পটুয়াখালীর যুবক ক্বারী সাইয়্যেদ মুসতানজিদ বিল্লাহ রব্বানীর কোরআন তেলাওয়াতে মুগ্ধ যুক্তরাষ্ট্রবাসী
ইসলামি সভ্যতা ও সংস্কৃতি বিকাশে বাংলাদেশের অবদান অনস্বীকার্য। এদেশে ইসলামি সংস্কৃতি চর্চার ইতিহাস অনেক প্রাচীন।
দাঙ্গাবাজ বাহিনী বাড়িঘরে হামলা, লুটপাট ও অগ্নিসংযোগ করতে এসেছে। চারদিকের চিৎকার চেঁচামেচিতে মা-বাবা আদরের শিশুসন্তানটিকে পেছনের দরজা দিয়ে বের করে দেন, ‘যা বাবা, পালিয়ে যা, অনেক দূরে পালিয়ে যা’। এরপর জীবন বাঁচাতে বের হওয়ার চেষ্টার মুহূর্তেই ঘরে প্রবেশ করে নির্দয় দাঙ্গাবাজরা। বাবাকে নৃশংসভাবে হত্যার পর মাকেও ধর্ষণ শেষে বাড়িতে আগুন লাগিয়ে পুড়িয়ে মেরে ফেলে। অসহায় শিশুটি ওদিকে আধো আধো কথা বলতে বলতে দৌড়াতে থাকে প্রাণভয়ে। ওই সময় তার চোখে কেবল ভেসে ওঠে মায়ের কোলখানি, যেখানে সে ঘুমাত। মায়ের ঘুমপাড়ানি গান শুনে। ভেসে ওঠে বাবার কাঁধখানি, যেখানে যে খেলত, সবার ওপরে উঠে যাওয়ার খেলা। তার চোখ বেয়ে পানি গড়ায়। যে মা-বাবাকে ছাড়া এক মুহূর্তও কাটে না, তাদের ছেড়ে সে আজ জীবন বাঁচাতে ছুটছে। এটি মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের লাখো রোহিঙ্গার ভাগ্যে ঘটতে থাকা নির্মম বাস্তবতা। এ বাস্তবতার করুণ শিকার শিশু আরমান, রহিম, আজিজ। মায়ের স্নেহের কোল আর বাবার আদরের কাঁধ ছেড়ে ছুটতে না চাইলেও মিয়ানমারের সেনাবাহিনী তাকেও দেশান্তরী হতে বাধ্য করেছে। সীমানা, দেশ অবশ্য না বুঝলেও আরমান বোঝে রাতের পর রাত ছুটতে ছুটতে নদী পার হয়ে এপারে এসে সে মা-বাবা থেকে অনেক ‘দূর’ হয়ে গেছে। বাড়ির আঙিনায় কাঁটা ফুটতেই মা বলে ডাক দিলে যে মা ছুটে আসতেন, নাফ নদীর তীরে বসে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে ডাকতে থাকলেও মা ছুটে না আসায় আরমান বোঝে, সে বড্ড দূরে চলে এসেছে। বাবা নাকি তার কাজে অনেক দূর যেতেন। আরমান জানে না, তার বাবা এখানেও আসবেন কিনা, তাকে কাঁধে করে বাড়ি ফিরিয়ে নিতে। পরনে ছেঁড়া কাপড় আর ক্লান্ত চোখ-মুখ দেখে বোঝা যায়, অনেক বেলা হয়তো খাওয়াও হয়নি। কিন্তু অসহায় শিশুটি খাবারের কথাও যেন ভুলে গেছে। কিছু খেতে চাইবার বদলে সে কেবল মা-বাবাকে ডাকছে। নদীর ওপারে জ্বলতে থাকা আগুন দেখিয়ে সে বোঝায়, ওই জ্বলন্ত মিয়ানমারে মা-বাবাকে রেখে সে চলে এসেছে এখানে। তাদের দিকে চেয়ে সে এখানে বসে আছে। তার অবুঝ মনের স্বপ্ন হয়তো তার কান্না শুনে অতীতের মত তার মা দৌড়ে এসে তাকে বুকে জড়িয়ে ধরবে। তার আশা তার ক্ষুধার্ত মুখে খাবার তুলে দিবে মা। তাইতো কিছুক্ষণ চুপ থেকে আরমান সেদিকে তাকিয়েই ফের কাঁদতে থাকে। কূলে নৌকা ভিড়তেই আরমানের চোখ যায় সেদিকে। বসা থেকে দাঁড়িয়ে যায় আরমান। এসব মানুষের ভিড়ে সে মা-বাবাকে খোঁজে। তার পাড়ার চাচা-মামাদের খোঁজে। যেন কেউ তার মা-বাবার খোঁজ নিয়ে আসবে। নৌকা থেকে নেমে আসা মানুষগুলো আরমানের পাশ ঘেঁষে চলে যাচ্ছে। যে যার মতো করে ছুটছে। কেউ কারও খোঁজখবর নেয়ার সময় নেই। মা-বাবার কথা বলতেই সে বাঁ হাতে চোখ মুছে আর ডান হাতে নদীর ওপারে ইশারা করে; ‘আম্মা-আব্বু ওই’। তার দু’ফোটা চোখের পানি গাল বেয়ে যেন আর পড়তেই চাই না। চোখের পানি ফুরিয়ে আসলেও তাদের জীবন কষ্ট কি আদৌ ফুরাবে?
এমনই অনিশ্চিত ভবিষ্যতের পথ পাড়ি দিয়ে আরমানের মতো আরও অনেক রোহিঙ্গা শিশু-বৃদ্ধ-মা-তরুণ-তরুণী এপারে পালিয়ে আসছে। রোহিঙ্গা নারী-পুরুষদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, মিয়ানমার থেকে পালিয়ে যেসব রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে তার অর্ধেকের বেশি শিশু। এর মধ্যে হাজারে অধিক শিশু রয়েছে যাদের সঙ্গে পরিবারের কোনো সদস্য নেই। তাহলে কীভাবে এসব শিশু এপারে আসছে-এমন প্রশ্নের উত্তরে রোহিঙ্গাদের জবাব, রাখাইন রাজ্যে মিয়ানমার আর্মিরা মূলত রাতের বেলায় আগুন দেয়। এতে যেসব গ্রাম আক্রান্ত হয় তাৎক্ষণিক ওইসব গ্রামের মানুষ ছোটাছুটিতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। তখন পরিবারের বাবা-মা-আত্মীয় স্বজন নিজেদের ছেলে-মেয়ে পাহাড়ের দিকে পালিয়ে যেতে সহায়তা করে। আবার অনেক শিশু রাতের আঁধারে পালাতে গিয়ে পাহাড় ও নাফ নদীর পাড়ে চলে আসে। এমন অনেক পরিবার আছে যারা পালানোর সময় তাদের সন্তানদের হারিয়ে ফেলে। এর মধ্যে অনেক শিশু এমনও আছে-যাদের মা-বাবাকে মিয়ানমার আর্মি গুলি করে মেরে ফেলেছে কিংবা তাদের ঘরে আগুন দেয়ায় মা-বাবা পুড়ে গেছে। কোনোমতে শিশুটি বেঁচে গেছে। এ অবস্থায় ওসব শিশু যখন তাদের মা-বাবা কিংবা আত্মীয়স্বজনদের খুঁজে না পায়, তখন দল বেঁধে আসা মানুষগুলোর মধ্যে ঢুকে পড়ে। তাদের সঙ্গেই এসব শিশু নাফ নদীর পাড়ে চলে আসে। ওখান থেকে কারও দয়া হলে নৌকায় তুলে শিশুদের এপারে শাহপরীর দ্বীপে নিয়ে আসা হয়। অনেক সময় দেখা যায়, শিশুদের বাঁচাতে এপারের নৌকায় তুলে দিয়ে ওপারে মা-বাবা থেকে যায়। আরমানের মতো রহিম নামে এক শিশু জানায়, তার বাবা-মা কোথায় সে জানে না। নদীর ওপার থেকে তার পরিচিত একজন তাকে নৌকায় তুলে দেয়। সেখান থেকে শাহপরীর দ্বীপে আসে। সেখান থেকে সাবরাং ইউনিয়ন হয়ে ট্রলারযোগে টেকনাফে আসে। পানি আর গাছের পাতা খেয়ে গত চারদিন কেটেছে তার। এখানে এসে কিছু খাবার পেয়েছে সে। কিন্তু উখিয়া কুতুপালং রোহিঙ্গা ক্যাম্প যেতে তার কাছে ভাড়ার টাকা নেই। মোহম্মদ আজিজ নামে এক শিশু জানায়, মিয়ানমারের আকিয়াব অঞ্চলের মংডু এলাকার তাদের বাড়ি ছিল। গত ১৪ সেপ্টেম্বর রাতে তাদের বাড়িতে আগুন দেয়া হয়। রাতের আঁধারে পালাতে গিয়ে বাবা-মাকে হারিয়ে ফেলে সে। পরে নৌকায় আরেক চাচার মাধ্যমে এপারে আসে। বাবা-মা বেঁচে আছেন কিনা জানে না আজিজ। আরমান-রহিম-আজিজই শুধু নয়, মিয়ানমারে সেনাবাহিনীর গণহত্যার মুখে সেখান থেকে পালিয়ে হাজার হাজার রোহিঙ্গা শিশু একাকি বাংলাদেশে চলে এসেছে। কিন্তু এসব শিশু ভবিষ্যত কী তা তারা জানে না। তারা অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে হয়তো পরবর্তী যে কোন নৌকায় ফিরে আসবে তাদের মা-বাবা।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।