে প্রতি কেন্দ্রে ৫০ জনকে সেবা দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে। এনজিওগুলো যদি এসব শিশুর শিক্ষা ও খাওয়ার দায়িত্ব নেয় সেটা হবে ‘সাগরে শিশির বিন্দুর’ মতোই। যদিও এনজিওগুলো শিশুদের মগজ ধোলাইয়ের আশঙ্কা রয়েছে। এ মূহুর্তে শরণার্থী ক্যাম্পগুলোতে হাজার হাজার বাবা-মা হারানো এতিম শিশুদের বাঁচাতে প্রয়োজন স্থায়ী এতিমখানা প্রতিষ্ঠা করা।
নাম তার মোঃ সেলিম, বাবার নাম মোহাম্মদ সুলতান। নিজের ছেলে অসুস্থ কিন্তু তাকে ক্যাম্পে রেখে দেড় বছরের এক শিশুকে চিকিৎসার জন্য ঘুমধুম সীমান্তের তমরু মেডিকেল ক্যাম্পে এসেছে সেলিম। আপনার ছেলের কি হয়েছে? প্রশ্নের জবাব শুনে চোখ ছানাবড়া। শিশুটি কে এবং তার নাম কিছুই জানে না সেলিম। মিয়ানমার বাহিনী গ্রামে আগুন দেয়ার পর সবার মতো তিনি স্ত্রী-ছেলেমেয়ে নিয়ে ছুঁটে পালাচ্ছিলেন সীমান্তের দিকে; তখন থাইনখালি গ্রামে রাস্তার শিশুকে পড়ে থাকতে দেখেন। অসুস্থ শিশু কাঁদতেও পারছিল না। পরিবারের সদস্যসহ নিজের জীবন বাঁচানোর জন্য দৌঁড়ানোর সময় শিশুটিকে এভাবে পড়ে থাকতে দেখে তার মায়া জন্মে। শিশুটিকে তুলে নিয়ে আবার দৌঁড়াতে শুরু করেন। শিশুটি বাবা-মা দূরের কথা নিজের নামও বলতে পারে না। নাম না জানা দেড় বছরের এই শিশুই নয়; নাম জানা হাজার হাজার শিশু শরণার্থী ক্যাম্পগুলোতে রয়েছে পিতামাতাহনী। জুমের পাড়া, তাজনিয়ামার কোলা, পালং খালি, হাকিমপাড়া, কুতুপালং, হোয়াইংক্যাং, তমুরুসহ রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলো ঘুরে একই চিত্র পাওয়া যায়।
বান্দরবান জেলার নাইখ্যাংছড়ির ঘুমধুমসীমান্তের তমরু পশ্চিমকুল গ্রাম। কাঁটাতারের বিপরীতে মিয়ানমার অংশের মগের বিল, পৈইরপাড়া গ্রাম। স্থানীয় স্কুল শিক্ষক হামিদুল হক নিয়ে গেলেন বাড়ির পিছনের দিকে পাহাড়ে। সেখানেই চোখে পড়লো পাহাড়ের উপর দিয়ে ধোঁয়া উড়ছে। নারকেল-সুপারি-পামসহ অসংখ্য বিদেশী গাছ লতাপাতা হীন দাঁড়িয়ে। ধোঁয়া কিসের জিজ্ঞেস করতেই জানালেন, প্রতিদিন এভাবে ধোঁয়া উড়ে। কোনো না কোনো বাড়ি জ্বালিয়ে দেয়া হচ্ছে। হঠাৎ চোখে পড়লো সীমান্তের কাঁটা তারের নতুন বেড়া। ইস্পাতের চকচকে তার দেখে বোঝা যায় নতুন। বেড়ার প্রায় ২০ গজ মাটিতে গাছপালা নেই। পুরনো বেড়ার মধ্যে এটুকু নতুন কেন? প্রশ্ন শুনে পাশে দায়িত্বপালনরত এক বিজিবি সদস্য জানালেন, ওপারে ফকিরপাড়া, পৈইর পাড়া, মগের পাড়া গ্রাম পুড়িয়ে দিলে ওই সব গ্রামের রোহিঙ্গা মুসলিম প্রাণ বাঁচাতে সীমান্তের বেড়া উপড়ে ফেলে এ পথে বাংলাদেশে প্রবেশ করে। এখন তারা তমরু নদীর দুই তীর এবং দুই দেশের নো ম্যান ল্যাÐে অবস্থান করছে। সেখানেও শত শত শিশু খালি গায়ে উদ্দেশ্য বিহীন ঘুরে বেড়াচ্ছে। টেকনাফের হোয়াইক্যাং শরণার্থী ক্যাম্পেও প্রায় অভিন্নচিত্র চোখে পড়লো।
সুকান্ত ভট্টাচার্যের ‘অবাক পৃথিবী! অবাক করলে তুমি/ জন্মেই দেখি ক্ষুব্ধ স্বদেশভূমি/ অবাক পৃথিবী! আমরা যে পরাধীন/- কী দ্রæত জমে ক্রোধ দিন দিন/ --- /দেখি এই দেশে অন্ন সেইকো কারো/--/ দেখি এই দেশে মৃত্যুরই কারবার’। রোহিঙ্গা মুসলিম শিশুদের জন্য এ যেন জন্মের বিধিলিপি! জন্মভুমি তাদের যায়গা দিতে পারেনি। ভাগ্যের নির্মম পরিহাস তারা পাশের দেশে এসে কোথায় থাকবে, কোথায় খাবে, কিভাবে বেড়ে উঠবে কিছুই জানেন না। জানে শুধু তাদের বাবাকে হত্যা করেছে সুচির সেনাবাহিনী। এই শিশুদের জন্য বাংলাদেশে এতিমখানা প্রতিষ্ঠা করা সময়ের দাবি।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।