পটুয়াখালীর যুবক ক্বারী সাইয়্যেদ মুসতানজিদ বিল্লাহ রব্বানীর কোরআন তেলাওয়াতে মুগ্ধ যুক্তরাষ্ট্রবাসী
ইসলামি সভ্যতা ও সংস্কৃতি বিকাশে বাংলাদেশের অবদান অনস্বীকার্য। এদেশে ইসলামি সংস্কৃতি চর্চার ইতিহাস অনেক প্রাচীন।
‘ব্লক রেইড’ দিয়ে আরো ভয়াবহ হচ্ছে বর্মী সেনাভিযান : গহীন পাহাড়-জঙ্গল নদ-নদী ও সীমান্তে পালিয়ে বেড়াচ্ছে কমপক্ষে তিন লাখ ও অবরুদ্ধ কয়েক লাখ রোহিঙ্গা : গণহত্যার শিকার পাঁচ হাজার ছাড়িয়েছে : গুম ধর্ষণের শিকার অগণিত : ট্রলার ডুবে নিখোঁজ তিন শতাধিক : ১০ লাশ উদ্ধার : সীমান্তে মিয়ানমারের স্থলমাইন, বাংলাদেশের প্রতিবাদ : কক্সবাজার-বান্দরবানে আশ্রয় নিয়েছে দেড় লাখেরও বেশি : জাতিসংঘ বলছে- আরো সোয়া লাখ বাংলাদেশের পথে : সঙ্কট সমাধানে ইন্দোনেশিয়ার ‘ফর্মুলা ফোর প্লাস ওয়ান’ প্রস্তাব : রোহিঙ্গা নির্যাতনে বৌদ্ধ নেতাদের উদ্বেগ
চোখে মুখে ভয়-আতঙ্ক। বুকফাটা কান্না আর আহাজারি। রোহিঙ্গা মুসলমানরা মাতৃভ‚মি মিয়ানমারের আরাকানে (পরিবর্তিত নাম রাখাইন স্টেট) বাবা-মা, স্বামী-স্ত্রী, ভাই-বোন এবং আত্মীয়-প্রতিবেশীদের লাশ পেছনে ফেলে শুধুই জীবন আর ইজ্জত-আব্রুটুকু বাঁচানোর তাগিদে অবিরত ছুটে আসছে সীমান্তের দিকে। গতকাল (বুধবার) পর্যন্ত ‘একটু শান্তির’ খোঁজে দলে দলে রোহিঙ্গা অচেনা ‘এপারে’ অর্থাৎ বাংলাদেশে পালিয়ে এসে ঠাঁই নিয়েছে বনে-বাঁদাড়ে রাস্তা-ঘাটে পাহাড়-টিলার কিনারে। নির্যাতনে-নিপীড়নে আরাকানি রোহিঙ্গাদের চোখের পানিও শুকিয়ে গেছে। নিরীহ লাখো নর-নারী শিশু-বৃদ্ধ রোহিঙ্গা এখন শোকে পাথর আর ক্ষুধার যন্ত্রণায় কাতর। অনেকেই গুলি বোমা কিংবা আগুনে পুড়ে যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছে। কোথায় পাবে চিকিৎসা? মাথা গোঁজার আশ্রয়টুকুও নেই। চোখের সামনেই সাজানো ঘর-সংসার তাদের ধ্বংস হয়ে গেছে। ৮৫ বছরের বয়োবৃদ্ধ থেকে শুরু করে এক সপ্তাহের নবজাতক কোলে নিয়ে অসহায় মা পর্যন্ত এখন শুধুই বেঁচে থাকার চেষ্টা করছে সীমান্তজুড়ে। জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো বলছে, রাখাইনের দুর্গম পাহাড়-পর্বত ও বন-জঙ্গল, নদী দিয়ে দীর্ঘ পথ অতিক্রম করে বাংলাদেশে পালিয়ে আসা এবং আসার অপেক্ষায় সীমান্তের বিভিন্ন পয়েন্টে জড়ো হওয়া শিশু-বৃদ্ধ, মহিলাসহ নিরীহ রোহিঙ্গারা অত্যন্ত ক্লান্ত, ক্ষুধার্ত ও অনেকেই অসুস্থ কিংবা আহত রয়েছে। তাদের আশ্রয়, সেবা ও খাদ্যের ব্যবস্থা করা এ মুহূর্তে সবচেয়ে জরুরি।
এ যাবত গত দুই সপ্তাহের হিংস্রতায় বর্মী বাহিনী ও তাদের সহচর উগ্র মগদের একতরফা নির্বিচার আক্রমণে নিরীহ রোহিঙ্গা মুসলমানদের বাড়িঘর, মসজিদ, মাদরাসা, দোকান-পাট, গৃহপালিত পশু-পাখি, ধান-চালের গোলাসহ সবকিছুই ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে। মিয়ানমার শাসকগোষ্ঠীর নির্দেশে সেনাবাহিনী পূর্ব-পরিকল্পনা মাফিক রোহিঙ্গা জনসংখ্যা-বহুল একেকটি এলাকা বিভক্ত করে ‘ব্লক রেইড’ দিয়ে চালাচ্ছে দমন-পীড়নের তথাকথিত এই অভিযান। বিভিন্ন সূত্রে আরো জানা গেছে, বর্মী সেনাবাহিনী আরাকানের (রাখাইন) মংডু জেলার পাঁচটি প্রশাসনিক এলাকাকে ‘সামরিক অভিযানের এলাকা ঘোষণা করেছে। এগুলো হচ্ছে- মংডু জেলার মংডু সদর, বুচিডং, রাচিডং, তমব্রু-বাম ও মিনলুট। এসব অঞ্চলে সেনা নেতৃত্বে যৌথবাহিনীর সংখ্যা বাড়ানো হয়েছে। এতে করে আরো ভয়াবহ রূপ নিচ্ছে সেনাভিযান।
এ অবস্থায় টিকে থাকতে না পেরে আরাকানের বিশেষত উত্তর-পশ্চিম দিকে সীমান্তের গহীন ও দুর্গম পাহাড়-জঙ্গল, নদ-নদীতে পালিয়ে বেড়াচ্ছে কমপক্ষে তিন লাখ রোহিঙ্গা। নিরাপত্তা ক্যাম্পে ও নিজেদের বসতবাড়িতে অবরুদ্ধ হয়ে আছে আরো কয়েক লাখ। সূত্রগুলো জানায়, আগস্ট থেকে পরিচালিত গণহত্যার শিকার রোহিঙ্গার সংখ্যা পাঁচ হাজার ছাড়িয়ে যেতে পারে। আর গুম ও ধর্ষণের শিকার হয়েছে অগণিত। পালাতে চাইলেও গুলি করে হত্যা করা হচ্ছে পশু-পাখি শিকারের মতো! স্বদেশ থেকে সমূলে উৎপাটিত বিপন্ন রোহিঙ্গাদের ঢলে সীমান্তের ওপারে-এপারে এক অবর্ণনীয় মানবিক বিপর্যয় সৃষ্টি হয়েছে। এ যাবত সীমান্ত পাড়ি দিয়ে কক্সবাজার ও বান্দরবান জেলায় আশ্রয় নিয়েছে দেড় লাখেরও বেশি। তাছাড়া জাতিসংঘ গতকাল বলেছে, আরো অন্তত সোয়া লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে পালিয়ে আসার পথে রয়েছে।
সত্যিই মগের মুল্লুক
আরাকানে মিয়ানমার সেনাবাহিনী, সীমান্তরক্ষী বিজিপি, গোয়েন্দা, পুলিশ ও উগ্র মগদস্যুদের জ্বালাও-পোড়াও আর গণহত্যার নারকীয় তান্ডব অব্যাহত রয়েছে। বাস্তব অর্থেই ‘মগের মুল্লুকে’ পরিণত হয়েছে আরাকান। পরিস্থিতি আরো ভয়াবহ রূপ নিয়েছে। নিরস্ত্র-নিরীহ রোহিঙ্গা মুসলমানদের পাইকারীভাবে ধরে ধরে গুলি চালিয়ে কিংবা ঘরবাড়িতে বোমা মেরে পেট্রল ও গানপাউডার দিয়ে আগুন লাগিয়ে হত্যাযজ্ঞ বেড়েই চলেছে। অবর্ণনীয় পাশবিক কায়দায় নির্যাতন-নিপীড়ন চালিয়ে তাদেরকে বিতাড়িত করা হচ্ছে স্বদেশের মাটি থেকে। অতীতে ১৯৭৭-৭৮, ১৯৯১-৯৬, ২০১২ এবং গত বছর ২০১৬ সালে রোহিঙ্গাদের ওপর অত্যাচার-নিপীড়ন, হত্যাকান্ড ও বিতাড়িত করতে দমনাভিযান পরিচালিত হয়েছিল। কিন্তু গত ২৪ আগস্ট থেকে শুরু হওয়া ইতিহাসের এই বর্বরতম নির্মূল অভিযানের মুখে রোহিঙ্গাদের আরাকানে ‘বেঁচে থাকা’ এবং ‘টিকে থাকা’র সম্ভাবনা যেন ফুরিয়ে আসছে। এই আশঙ্কা ব্যক্ত করেছেন কোনোমতে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গারা এবং মানবাধিকার কর্মীরা।
সুচির দম্ভোক্তি : ‘রক্ষা করছি’!
রোহিঙ্গা নিধন-নিপীড়নের প্রেক্ষাপটে মিয়ানমারের নেত্রী অং সান সুচির বিরুদ্ধে সারাবিশ্বে যখন নিন্দা-ঘৃণা-ধিক্কারের ঝড় বয়ে যাচ্ছে এবং তার নোবেল পুরস্কার কেড়ে নেয়ার দাবিতে সোচ্চার হয়েছে বিবেকবান মানুষ তখন দেশটির স্টেট কাউন্সিলর ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী সেই সুচিই বলছেন উদ্ভট কথাবার্তা! তার দম্ভোক্তি হলো, ‘সরকার রাখাইন রাজ্যের প্রত্যেককে রক্ষা করছে। আর সস্ত্রাসীদের পক্ষ নিয়ে মিডিয়া অপপ্রচার করছে’! গত মঙ্গলবার তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রজব তাইয়্যেব এরদোগান মিয়ানমারে নিরীহ রোহিঙ্গাদের উপর পরিচালিত গণহত্যা, নির্যাতন ও বিতাড়ন বন্ধের জন্য অং সান সুচিকে টেলিফোন করেন। এ সময় কী কথা হয়েছিল তা জানাতে গিয়ে গতকাল (বুধবার) এবারই প্রথম মুখের কুলুপ খুললেন গণতন্ত্রের খলনায়িকা অং সান সুচি। সুচির বরাত দিয়ে তার অফিস থেকে মিডিয়াকে জানানো হয়, ‘রাখাইন রাজ্যেও সবাইকে বাঁচাতে সরকার সর্বোচ্চ চেষ্টা শুরু করেছে। মানবাধিকার ও গণতান্ত্রিক সুরক্ষা থেকে বঞ্চিত হওয়ার মানে কী আমরা তা ভালোভাবে বুঝি। তাই আমার দেশের প্রত্যেকটি নাগরিকের মানবাধিকারের বিষয়টি নিশ্চিত করতে কাজ করে যাবো’। সুচির বিবৃতিতে মিডিয়াকে ঝাড়া দিয়ে দাবি করা হয়েছে, ‘সন্ত্রাসীদের স্বার্থরক্ষা করতে প্রচুর ভুল তথ্য ছড়ানো হচ্ছে। সন্ত্রাসীদের উস্কে দিতে এবং বিভিন্ন স¤প্রদায়ের মধ্যে জাতিগত সমস্যা তৈরি করতে রোহিঙ্গা নির্যাতনের অনেক ভুল সংবাদ ও ছবি ছড়িয়ে দেয়া হচ্ছে!’
অবরুদ্ধ রেখেই ‘অভিযান’
মিয়ানমারের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলীয় রাজ্য আরাকানে (রাখাইন) হাজার বছর ধরে মুসলমান আরাকানি আদিবাসী রোহিঙ্গাদের (রো-আং) বসবাস। দীর্ঘ ৩৮ বছরের মধ্যে বিভিন্ন সময়ে পরিচালিত রোহিঙ্গারা নিধন ও বিতাড়ন অভিযানের শিকার। তারা বাংলাদেশ ছাড়াও এ যাবত পৃথিবীর প্রায় ৩০টি দেশে পালিয়ে আশ্রয় খুঁজছে। জাতিসংঘের অফিসিয়াল তথ্য মতে, রোহিঙ্গারা সারাবিশ্বের মধ্যে বর্তমানে সর্বাপেক্ষা ভাগ্যাহত জনগোষ্ঠী। যাদেরকে বলা হয় স্টেটলেস সিটিজেন অর্থাৎ ‘রাষ্ট্রবিহীন নাগরিক’। রাখাইন রাজ্যে শান্তি ফিরিয়ে আনতে রোহিঙ্গাদের অবাধে চলাচলের স্বাধীনতা ও নাগরিকত্ব নিশ্চিতের জোরালো তাগিদ দিয়ে সাবেক জাতিসংঘ মহাসচিব কফি আনানের নেতৃত্বাধীন কমিশনের (আনান কমিশন) ৮৮টি সুপারিশ সম্বলিত ৬৩ পৃষ্ঠার প্রতিবেদন গত ২৪ আগস্ট সকালে অং সান সুচিসহ মিয়ানমার সরকারের কাছে পেশ করা হয়। কফি আনান নিজেই সুচিকে এই সুপারিশমালা দ্রুত বাস্তবায়ন সবার জন্য মঙ্গলজনক হবে বলেই স্মরণ করিয়ে দেন। আর দিনটি শেষ হতে না হতেই সেই ভয়াল রাতে রোহিঙ্গাদের উপর চরম বর্বর গণহত্যা, জুলুম, নিপীড়ন আরো ব্যাপকমাত্রায় শুরু হয়ে যায়। তবে এর আগে ১১ আগস্ট থেকে মুসলমানদের পাড়াগুলো সেনাবাহিনী অবরুদ্ধ করে রেখে টহল অভিযান শুরু করে, যা মূল অপারেশনের আগে ড্রেস রিহার্সেল। গত দুই সপ্তাহ যাবত চলমান এ ভয়ঙ্কর সেনাবাহিনীর দমনাভিযান, সেই সাথে বিজিপি, পুলিশ, গোয়েন্দা এবং মগ সন্ত্রাসী বাহিনীর নির্মম অত্যাচার থেকে নারী শিশুসহ কেউই রেহাই পাচ্ছে না। প্রতিদিনই চলছে হরেক বর্বরোচিত কায়দায় গণহত্যা ও নিপীড়নের স্টিমরোলার। বর্মী সরকারের এহেন হিংস্র অভিযানের আসল লক্ষ্য-উদ্দেশ্য হলো, রোহিঙ্গা মুসলমানদের মাতৃভ‚তি থেকে বিতাড়িত করে সেখানে চিরতরে একচ্ছত্র মগের মুল্লুক কায়েম করা। আর সেদিকেই এগিয়ে যাচ্ছে মিয়ানমার শাসকগোষ্ঠী।
বাড়ছে রোহিঙ্গার ঢল : সক্রিয় দালালচক্র
টেকনাফ উপজেলার প্রধান সড়ক ও ও উপকূলে রোহিঙ্গার ঢল নেমেছে। স্থানীয় দালালের মাধ্যমে প্রাণ বাঁচতে তারা বাংলাদেশে এসেছেন। মানব পাচারকারী দালাল সিন্ডিকেট ফের সক্রিয় হয়ে উঠেছে। প্রশাসন ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে ৪৪ জন দালালকে বিভিন্ন মেয়াদে সাজা দেয়া হয়েছে। দেখলে যে কারো মনে হবে যেন টেকনাফ সীমান্ত খুলে দেয়া হয়েছে। ঈদের আগে ও পরে একাধিক নৌকাডুবির ঘটনার পর অনুপ্রবেশকারী রোহিঙ্গারা সতর্ক হলেও বর্তমানে টেকনাফের প্রধান সড়ক ও উপকূলে রোহিঙ্গার ঢল নেমেছে। সেন্টমার্টিনদ্বীপসহ পুরো উপজেলা জুড়ে দলে দলে রাত-দিন বিরামহীনভাবে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ করছে। গত ১১ দিনে বেসরকারি জরিপে প্রায় দুই লাখের কাছাকাছি রোহিঙ্গা টেকনাফের নাফ নদী ও সমুদ্র উপক‚লীয় এলাকায় অনুপ্রবেশ করেছে। ঢুকে পড়া এসব রোহিঙ্গারা সর্বত্রই গন্তব্যহীনভাবে এদিক-সেদিক ছুটাছুটি করছে।
এর মধ্যে টেকনাফের হোয়াইক্যং ইউনিয়নের রইক্ষ্যং এলাকায় পাহাড়ি ভ‚মি দখল করে অন্তত ৩৫ হাজার রোহিঙ্গা আশ্রয় নিয়েছে। নয়াপাড়া, মোছনী, লেদা, সাবরাং, শাহপরীর দ্বীপ, শামলাপুর এলাকায় আশ্রয় নিয়েছে অন্তত এক লাখ রোহিঙ্গা। এ ছাড়া টেকনাফের বিভিন্ন আত্মীয়স্বজনের বাড়িতে রয়েছে আরো ৫০ হাজারের বেশি রোহিঙ্গা।
টেকনাফ সদর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান শাহজাহান জানিয়েছেন, সোমবার রাত ও বুধবার সকালে সমুদ্র উপক‚ল পয়েন্ট দিয়ে টেকনাফে ঢুকে পড়া রোহিঙ্গার সংখ্যা অন্তত ৮০ হাজার হতে পারে বলে তিনি অনুমান করছেন।
স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, টেকনাফের উপক‚লে কয়েক হাজার নৌকা সাগরে ও নদীতে মাছ শিকারে নিয়োজিত রয়েছে। বর্তমানে এসব নৌকা ব্যবহার হচ্ছে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ কাজে। সংশ্লিষ্ট এলাকা থেকে প্রাপ্ত নির্ভরযোগ্য তথ্যে জানা গেছে, টেকনাফ উপজেলার সেন্টমার্টিন দ্বীপ, শাহপরীর দ্বীপ, শাপলাপুর, বড়ডেইল, মাথাভাঙ্গা, মারিশবনিয়া, শীলখালী, মহেশখালীয়া পাড়া, বাহারছড়া, হাদুরছড়া, কাটাবনিয়া, খুরেরমুখ, লম্বরী, মিঠাপানিরছড়া, জাহাজপুরা, উখিয়া উপজেলার ছেপটখালী, মনখালী ঘাটে এখন কোন নৌকা নেই। সব নৌকা দালালের সাথে আঁতাত করে রোহিঙ্গা আনার জন্য মিয়ানমার যাতায়াত করছে। দালালরা নাকি জনপ্রতি ভাড়া নিচ্ছে ১০ থেকে ১২ হাজার টাকা করে। টাকা দিতে ব্যর্থ হলে স্বর্ণালঙ্কার কেড়ে নিচ্ছে। দিনের বেলায়ও বাহারছড়া শামলাপুর সৈকতে সরাসরি রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ অব্যাহত ছিল।
অভিযোগে জানা যায়, শাহপরীর দ্বীপে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশে নেতৃত্ব দিচ্ছে শাহপরীর দ্বীপ জালিয়াপাড়ার শামসুল ইসলাম হাসু, নুরুল আলম, আবু তাহের, আকবর, মিস্ত্রীপাড়ার লম্বা সলিম, শরীফ হোছন, নাজির হোছন, মো: হোছন, এনায়তুল্লাহ, নুর হোছন এবং ঘুলাপাড়ার কবিরা। এরা সবাই চিহ্নিত ও তালিকাভুক্ত দালাল। এসব সিন্ডিকেটে আরো কয়েকজন দালাল রয়েছে। এদের নেতৃত্বে শত শত বোট মিয়ানমারে গিয়ে হাজার হাজার রোহিঙ্গা বাংলাদেশের টেকনাফে অনুপ্রবেশ ঘটিয়েছে। এরা জনপ্রতি এক থেকে দুই লাখ কায়াত (মিয়ানমার মুদ্রা) নেয়ার পরও বাংলাদেশের শাহপরীর দ্বীপ উপক‚লে তীরে ভিড়ার আগে বোটের উপর স্বর্ণালঙ্কার ও টাকা কেড়ে নিতে ধস্তাধস্তির কারণে বোট ডুবির মতো জঘন্যতম ঘটনা ঘটেছে বলে শোনা যাচ্ছে। এদের দেখাদেখি আরো কিছু নতুন দালাল সিন্ডিকেট সৃষ্টি হচ্ছে। তার মধ্যে শাহপরীর দ্বীপ জালিয়াপাড়ার শামসুল আলম হাসু, মিস্ত্রীপাড়ার লম্বা সলিম ও শরীফ হোছন এবং ঘুলাপাড়ার কবিরা বিগত কয়েক যুগ ধরে এপার-ওপার ব্যবসা করার দীর্ঘ অভিজ্ঞতায় মানব পাচারে পারদর্শী হয়ে উঠেছে বলে এলাকায় জনশ্রæতি রয়েছে। এভাবে শুধু শাহপরীর দ্বীপ নয়, সাবরাং, বাহারছড়াসহ বিভিন্ন এলাকায় দালাল সিন্ডিকেট সক্রিয় রয়েছে।
এদিকে, গতকাল টেকনাফ মডেল থানা পুলিশ, বিজিবি ও কোস্টগার্ড জওয়ানেরা পৃথক অভিযান চালিয়ে টেকনাফ সদর ইউনিয়নের ১৫ দালালকে আটক করে ভ্রাম্যমাণ আদালতে বিভিন্ন মেয়াদে সাজা প্রদান করেছে।
রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশে বাধা : ট্রলার ডুবে নিখোঁজ তিন শতাধিক
টেকনাফ সীমান্তে তিন হাজার ১২৯ রোহিঙ্গাকে অনুপ্রবেশকালে প্রতিহত করেছে বিজিবি ও কোস্টগার্ড। গতকাল সকালে সীমান্তের বিভিন্ন পয়েন্ট দিয়ে রোহিঙ্গারা অনুপ্রবেশের চেষ্টা করলে তাদের প্রতিহত করা হয়। তার মধ্যে বিজিবি দুই হাজার ৬৪৯ জন ও কোস্টগার্ড ৩৭০ জনকে প্রতিহত করে। বিজিবি টেকনাফের সিও লে: কর্নেল আরিফুল ইসলাম জানান, রোহিঙ্গা পুশব্যাক করলেও তাদের প্রতি মানবিক আচরণ দেখাচ্ছে বিজিবি।
অন্যদিকে, টেকনাফ উপজেলার বিভিন্ন সীমান্তে বিজিবি ও কোস্টগার্ড সদস্যরা রোহিঙ্গাবোঝাই ১২ ট্রলার আটকের পর মিয়ানমারে ফেরত পাঠায়। এসব ট্রলার ফের বাংলাদেশ সীমান্তে প্রবেশের চেষ্টাকালে ডুবে যায় বলে জানিয়েছে প্রাণে বেঁচে যাওয়া রোহিঙ্গারা। এসময় তাদের ট্রলারে থাকা তিন শতাধিক রোহিঙ্গা নিখোঁজ ও ১০ জনের লাশ উদ্ধার করা হয়েছে।
সীমান্তে মিয়ানমারের স্থলমাইন : রয়টার্সের বিশেষ প্রতিবেদন
সা¤প্রতিক সেনাদের নির্যাতন-নিপীড়নের হাত থেকে রেহাই পেতে দুই সপ্তাহে লক্ষাধিক রোহিঙ্গা বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। তারা যেন আর মিয়ানমারে ফিরতে না পারে, সেই উদ্দেশ্যেই মাইন পুঁতে রাখা হচ্ছে বলে জানিয়েছে দুইটি সূত্র। মূলত স্থিরচিত্র ও গোপন সংবাদদাতা মাধ্যমে মিয়ানমারের এই ভূমিমাইন বসানোর বিষয়টি জানা গেছে বলে রয়টার্সকে জানিয়েছেন তারা। যে গ্রুপগুলো ভূমিমাইন পুঁতে রেখেছিল তাদের গায়ে কোনো ইউনিফর্ম ছিল কি না তা নিশ্চিত করেনি সূত্রগুলো। একটি সূত্র বলেছে, ‘তারা নিজেদের সীমান্তে কাঁটাতারের বেড়ার কাছ ঘেঁষে ভূমিমাইন বসাচ্ছে। আমাদের সেনারাও কাঁটাতারের বেড়ার কাছ ঘেঁষে তিন থেকে চারটি গ্রুপকে কাজ করতে দেখেছে। তারা মাটিতে কিছু একটু পুঁতে রাখছিল। পরে আমাদের গোপন সংবাদদাতারা নিশ্চিত করেছে তারা ভূমিমাইন পুঁতে রেখেছে।’ তবে তারা নিশ্চিত যে, এরা রোহিঙ্গা বিদ্রোহী ছিল না। এদিকে বাংলাদেশের একজন কূটনীতিক নাম প্রকাশ না করার শর্তে বিবিসিকে জানিয়েছেন, সীমান্তে মাইন পেতে রাখার এবং এসব মাইনে বাংলাদেশে পলায়নরত রোহিঙ্গা শরণার্থীদের হতাহত হওয়ার কিছু কিছু খবর তারাও পাচ্ছেন।
সঙ্কট সমাধানে ইন্দোনেশিয়ার ‘ফর্মুলা ফোর প্লাস ওয়ান’ প্রস্তাব
রাখাইনে শান্তি-শৃঙ্খলা পুনঃস্থাপন ও শিগগিরই মানবিক সহায়তা সরবরাহের অনুমতি দিতে মিয়ানমারকে চার শর্তযুক্ত ‘ফর্মুলা ফোর প্লাস ওয়ান’ নামের একটি প্রস্তাব দিয়েছে ইন্দোনেশিয়া। গত সোমবার মিয়ানমারের রাজধানী নেইপিদোতে দেশটির রাষ্ট্রীয় উপদেষ্টা অং সান সুচির সঙ্গে সাক্ষাতের সময় এ প্রস্তাব দেন ইন্দোনেশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী রেন্টো মারসুদি। রোহিঙ্গা সঙ্কট সমাধানে জাকার্তার এই চার প্রস্তাব হলো :
এক. রাখাইনের স্থিতিশীলতা এবং নিরাপত্তা ফিরিয়ে আনা। দুই. সর্বোচ্চ সংযম ও অসহিষ্ণুতা প্রদর্শন তিন. জাতি ধর্মনির্বিশেষে রাখাইনের সব মানুষের সুরক্ষা। চার. অবিলম্বে মানবিক সহায়তার প্রবেশাধিকারের ওপর গুরুত্বারোপ। ইন্দোনেশিয়ার এই চার প্রস্তাবের ব্যাখ্যা দিয়ে মারসুদি বলেন, প্রথম চারটি শর্ত হচ্ছে প্রধান বিষয়, যা শিগগিরই বাস্তবায়ন করতে হবে; যাতে মানবিক সঙ্কট এবং নিরাপত্তা পরিস্থিতি খারাপ হতে না পারে।
এ ছাড়া জাতিসংঘের সাবেক মহাসচিব কফি আনানের নেতৃত্বে রাখাইনে সহিংসতার ঘটনায় জাতিসংঘের স্পেশাল অ্যাডভাইজরি কমিশনের প্রতিবেদনের সুপারিশ অবিলম্বে বাস্তবায়নের পরামর্শ দেয়া হয়েছে ইন্দোনেশিয়ার এই প্রস্তাবে।
রোহিঙ্গা নির্যাতন বৌদ্ধ নেতাদের উদ্বেগ
মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে রোহিঙ্গারা জনগোষ্ঠীর উপর নির্মম নির্যাতন ও নিষ্ঠুরতার ঘটনায় বাংলাদেশের বৌদ্ধ সংগঠনের নেতারা গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করে এ ব্যাপারে জাতিসংঘের হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন। গতকাল (বুধবার) এক বিবৃতিতে তারা বলেন, রাখাইন রাজ্যে নিষ্ঠুরতার শিকার রোহিঙ্গারা তাদের বাসস্থান ছেড়ে পালাতে বাধ্য হচ্ছে। অনেকে অস্বাভাবিক মৃত্যুর সম্মুখীন হচ্ছে। নিরাপরাধ শিশু, মহিলা এবং নিরীহ মানুষের জীবন অনিশ্চিত অবস্থায় পতিত হচ্ছে। আমরা রোহিঙ্গাদের উপর এহেন নারকীয় হত্যা, বর্বর ও নির্মম আচারণের তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানাচ্ছি। বিবৃতিতে স্বাক্ষরকারী বৌদ্ধ নেতৃবৃন্দ হলেন- বাংলাদেশ বৌদ্ধ সমিতির চেয়ারম্যান অজিত রঞ্জন বড়ুয়া, মহাসচিব সুদীপ বড়ুয়া, বাংলাদেশ বৌদ্ধ কৃষ্টি প্রচার সংঘের যুগ্ম মহাসচিব প্রফেসর ড. বিকিরণ প্রসাদ বড়–য়া, বাংলাদেশ সংঘরাজ ভিক্ষু মহাসভার সভাপতি অজিতানন্দ মহাথের, মহাসচিব এস. লোকজিত থের, বাংলাদেশ বৌদ্ধ ভিক্ষু মহাসভার সভাপতি সুনন্দপ্রিয় মহাথের, মহাসচিব বোধিমিত্র মহাথের প্রমুখ।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।