Inqilab Logo

রোববার, ২৮ এপ্রিল ২০২৪, ১৫ বৈশাখ ১৪৩১, ১৮ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

মিরপুরে জঙ্গি আস্তানায় শিশু ও মহিলাসহ ৭ দগ্ধ লাশ

স্টাফ রিপোর্টার | প্রকাশের সময় : ৭ সেপ্টেম্বর, ২০১৭, ১২:০০ এএম

রাজধানীর মিরপুরের জঙ্গি আস্তানায় ৭টি লাশ পাওয়া গেছে। গতকাল বুধবার বিকেলে এক সংবাদ সম্মেলনে এ কথা জানিয়েছেন র‌্যাব মহাপরিচালক বেনজীর আহমদ। পরে বিকালে জঙ্গি আস্তানা থেকে পুড়ে কয়লা হয়ে যাওয়া সাতটি লাশ উদ্ধার করে ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালের মর্গে পাঠায় র‌্যাব।
র‌্যাবের লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক কমান্ডার মুফতি মাহমুদ খান বলেন, দগ্ধ সাতটি মরদেহ ঘটনাস্থল থেকে উদ্ধার করে বিকেল সাড়ে ৪টার দিকে ঢামেক মর্গে পাঠানো হয়েছে।
তিনি বলেন, পঞ্চম তলার যে রুমটি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে সেখানে কিছুই পোড়ার বাকি নেই। পাশের একটি রুমে তল্লাশি চালিয়ে কার্টনে মোড়ানো ৯-১০টি অবিস্ফোরিত ইম্প্রোভাইজড এক্সপ্লোসিভ ডিভাইস (আইইডি) পাওয়া গেছে। ভবনে কাইকে প্রবেশ করতে দেয়া হচ্ছে না।
র‌্যাবের ডিজি আরো বলেন, নিহতরা হলো- জঙ্গি আব্দুল্লাহ, তার দুই স্ত্রী, দুই সন্তান ও দুই কর্মচারী। আব্দুল্লাহ জঙ্গিদের আশ্রয়দাতা হিসেবে কাজ করত। ২০০৫ সাল থেকে সে জঙ্গি কর্মকান্ডের সঙ্গে জড়িত। গতকাল সকালে ওই বাড়িতে র‌্যাব তল্লাশি চালিয়ে ৫ তলার তিনটি রুমে লাশগুলো দেখতে পায়। ডিজি আরো বলেন, এগুলো জঙ্গি আবদুল্লাহ, তার দুই স্ত্রী, দুই সন্তান ও দুই সহযোগীর। তবে লাশগুলো এমনভাবে পুড়েছে যে কোনটা কার লাশ তা শনাক্ত করা যায়নি। পরে ডিনএনএ পরীক্ষা করে পরিচয় জানানো হবে।
তিনি বলেন, মঙ্গলবার রাতে পঞ্চম তলায় বিস্ফোরণের পর ২/২ ফুট গর্ত হয়ে আগুন চার তলায় ছড়িয়ে পড়ে। ওই ভবনটি এখন ঝুঁকিপূর্ণ। চার তলা পর্যন্ত পরিষ্কার করা হয়েছে। পাঁচতলার তাপমাত্রা এখন অনেক বেশি। ৫০-৫৫ ডিগ্রি তাপমাত্র রয়েছে সেখানে। বেশিক্ষণ সেখানে থেকে কাজ করা সম্ভব হচ্ছে না। তাই পুরো পঞ্চম তলা পরিষ্কার করতে বেশ কয়েকদিন সময় লাগবে। সেখানে থাকা সব বিস্ফোরকের বিস্ফোরণ হয়েছে।
র‌্যাবের ডিজি বলেন, ২০০৫ সালে জেএমবির সঙ্গে যুক্ত হয় জঙ্গি আবদুল্লাহ। ২০১৩ সালে তিনি নব্য জেএমবির সঙ্গে যুক্ত হয়। তার বাসায় জঙ্গিদের আশ্রয় দেওয়া হতো। এছাড়া তিনি জঙ্গিদের অর্থের যোগান দিয়েছে। ওই বাসায় সরোয়ার জাহান, তামিম চৌধুরীর যাতায়াত ছিল। সরোয়ার-তামিম গ্রুপের একজন শুরা সদস্য কারাগারে বন্দি আছে। তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করে এই আবদুল্লাহর নাম জানতে পেরেছিল র‌্যাব। বছর খানেক ধরেই তারা আবদুল্লাহকে খুঁজছিল বলে জানান ডিজি। তবে অবশেষে তাকে খুঁজে পাওয়া যায়। ফলে বড় ধরনের বিপর্যয় থেকে দেশ ও জাতিকে বাঁচানো সম্ভব হলো। তার বাসায় যে পরিমাণ বিস্ফোরক ছিল তা দিয়ে বড় ধরেন নাশকতা চালানো সম্ভব হতো।
র‌্যাবের ফরেনসিক টিমের একজন সদস্য বলেন, পঞ্চম তলার ফ্ল্যাটের তিন রুমে মৃতদেহগুলো ছড়ানো ছিটানো ছিল। এর আগে সকাল থেকে জঙ্গি আস্তাানায় দ্বিতীয় দিনের অভিযান শুরু করে র‌্যাব।
র‌্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার মুফতি মাহমুদ খান এর আগে বেলা পৌনে একটায় সংবাদ সম্মেলনে জানিয়েছিলেন ৩টি দগ্ধ লাশ পাওয়া গেছে ওই ভবনে।
মুফতি মাহমুদ খান বলেন, ভবনটির পঞ্চম তলার একটি কক্ষে তিনটি লাশের সন্ধান পাওয়া গেছে। তবে লাশগুলো দগ্ধ হওয়ায় পরিচয় নিশ্চিত করা সম্ভব হচ্ছে না। তিনি বলেন, ‘মনে হচ্ছে গত রাতের বিস্ফোরণে তারা মারা গেছে। আমাদের অভিযান চলছে।
এর আগে দুপুর পৌনে ১২টার দিকে গুলির শব্দ পাওয়া যায়। সকালে ওই ভবনে তল্লাশি শুরু করে বোমা নিষ্ক্রিয়কারী দল, র‌্যাব ও ফায়ার সার্ভিসের সদস্যরা। বাড়িটি এখনো আইন শৃংখলা বাহিনীর সদস্যরা ঘিরে রেখেছে। তবে ভবনের ভিতরে কোন সংবাদ কর্মীকে প্রবেশ করতে দেয়া হয়নি। ওই আস্তাানার আশপাশে কড়া অবস্থানে রয়েছে র‌্যাব। গাবতলীর দিক থেকে ওই এলাকায় যাওয়ার পথ বন্ধ রয়েছে।
গতকাল সকালে পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) এ কে এম শহীদুল হক ও র‌্যাবের মহাপরিচালক বেনজীর আহমেদ ওই এলাকা পরিদর্শন করেন।
র‌্যাব-৪-এর সহকারী পুলিশ সুপার আবদুল আউয়াল জানান, জঙ্গি আবদুল্লাহর গ্রামের বাড়ি চুয়াডাঙ্গায়। তার বাবা ইউসুফ আলী অনেক আগেই মারা গেছেন। ওই আস্তানায় আবদুল্লাহর সঙ্গে তার দুই স্ত্রী ফাতেমা ও নাসরিন ছিলেন। ছিল দুই শিশু ওসামা ও ওমর। সঙ্গে আবদুল্লাহর দুই সহযোগীও ছিলেন। তিনি জানান, আবদুল্লাহর চুয়াডাঙ্গার বাড়ি থেকে তার বোন মেহেরুন্নেসা মেরিনাকে আটক করে র‌্যাব হেফাজতে নেওয়া হয়েছে।
জঙ্গি আস্তাানাটি ঘিরে রাখার প্রায় ২৪ ঘণ্টার মাথায় গত মঙ্গলবার দিবাগত রাত পৌনে ১০টার দিকে বাড়িটিতে পরপর তিনটি বড় ধরনের বিস্ফোরণ হয়। বাড়ি থেকে আগুন ও ধোঁয়ার কুন্ড লী বের হয়। বিস্ফোরণের পরে র‌্যাবের কর্মকর্তারা বলেন, বাড়ির ভেতরে থাকা জঙ্গিরা নিজেরা বিস্ফোরণ ঘটিয়ে আত্মঘাতী হয়েছেন। গত সোমবার রাত ১১টার দিকে মিরপুর মাজার রোডের বর্ধনবাড়ি এলাকার ‘কমল প্রভা’ নামের বাড়িটি ঘেরাও করে র‌্যাব। বাড়ির পাঁচতলার একটি ফ্ল্যাটে জঙ্গিদের অবস্থান র‌্যাব চিহ্নিত করে। পরে বাড়ির বিদ্যুৎ, গ্যাস ও পানির সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা হয়। এক প্রবাসীর মালিকানাধীন ছয়তলা বাড়িটির ২৪টি ফ্ল্যাটের মধ্যে ২৩টি ফ্ল্যাটের ৬৫ জন বাসিন্দাকে সোমবার রাতেই সরিয়ে নেয় র‌্যাব।
আশপাশের সাধারণ মানুষ বলছেন ভিন্ন কথা
এদিকে র‌্যাব বলছে, আব্দুল্লাহ ২০০৫ সাল থেকে জঙ্গিবাদের সাথে জড়িত। সে ফ্রিজ মেরামত ও আইপিএস তৈরির পেশার আড়ালে বিপুল পরিমাণে বিস্ফোরকের মজুদ গড়ে তুলেছিল। কিন্তু ওই এলাকার অন্যান্য বাসিন্দাদের সাথে কথাবার্তা বলে পাওয়া যাচ্ছে ভিন্ন বক্তব্য। তারা বলছেন, জঙ্গিরা সাধারণত বাড়ি ভাড়া নেয়ার পর আশপাশের লোকজনের সাথে মেলামেশা করে না। বাড়ি থেকে বেরও হয় না। কিন্ত আবদুল্লাহ ছিল ভিন্ন ধরনের। সে সবার সাথেই যোগাযোগ রাখত। সে কবুতর লালন পালন করত এবং আইপিএস এর ব্যবসা করত, মেরামত করতে। এই সুবাদে এলাকাবাসীর সাথে তার খুবই সুসম্পর্ক ছিল। সে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ দোয়া পড়ত। জঙ্গিবাদে জড়িত হয়েছে এমনটি এলাকার মানুষ জানত না।
‘কমল প্রভা’ বাড়িটির পাশের বাড়ির একজন জানান, র‌্যাব বাড়িটিতে তাদের চূড়ান্ত অভিযান শুরু করার আগেই বাড়িটির অন্যান্য ফ্ল্যাট এবং আশপাশের বাড়িগুলো ফাঁকা করে ফেলে। ‘কমল প্রভা’ নামের ওই বাড়িটির ঠিক পিছনের বাড়িতেই সপরিবারে থাকেন ব্যবসায়ী বজলুর রহমান এবং মামুন। তারা জানান, অভিযানের আগেই র‌্যাব ওই বাড়ির আশপাশের লোকজনকে সরিয়ে নেয়। তারা ওই দিন খুব আতঙ্কের মধ্যে ছিল। মুহুমুর্হু গুলি আর বোমা বিস্ফোরণের শব্দে তারা কেঁপে কেঁপে উঠছিলেন বলে জানান মামুন এবং পাশের চা দোকানদার।
প্রতিবেশীরা জানান, আব্দুল্লাহরা দশ-বারো বছর ধরে ‘কমল প্রভা’ নামের ওই বাড়িতে আছেন। ব্যবসায়ী হিসেবে তাদেরকে এলাকার অনেকেই কমবেশি চিনতো। তারা বলেন, আবদুল্লাহ সবার সাথে মিশতেন। জঙ্গিদের সাথে তার যোগাযোগ থাকতে পারে এটা এলাকার মানুষ বিশ্বাস করতে পারছেন না।
ওই এলাকার একজন চা-দোকানের মালিক জানান, আব্দুল্লাহর বড় ভাই খোকার ছিল আইপিএস সরবরাহের ব্যবসা। এলাকার সবার সাথেই তার কম-বেশি যোগাযোগ ছিল। প্রায়ই দোকানে চা খেতে আসতো। তার পুরো নাম জানা সম্ভব হয়নি। সেই অভিযান চলাকালে বাড়িটিতে ছিল কিনা তাও জানা যায়নি। তার ছিল দীর্ঘ বাবরি চুল। ওই বাড়িটির পেছনের বাড়ির এক ব্যক্তি জানান, তার নিজের বাড়ির আইপিএসটিও খোকার কাছ থেকেই নিয়েছেন। তিনি জানান, আব্দুল্লাহর পেশা ছিল কবুতর বেচাকেনা। বাড়ির ভেতরেই সে বিরাট কবুতরের খামার গড়ে তুলেছিল। সে ছিল হালকা পাতলা গড়নের। তারা দুই ভাই-ই নামাজ পড়ত। দু’ভাইয়েরই দাড়ি ছিল। কিন্তু আব্দুল্লাহ যে জঙ্গিবাদের সাথে জড়িত তা ঘুণাক্ষরেও টের পাননি বলে জানাচ্ছেন পাশের বাড়ির ওই ব্যক্তি।
স্থানীয়রা জানান, এখন পর্যন্ত বিভিন্ন অভিযানে নিহত কিংবা ধৃত ‘জঙ্গিদের’ চরিত্র সম্পর্কে যা জানা যায়, বেশিরভাগই অন্তর্মুখী স্বভাবের। বাইরের মানুষের সাথে মেশার নজির কারোই খুব একটা নেই। কিন্তু আব্দুল্লাহ কিংবা তার ভাই খোকা এলাকাবাসীর সাথে নিয়মিতই কুশল বিনিময় করত পাশের চা দোকানে চাও খেত মাঝে মাঝে। তবে তাদেরকে রাজনৈতিক কোন আলাপে যোগ দিতে দেখা যায়নি কখনো।
‘কমল প্রভা’ বাড়িটির ভেতরের অবস্থা
রাজধানীর মিরপুরে জঙ্গি আস্তানার পাঁচতলা বিস্ফোরণ ও আগুনে ধ্বংসস্তুপে পরিণত হয়েছে। গতকাল বুধবার দুপুরে ওই বাড়ি পরিদর্শন করে এসে র‌্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার মুফতি মাহমুদ খান জানান, ছয়তলা ওই ভবনের পাঁচতলায় তিনটি রুমে থাকত জঙ্গি আবদুল্লাহ, তার স্ত্রী সন্তান ও তার সহযোগীরা। বিস্ফোরণ ও আগুনে তিনটি রুমের সব আসবাবপত্র পুড়ে গেছে। লাশগুলো পুড়ে একদম কঙ্কালের মতো হয়ে গেছে। তিনি আরও জানান, প্রচন্ড তাপ থাকায় অন্য দুটি রুমে বোম্ব ডিসপোজাল ইউনিটের সদস্যদের তল্লাশি করতে কিছুটা সমস্যা হচ্ছে। তল্লাশি চলবে, রাতে শেষ হতে পারে। তবে প্রয়োজন হলে আগামীকাল (বৃহস্পতিবার) সকালে আবার তল্লাশি করা হবে। মুফতি মাহমুদ খান জানান, পাঁচতলায় কিছু পোষা কবুতর ছিল। আগুনে অনেক কবুতর মারা গেলেও কিছু জীবিত উদ্ধার করা হয়েছে। তিনি আরও জানান, বর্তমানে ভবনে আগুন না থাকলেও ধোঁয়া দেখা যাচ্ছে। বিস্ফোরণ ও আগুনে ভবনটি ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে। তিনি জানান, রাতে স্থগিত রাখার পর বুধবার সকালে র‌্যাব ওই ভবনে ফের অভিযান শুরু করে। গতকাল সকাল ৮টা ৩৫ মিনিটে ফায়ারর সার্ভিসের উপ-পরিচালক দেবাশিস বর্ধন জানান, ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা ভবনে প্রবেশ করে উদ্ধার তৎপরতা শুরু করেছে।
রাজধানীর মিরপুরের বর্ধনবাড়ি এলাকার ওই আস্তানায় থাকা জঙ্গি আবদুল্লাহ র‌্যাবের আহ্বানে আত্মসমর্পণ করতে রাজি হয়েও শেষ পর্যন্ত মত পাল্টে ফেলে। শুধু তাই নয়, অভিযানের ঘেরাটোপে আটকে থাকা অবস্থায় মঙ্গলবার রাতে আস্তানার ভেতর থেকে পর পর চার দফায় ভারি বিস্ফোরণও ঘটায়। কেঁপে ওঠে পুরো এলাকা। থেমে থেমে শোনা যায় গুলির শব্দ। বিস্ফোরণে ছয়তলা বাড়িটির পঞ্চমতলায় আগুন ধরে যায়।



 

Show all comments
  • আজিজ ৭ সেপ্টেম্বর, ২০১৭, ১১:৩০ এএম says : 0
    হে আল্লাহ এই জঙ্গি অভিশাপ থেকে আমাদের দেশকে তুমি রক্ষা করো
    Total Reply(0) Reply
  • বাবুল ৭ সেপ্টেম্বর, ২০১৭, ৩:০৭ পিএম says : 0
    কবে যে আমাদের দেশ জঙ্গিমুক্ত হবে ?
    Total Reply(0) Reply

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: জঙ্গি


আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ