Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে কূটনৈতিক তৎপরতা জোরদার

স্টালিন সরকার | প্রকাশের সময় : ১৭ সেপ্টেম্বর, ২০১৭, ১২:০০ এএম

রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে ব্যাপক কূটনৈতিক তৎপরতা শুরু করেছে বাংলাদেশ। রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিতে মিয়ানমারকে বাধ্য করতে চাপ সৃষ্টির লক্ষ্যে কূটনৈতিক পর্যায়ে রাষ্ট্র টু রাষ্ট্রের বৈঠক করার জন্য বিদেশে কর্মরত বাংলাদেশের কূটনীতিকদের নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। রোহিঙ্গা শরণার্থীদের আশ্রয় দেয়া এবং সংকটের স্থায়ী সমাধানে বিশ্ব সম্প্রদায়কে ঐক্যবদ্ধ করার বাংলাদেশের উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়েছে তুরস্ক, নেদারল্যান্ড, বৃটেন, আমেরিকা, ভারতসহ প্রভাবশালী কয়েকটি দেশ। এর আগে সর্বপ্রথম তুরস্ক বাংলাদেশের পাশে থাকাসহ জাতিসংঘে রোহিঙ্গা ইস্যু উদ্ধাপন করার ঘোষণা দিয়েছে। ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রী সুষমা স্বরাজ ইতোমধ্যেই ফোন করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ‘পাশে থাকার’ প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। সাবেক কূটনীতিক ও আন্তর্জাতিক সম্পর্কের বিশ্লেষকরা বলছেন, কূটনৈতিকভাবে বিশ্ব সম্প্রদায়কে ঐক্যবদ্ধ করে মিয়ানমারকে রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিতে বাধ্য করা সময়ের দাবি। সরকার সে উদ্যোগ নিচ্ছে।
মিয়ানমারকে চাপ দিয়ে রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নেয়ার মাধ্যমে সমস্যা সমাধানে পাশাপাশি জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনের সাইড বৈঠক এবং ফোরামে রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানের বিষয়টি তুলে ধরার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। নিউ ইয়ূর্কে জাতিসংঘের অধিবেশনে ইস্যুটি গুরুত্বসহকারে তুলে ধরবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এর আগে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে ঢাকায় কর্মরত বিভিন্ন দেশের কূটনীতিকদের ডেকে নিয়ে রোহিঙ্গা ইস্যুতে বাংলাদেশের অবস্থান তুলে ধরা হয়। ঢাকায় কর্মরত প্রায় ৫০টি দেশের রাষ্ট্রদূত, হাইকমিশনার ও কূটনীতিককে রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবিরগুলো পরিদর্শন করানো হয়। উন্নয়ন সহযোগী চীন ও ভারত যাতে রোহিঙ্গা ইস্যুতে বাংলাদেশের অবস্থা বুঝে মিয়ানমারের প্রতি চাপ সৃষ্টি করেন সে প্রচেষ্টা চালানো হয়েছে। ইতোমধ্যেই জাতিসংঘ, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, তুরস্কসহ কয়েকটি দেশে বাংলাদেশের ভূমিকার প্রশংসা করেছে। অন্যদিকে ঢাকায় কর্মরত মিয়ানমারের ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রদূতকে কয়েক দফায় তলব করে বাংলাদেশের অবস্থান জানিয়ে দেয়া হয়েছে। রোহিঙ্গা শরণার্থীদের প্রতি বাংলাদেশের মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখার প্রশংসা করে বিশ্বের কয়েকটি দেশ ও আন্তর্জাতিক সংস্থা শরণার্থীদের জন্য বিপুল পরিমাণ খাদ্য সহায়তা পাঠিয়েছে।
মানবিক দিক বিবেচনা করেই বাংলাদেশ রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিয়েছে। তাদের পাশে দাঁড়ানোর জন্য বিশ্ব সম্প্রদায়ের প্রতি আহবান জানিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা রোহিঙ্গা শরণার্থীদের দূর্দশার চিত্র দেখে আবেগাপ্লুত হয়ে ঘোষণা দিয়েছেন, আমরা ১৬ কোটি মানুষের খাদ্যের সংস্থান করতে পারলে পাঁচ-সাত লাখ রোহিঙ্গাকে খাওয়াতে পারবো। জাতিসংঘে নিযুক্ত বাংলাদেশের স্থায়ী প্রতিনিধি মাসুদ বিন মোমেন নিউইয়ূর্কে সংবাদ সম্মেলন করে জানিয়েছেন, জাতিসংঘের এবারের অধিবেশনে রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে আন্তর্জাতিক স¤প্রদায়ের সমর্থন অর্জনের জোড়ালো চেষ্টা করা হবে। সেখানেই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে আগামী ১৯ সেপ্টেম্বর রোহিঙ্গা সংখ্যালঘু বিষয়ে ওআইসির কন্টাক্ট গ্রুপের সভা অনুষ্ঠিত হবে। ওই সভায় রোহিঙ্গাদের ওপর মিয়ানমার সরকারের সহিংসতা, নিপীড়ন এবং এর ফলে প্রাণ বাঁচাতে রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে পালিয়ে আসার চিত্র তুলে ধরা হবে এবং আলোচনা হবে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা রোহিঙ্গাদের দুর্দশা তুলে ধরে এ সমস্যার আশু সমাধানে মুসলিম উম্মাহর দ্রুত ও কার্যকর পদক্ষেপ কামনা করবেন।
এদিকে ঢাকায় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক সংবাদ সম্মেলনে পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী জানান, রোহিঙ্গাদের ওপর মিয়ানমার সরকারের চলমান ‘জাতিগত নির্মূল অভিযান’ অবিলম্বে বন্ধ করে বাংলাদেশের শরণার্থী শিবিরে আশ্রয় নেয়া সকল রোহিঙ্গার নিরাপদ প্রত্যাবাসন নিশ্চিত করতে মিয়ানমার সরকারের ওপর আন্তর্জাতিক চাপ অব্যাহত রাখার চেষ্টা চলমান থাকবে। প্রধানমন্ত্রী রোহিঙ্গা ইস্যুটি জাতিসংঘে শক্তভাবে তুলে ধরবেন। রাখাইন রাজ্যে মিয়ানমার যে গণহত্যা চালাচ্ছে; তা তিনি তুলে ধরবেন এবং বিশ্বনেতাদের প্রতি আহ্বান জানাবেন এ সমস্যার স্থায়ী সমাধানে পদক্ষেপ নেওয়ার। রোহিঙ্গা সমস্যার মূল কারণ বিশ্বনেতাদের সামনে তুলে ধরার পাশাপাশি শরণার্থী রোহিঙ্গাদের প্রতি বাংলাদেশের মানবিক আচরণের বিষয়টি নিয়েও কথা বলবেন তিনি। মধ্যপ্রাচ্যের মুসলিম দেশগুলো যাতে রোহিঙ্গ মুসলিমদের সহায়তায় এগিয়ে আসে সে প্রচেস্টাও চলছে।
বাংলাদেশ কূটনৈতিক পর্যায়ে তৎপরতা চালিয়ে রোহিঙ্গা সমস্যার স্থায়ী সমাধানের পক্ষ্যে। এ জন্য রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারকে ফিরিয়ে নিতে বাধ্য করতে বিশ্বের জনমত সৃষ্টির চেষ্টা চলছে। সে লক্ষ্যেই ঢাকায় কর্মরত কূটনীতিকদের সরেজমিন সে চিত্র দেখাতে শরণার্থী শিবির সফরে যান। যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ইওরোপীয় ইউনিয়ন, রাশিয়া, চীন, ভারত, সউদী আরবের রাষ্ট্রদূতরা এই সফরে সামিল হন। বিদেশী কূটনীতিকরা কখনও গাড়িতে চড়ে আবার কখনও পায়ে হেঁটে শিবিরগুলোতে গিয়ে শরণার্থীদের দুঃখ দূর্দশার চিত্র দেখেন এবং তাদের ওপর মিয়ানমার বাহিনীর লোমহর্ষক হত্যাযজ্ঞের বণর্না শোনেন। কূটনীতিকদের পক্ষে কথা বলার সময় নেদারল্যান্ডসের দূত লিওনি মার্গারেটা বলেন, অবশ্যই রোহিঙ্গা সংকট এখন আগের চেয়েও বেশি বিপর্যয়কর। অনেক বেশি নির্যাতিত মানুষ প্রাণ বাঁচাতে শিবিরগুলোতে আশ্রয় নিয়েছে। নিঃসন্দেহে এটি একটি মানবিক সংকট। আমাকে অবশ্যই বাংলাদেশ সরকারের প্রশংসা করতে হবে এতো মানুষকে উষ্ণতার সাথে গ্রহণ করার জন্য। আমরা সব ধরণের সহায়তা করবো। বিদেশী কূটনীতিকরা জানান, তারা রোহিঙ্গা সমস্যা সম্পর্কে নিজ নিজ দেশে প্রতিবেদন পাঠাবেন এবং বাংলাদেশের পাশে দাঁড়ানোর প্রস্তাবনা দেবেন। তুরস্কের ফাষ্ট লেডি এমিনি এরদোগান নিজেই কক্সবাজারের রোহিঙ্গা শরনার্থী শিবিরগুলো পরিদর্শন করে তাদের ত্রাণ দিয়ে গেছেন। তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ সেইয়েপ এরদোগান বাংলাদেশের প্রেসিডেন্টের সঙ্গে ফোনে কথা বলে বাংলাদেশের পাশে থাকার ঘোষণা দিয়েছেন। তিনি রোহিঙ্গা সংকট ইস্যু নিয়ে দ্রুত প্রস্তাব গ্রহণের জন্য জাতিসংঘ সাধারণ অধিবেশনে বিষয়টি উত্থাপন করার ঘোষণা দেন। মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়াসহ কয়েকটি দেশ প্রথম থেকেই সংকট সমাধানে সব ধরণের সহায়তা কথা বলছেন।
এ প্রসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক ড. শাহেদুজ্জামান বলেন, রোহিঙ্গা মুসলিমদের হত্যাযজ্ঞ পরিকল্পিত ভাবে করছে মিয়ানমার সেনাবাহিনী। আন্তর্জাতিক চাপ সৃষ্টি ছাড়া রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিতে মগ কসাইদের বাধ্য করা সম্ভব নয়। আর এটা করতে হলে চীন ও ভারতকে পাশে পাওয়া বাংলাদেশের জন্য জরুরী। সৈয়দ আবুল মকসুদ বলেন, মিয়ানমারের উপর আন্তর্জাতিক চাপ খুব প্রয়োজন। তবে শুধু এই টুকু চাপে সমস্যা সমাধান হবে না। এই সমস্যার সমাধান করতে হলে আমাদের আঞ্চলিক শক্তিধর দেশ চীন, ভারত এবং রাশিয়ার সহযোগিতা দরকার। আবার চীন মিয়ানমারের পক্ষে অবস্থান নিয়েছে। এখন চীন যদি মিয়ানমারের পক্ষে থাকে আর সবাই যত রেজুলেশন দিক সেটা বাস্তবায়ন করা কঠিন হয়ে পড়বে। সেই জন্যেই আঞ্চলিক শক্তি গুলোর ভূমিকা বেশি দরকার। সুজনের সাধারণ সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেন, রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী অমানবিক এবং মানবেতর জীবন-যাপন করছে। আশ্রয় নিয়েছে আমাদের দেশে। সেজন্য জাতিসংঘ, অন্যান্য শক্তিশালী-পরাক্রমশালী রাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং আমাদের প্রতিবেশী ভারত ও চীন চাপ প্রয়োগ করলেই সমস্যার সমাধান হবে; তা না হলে হবে না। এটাই একমাত্র পথ। এখানে আমাদের তিনটি কাজ করতে হবে। প্রথমত বিশ্ব জনমতকে মোবিলাইজ করা, দ্বিতীয়ত বিশ্ব বুদ্ধিজীবী বা গুরুত্বপূর্ণ নাগরিকদের মোবিলাইজ করা এবং তৃতীয়ত বিশ্ব মিডিয়াকে বোবিলাইজ করা। ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) সাখাওয়াত হোসেন বলেছেন, রোহিঙ্গাদের দ্রæততম সময়ের মধ্যে ফেরত দিতে না পারলে তারা নানা রকমের অপরাধের সঙ্গে জড়িয়ে পড়তে পারে। এ জন্য কূটনৈতিক তৎপরতা জোরদার করা প্রয়োজন।
এদিকে ঢাকায় নিযুক্ত ব্রিটিশ হাইকমিশনার অ্যালিসন বেøক জানিয়েছেন শুধু মানবিক সহায়তা নয় রোহিঙ্গা সংকটের দীর্ঘমেয়াদি রাজনৈতিক সমাধানেও পাশে থাকবে যুক্তরাজ্য। এ তথ্য জানিয়ে গতকাল তিনি বলেন, মিয়ানমারকে সহিংসতা বন্ধে নিরাপত্তা পরিষদের দেওয়া বিবৃতির পেছনে গুরুত্বপূর্ণ পালন করেছে যুক্তরাজ্য ও সুইডেন। রোহিঙ্গা সমস্যার একটি স্থায়ী সমাধান খুঁজতে হবে, যার অর্থ হলো আনান কমিশন বাস্তবায়নে সমর্থন জানানো। নির্যাতনের জন্য যারা দায়ী, তাদের জবাবদিহিতার আওতায় আনতে হবে এবং দীর্ঘমেয়াদি ও স্থায়ী সমাধানের জন্য এটা জরুরি। শুধু ব্রিটেনের হাইকমিশনার নয়, ঢাকায় কর্মরত অধিকাংশ দেশের কূটনীতিকরাই রোহিঙ্গা সমস্যার স্থায়ী সমাধানে বাংলাদেশের কূটনৈতিক উদ্যোগকে স্বাগত জানাচ্ছেন।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: রোহিঙ্গা


আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ