Inqilab Logo

শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১, ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

জনশক্তি রফতানিতে ধসের আশংকা

মন্ত্রীকে উপেক্ষা করে সার্কুলার জারি : শেষ হয়ে যাচ্ছে ভিসার মেয়াদ : তবু অনুমতি মিলছে না

শামসুল ইসলাম : | প্রকাশের সময় : ২২ সেপ্টেম্বর, ২০১৭, ১২:০০ এএম

১০ লাখ কর্মী প্রেরণের টার্গেট সফল হবে না -নুরুল ইসলাম বিএসসি
 জনশক্তি রফতানিতে ধসের আশংকা দেখা দিয়েছে। প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রী নুরুল ইসলাম বিএসসি’কে উপেক্ষা করে সউদী আরবে গমনেচ্ছু অভিবাসী কর্মীদের ভিসা সত্যায়ন বাধ্যতামূলক সম্পর্কিত সার্কুলার জারি করা হয়েছে। এতে বিদেশ গমনেচ্ছু একক ভিসার কর্মীদের ছাড়পত্র ইস্যুও বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। মিশনগুলোর সত্যায়ন বিহীন একক ভিসার ক্ষেত্রে গত বুধবার থেকে বিএমইটি’র সার্ভার বন্ধ করে দেয়ায় শতাধিক বৈধ রিক্রুটিং এজেন্সি’র কর্মীদের ছাড়পত্রের অনুমতি মিলছে না। বর্হিগমন ছাড়পত্র ইস্যু নিয়ে জটিলতার সৃষ্টি হওয়ায় আটকেপড়া এসব কর্মীদের নিয়ে বিপাকে পড়েছে রিক্রুটিং এজেন্সিগুলো। বহু কষ্টে যোগাড় করা এসব একক ভিসার অনেকেরই ভিসার মেয়াদ শেষ হয়ে যাচ্ছে। ফলে জনশক্তি রফতানি নিন্মগতি লক্ষ্য করা যাচ্ছে। সউদী আরব হচ্ছে জনশক্তি রফতানির সব চেয়ে বৃহৎ শ্রমবাজার । কোনো সময় না দিয়ে হঠাৎ বর্হিগমন ছাড়পত্র ইস্যুর উপর সার্কুলার জারি হওয়ায় বৈধ রিক্রুটিং এজেন্সিগুলোর মাঝে তোলপাড় শুরু হয়েছে। বায়রার একাধিক সূত্র জানিয়েছে বিদেশ গমনেচ্ছু কর্মীদের বর্হিগমন ছাড়পত্র ইস্যু নিয়ে নতুন নতুন সার্কুলার জারি করায় জনশক্তি রফতানিতে ভয়াবহ বিপর্যয় নেমে আসতে পারে। বায়রার নেতৃবৃন্দ বলেন, যুগযুগ ধরে বিদেশ গমনেচ্ছু একক ভিসার কর্মীদের কোনো সত্যায়ন ছাড়াই বর্হিগমন ছাড়পত্র নিয়ে বিদেশে যাচ্ছে। সত্যায়ন ব্যতীত একক ভিসার লাখ লাখ কর্মী বিদেশে গিয়ে না খেয়ে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরেনি। বরং তারা বিদেশে কঠোর পরিশ্রম করে প্রতি মাসে কোটি কোটি টাকার রেমিটেন্স দেশে পাঠাচ্ছেন। এসব রেমিটেন্স দেশের অর্থনীতির চাকাকে সচল রাখছে। বায়রা নেতৃবৃন্দ বলেন, সত্যায়নের দোহাই দিয়ে কর্মী প্রেরণে পদে পদে বাধার সৃষ্টি করা হলে অভিবাসন ব্যয় অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে যাবে এবং শ্রমবাজারে অশনি সংকেত দেখা দিবে। এর দায়-দায়িত্ব সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকেই বহন করতে হবে। তারা শ্রমবাজার সম্প্রসারণের স্বার্থে অনতিবিলম্বে একক ভিসার সত্যায়ন ছাড়াই পূর্বের ন্যায় বর্হিগমন ছাড়পত্র ইস্যুর জোর দাবী জানান। প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রী নুরুল ইসলাম বিএসসি’কে অবহিত না করেই প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের ভারপ্রাপ্ত সচিব ড.নমিতা হালদার একক সিদ্ধান্তে গত ১৪ সেপ্টেম্বর সিনিয়র সহকারী সচিব মো: সামছুল ইসলামের স্বাক্ষরের মাধ্যমে দূতাবাস ও কনস্যুলেট জেনারেল কর্তৃক ভিসায় সত্যায়ন ব্যতীত বর্হিগমন ছাড়পত্র প্রদান না করতে বিএমইটি’র মহাপরিচালক সেলিম রেজার কাছে লিখিত সার্কুলার পাঠান (স্মারক নং ৪৯.০০.০০০০.১০২.১৮.০৬৫১৬-১১৭৬)। কোম্পানী ভিসা ও গ্রæপ ভিসায় মিশনগুলোর শ্রম সচিবদ্বয়ের সত্যায়নের মাধ্যমেই বর্হিগমন ছাড়পত্র ইস্যু করা হয়ে আসছে। গত ১৪ সেপ্টেম্বরের সার্কুলারের দরুণ সকল দেশের সত্যায়ন বিহীন একক ভিসার বর্হিগমন ছাড়পত্র ইস্যূ বন্ধ হয়ে গেছে। যুগ যুগ ধরে বিভিন্ন দেশের একক ভিসার কোনো সত্যায়নের প্রয়োজন হতো না। বিএমইটি’র সূত্র জানায়, গত ৪ সেপ্টেম্বর থেকে গত ২০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বিভিন্ন দেশে ২৭ হাজার ৫শ’ ৭৫জন কর্মী চাকুরি নিয়ে গেছে। গত জুলাই মাসে বিভিন্ন দেশে ৭৬ হাজার ২শ’১৫জন এবং আগষ্ট মাসে ৯৩ হাজার ৩শ’ ৪১জন কর্মী বিদেশে গেছে। এসময়ে কোনো একক ভিসায় সত্যায়ন প্রয়োজন হতো না। গত জানুয়ারী থেকে গত ২০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বিদেশে কর্মসংস্থান লাভ করেছে ৭ লাখ ১৭ হাজার ৬শ’২১জন।
বর্হিগমন ছাড়পত্র ইস্যুর উপর সত্যায়ন সম্পর্কিত নতুন নিষেধজ্ঞা জারি হওয়ায় জনশক্তি রফতানিতে নিন্মমুখী হওয়ার বিষয়টি স্বীকার করেছেন প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রী নুরুল ইসলাম বিএসসি। প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রী নুরুল ইসলাম বিএসসি গতকাল বৃহস্পতিবার তার দপ্তরে ইনকিলাবকে বলেন, সত্যায়ন ছাড়া বর্হিগমন ছাড়পত্র ইস্যু বন্ধের নোটিশ জারি সর্ম্পকে আমাকে কিছু জানানো হয়নি। চলতি বছর বিদেশে দশ লক্ষাধিক কর্মী প্রেরণের টার্গেট করা হয়েছে। এ ধরনের নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করা না হলে চলতি বছর বিদেশে ১০ লাখ কর্মী প্রেরণের টার্গেট পূরণ না হওয়ার আশংকা প্রকাশ করেছেন প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রী । প্রবাসী মন্ত্রী বলেন, বিশ্বের বিভিন্ন দেশে দক্ষ আধা-দক্ষ বাংলাদেশী কর্মীর প্রচুর চাহিদা বাড়ছে। দেশের কারিগরি প্রশিক্ষণ কেন্দ্রগুলোতে দক্ষ জনবল তৈরির লক্ষ্যে ব্যাপক কর্মসূচি হাতে নেয়া হচ্ছে। ২০১৬ সালে বিভিন্ন দেশে ৭ লাখ ৫৭ হাজার ৭শ’ ৩১জন কর্মী চাকুরি নিয়ে গেছে। বুধবার রাতে প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের ভারপ্রাপ্ত সচিব ড.নমিতা হালদারের সাথে যোগাযোগ করে দূতাবাসের সত্যায়ন ছাড়া বিদেশে বর্হিগমন ছাড়পত্র ইস্যুর উপর নিষেধাজ্ঞা জারি সর্ম্পকে জানতে চাইলে তিনি এ ব্যাপারে প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রীর সাথে যোগাযোগ করার পরামর্শ দেন। এদিকে, গতকাল বায়রার সভাপতি বেনজির আহমেদও বর্হিগমন ছাড়পত্রের উপর জারিকৃত নিষেধাজ্ঞায় গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেছেন, প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রীকে গতকাল অনুরোধ করেছি নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের জন্য। তিনি বলেন, আশা করছি বর্হিগমন ছাড়পত্র নিয়ে সৃষ্ট সংকট দুই এক দিনের মধ্যেই নিরসন হবে।
সউদী আরবে নিযুক্ত রাষ্ট্রদূত গোলাম মসীহ ইতিপূর্বে প্রবাসী কল্যাণ সচিবকে এক লিখিত চিঠিতে একক ভিসা সত্যায়ন সম্পর্কিত নিদ্ধান্ত পুন:বিবেচনা করার জন্য অনুরোধ জানিয়েছিলেন। ঐ চিঠিতে রাষ্ট্রদূত বলেন, সউদী শ্রমবাজারে আগত কর্মীর সংখ্যা অনেক বেশি হওয়ায় প্রত্যেকটি ভিসা সরেজমিন যাচাই করে সত্যায়ন করা বিরাট কর্মযজ্ঞ। এ বিরাট কর্মযজ্ঞ সম্পন্ন করার জন্য দূতাবাসের শ্রম উইংয়ে পর্যাপ্ত জনবল ও বরাদ্দ নেই। এ কারণে একক ভিসা সত্যায়ন করা দূতাবাসের পক্ষে সম্ভব নয়। তবে কোম্পানী ভিসা ও গ্রæপ ভিসা সত্যায়ন করা দূতাবাসের পক্ষে সম্ভব হবে। কোম্পানী ভিসা ও গ্রæপ ভিসার চাহিদাপত্র দূতাবাসে দাখিলের পর তা’ সত্যায়নের জন্য চার সপ্তাহ সময় লাগবে।
বিএমইটি’র একজন কর্মকর্তা গতকাল বর্হিগমন নিয়ে নতুন সার্কুলার জারি প্রসঙ্গে বলেন, এতো দিন বিএমইটি থেকে দৈনিক প্রায় সাড়ে তিন হাজার থেকে চার হাজার বর্হিগমন ছাড়পত্র ইস্যু হতো। এখন দৈনিক ছাড়পত্র ইস্যুর সংখ্যা অর্ধেকের চেয়েও নীচে নেমে এসেছে। অতিসম্প্রতি এ সার্কুলার জারি হওয়ায় যেসব রিক্রুটিং এজেন্সি’র বিদেশ গমনেচ্ছু কর্মীর বর্হিগমন ছাড়পত্র ইস্যুর ফাইল বিএমইটিতে আটকা পড়েছে তা’হচ্ছে, দি ইফতি, বায়তুল্লাহ ওভারসীজ, মজুমদার ওভারসীজ, গালফ ওভারসীজ, রীম ওভারসীজ, মিডিল ইস্ট, এম এফ ওভারসীজ, এম এ হামিদ এন্ড সন্স, আল-রাবেতা ইন্টারন্যাশনাল, ফ্যামেক্স ট্রেড, আল মজিল, আমির এভিয়েশন, কিউ কে ওভারসীজ সার্ভিসেস, দি ল²ীপুর ও আল- ফারুক। এসব এজেন্সি’র মালিক ও প্রতিনিধিরা বর্হিগমন ছাড়পত্রের জন্য বিএমইটি ও প্রবাসী কল্যান মন্ত্রণালয়ের দ্বারে দ্বারে ধরর্না দিয়েও কোনো সাড়া পাচ্ছে না। বায়রার সাবেক যুগ্ন-মহাসচিব-১ আলহাজ আবুল বাশার বর্হিগমন ছাড়পত্র ইস্যু নিয়ে নতুন সার্কুলার জারি করায় গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেন, মধ্যপ্রাচ্যের অন্যতম শ্রমবাজার সংযুক্ত আরব আমিরাতে দীর্ঘ চার বছর যাবত জনশক্তি রফতানি বন্ধ। অন্যতম শ্রমবাজার মালয়েশিয়া জিটুজি প্লাস প্রক্রিয়ায় দশ সিন্ডিকেটের দখলে। এসময়ে প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয় থেকে হঠাৎ করে সকল চাহিদাপত্রে দূতাবাসের সত্যায়ন বাধ্যতামূলক সংক্রান্ত নোটিশ জারি করায় জনশক্তি রফতানিতে বিপর্যয় নেমে আসতে পারে। তিনি বলেন, যুগ যুগ ধরে একক ভিসার ছাড়পত্র ইস্যুতে দূতাবাসের কোনো সত্যায়নের প্রয়োজন হয়নি। কার স্বার্থে কি উদ্দেশ্যে এসব একক ভিসায় সত্যায়ন বাধ্যতামূলক করে নতুন নতুন নোটিশ জারি করে জনশক্তি রফতানিতে বাধার সৃষ্টি করা হচ্ছে তা’ খতিয়ে দেখা উচিত। বায়রার ঐ সাবেক নেতা বলেন, জনশক্তি রফতানিতে ইতিপূর্বে নানা বাধার কারণে সাগরপথে অবৈধভাবে মালয়েশিয়া ও থাইল্যান্ডে গিয়ে শত শত মানুষ অকালে প্রাণ হারিয়েছে। এতে দেশের ভাব মর্যাদাও বর্হিবিশ্বে ক্ষুন্ন হয়েছে। এ ধরনের ঘটনার আর যাতে না ঘটে সে দিকে লক্ষ্য রেখে বায়রার নেতৃবৃন্দের সাথে আলাপ আলোচনা করে বৈধভাবে জনশক্তি রফতানির ক্ষেত্রে নীতিগত সিদ্ধান্ত নেয়ার জন্য অনুরোধ জানান। তিনি জনশক্তি রফতানি বৃদ্ধির স্বার্থে বর্হিগমন ছাড়পত্র ইস্যুতে সৃষ্ট জটিলতা দ্রুত নিরসনের জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আশু হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন। বর্হিগমন ছাড়পত্র ইস্যুর নিন্মগতি ও নতুন সার্কুলার প্রসঙ্গে বিএমইটি’র মহাপরিচালক সেলিম রেজার সাথে একাধিকবার যোগাযোগ করেও তাকে পাওয়া যায়নি। গতকাল প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের সভাকক্ষে ভারপ্রাপ্ত সচিব ড. নমিতা হালদারের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সভায় বর্হিগমন ছাড়পত্র সংক্রান্ত জারিকৃত নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার নিয়ে কোনো সিদ্ধান্ত হয়েছে কিনা এমন প্রশ্নের জবাবে মন্ত্রণালয়ের জনসংযোগ কর্মকর্তা জাহ্ঙ্গাীর আলম বলেন, এ ব্যাপারে আমি কিছু জানি না।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: জনশক্তি রফতানি

১৫ জানুয়ারি, ২০২০
২৮ সেপ্টেম্বর, ২০১৭
২২ সেপ্টেম্বর, ২০১৭

আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ