ইসলামী ইবাদতের চতুর্থ রোকন : হজ
এ. কে. এম. ফজলুর রহমান মুনশী | প্রকাশের সময় : ৩১ আগস্ট, ২০১৭, ১২:০০ এএম
(পূর্ব প্রকাশিতের পর)
ফল ও ফসলের রিজিক সম্পর্কে দোয়া :
এই কেন্দ্রকে কায়েম এবং আবাদ রাখার জন্য এটা প্রয়োজন ছিল যে, এ বিরান ঊষর এলাকার বাসিন্দাদের জন্য ফল ও ফসলের রিজিকের ব্যবস্থা করা। এজন্য হযরত ইব্রাহীম (আ:) দোয়া করেছিলেন, “হে আল্লাহ! আমি আমার আওলাদ-ফরজন্দকে পানিহীন বিশুষ্ক মুরুভূমিতে আবাদ করেছি, আপনি মানুষের অন্তরসমূহ তাদের দিকে অনুপ্রাণীত করে দিন এবং তাদের রুজী- রোজগারের ব্যবস্থা করে দিন এবং তাদের ফল ও ফসলের রিজিক প্রদান করুন।” আল্লাহ পাক তাঁর এই দোয়া কবুল করেছিলেন। এর একটি ব্যবস্থা এই হতে পেরেছিল যে, এখানকার বাসিন্দাদের জন্য যাকাত, খয়রাতের অর্থের একটি অংশ নির্ধারিত করে দেয়া। কিন্তু এটা তাদের নৈতিক অবনতির ও অভাবগ্রস্ততার কারণে মানুষের নজরে হেয় প্রতিপন্ন হওয়ার উপক্রম হত। যা তাদের সম্মান, মর্যাদা ও বৈশিষ্ট্যের উপযোগী হত না। এজন্য আল্লাহপাক এর জন্য এই ব্যবস্থা গ্রহণ করলেন যে, তাদের অন্তরে ব্যবসায়ের স্পৃহা বাড়িয়ে দিলেন। এবং ব্যবসাকেই তাদের রুজী- রোজগারের উপকরণ বানিয়ে দিলেন।
হযরত ইসমাঈল (আ:)-এর সন্তানদের কথা অতীত ইতিহাসের যেখানেই পরিদৃষ্ট হয়, সেখানে তাদেরকে সওদাগরের বেশেই বেশী দেখা যায়। হযরত ইসমাঈল (আ:)-এর ভ্রাতুষ্পুত্র এবং হযরত ইসহাকের (আ:) ছেলে হযরত ইয়াকুব (আ:)-এর জমানায় বনী ইসমাঈল (আ:)-এর তেজারতী কাফেলা আরব হতে মিসর পর্যন্ত গমন করতে দেখা যায়। (তাকবীন-২৭-২৮ হতে ২৬ পর্যন্ত) তৌরাতের বিভিন্ন স্থানে আরব সওদাগর ব্যবসায়ীদের উল্লেখ বিশেষভাবে পাওয়া যায়। স্বয়ং কুরাইশরাও সেকালের বড় ব্যবসায়ী ও সওদাগর ছিলেন, যার উল্লেখ সূরা কুরাইশে সুস্পষ্ট পাওয়া যায়। তারা একদিকে ইয়েমেন ও হাবশা পর্যন্ত এবং অপর দিকে সিরিয়া ও মিসর পর্যন্ত গমনাগমন করতেন।
কিন্তুু এই ব্যবসাও মক্কা মুয়াজ্জমার ছোট বড় সকলের উদরপূর্তির জন্য যথেষ্ট ছিল না। এ জন্য স্বয়ং মক্কার ভূখÐকে হজ্জের সময়ে ব্যবসায়ী বানানোর প্রয়োজন ছিল। কেননা ইসলামের পূর্বেও হজ্জের মওসুম ছিল আরবদের জন্য বৃহত্তর মেলাস্বরূপ। ওকাজ প্রভৃতি স্থানে বড় মেলার আয়োজন করা হত। ইসলাম ও হজ্জের মওসুমে মক্কায় ব্যবসা-বাণিজ্যকে জারী রেখেছে। কেননা এ কাজটি ছিল হযরত ইব্রাহীম (আ:)-এর দোয়ার ফলশ্রæতি। এবং এই অনুর্বর মরুসদৃশ ভূমির অধিবাসীদের জন্য রুজী-রোজগারের উপায়। ইসলামের বিজয় অর্জিত হওয়ার পর সারা দুনিয়ার মুসলমানগণ এখানে আগমন করতে থাকে। ফলে এখানে দু’তিন মাস অবস্থানকারী ব্যবসায়ীগণ অল্প সময়ে এত অধিক মুনাফা করতে পারেন যে, তারা গোটা বছরের খাওয়া-পরার সংস্থান করতে সক্ষম হন।
পবিত্র মক্কা হতে পবিত্র মদীনায় যে সকল কাফেলা গমন করত, তারা সকল রাস্তায় চলার পথে স্থানীয় বেদুঈন অধিবাসীরা উৎপাদিত পণ্য নিয়ে আসত এবং যাত্রীদের নিকট বিক্রয় করত। এভাবে ক্রয়-বিক্রয়ের মাধ্যমে সেখানকার অধিবাসীরা প্রয়োজনীয় প্রচুর মুনাফা অর্জন করত। একই সাথে খাওয়া-পরা, বাসস্থান দেয়া, আরোহীর ব্যবস্থা করা এবং অন্যান্য জরুরি তৈজস-পত্র সংগ্রহ করার মাধ্যমে ব্যবসায়ের বাজার গরম হয়ে উঠত। শুধু শহরাঞ্চলই নয়, শহরতলী ও গ্রামীণ এলাকার লোকেরাও নানাভাবে উপকৃত হত। বহিরাগত হাজীগণ নিজেদের প্রয়োজনে মক্কা ও মদীনার অধিবাসীদের দ্বারস্থ হতেন এবং স্থানীয় অধিবাসীরা তাদের নিকট হতে বিনিময়স্বরূপ অর্থ-কড়ি ও নানা প্রকার ব্যবহারিক জিনিস-পত্র সংগ্রহ করত। এতে করেই মক্কা ও মদীনার অধিবাসীদের মাঝে ব্যবসায়ের ভিত্তিতে জীবন পরিচালনার জোর প্রচেষ্টা আজও অব্যাহত রয়েছে।
কুরবানীর অর্থনৈতিক সুফল :
আরব ভূখÐ বিশেষ করে মক্কার আশে পাশে পণ্য উৎপাদন উপযোগী কোনই অঞ্চল ছিল না। সেখানকার উৎপাদন বলতে একমাত্র পশুসম্পদ ছাড়া আর কিছুই ছিল না। এ কারণে কুরবানীর অপরিহার্য কর্মও আরবের অধিবাসীদের অর্থনৈতিক স্বচ্ছলতার পথ উন্মুক্ত করে দেয়। আরবের বেদুঈন ও গ্রামীণ এলাকার অধিবাসীদের জীবন ধারণের একমাত্র অবলম্বন ছিল পশু পালন। পশুসম্পদে সমৃদ্ধ এই লোকজনতাদের পালত পশুগুলো হজ্জের সময় হাজীগণের নিকট বিক্রয় করার সুবর্ণ সুয়োগ লাভ করত। প্রতি বছর প্রায় এক লাখ লোক হজ্জ করতে মক্কায় আগমন করেন এবং এদের প্রত্যেকেই কুরবানী করেন। এদের মাঝে কেউ একাধিক কুরবানীও আদায় করেন। এই হিসেব অনুসারে প্রতি বছর কুরবানীর জন্য কয়েক লাখ পশুর প্রয়োজন পড়ে। কমের পক্ষে একটি পশুর মূল্য আট টাকা, অথবা একটি বরকীর মূল্য চার টাকা ধার্য্য কর াহয়। (এই মূল্য বহু আগের। বর্তমানের ককুরবানীর মূল্য অনেক বেশী।) তাই সম্ভবত : প্রতি বছর দশ লাখ পশুর যোগান দেয়া আবশ্যকীয় হয়ে পড়ে। এভাবে লক্ষ লক্ষ টাকা পশু ব্যবসায়ীরা এবং বেদুঈনরা অর্জন করতে সক্ষম হয়। তাছাড়া বেদুঈন গোত্রের লোকেরা অন্যান্য-খাদ্র-সামগ্রী ও মুরগীর ব্যবস্থাও করত। বিস্তীর্ণ খোলা ময়দানে মুরগী পালন তাদের জন্য খুবই সহজ ছিল। এদিক থেকেও অর্থাগমের ব্যবস্থা ছিল খুবই সহজ। এতে করে পশু বিক্রয় ও খাদ্য-সামগ্রী বিক্রয়ের মাধ্যমে পানিশূন্য বিশুষ্ক মুরুবাসীরা এমনকি শহরবাসীরাও লাভবান হত। দারিদ্র্যতা বিমোচনে এ কুরবানী গোটা আরবের অর্থনৈতিক স্বচ্ছলতার পথ সুগম করার প্রধান উপাত্ত ছিল। লক্ষ্য করলে দেখা যায় যে, হযরত ইব্রাহীম (সা:)-এর দোয়ার প্রতিফলন মক্কার সর্বত্রই এক বিশিষ্ট মর্যাদার আসন দখল করে আছে। এই দোয়ার ফলেই আরবের অনুর্বর এলাকার লোকেরা বছরের সকল অংশে অভাব অনুভব করার চিন্তাগ্রস্ত হয় না।
দোয়ায়ে ইব্রাহীমীর মাকবুলিয়াত :
হযরত ইব্রাহীম (আ:) স্বীয় দোয়াতে মক্কার অধিবাসীদের জন্য ফলের কথা উল্লেখ করেছেন। আল কুরআনে ইরশাদ হচ্ছে : “এখানকার অধিবাসীদেরকে ফল দ্বারা রিজিক দান করুন।’’ (সূরা বাকারাহ : রুকু-১৫) এই দোয়ার প্রতিফলন দেখলে অবাক না হয়ে পারা যায় না। লক্ষ্য করলে দেখা যায় যে, মক্কার বাজারগুলোতে সর্বদাই তরতাজা ফলের সমারোহ থাকে প্রচুর। ফল, তরকারী, সবজি স্তুুপ সর্বত্রই নজরে পড়ে। এর মূলে হযরত ইব্রাহীম (আ:)-এর দোয়াই যে সম্পৃক্ত রয়েছে তা আর নতুন করে বলার প্রয়োজন পড়ে না। এভাবে ব্যবহারিক পণ্যের সম্ভার ও পরিপূর্ণ বিশ্বাসের আস্বাদ সকলের মনকেই আপ্লুত করে তোলে।
ব্যবসা ও তেজারত :
কুরআনুল কারীমের পরিভাষায় ‘আল্লাহর ফজল তালাশ’ করার অর্থ হচ্ছে ব্যবসায়, তেজারত ও রুজী হাসিল করা। মহান আল্লাহ পাক হজ্জের একটি প্রকৃষ্ট উদ্দেশ্য তেজারত ও রিজিক অর্জনের পথকেও নির্ধারিত করেছেন। সূরা মায়িদাতে ইরশাদ হচ্ছে : “এবং তাদেরকে নিগ্রহ করো না, যারা এই মর্যাদাপূর্ণ গৃহের উদ্দেশ্যে গমন করছে এবং যারা স্বীয় প্রতিপালকের ফজল তালাশ করছে। (সূরা মায়িদাহ : রুকু-১) অর্থাৎ তাদের মাল ও সম্পদ লুণ্ঠন করা জায়েয নয়। যদি মাল-সম্পদ লুট হওয়ার সম্ভবনা থাকে, তাহলে শান্তিপূর্ণভাবে হজ্জ আদায়ের উদ্দেশ্য ব্যর্থ হতে বাধ্য।
বাহ্যত : তেজারত এবং ব্যবসাকে দুনিয়াদারীর একটি কাজ বলে মনে হয়। এ জন্য ইসলাম আগমনের পর কোন কোন সাহাবী নিজেদের এই খাস ধর্মীয় সফরে তেজারত করাকে অর্থাৎ দুনিয়াদারীর উদ্দেশ্যকে শামিল করাকে পছন্দ করতেন না। তখন এই আয়াত নাজিল হয় যে, “মানুষের কাছে ভিক্ষা করে হজ্জ করা ভাল নয়। কেননা এটা তাকওয়া ও পরহেজগারীর খেলাপ; বরং ব্যবসা করতে করতে অগ্রসর হও। এটাই উত্তম পন্থা। আরোও ইরশাদ হচ্ছে : “তোমরা পথ খরচ নিয়ে চল। পথ চলার উত্তম সম্পদ হচ্ছে তাকওয়া (ভিক্ষা না চাওয়া)। এবং হে জ্ঞানবানগণ! তোমরা আমাকেই ভয় কর; তোমাদের উপর কোনই গোনাহ হবে না, যদি তোমরা স্বীয় প্রতিপালকের ফজল তালাশ করে চলতে থাক (অর্থাৎ ব্যবসা করতে করতে)।” (সূরা বাকারাহ : রুকু-২৫)
এই ধারণা যে, “ব্যবসা হচ্ছে দুনিয়ার কাজ, যা দীনের সফরে জায়েয নয়।” এটা মোটেই ঠিক নয়। প্রথমত : হালাল পন্থায় রিজিক তলব করা ইসলামের দৃষ্টিতে ইবাদত এবং পুণ্যের কাজ। এই পুণ্য থেকে দূরে থাকা মোটেই ঠিক নয়। দ্বিতীয়ত : হযরত ইব্রাহীম (আ:)-এর দোয়া অনুসারে ব্যবসাও হজ্জের উদ্দেশ্যের সাথে সম্পৃক্ত। হজ্জ আদায়কারী অথবা এর সহায়তা দানকারীদের মাঝে অবশ্যই কোন না কোনভাবে ব্যবসায়িক মনোভাব বিদ্যমান থাকে। তাই মক্কা নগরীর অধিবাসীদের উন্নতি, আবাদী এবং স্থিতিশীলতা ব্যবসা ছাড়া মোটেই সম্ভব নয়। অর্থাৎ হজ্জের একটি উদ্দেশ্য এই যে, খানায়ে কা’বার হেফাজত এবং খেদমতের জন্য এই শহরের বাসিন্দাদের আবাদী ও সৌন্দর্য কায়েম থাকতে হবে। এর বড় উপায় হচ্ছে তেজারত ও ব্যবসা। মূলত : এই স্থানটি যেন মুসলমানদের বিশ্বজনীন তেজারত ও কায়-কারবারের প্রাণকেন্দ্র এবং মুসলিম বিশ্বের শিল্পসমূহের বাৎসরিক প্রদর্শনী কেন্দ্র। যার অতীত নমুনা আজও অবিকল অভঙ্গুর রয়েছে। এমন কোন মুসলিম দেশ রয়েছে কি? যার শিল্পকর্ম পবিত্র মক্কায় দেখতে পাওয়া যায় না? কিন্তুু বড়ই আফসুসের বিষয়, বর্তমানকালের মুসলমানগণ এই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টির কথা যেন বেমালুম ভুলে গেছে। যার ফলে কিছু সংখ্যক অমুসলিম দেশের ব্যবসায়িক কূট- কৌশলের ফাঁদে মুসলিম ব্যবসায়ীরা আটকা পড়ে গেছেন বলেই অবস্থা দৃষ্টে মনে হয়। এরই ফলশ্রæতিতে পরিণাম এই দাঁড়িয়েছে যে, একদিন মক্কা ছিল মুসলিম শিল্পের শ্রেষ্ঠকেন্দ্র এবং সর্বোৎকৃষ্ট প্রদর্শনী, তা-ই আজ ইউরোপের শিল্পের প্রধান বাজারে পরিণত হয়েছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর এই অবস্থার আরও অবনতি হতে চলেছে।
(চলবে)