হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির খড়গ : আসামের এনআরসি এবং বাংলাদেশ
কিশোর শিক্ষার্থীদের নিরাপদ সড়ক দাবীর আন্দোলনে ঢাকাসহ সারাদেশে তীব্র রাজনৈতিক উত্তেজনা ও অনিশ্চয়তা দেখা যাচ্ছিল,
কাজী নজরুল ইসলাম বাংলাদেশের জাতীয় কবি। এটা কোন রাষ্ট্রনেতার ঘোষণার উপর নির্ভর করে হয়নি। এ ব্যাপারে রাষ্ট্রীয় নেতাদের যা করা প্রয়োজন ছিল, তা তাঁরা করেছেন এমনটা তাঁরা দাবীও করতে পারবেন না। তাছাড়া বর্তমানে কাজী নজরুল ইসলামকে যেভাবে স্মরণ করা হয়, তা জাতীয় কবি হিসেবে তাঁকে স্মরণ করার সাথে সঙ্গতিশীলও হয় না।
নজরুল ইসলাম যে বাংলাদেশের জাতীয় কবি এর স্বপক্ষে অজ¯্র যুক্তি আছে। জাতীয় কবির সঙ্গে জাতীয় স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট সত্তার সুগভীর সম্পর্কে থাকতে হবে। বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের দুই শ্রেষ্ঠ কবির একজন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, আরেকজন কাজী নজরুল ইসলাম। রবীন্দ্রনাথ ঊনিশ শতকের দ্বিতীয় দশকেই নোবেল পুরষ্কার পেয়ে বিশ্ব কবির পর্যায় ভুক্ত হন।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও কাজী নজরুল ইসলাম উভয়ই জন্মগ্রহণ করেন এমন সময়ে যখন সমগ্র ভারতীয় উপমহাদেশ ছিল সা¤্রাজ্যবাদী বৃটেনের শাসনাধীন। রবীন্দ্রনাথের জন্ম ১৮৬১ সালে, মৃত্যু ১৯৪১ সালে। নজরুল ইসলাম জন্ম গ্রহণ করেন ১৮৯৯ সালে। যদিও তিনি দৈহিকভাবে মৃত্যু বরণ করেন ১৯৭৬ সালে স্বাধীন বাংলাদেশে, তবুও ১৯৪২ সালে এক দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়ে বাকশক্তি সম্পূর্ণ হারিয়ে ফেলার কারণে ১৯৪২ সালেই তাঁর কবি জীবনের করুণ পরিসমাপ্তি ঘটে। সে নিরিখে তাঁর কবি জীবনের ব্যাপ্তি ছিল মাত্র দুই দশকের সামান্য বেশীতে সীমাবদ্ধ। এই অল্প সময়ের মধ্যেই তিনি বাংলা কবিতা, সঙ্গীত, উপন্যাস, গল্প, নাটক, প্রবন্ধ, সাংবাদিকতা, চলচ্চিত্র প্রভৃতি ক্ষেত্রে এমন অপরিমেয় অবদান রেখে যান, যা তাঁকে সাহিত্য সংস্কৃতি জগতে অমর করে রেখেছে।
আগেই বলা হয়েছে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও কাজী নজরুল ইসলাম উভয়ই জন্ম গ্রহণ করেন বৃটিশ শাসনাধীন ভারতবর্ষে। পরাধীন দেশে জন্ম গ্রহণকারী যে কোন বিবেকবান মানুষের প্রধান কাজ হচ্ছে স্বদেশের স্বাধীনতার জন্য সংগ্রাম করা। নজরুল ইসলাম তাঁর লেখালেখির মাধ্যমে স্বাধীনতা সংগ্রামে অংশ গ্রহণ করার দায়ে একাধিকবার কারারুদ্ধ হন। একই কারণে তাঁর একাধিক গ্রন্থ বৃটিশ সরকার কর্তৃক নিষিদ্ধ ঘোষিত হয়। এর বিপরীতে পরাধীন ভারতবর্ষে জন্মগ্রহণকারী রবীন্দ্রনাথ এদেশের তদানীন্তন সা¤্রাজ্যবাদী বৃটিশ সরকার কর্তৃক ‘নাইট’ উপাধিতে ভূষিত হন।
এই পটভূমিতেই সেই ১৯২৯ সালে অবিভক্ত বঙ্গের তদানীন্তন হিন্দু-মুসলমান নেতৃস্থানীয় বুদ্ধিজীবি ও রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ সম্মিলিতভাবে কলিকাতার এলবার্ট হলে গাজী নজরুল ইসলামকে জাতীয় সংবর্ধনা দেন। সেই সংবর্ধনা সভায় সভাপতিত্ব করেন বিশিষ্ট বিজ্ঞানী আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র। অন্যান্য আয়োজকদের মধ্যে ছিলেন সাহিত্যক এস. ওয়াজেদ আলী উদীয়মান বিপ্লবী নেতা সুভাষ চন্দ্র বসু প্রমুখ। সংবর্ধনা সভায় বক্তৃতা করতে গিয়ে সুভাষ চন্দ্র এক পর্যায়ে ঘোষণা করেন, আমরা যখন রাজপথে থাকব, তখন নজরুলের লেখা আমাদের প্রেরণা যোগাবে। আবার আমরা যখন কারাগারে যাব, সেখানেও তাঁর গান গাওয়া হবে।
কেন, নজরুলের কবিতা ও গান বিপ্লবী নেতা সুভাষ চন্দ্র বসুর এত ভাল লেগেছিল? কারণ নজরুলের গানে সা¤্রাজ্যবাদী বৃটিশ সরকারের শাসন-রূপী কারাগার ভেঙ্গে ফেলার বিপ্লবী আহŸান ছিল :
কারার ঐ লৌহ-কবাট
ভেঙ্গে ফেল, কর রে লোপাট
রক্ত-জমাট
শিকল-পূজোর পাষান-বেদী।
ওরে, ও তরুণ ঈশান।
বাজা তোর প্রলয়-বিষান!
ধ্বংসÑ নিশান
উড়–ক প্রাচীর প্রাচীর ভেদি।
..............................
..............................
নাচে ঐ কাল বোশেখি,
কাটাবি কাল বসে কি?
দেরে দেখি
ভীম কারার ঐ ভিত্তি নাড়ি!
লাথি মার ভাঙরে তালা।
যতসব বন্দী-শালায়-
আগুন জ্বালা
আগুন জ্বালা, ফেল উপাড়ি।
পলাশীর প্রান্তরে জাতির ভাগ্য বিপর্যয়ের ফলে এদেশ ইংরেজদের পরাধীন হয়। নজরুল বিশ্বাস করতেন, দেশকে পুনরায় স্বাধীন করতে হলে হিন্দু-মুসলিম মিলন অপরিহার্য। বিশিষ্ট কথাশিল্পী শরৎ চন্দ্র যেখানে হিন্দু-মুসলমান মিলনের সম্ভাবনাকে অলীক কল্পনা বলে মনে করতেন, সেখানে নজরুল ইসলাম বিশ্বাস করতেন সা¤্রাজ্যবাদী বৃটেনের কবল থেকে এদেশকে মুক্ত করতে হলে অবশ্যই দেশের দুই প্রধান সম্প্রদায়ের মধ্যে মিলন ও ঐক্য গড়ে তোলার পথে অগ্রসর হওয়ার কোন বিকল্প নেই। তাই তিনি তাঁর “কাÐারী হুশিয়ার” শীর্ষক বিখ্যাত কবিতার মাধ্যমে জাতীয় নেতৃবৃন্দকে সতর্ক করে দিয়ে বলতে পেরেছিলেন :
দুর্গম গিরি, কাতার-মরু, দুত্তর পারাবার
লঙ্ঘিতে হবে রাত্রি নিশীথে, যাত্রীরা হুশিয়ার!
দুলিতেছে তরী ফুলিতেছে জল, ভুলিতেছে মাঝি পথ,
ছিঁড়িয়াছে পাল, কে ধরিবে হাল, আছে কার হিম্মৎ?
কে আছো জোয়ান হও আগুয়ান হাঁকিছে ভবিষ্যৎ।
এ তুফান ভারি, দিতে হবে পাড়ি, নিতে হবে তরী পার\
অসহায় জাতি মরিছে ডুবিয়া জানেনা সন্তরন,
কাÐারী আজ দেখিব তোমার মাতৃমুক্তিপণ।
“হিন্দু না ওরা মুসলিম” ওই জিজ্ঞাসে কোন্ জন?
কাÐারী বল মরিছে মানুষ, সন্তান মোর মার।
দেশের স্বাধীনতার জন্য হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে নজরুল মিলন কামনা করলেও তিনি যে ব্যক্তিগতভাবে গভীর বিশ্বাসী ছিলেন ইসলামে, এ সম্বন্ধে সামান্যতম কোন সন্দেহ ছিল না। তাই তিনি লিখতে পেরে ছিলেন :
তওফিক দাও খোদা ইসলামে
মুসলিম জাঁহা পুন হোক আবাদ!
দাও সেই হারানো সুলতানাত
দাও সেই বাহু, সেই দিল আজাদ \
দাও সেদেরেগ তেজ জুলফিকার
খয়বর-জয়ী শেরে খোদার,
দাও সেই খলিফা সে হাসমত
দাও সেই মদিনা সে বাগদাদ\
নজরুল বিশ্বাস করতেন, মুসলমানদের যে ঈমানের জোরে ইসলাম একদা বিশ্বে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে ছিলো সেটি আবার ফিরে আসবে। তাই তিনি লিখতে পেরেছিলেন :
বাজিছে দামামা বাঁধরে আমামা
শির উচু করি মুসলমান।
দাওত এসেছে নয়া জামানার
ভাঙা কেল্লায় উড়ে নিশান \
মুখেতে কলেমা হাতে তলোয়ার,
বুকে ইসলামী জোশ দুর্বার,
হৃদয়ে লইয়া এশ্ক আল্লার,
চল আগে চল বাজে বিষান।
ভয় নাই তোর গলায় তাবিজ,
বাঁধা যেরে তোর পাক কোরান \
নাই মোরা জীব ভোগ-বিলাসের
শাহাদাৎ ছিল কাম্য মোদের,
ভিখারীর সাজে খলিফা যাদের
শাসন করিতো আধা জাহানÑ
তারা আজ পড়ে ঘুমায় বেহোশ,
বাহিরে বহিছে ঝড়-তুফান \
ঘুমাইয়া কাজা করেছি ফজর,
তখনোও জাগিনী যখন জোহর,
হেলায় ও খেলায় কেটেছে আসর,
মগরেবের আজ শুনি আজান \
জমাত-শামিল হওরে এশাতে
এখনো জামাতে আছে স্থান \
শুকনো রুটিরে সম্বল করে
যে ঈমান আর যে প্রাণের জোরে
ফিরেছি জগৎ মন্থন করে
সে শক্তি আজ ফিরিয়ে আন।
আল্লাহু আকবার রবে পুন
কাঁপুব বিশ্ব দূর বিমান \
নজরুল ইসলাম আজীবন স্বপ্ন দেখেছেন ইসলামের বিধান মোতাবেক জীবনে অন্তত একবার হজ্জ পালন উপলক্ষে কাবা শরীফ ও মদীনা জিয়ারতে করবেন। নিজে যেতে না পারার এ বেদনার প্রকাশ ঘটিয়েছেন নিজের লেখার মাধ্যমে :
দূর আরবের স্বপ্ন দেখি বাংলাদেশের কুঠির হতে।
বেহোঁশ হয়ে চলছি যেন কেঁদে কেঁদে কাবার পথে \
হায় গো খোদা কেন মোরে
পাঠাইলে কাঙাল করে
যেতে নারি প্রিয়-নবীর মাজার শরীফ জিয়ারতে।
স্বপ্নে শুনি নিতুই রাতে যেন কাবার মিনার থেকে
কাঁদছে বেলাল ঘুমন্ত সব মুসলিমেরে ডেকে ডেকে।
ইয়া এলাহি! বল সে কবে
আমার স্বপ্ন সফল হবে,
গরীব বলে হবো কি নিরাশ মদিনা দেখার জিয়ারতে?
আজ মুসলমান সমাজ নবীর (সা:) দেখানো পথ ভুলে বিপথগামী হচ্ছে ধন-দৌলতের লোভে পড়ে। নজরুল এদের হয়ে ক্ষমা চাইছেন মহা নবী (সা:) এর কাছে :
তোমার বাণীরে করিনি গ্রহণ ক্ষমা করো হজরত।
ভুলিয়া গিয়াছি তব আদর্শ তোমার দেখানো পথ।
ক্ষমা করো হজরত \
বিলাস বিভব দলিয়াছ পায়ে ধুলি সম তুমি প্রভু,
আমির হইবে বাদশা নওয়াব, তুমি চাহ নাই কভু।
এই ধরণীর ধন-সম্ভার
সকলের এতে সম-অধিকার,
তুমি বলেছিলে ধরণীতে সব সমান পুত্রবৎ \
তোমার ধর্মে অবিশ্বাসীরে তুমি ঘৃণা নাহি করে
আপনি তাদের করিয়াছ সেবা ঠাঁই দিয়ে নিজ ঘরে।
ভিন ধর্মীর পূজা-মন্দির
ভাঙিতে আদেশ দাওনি হে বীর।
আমরা আজিকে সহ্য করিতে পারি নাকো পরমত \
আজ পৃথিবীতে কোটি কোটি মুসলমান রয়েছে। তবুও প্রকৃত মুসলমানের বড্ড অভাব। তাই কবি প্রশ্ন রাখছেন :
আল্লাহতে যাঁর পূর্ণ ঈমান কোথা সে মুসলমান।
কোথা সে আরিফ-অভেদ যাদের জীবন মৃত্যু-জ্ঞান।
যার মুখে শুনি তওহিদের কালাম
ভয়ে-মৃত্যুও করিত সালাম।
যার দ্বীন দ্বীন রবে কাঁপিত জীন-পরী-ইনসান \
স্ত্রীপুত্ররে আল্লারে সপি জেহাদে যে নির্ভিক
হেসে কোরবানী দিল প্রাণ হায়! আজ তারা মাঘে বিখ \
কোথা সে শিক্ষা-আল্লার ছাড়া
ত্রিভুবনে ভয় করিত না যারা
আজাদ করিতে এসেছিল যারা হাতে লয়ে কোরআন \
প্রিয় নবী (সা:) কেমন সমাজ গড়তে চেয়েছিলেন, সে সম্পর্কে নজরুল বলেছেন :
দীন দরিদ্র কাঙালের তবে এই দুনিয়ায় আসি
হে হযরত, বাদশাহ হয়ে ছিলে তুমি উপবাসী।
(তুমি) চাহ নাই কেহ হইবে আমির, পথের ফকির কেহ,
(কেহ) মাথা গুজিবার পাইবে না ঠাঁই, কাহারো হাজার গেহ
ক্ষুধার অন্য পাইবে না কেহ, কারো শত দাস-দাসী \
নজরুলের অনেক স্বপ্ন অনেক আকাংখাই পুরন না হতে পারলেও তাঁর একটি স্বপ্ন ঠিক ঠিকই পূরণ হয়। ১৯৭৬ সালে তাঁর স্বপ্নের স্বাধীন বাংলাদেশে যখন তাঁর মৃত্যু হয় তাঁর শেষ আকাংখা মোতাবেক তাঁর কবর হয় মসজিদের পাশে। যে মসজিদের পাশে তাঁর কবর হয় সেটি ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় মসজিদ। কবির জীবনের বড় একটা স্বপ্ন পূরন হয় এর মাধ্যমে। কবির ভক্তরা কবির এ স্বপ্ন পূরনে সহায়তা করেন : কবির স্বপ্ন ছিল :
মসজিদেরই পাশে আমার কবর দিও ভাই।
যেন ঘোরে থেকেও মোয়াজুনের আজান শুনতে পাই \
আমার ঘোরের পাশ দিয়ে ভাই নামাজিরা যাবে,
পবিত্র সেই পায়ের ধ্বনি এ বান্দা শুনতে পাবে।
গোর-আজাব থেকে এগুনাগার পাইবে রেহাই \
কত পরহেজগার খোদার ভক্ত নবীজীর উম্মত
ঐ মসজিদে করে রে ভাই কোরান তেলাওত
সেই কোরান শুনে যেন আমি পরান জুড়াই \
কত দরবেশ ফকির রে ভাই মসজিদের আঙিনাতে
আল্লার নাম জিকির করে লুকিয়ে গভীর রাতে।
আমি তাদের সাথে কেঁদে কেঁদে
আল্লার নাম জপিতে চাই \
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।