Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

ঈদুল আজহার সামাজিক-অর্থনৈতিক বাস্তবতা এবং আরাকানে বার্মিজ গণহত্যা প্রসঙ্গে

জামালউদ্দিন বারী | প্রকাশের সময় : ৬ সেপ্টেম্বর, ২০১৭, ১২:০০ এএম

আমাদের দেশে সামাজিক-অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে ঈদুল আজহা সত্যিকার অর্থেই আনন্দময় প্রাণচাঞ্চল্যে ভরপুর একটি ধর্মীয় উৎসব। গ্রামের যেসব ব্যক্তি ও সম্ভ্রান্ত পরিবার নানা কারণে শহরে বসবাস করেন, কিন্তু তাদের আত্মীয়-পরিজন বেশীরভাগই গ্রামে থাকেন, সেসব পরিবারও বছরের এই একটি সময়ে গ্রামে গিয়ে সামর্থ্য অনুসারে গরু কিনে কোরবানী দিয়ে থাকেন। আমাদের উচ্চ-মধ্যবিত্ত শ্রেণীর এই ধর্মীয় সংস্কৃতি আমাদের গ্রামীণ অর্থনীতি ও সমাজব্যবস্থাকে বিশেষভাবে প্রভাবিত করে চলেছে। যদিও দেশের বিভিন্ন স্থানে কোরবানীর পশুর গোশত ও চামড়ার বিলিবন্টনে কিছু পার্থক্য পরিলক্ষিত হয়। এ কথা নিশ্চিতভাবেই বলা যায় ঈদুল আজহায় বাংলাদেশে প্রায় এককোটি পশু কোরবানীর পেছনে অন্তত ৫০ হাজার কোটি টাকার লেনদেন হয়ে থাকে। এই লেনদেনে প্রথমত: দেশের গবাদিপশুর খামারি থেকে শুরু করে, গরু ব্যবসায়ী এবং কোটি কোটি দরিদ্র মানুষ উপকৃত হয়ে থাকে। অনেক দরিদ্র পরিবারের পক্ষে এখন ৫০০ টাকায় ১ কেজি গরুর গোশত কিনে খাওয়া সম্ভব হয়না বলে কোরবানীর ঈদই হচ্ছে তাদের জন্য গোশত খাওয়ার সবচে বড় উপলক্ষ্য। আর কোরবানীর পশুর চামড়ার টাকা পুরোটাই সমাজের দুস্থ-হতদরিদ্র, যেসব এতিম শিশুরা মাদরাসার লিল্লাহ বোর্ডিং-এ থেকে খেয়ে ধর্মীয় শিক্ষা গ্রহণের সুযোগ পায় তাদের জন্য ব্যয় হয়। কিন্তু গত বছরের ধারাবাহিকতায় এবারো কোরবানীর পশুর চামড়ার মূল্যে ধস নেমেছে। কয়েক বছর আগেও একেকটি গরুর চামড়া দু-তিন হাজার এবং ছাগলের চামড়া ৭-৮শ টাকায় বিক্রি হয়েছে। সেখানে এবার গরুর চামড়া বিক্রি হয়েছে গড়ে ৫-৬শ টাকায়। দেশের এক কোটি পশুর চামড়া থেকে অন্তত যে দু’হাজার কোটি টাকা সমাজের দুস্থ, এতিম শিশুদের ভরণ পোষন ও ধর্মীয় শিক্ষাখাতে ব্যয় করার সুযোগ ছিল তা এখন ৫শ কোটিতে নেমে এসেছে। কোরবানীর পশুর চামড়ার মূল্যের এই অবনমন গ্রামীণ অর্থনীতি ও সামাজিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে এটি বড় ধরনের ধস সৃষ্টি করবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। সেই সাথে দেশের রফতানীমুখী চামড়াশিল্প খাতও বড় ধরনের ঝুঁকির মধ্যে পড়তে চলেছে। দেশের টেনারীশিল্প নিয়ে এক ধরনের কারসাজি লক্ষ্য করা যাচ্ছে। একদিকে ভারত বাংলাদেশে গরু পাঠাতে কঠোর, অযৌক্তিক ও আগ্রাসী ব্যবস্থা কায়েম করছে, অন্যদিকে বাংলাদেশ থেকে গরুর চামড়া নিয়ে যেতে নানা ধরনের তৎপরতা চলছে। বেশীদামে কেনা গরুর চামড়ার মূল্য অস্বাভাবিক কমিয়ে দিয়ে দেশ থেকে চামড়া পাচারের বন্দোবস্ত আরো প্রশ্বস্ত করা হয়েছে। হাওরাঞ্চল এবং দেশের উত্তর পশ্চিমাঞ্চলের বন্যাকবলিত জেলাগুলোতে লাখ লাখ বানভাসি মানুষকে একটি অর্থনৈতিক-মানবিক বিপর্যয়ের মধ্যে এবার ঈদ উদযাপন করতে হয়েছে। সেখানে অনেক স্বচ্ছল গৃহস্থ পরিবারও আকষ্মিক বন্যায় খেতের উঠতি ফসল হারিয়ে কার্যত নি:স্ব হয়ে গেছে। তারা নিজেদের ভবিষ্যত নিয়ে উদ্বিগ্ন। বন্যা দুর্যোগের বিপর্যয় ছাপিয়ে ঈদের স্বাভাবিক আনন্দ সে সব এলাকায় অনেকটাই ¤øান ও বিবর্ণ ছিল।
গ্রামে গেলে চেনাজানা মানুষের কাছে সমসাময়িক রাজনীতি সম্পর্কে ও দেশের ভবিষ্যত সম্পর্কে কিছু প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয়। পেশাগত কারণেই আমাদেরকে এমন প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয়। তবে এখন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অনেক প্রশ্নের উদয় ও জবাব অনেকের কাছে আগের চাইতে সহজলভ্য হয়ে উঠেছে। আমাদের দেশে রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা, আগামী নির্বাচনের আগে রাজনৈতিক সমঝোতা, প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর নির্বাচনে অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে দেশের বিচ্চুত গণতন্ত্রের পুর্নযাত্রা নিশ্চিত করা অনেক বেশী গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলেও সে সব অতীব গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু ছাপিয়ে সাম্প্রতিক সময়ে উচ্চ আদালত থেকে সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের রায় নিয়ে বিচারবিভাগ ও সরকারের মধ্যকার কথিত দ্ব›দ্বই যেন মূখ্য আলোচ্য বিষয়ে পরিণত হয়েছে। তবে এ সবকিছু ছাপিয়ে এবারের ঈদে বেশীরভাগ মানুষের জিজ্ঞাস্য, আলোচ্য ও উদ্বেগের বিষয় হয়ে উঠেছে আরাকানের রোহিঙ্গা মুসলমানদের গণহত্যা ও বাংলাদেশ সরকারের ভ’মিকার বিষয়টি। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া(ভাইরাল) রোহিঙ্গাদের উপর মিয়ানমার বাহিনীর ইতিহাসের বর্বরতম নৃসংশতার চিত্র ও ভিডিওগুলো আমাদের সমাজকেও একধরনের ট্রমাটিক সিনড্রোমে আক্রান্ত করছে। অনেকের মুখেই সেই বিভৎস্য দৃশ্যাবলীর প্রতিক্রিয়া দেখেছি। দেশে-বিদেশে অবস্থানরত অনেক মানুষকেই ঈদের শুভেচ্ছা বিনিময়, ক্যাম্পেইন এবং পিটিশনের বিষয় হিসেবে রোহিঙ্গা গণহত্যা ও তাদের অধিকারের স্বপক্ষে জনমত গড়ে তোলার নানা উদ্যোগ এখনো আরো জোরদার হতে দেখা যাচ্ছে। বিশেষত: আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের মানবিক আবেদন উপেক্ষা করে মিয়ানমার সরকারের পৈশাচিক নির্মম অবস্থানের বিপরীতে একদিকে যেমন মিয়ানমারের তথাকথিত গণতন্ত্রপন্থী নেতা অং সান সুচিকে হিটলারের চেয়ে রক্তপিপাসু সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাসবাদি হিসেবে তুলে ধরা হচ্ছে, অন্যদিকে রোহিঙ্গা প্রশ্নে বাংলাদেশ সরকার কূটনৈতিক ব্যর্থতা এবং কথিত আরাকান রোহিঙ্গা সালভেশন আর্মির তৎপরতা বন্ধে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে মিয়ানমারকে যৌথ সামরিক অভিযান পরিচালনার অযৌক্তিক প্রস্তাব ইত্যাদি দেশের মানুষ স্বাভাবিকভাবে মেনে নিতে পারছেনা। যেখানে প্রায় শত বছর ধরেই আরাকানের রোহিঙ্গা মুসলমানরা বার্মিজদের হাতে নির্যাতন ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের শিকার হচ্ছে। সেখানে রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্বের অধিকারের প্রশ্নে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের দাবীগুলো উপেক্ষা এবং বার্মিজদের সাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের পরিবর্তন না করেই শুধুমাত্র সামরিকভাবে মোকাবেলার অবিমৃশ্যকারি ভ’মিকার সাথে বাংলাদেশ সরকারের সম্পৃক্ত হওয়ার আত্মঘাতি প্রস্তাব দেশের মানুষ মেনে নিতে পারছেনা। বিশেষত কোফি আনানের নেতৃত্বে গঠিত জাতিসংঘের তদন্ত কমিশনের ১২ দফা দাবী ও সুপারিশগুলোর বাইরে যাওয়ার বাংলাদেশের কোন সুযোগ নেই। আনান কমিশনের রিপোর্টে কোন অতিরঞ্জন বা পক্ষপাতিত্ব নেই। আনান কমিশন আরাকানে মানবিক সহায়তা প্রদানকারি, মানবাধিকার সংগঠন এবং দেশি-বিদেশি মিডিয়াকর্মীদের প্রবেশাধিকার নিশ্চিত করার দাবী জানিয়েছে। আনান কমিশনের প্রায় ১৫ পৃষ্ঠার অন্তবর্তিকালীন রিপোর্টের বার দফা দাবীর চতুর্থ দফার শিরোনাম, বর্ডার ইস্যুজ অ্যান্ড দি বাইলেটারেল রিলেশনশিপ উইথ বাংলাদেশ’। বাংলাদেশের সাথে সীমান্ত সমস্যা এবং বাংলাদেশে অবস্থানরত রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিতে ও পুর্নবাসনের ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক মান ও দ্বিপাক্ষিক ভেরিফিকেশনের উদ্যোগ গ্রহনের কথা বলা হয়েছে। সেই সাথে মানব পাচার এবং মাদক পাচারের মত ইস্যুগুলোতেও বাংলাদেশের সাথে দ্বিপাক্ষিক উদ্যোগের কথা বলা হয়েছে। জাতিসংঘের উদ্যোগে ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে গ্রহণযোগ্য ব্যক্তিদের সমন্বয়ে গঠিত তদন্ত কমিশনের এই রিপোর্ট রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধাণে একটি গুরুত্বপূর্ণ রোডম্যাপ হিসেবে বিবেচিত হতে পারে। মিয়ানমার সরকার শুরু থেকেই আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের উদ্যোগকে গ্রাহ্য করছেনা। তারা রোহিঙ্গাদের উপর নির্যাতন গণহত্যার মাত্রা বাড়িয়ে দিয়েছে। শত বছর ধরে চলা একপাক্ষিক নির্যাতন ও নির্মূলের কার্যক্রমকে সাম্প্রতিক সময়ে সৃষ্ট আরাকান রোহিঙ্গা সালভেশন আর্মির সীমান্ত হামলার ঘটনা দিয়ে জাস্টিফাই করার চেষ্টা করছে বার্মিজরা। সেখানে বাংলাদেশও যদি তাদের সাথে সুর মিলায় তা’ সারা বিশ্বের কাছে বিষ্ময়কর হয়ে দাড়ায়।
পশ্চিমে ও উত্তরে ভারত দ্বারা বেষ্টিত বাংলাদেশের পূর্ব-দক্ষিণে মিয়ানমারই হচ্ছে সবচে নিকটবর্তি প্রতিবেশি, যাদের সাথে আমাদের স্থল ও নৌ-সীমান্ত রয়েছে। বাংলাদেশের বিগত চারদলীয় জোট সরকারের ধারাবাহিকতায় মহাজোট সরকারও নীতিগতভাবে পূর্বমুখী পররাষ্ট্রনীতি ঘোষণা করে এশিয়ান হাইওয়ে এবং চীনের রোড ইনিশিয়েটিভের সাথে বাংলাদেশকে সংযুক্ত করে বাংলাদেশকে সড়কপথে এশিয়া ও ইউরোপের বিশাল বাজারের সাথে সরাসরি যুক্ত করার সম্ভাবনাময় পদক্ষেপের সাথে একাত্মতা ঘোষণা করেছিল। আন্তর্জাতিক আদালতের মাধ্যমে ইতিমধ্যে ভারতও মিয়ানমারের সাথে সমুদ্রসীমার অমীমাংসিত বিরোধের নিস্পত্তি হওয়ার পর বাংলাদেশের বিশেষ অর্থনৈতিক জোনের বøু ইকোনমিসহ বিশেষত মিয়ানমারের সাথে একটি নতুন সম্ভাবনাময় আঞ্চলিক, ভূরাজনৈতিক ও বাণিজ্যিক সম্পর্ক গড়ে ওঠার যে সম্ভাবনা ছিল রোহিঙ্গা সমস্যা তার প্রধান অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছে। মিয়ানমারে যে ধরনের সরকারই থাক না কেন, বাংলাদেশ বরাবরই মিয়ানমারের সাথে সুসম্পর্কের বার্তা দিয়েছে। কিন্তু মিয়ানমার বার বার উস্কানীমূলক ভূমিকা গ্রহণ করেছে। সীমান্ত নদীতে বাধ নির্মান ও ভূমি বিরোধ নিয়ে মিয়ানমারের সীমান্তরক্ষি বাহিনীর উস্কানীমূলক ও আগ্রাসী ভ’মিকার জবাব দিতে এক পর্যায়ে বাংলাদেশের সীমান্তরক্ষি বাহিনী(বিডিআর) অস্ত্র হাতে রুখে দিতে বাধ্য হয়েছে। ২০০০ সালে তৎকালীন বিডিআর’র মহাপরিচালক আ ল ম ফজলুর রহমানের নির্দেশে মিয়ানমার বাহিনীর বিরুদ্ধে সীমান্ত সংঘাতে বাংলাদেশের হাতে মার খেয়ে বিপুল সদস্য হারিয়ে, হতাহতের পর সমঝোতা ও শান্তির সন্ধি স্থাপনের বাধ্য হয়েছিল মিয়ানমার বাহিনী। এর আগে বাংলাদেশের সীমান্তরক্ষিদের শক্ত অববস্থান এবং ১৯৭৮,১৯৭৯ সালে প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের যথাযোগ্য নির্দেশনা ও নেতৃত্বে রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিতে এবং বাংলাদেশের সাথে স্থলসীমান্ত চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছিল। উল্লেখ্য মিয়ানমারের সাথে বাংলাদেশের ২৭৩ কিলোমিটার স্থল সীমান্ত রয়েছে। বেশ কয়েকটি স্থানে এখনো সীমান্ত অচিহ্নিত ও অমিমাংসিত। মিয়ানমারের জান্তা সরকার যখন পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞার কবলে পড়ে একপ্রকার একঘরে হয়েছিল, পক্ষান্তরে এ সময় বাংলাদেশ রফতানী বাণিজ্য ও বৈদেশিক কর্মসংস্থানের হাত ধরে অর্থনৈতিকভাবে বেশ খানিকটা এগিয়েছে। জীবনমান এবং জিডিপি রেশিওতে বাংলাদেশ মিয়ানমারকে পেছনে ফেলে এখন আগামী দশকে একটি মধ্য আয়ের দেশে উন্নীত হওয়ার স্বপ্ন দেখছে। কিন্তু আগ্রাসী শত্রæর বুলেটের সামনে রক্তাক্ত মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে গড়ে ওঠা বাংলাদেশ সেনাবাহিনী কেন মিয়ানমার থেকে পিছিয়ে থাকবে, তা দেশের সাধারণ মানুষের কাছে বোধগম্য ও সমর্থনযোগ্য নয়। যদিও সমপ্রর্যায়ের প্রতিবেশী দেশের সামরিক বাহিনীর শক্তি-সামর্থ্যের বিষয় অনেকটাই হাইপোথেটিক্যাল বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। নানা মাধ্যমে বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের সামরিক শক্তির যে তুলনামূলক পরিসংখ্যান দেখা যায়. তাতে সামরিক শক্তির দিক থেকে দুই দেশের মধ্যে এক ধরনের ভারসাম্য রয়েছে বলেই মনে হতে পারে। তবে মিয়ানমারের সীমান্তরক্ষি বাহিনীর নানা ধরনের উস্কানীমূলক তৎপরতা এবং সীমালঙ্ঘনের ঘটনা থেকে বোঝা যায় মিয়ানমার বাহিনী বাংলাদেশ সেনা বাহিনীকে টার্গেট করেই তাদের শক্তিবৃদ্ধি করে চলেছে। সাম্প্রতিক ভূ-রাজনৈতিক বাস্তবতায় বাংলাদেশ ছাড়া অন্যকোন প্রতিবেশীর সাথে মিয়ানমারের যুদ্ধ করার কোন কারণ বা অবস্থা সৃষ্টি হয়নি। আর আরাকানের রোহিঙ্গা গণহত্যাসহ বাংলাদেশের সাথে উদ্ভুত উত্তেজনা ও হুমকির প্রায় সবটাই একপাক্ষিকভাবে মিয়ানমারের সৃষ্টি। কোরবানী ঈদের এক সপ্তাহ আগে মিয়ানমার সীমান্তে কথিত আরসা’র বন্দুক হামলার পর থেকে রোহিঙ্গা গণহত্যার মাত্রা অতীতের সব রেকর্ড অতিক্রম করেছে। প্রচুর হতাহতসহ ইতিমধ্যে আরো লক্ষাধিক রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আশ্রয় গ্রহণের বিষয়টি যখন সারাবিশ্বে আলোচিত ঘটনায় পরিনত হয়েছে ঠিক তখন উস্কানিমূলকভাবে মিয়ানমার সামরিক বাহিনীর হেলিকপ্টারের বার বার বাংলাদেশে অনুপ্রবেশের ঘটনা বাংলাদেশের জন্য রেড এলার্ট। বাংলাদেশে ৫লক্ষাধিক রোহিঙ্গা রিফিউজির অবস্থান, এসব রোহিঙ্গাকে বাঙ্গালী সন্ত্রাসী বা রাখাইনে অনুপ্রবেশকারি হিসেবে আখ্যায়িত করা এবং বাংলাদেশকে বার বার প্রচ্ছন্ন হুমকি দেয়ার বাস্তবতায় বাংলাদেশ সরকার এবং সেনাবাহিনীর ভ’মিকা নিয়ে জনসাধারণ্যে এক ধরনের হতাশা ও ক্ষোভ দেখা দিয়েছে। বার্মিজদের বর্বরতার চিত্র দেখে এখন সারাবিশ্বই বার্মার বিরুদ্ধে ঘৃনা ও বিক্ষোভ প্রকাশ করতে শুরু করেছে।
আরাকানের রোহিঙ্গাদের হাজার হাজার বাড়িঘর ক্ষেত খামার আগুনে জ্বালিয়ে দিয়ে হাজার বছর ধরে মুসলিম অধ্যুষিত আরাকানকে বিরাণ ভূমিতে পরিণত করা হচ্ছে। বার্মিজ বাহিনীর এই গণহত্যাকে হাজার বছর আগে স্পেনে মুসলিম গণহত্যার চাইতেও ভয়ঙ্কর ঘটনা হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। কেউ কেউ আরাকানকে দক্ষিণ এশিয়ায় ইসরাইল-ফিলিস্তিনের মত আরেক সঙ্কট হিসেবে দেখছেন। ইঙ্গ-মার্কিন সা¤্রাজ্যবাদের সহযোগিতায় সত্তুর বছর আগে ১৯৪৮ সালে ফিলিস্তিন থেকে আরবদের বিতাড়িত করে তাদের বাড়িঘর বুলডোজারে গুড়িয়ে দিয়ে যে নতুন রাষ্ট্র নির্মান করা হয় তার নাম ইসরাইল। অস্ত্রের মুখে বিতাড়িত উদ্বাস্তু হয়ে গাজা উপত্যকা ও পশ্চিম তীরে আশ্রয় গ্রহনকারি ফিলিস্তিনিরা এরপর গত সাত দশকেও একটি স্বাধীণ রাষ্ট্রীয় জাতিসত্তার স্বীকৃতি পায়নি। আমরাও আমাদের পার্বত্য চট্টগ্রাম নিয়ে আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক মহলের নানা ধরনের ভ’-রাজনৈতিক এক্সপেরিমেন্ট দেখেছি। এখনো দেখছি। সেখানে উপজাতীয় সন্ত্রাসীদের হাতে অস্ত্র তুলে দিয়ে কয়েক দশক ধরে হাজার হাজার বাঙ্গালীকে হত্যা করা হয়েছে। এখন আরাকানে বার্মিজদের গণহত্যার বিরুদ্ধে ক্ষীনস্বরে হলেও জাতিসংঘ যখন কিছু উদ্যোগ নিতে যাচ্ছে, তখন চীনের মত আঞ্চলিক পরাশক্তি পরোক্ষভাবে বার্মিজদের সমর্থন দিয়ে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের উদ্যোগকে ব্যর্থ করে দিতে চাচ্ছে বলে অনেকে সন্দেহ করছে। ইসরাইলের আগ্রাসন, ঔদ্ধত্ব ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিরুদ্ধে জাতিসংঘ ও বিশ্বসম্প্রদায়ের ঐক্যবদ্ধ সিদ্ধান্তগুলো যেভাবে ইঙ্গ-মার্কিনীদের ভেটোর কারণে ব্যর্থ হয়ে গেছে, ঠিক একইভাবে মিয়ানমারের বর্বরতা ও রোহিঙ্গা মুসলমানদের ভাগ্য নির্ধারনে বিশ্বসম্প্রদায়ের উদ্যোগগুলো যদি চীনের ভেটোর কারণে ব্যর্থ হয়ে যায় তাহলে আরাকান আরেকটি ফিলিস্তিনে পরিনত হতে পারে। সে ক্ষেত্রে প্রধান ভুক্তভোগি রাষ্ট্র এবং বিশ্বসম্প্রদায়ের অন্যতম সদস্য হিসেবে বাংলাদেশকে গুরুত্বপূর্ণ ও অগ্রণী ভূমিকা পালন করতেই হবে। আরাকান মুসলমানদের জাতিসত্বা, নাগরিকত্ব এবং মানবাধিকার রক্ষায় বার্মিজদের যেমন দায় এড়ানোর এবং বাংলাদেশের নিস্ক্রীয় বা নীরব দর্শক হয়ে বসে থাকার কোন সুযোগ নেই। আঞ্চলিক ভূ-রাজনৈতিক প্লে-গ্রাউন্ডে বাংলাদেশকে তার নিরাপত্তা ও ভবিষ্যতের সম্ভাবনা টিকিয়ে রাখতে এখন একটি জাতীয় ঐক্য গড়ে তোলা প্রয়োজন। কারণ রাজনৈতিকভাবে বৈরী ও দ্বিধাবিভক্ত কোন জাতি প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে পারেনা। আসিয়ানভুক্ত দেশ মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, চীনের অন্যতম মিত্র ও পারমাণবিক ক্লাবের সদস্য দেশ পাকিস্তান, মধ্যপ্রাচ্যের অন্যতম অনুঘটক মুসলিম রাষ্ট্র তুরস্ক ও ইরানসহ বেশ কিছু দেশ বার্মার রোহিঙ্গা গণহত্যার বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থানের কথা জানিয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ কিছু পশ্চিমা দেশকে কিছুটা সক্রিয় দেখা যাচ্ছে। ইতিহাসের ঘৃণ্যতম মানবাধিকার লঙ্ঘন ও গণহত্যার ঘটনাকে কোন পরাশক্তি যদি সমর্থন করে তার পতনও অত্যাসন্ন। পশ্চিমা সা¤্রাজ্যবাদি শক্তিগুলোর ভূ-রাজনৈতিক দাবার গুটি হয়ে এ অঞ্চলে দীর্ঘস্থায়ী অশান্তি ও অস্থিতিশীলতা সৃষ্টির প্রয়াসকে ব্যর্থ করে দিতে চীন-ভারত, বাংলাদেশ, মিয়ানমারকে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করতে হবে। সামরিক শক্তি দিয়ে রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধান যে অসম্ভব, বার্মিজরা যত তাড়[তাড়ি তা’ বুঝতে পারবে ততই মঙ্গল।
[email protected]



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: ঈদুল আজহা

৯ জুলাই, ২০২২

আরও
আরও পড়ুন
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ