হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির খড়গ : আসামের এনআরসি এবং বাংলাদেশ
কিশোর শিক্ষার্থীদের নিরাপদ সড়ক দাবীর আন্দোলনে ঢাকাসহ সারাদেশে তীব্র রাজনৈতিক উত্তেজনা ও অনিশ্চয়তা দেখা যাচ্ছিল,
আবদুল আউয়াল ঠাকুর
এক শিশু আরেক শিশুকে বলছে, ঠিকমত পড়াশোনা কর নয়ত মা মেরে ফেলবে-এ ধরনের বক্তব্য ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় প্রকাশিত ও প্রদর্শিত হওয়ার পর অভিজ্ঞ মহলে সংগত প্রশ্ন উঠেছে শিশুরা তাদের মৃত্যু সম্পর্কে কতটা সচেতন। এ সম্পর্কে পুরোপুরি আশ্বস্ত হতে হলে বর্তমান হাল অনুযায়ী বিশেষজ্ঞদের দ্বারস্থ হওয়া ছাড়া উপায় নেই। কারণ গত কিছুদিনে ওয়াশার খোলা কুপে পড়ে, ম্যনহোলের গর্তে পড়াসহ খেলতে খেলতে গলায় ফাঁস জড়িয়ে এবং অনেক তুচ্ছ ঘটনা শিশু মৃত্যুর কারণে পরিণত হয়েছে যা থেকে সহজেই অনুমান করা যায় শিশুরা মৃত্যু সম্পর্কে সচেতন হলে বা এ সম্পর্কে কোন ধারণা থাকলে তারা হয়তো এমনটি করতে পারত না। তবে এটা নিশ্চিত করে বলা যায়, শিশুরা খিদে পেলে চিৎকার করে, আদরে সোহাগে মায়ের মুখে আঁচর কাটে, মায়ের মাথার চুল নিয়ে খেলা করে। মায়ের কোল-বুক শিশুর জন্য চরম ও পরম আশ্রয় আস্থা ও বিশ্বাসের জায়গা। শিশুকে উপরে তুলে ধরে মায়ের আদর আর শিশুর হাসি বোধকরি এই জটিল ও কুটিল পৃথিবিতে এক অনন্য পাওয়া। এর তুলনা অন্য কোথাও নেই। সেজন্যই বলা হয়, শিশু সুন্দর মাতৃক্রোড়ে। এতকিছু সত্ত্বেও গত কিছুদিনে শিশু মৃত্যু ও হত্যার গতি প্রকৃতি বিশ্লেষণে নানা প্রশ্নের উদয় হয়েছে। বিশেষ করে বনশ্রীতে শিশু নুসরত আমান ও আলভী আমানের হত্যাকারী হিসেবে তার মায়ের স্বীকারোক্তির পর অনেকেই নতুন বিবেচনায় দেখতে শুরু করেছেন। একজন সাবেক কলেজ শিক্ষিকা মাহফুজা হত্যার কারণ সম্পর্কে বলতে গিয়ে বলেছে, লেখাপড়ার ভবিষ্যৎ নিয়ে উদ্বিগ্ন হয়েই দু’সন্তানকে হত্যা করেছে। তার মতে তাদের আয় রোজগার কম। সন্তানরা কি করতে পারবে না পারবে এ ভাবনাই তাকে হত্যায় তাড়িত করেছে। তার এতটুকু কথা এখন পর্যন্ত কোন মহলই বিশ্বাস করেনি। সে ভিন্ন প্রসঙ্গ। একথাও ঠিক যে গত কিছুদিনে একদিকে যেমনি শিশু নির্যাতন হত্যা এমনকি ধর্ষণের হার উদ্বেগজনক হারে বেড়েছে; তেমনি নবজাতক, অবুঝ নাবুঝ শিশুদের হত্যা, পরিত্যাগ বা ফেলে দেয়ার মতো অনেক ঘটনা ঘটেছে-যা প্রকৃত বিবেচনাতেই গভীর বিশ্লেষণের দাবি রাখে।
মায়ের গর্ভের আরবি নাম হচ্ছে রেহেম। শব্দটি দয়া-মায়া-ভালোবাসা থেকে এসেছে। এ শব্দটির সাথে যেসকল বিষয় সম্পর্কিত প্রকৃতঅর্থে তার পুরোটাই মা ও সন্তানের একান্ত নিবিড়, গভীর ও আন্তরিক সম্পর্কের সাথে সম্পর্কিত। মা সন্তান সম্পর্ক কেবলমাত্র মানুষের বেলাতেই নয় বরং পশু-পাখীসহ প্রাণী জগতেও বিদ্যমান। এ দৃশ্য অনেকেরই অজানা নয় যে, বাচ্চা রক্ষার জন্য মা মুরগী কিভাবে শিকারিবাজকে ধাওয়া করে। বাঘিনী কিভাবে তার বাচ্চা রক্ষায় হিং¯্র হয়ে ওঠে। চোখের সামনেই দেখা যায় ঘৃণিত পশু কুকুরী তার বাচ্চাকে কতো যতেœ রক্ষা করে। কিভাবে সে আড়াল করে রাখে অন্যদের থেকে। গৃহপালিত প্রাণী বিড়ালের কথা তো বলাইবাহুল্য। বাচ্চার নিরাপত্তার জন্য ক্ষণে ক্ষণে সে স্থান পরিবর্তন করে। প্রাসঙ্গিক আলোচনায় একটি উদাহরণ তুলে ধরছি। এক গৃহিণী যার বিড়াল একেবারে অপছন্দ, তার ঘরে বিড়াল বাচ্চা দিলে তিনি গৃহভৃত্যকে দিয়ে বিড়ালের সদ্য প্রসূত বাচ্চাগুলো অন্যত্র ফেলে দিলেন। বিড়াল এসে তার বাচ্চা না পাওয়ায় অনেকটাই যেন অবরোধ কর্মসূচি পালন শুরু করল। শেষতক খুঁজে যা দু’একটা পাওয়া গেল সেটা তাকে এনে দেয়ার পর নিশ্চিন্তে বাড়ি ছেড়ে চলে গেল। একটি ভিডিওতে দেখছিলাম, এক পাখি তার বাচ্চাকে ঠোঁট দিয়ে আহার করাচ্ছিল। ঠিক এসময়ে শিকারি পাখি তা দেখে ফেলে। বিষয়টি মা পাখিরও অগোচরে ছিল না। মা পাখি এমন পরিস্থিতি তৈরি করল যে শেষপর্যন্ত শিকারি পাখিকে নাস্তনাবুদতই হতে হল। এক হাতির বাচ্চা সিংহ দ্বারা আক্রান্ত হলে হাতির পাল সিংহের দলকে বিপর্যস্ত করে তুলেছিল। সাধারণ উদাহরণ তো ভূরি ভূরি রয়েছে। গ্রামীণ জীবনে গাভীর বাচ্চার প্রতি গাভীর আদর ভালোবাসার কথা কে না জানে। বাচ্চা যখন গাভীর দুধ পান করে তখন কত পরম আদরে সে বাচ্চার শরীর লেহন করে। ক্ষুধায় যখন বাচ্চা চিৎকার করে তখন গাভী প্রতিউত্তর করে, অবস্থান জানায়। প্রাণী জগতেও প্রতিটি প্রাণী তার নিজস্ব বাচ্চাকে আলাদা করে চিনতে পারে। মুরগির ওমে যেমনি অন্য বাচ্চা ঢুকে পড়লে সে তাড়িয়ে দেয় তেমনি কাকের বাসায় কোকিলের ছানাও বড় হতে পারে না। চেনামাত্র তাড়িয়ে দেয়। প্রকৃতির রাজ্যের এই নিয়মের কোন পরিবর্তন এখন পর্যন্ত দেখা যাচ্ছে না। অথচ সৃষ্টির সেরা বিবেকবান বলে পরিচিত মানুষের মধ্যে লক্ষণীয় পরিবর্তন স্থান করে নিয়েছে। মানুষ ও পশু উভয়ের মধ্যেই বিবেক ও পশুত্ব বিদ্যমান। মানুষের মধ্যে বিবেক প্রণিধানযোগ্য বলে মানুষেরই শ্রেষ্ঠত্ব। পশুর মধ্যে পশুত্ব অত্মকেন্দ্রিকতা বিচার বিবেকহীনতা প্রণিধানযোগ্য বিধায় পশু বলা হয়। বর্তমান সময়ে যেসব প্রশ্ন উঠছে তাতে বোধহয় সংজ্ঞা নির্ধারণেও নতুন উপাত্ত বিবেচনায় নিতে হবে। প্রশ্ন হচ্ছে কেন এমনটা হচ্ছে, হতে পারছে?
সন্তান ও পিতা-মাতার সম্পর্কের গভীরতা আন্তরিকতা লিখে বা বলে বুঝাবার বিষয় নয়। জাতি-ধর্ম-বর্ণ-নির্বিশেষে এর স্বীকৃতি রয়েছে। পিতা-মাতার জন্য দোয়া করতে আল্লাহ্ পবিত্র কোরআনে নির্দেশ দিয়েছেন। তিনি শিখিয়ে দিয়েছেন কিভাবে দোয়া করতে হবে। আল্লার রাসূল (সা.) বলেছেন, মায়ের পায়ের নিচে জান্নাত। তিনি আরো বলেছেন, সে ধংস হোক যে মাকে জীবিত পেল কিন্তু জান্নাত কিনতে পারল না। রাসূলের জমানার হযরত ওয়েস কুরুনির মাতৃভক্তির কথা প্রায় সকলেরই জানা। মায়ের প্রতি কর্তব্যবোধের কারণে হযরত বায়েজিত বোস্তামীর প্রতি তার মায়ের দোয়া এবং পরবর্তীতে বিশিষ্ট ওলিতে পরিণত হবার কথা মুসলিম সমাজে সুবিদিত। যুগে যুগে এরকম অসংখ্য উদাহরণ রয়েছে যারা পিতা-মাতার সেবা-যতেœর অনন্য উদাহরণ সৃষ্টি করেছেন। এ যুগেও এ ধরনের উদাহরণ আমাদের সমাজে ভূরিভূরি রয়েছে। নিজে না খেয়ে সন্তকে খাওয়ানোর উদাহরণ যেমনি রয়েছে তেমনি হযরত সোলাইমান (আ.)-এর সময়কার সেই কালজয়ী ঘটনাও বিস্মৃত হওয়ার নয়। সন্তানের মঙ্গল কামনায় নিজের স্বত্ব ত্যাগ করতেও দ্বিধা করেননি যে মা তিনি তো আমাদের জন্য সন্তানে প্রতি দরদের উদাহরণ সৃষ্টি করে গেছেন। আজকের দিনেও প্রতিবছর মাধ্যমিক উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষার ফল প্রকাশিত হলে বিজয়ীদের যে বিবরণ প্রকাশিত হয় তাতে দেখা যায় বহু মা অন্যের বাসায় গৃহভৃত্যের কাজ করে সন্তানের পড়ার খরচ যোগাচ্ছেন। অনেক পিতা দিমজুরি করে সন্তানের পড়ার খরচ যোগাচ্ছেন। মাতৃভক্তির কারণে বিশেষস্থানে রয়েছেন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যারসাগর। মধ্যযুগের কবি ভারতচন্দ্র রায়গুনকর তার দেবির কাছে অন্যকিছু না চেয়ে সন্তান যাতে দুধে-ভাতে থাকে সে প্রার্থনাই করেছিলেন। আজকের সমাজেও সন্তানের অনাগত ভবিষ্যতের মঙ্গল কামনায় পিতা-মাতা তাদের সমস্ত সুখ সম্ভোগকে বিসর্জন দিয়ে যাচ্ছে। ব্যতিক্রম শুধু আলোচ্য ঘাতক। মাতৃতান্ত্রিক বহুত্ববাদি হিন্দু ধর্মে ঘরকে যে মন্দির বলা হয় সে মন্দিরের প্রধান মূলত মা। মা তথা পিতা-মাতার প্রতি সন্তানের দায়িত্ব-কর্তব্য এবং সন্তানের প্রতি পিতা-মাতার দায়িত্ব-কর্তব্য মূলত ধর্মই শিখিয়েছে। সমাজ রাষ্ট্রের মূল একক হচ্ছে পরিবার। পরিবার গড়ে ওঠে পিতা-মাতাকে কেন্দ্র করে। দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্যি সেই পরিবারের মূলেই এখন আঘাত পড়তে শুরু করেছে। মূলত এরজন্য আমাদের শিক্ষা এবং রাজনৈতিক সংস্কৃতিই দায়ী।
বর্তমান শিক্ষাকে বলা হয় কর্মোপযোগী শিক্ষা। এটি আমরা পেয়েছি পাশ্চাত্য ধারণা থেকে। এর মূল দর্শণ হচ্ছে, ভোগবাদ। যারা মনে করেন একটাই পৃথিবী তারা পার্থিব শুখভোগের জন্য সবকিছুই করতে প্রস্তুত। নারী স্বাধীনতার নামে পর্নের মত গর্হিত বিষয়কেও তারা মানবাধিকারভুক্ত করেছেন। অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে যে, বিশ্ববিবেককে নাড়া দেয়া অভিভাসন প্রত্যাশী মৃত শিশু আয়লানকেও ধর্ষক হিসেবে তারা দেখাতে কুণ্ঠাবোধ করেনি। এটা ঘটেছে খোদ ফ্রান্সে যারা দাবি করে যে, বর্তমান বিশ্বের মানবাধিকারের প্রবক্তা তারাই। তারা আক্রমণ করছে তাদের যারা ধর্ষণ-ব্যভিচারকে নীতিগতভাবে ঘৃণা করে। মূল্যবোধের অনুসারীদের বলছে ধর্ষণকারী আর যারা পোশাক পরতে লজ্জাবোধ করে তারা হচ্ছেন মানবতাবাদি। পাশ্চাত্যের এই ভোগবাদি প্রবণতাই বিদ্ধ করেছে ঘাতক মাকে। সন্তানের কি হবে অর্থাৎ চলমান প্রতিযোগিতায় তার বোধ-বিশ্বাসে টিকে থাকতে পারবে কি-না সেটাই হয়তো তার প্রধান বিবেচ্য হয়ে থাকতে পারে। এটা মূলত আমাদের চলমান শিক্ষা ব্যবস্থা তথা নীতি-নৈতিকতাহীন প্রবণতার অংশ। সংগত প্রশ্ন উঠতে পারে তাহলে পাশ্চাত্যে এধরনের ঘটনা ঘটছে না কেন? সেখানে এর চেয়েও জঘণ্য ঘটনা ঘটছে। ঔরসজাত কন্যাকে জোর করে আটকে রেখে ধর্ষণ করার মত পাশবিক খবর তো সেদিনই মাত্র প্রকাশিত হয়েছে। ভিন্ন আলোচনাও রয়েছে। সেসব দেশের নাগরিকরা রাষ্ট্রীয় অর্থনৈতিক নিরাপত্তা বলয়ে রয়েছে। সন্তান জন্মের পর তাদের নিয়ে পিতা-মাতাকে ভাবতে হয় না। সেসব দেশে পিতা-মাতাকে ঘিরে পারিবারিক বন্ধন অনেকটাই অনুপস্থিত। সেকারণেই তারা ঘটা করে বাবা দিবস, মা দিবস, ভাই-বোন দিবস পালন করে। এর মধ্যদিয়ে খানিকটা হারিয়ে যাওয়া ঐতিহ্যে খুঁজে পাওয়ার ব্যর্থ চেষ্টা আর কি। বাংলাদেশেও এখন অর্থনৈতিক বাস্তবতা নাগরিকদের সুন্দর ভবিষ্যৎ ভাবনায় যে কতটা কঠিন হয়ে উঠেছে তার একটি উদাহরণ হতে পরে ঘাতক মায়ের বক্তব্য। কথায় বলে প্রয়োজন কোন আইন মানে না। এটা যে কতটা সত্যি তার বহু নিদর্শন, গল্প রয়েছে। এ ব্যাপারে জ্যাঁ ভাল জ্যাঁয়ের ঘটনা প্রায় সকলেই জানা। ক্ষুধার তাড়নায় একখ- রুটি চুরির ‘অপরাধে’ তাকে কতটা শাস্তি পেতে হয়েছিল সে গল্প সুবিদিত। গল্প নয় সত্যি মর্মস্পর্শী এক কাহিনী বর্ণনা করেছেন সহযোগী একটি দৈনিকের বন্ধু পিনাকি দাসগুপ্ত। রিপোর্টাস ভয়েজের চলতি সংখ্যায় একজন ট্রাফিক কনেস্টবলের ঘুষ খাওয়ার পেছনের করুণ আলোচনায় তিনি তুলে ধরেছেন আসলে জীবন কতটা নির্মম বাস্তবতা। দু’টাকা, ৫ টাকা ঘুষ খাওয়ার অপরাধে তাকে পুলিশের প্রধান কর্মকর্তার মুখোমুখি হতে হলেও শেষপর্যন্ত আইজিপি কনেস্টবলের চাকরি খাওয়া বা শাস্তির ব্যবস্থা করার পরিবর্তে সংকট মেটানোর পক্ষেই দাঁড়িয়েছেন। এর অর্থ অবশ্যই এই নয় যে, ঘুষ খাওয়া বৈধ। মোহাম্মদপুরে তিন বছরে শিশু ধর্ষণের প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে সেখানেও দারিদ্র্য উঠে এসেছে। চলমান বাস্তবতাতেও যে যাই বলুক মানুষের অর্থনৈতিক নিরাপত্তা, চাকরি পাওয়ার নিরাপত্তা, সমগ্রীকভাবে বেঁচে থাকার প্রয়োজনীয়তা নিয়েই হয়তো নানাজনের মনে প্রশ্ন দেখা দিয়ে থাকতে পারে। এই ধারণা বোধ-বিশ্বসের মূলে কাজ করছে ভোগবাদি ধারণা চিন্তা-চেতনা। প্রকৃত জবাবদিহিতা থাকলে এ অবস্থা হয়তো তৈরি নাও হতে পারত। আমরা স্বীকারকরি বা না করি এটাই সত্যি যে পাশ্চাত্য দুনিয়ায় রাষ্ট্র যেখানে কল্যাণকর ভূমিকায় অবতীর্ণ আমাদের রাষ্ট্র, সরকার সেখানে জনগণের অর্থে নিজেদের সুখভোগে ব্যস্ত। যে যা কিছু আয় করছে সেখান থেকে ভাগ বসাবার প্রক্রিয়ায় রয়েছে। এখন তো বাতাস পানি থেকে শুরু করে সবকিছুতেই কর রয়েছে। তাতে হয়তো সমস্যা হতো না যদি এ কর আবার নাগরিকদের অর্থনৈতিক নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণে ব্যয়িত হতো। সামগ্রীকভাবে মানুষের মনে যে হতাশা কাজ করছে তার মাশুলই দিতে হচ্ছে অন্যদের। এখানেই নাগরিক নিরাপত্তার মূল ভাবনা। সে কারণেই শিক্ষা এবং বাস্তবতা নিয়ে কার্যকর ভাবনার অবকাশ রয়েছে।
অপরাধের কোন প্রকৃতি নেই। কোন নির্দিষ্ট নিয়ম-কানুন মেনে তা হয় না। দেখা যায় একটি নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা হয়েছে তো অন্যটি বেড়ে গেছে। গত কিছুদিনে সামাজিক অপরাধ প্রবণতা বৃদ্ধি পেয়েছে। নারী, শিশু হত্যা ধর্ষণ থেকে শুরু করে কিশোর অপরাধও অনেক মাত্রায় বেড়ে গেছে। সর্বনাশা মাদকে শিশু-কিশোরদের ব্যবহার রীতিমত উদ্বেগজনক। চুরি, ছিনতাই, হত্যার সাথেও শিশু-কিশোরদের সম্পৃক্ততা আশঙ্কাজনক। সাম্প্রতিক বিভিন্ন ঘটনায় দেখা গেছে, আইনÑশৃঙ্খলা বাহিনীর এক শ্রেণীর সদস্যের মধ্যেও সামাজিক অপরাধ প্রবণতায় সম্পৃক্ততা বৃদ্ধি পেয়েছে। এসব কার্যত সামাজিক ধ্বসের বার্তাবাহী। সমাজ থেকে যখন প্রকৃত জবাবদিহিতা অপলুপ্ত হয় অথবা এর কোন তাগিদ না থাকে তখনই সামাজিক নৈরাজ্য স্থান করে নেয়। বর্তমান চালচিত্র সে কথাই তুলে ধরছে নয়ত মায়ের মতো পরম আস্থা ও নির্ভরশীলতার স্থানটিও কেন বিতর্কিত হয়ে উঠবে। কেউ কি ভেবে দেখেছেন, মা বিতর্কিত হলে জন্মভূমিও বিতর্কিত হয়ে উঠতে পারে। সমস্ত বাধা-বিপত্তি ঠেলে যে মায়ের কোল সন্তানের জন্য সবচেয়ে নিরাপদ, যে মায়ের আঁচল সমস্ত বাধা আগলে রাখে সেই মা-ই যদি অবিশ্বাসের কেন্দ্রে অবস্থান করে তাহলে ভবিষ্যতের যাত্রা যে অনিশ্চিত গন্তব্যে সেকথা বোধকরি লিখে বা বলে বুঝাবার কোন প্রয়োজন নেই।
দুর্ভাগ্যের বিষয় হচ্ছে, আমাদের কেউ কেউ কথায় কথায় ধর্ম নৈতিকতাকে গালি দিতে বা একহাত নেয়ার আগে একবারও ভাবছি না যে সৃষ্টির মালিক যিনি তার আইন কিন্তু প্রকৃতি প্রাণী জগতে কেউ অমান্য করছে না। মানবিকতা মূল্যবোধ ধর্মীয় অনুশাসন সমাজ রাষ্ট্রকে পিছিয়ে দেয় না বরং এগিয়ে যেতে সাহায্য করছে। যাদের মধ্যে প্রকৃত জবাবদিহিতা রয়েছে তাদের মধ্যে অপরাধ প্রবণতা নেই বললেই চলে। খুন, রাহাজানি, হত্যা, ধর্ষণ এ সবের সাথে জড়িত সমাজের ভোগবাদী মানসিকতা। আমাদের রাজনৈতিক চর্চায় এর মারাত্মক প্রভাব রয়েছে। বলা অত্যুক্তি হবে না যে চলমান রাজনৈতিক বিতর্কেও এ প্রসঙ্গও যুক্ত হয়ে আছে। কোনটি সঠিক কোনটি বেঠিক তার প্রকৃত জ্ঞান হয়তো অনেকেরই রয়েছে বাস্তবে চোখ বন্ধ করে যে যেভাবে পারছি অর্থ আয়ের অসম প্রতিযোগিতায় মেতে উঠেছি। এই নাজুক ও আত্মঘাতী প্রবণতা থেকে মুক্তির উপায় রাজনীতিক তথা সমাজ পরিচালকদেরই খুঁজতে হবে। চলমান ঘটনাগুলোকে কেবলমাত্র প্রচলিত অপরাধের সংজ্ঞায় দেখলে চলবে না। গোড়ায় যেতে হবে। আমাদের সমাজ এরকম ছিল না। এখন কেন হয়েছে বা হতে যাচ্ছে তার কারণ অনুসন্ধান না করে এসব সমস্যার সমাধান খুঁজে পাওয়া কষ্টকর।
আমরা প্রযুক্তিকে অভিনন্দন জানিয়েছি। এখন দেখা যাচ্ছে, প্রযুক্তিগত বিপর্যয় নেমে এসছে সর্বত্র। আমাদের সমাজ বিনির্মাণে পুরনো কাঠামো মূল্যবোধ বিশ্বাসে যারা আঘাত হানছেন এখন যা ঘটছে তার দায় কি তাদের উপর বর্তাবে না? অবশ্যই। যেকোন পরিবর্তনই সমাজের সাথে ঘাপ খাইয়ে না নিলে তা টিকে না এবং সমাজ রক্ষায়ও কোন ভূমিকা রাখতে পারে না। একথা সকলেরই মনে রাখা দরকার, পিতা-মাতা-ভাই-বোন পরিবার যদি টিকে না থাকে বা থাকার অবস্থায় না থাকে তাহলে রাষ্ট্র সমাজ কিছুই টিকিয়ে রাখা যাবে না। এ কারণেই আমাদের শিক্ষা অর্থনৈতিক ব্যবস্থা সামাজিক নিরাপত্তা ভাবনা সব ক্ষেত্রেই মূল্যবোধকে জাগ্রত করার অনুকূল বাস্তবতা তৈরি করা জরুরি হয়ে উঠেছে।
[email protected]
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।