হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির খড়গ : আসামের এনআরসি এবং বাংলাদেশ
কিশোর শিক্ষার্থীদের নিরাপদ সড়ক দাবীর আন্দোলনে ঢাকাসহ সারাদেশে তীব্র রাজনৈতিক উত্তেজনা ও অনিশ্চয়তা দেখা যাচ্ছিল,
বিচার বিভাগ, বিশেষ করে উচ্চ আদালত এবং সরকারের এই বিরোধ শেষ পর্যন্ত কোথায় গিয়ে শেষ হবে সেটি এখন কেউ বলতে পারছেন না। উচ্চ আদালত, বিশেষ করে প্রধান বিচারপতির বিরুদ্ধে সরকারি দল মনে হয় রীতিমতো ক্রুসেডে নেমেছে। এমন কোনো দিন নেই যেদিন আওয়ামী লীগ বা সরকারের কোনো না কোনো মন্ত্রী বা বড় নেতা প্রধান বিচারপতির বিরুদ্ধে বিষ উদ্গীরন না করছেন। প্রথমে শুরু হয়েছিল জাতীয় সংসদের অধিবেশনে এই বিষোদগার। প্রধানমন্ত্রীর উপস্থিতিতে আওয়ামী লীগের সমস্ত বড় বড় নেতা এবং মন্ত্রী হেন কোনো আক্রমণ নেই যেটা তারা করেননি। মতিয়া চৌধুরী ছাত্র ইউনিয়ন এবং কমিউনিস্ট পার্টি বা ন্যাপ থেকে আওয়ামী লীগে জয়েন করলেও এখন তিনি প্রধানমন্ত্রীর অত্যন্ত আস্থাভাজন। কিন্তু তারা যখন কারো কোনো সমালোচনা করেন তখন লাগাম ছেড়ে দেন। মতিয়া চৌধুরী এতদূরও বলেছেন যে, পাকিস্তান নাকি প্রধান বিচারপতি এসকে সিনহার নিকট রোল মডেল। তিনি পরোক্ষভাবে তাকে পাকিস্তানপন্থী হিসেবে চিত্রিত করার চেষ্টা করেছেন। সবচেয়ে দুর্ভাগ্যজনক ব্যাপার হলো এই যে, কারো অ্যাকশন যদি প্রত্যক্ষভাবে হোক অথবা পরোক্ষভাবে হোক, আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে যায় তাহলে সাথে সাথে তার পেছনে পাকিস্তানের এজেন্টের ছাপ মেরে দেওয়া হয়। ২০ অগাস্ট রবিবার একটি পত্রিকায় দেখলাম, বদরুদ্দীন উমরের একটি নিবন্ধ। তাকেও রাজাকারের তকমা দেওয়ার চেষ্টা করা হয়েছে। ইংরেজিতে একটি কথা আছে। সেটি হলো, ‘টু হিট বিলো দি বেল্ট’। অর্থাৎ কোমরের নিচে আঘাত করা। দুর্ভাগ্যজনক বিষয় হলো এই যে, প্রধান বিচারপতির মতো একটি সর্বোচ্চ সন্মানজনক পদবীধারী ব্যক্তিকেও যে ভাষায় আক্রমণ করা হচ্ছে সেটি কোনো সন্মানজনক ভাষা নয়। অপু উকিল বলে আওয়ামী লীগে একজন মহিলা নেত্রী রয়েছেন। গতবার তিনি সংরক্ষিত কোটায় এমপি হয়েছিলেন। এবার তিনি এমপি হয়েছেন কিনা সেটি আমার জানা নেই। তিনি আওয়ামী লীগের আরেক নেতা, সাবেক ছাত্রলীগ নেতা অসীম কুমার উকিলের স্ত্রী। এই ভদ্র মহিলা এতদূরও বলেছেন যে, সুরেন্দ্র কুমার সিনহা নাকি হিন্দু নন। প্রশ্ন জাগে, তাহলে তার ধর্ম কি? তিনি কি মুসলমান? তিনি অবশ্যই সনাতন ধর্মের লোক। বাংলাদেশের মানুষ যে কত বড় অসাম্প্রদায়িক তার সবচেয়ে বড় প্রমাণ হলো এই যে, একজন সনাতন ধর্মের মানুষ দেশের প্রধান বিচারপতি হয়েছেন। এ নিয়ে কেউ টু-শব্দ করেনি। শুধু তাই নয়। আজ যখন তার বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগ সারাদেশে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে তখন যেসব দল এবং নেতা এবং লক্ষ লক্ষ মানুষ, যারা ইসলামী মূল্যবোধ এবং বাংলদেশি জাতীয়তাবাদে বিশ্বাস করেন, তারা তার পেছনে এসে দাঁড়িয়েছেন। সাম্প্রদায়িকতা তাদেরকে এতটুকু স্পর্শ করতে পারেনি। অথচ, এখন সরকারি দলের নেতারাই তাকে পাকিস্তানপন্থী বলছেন এবং অপু উকিলের মতো হিন্দু ধর্মাবলম্বীও বলছেন যে, সুরেন্দ্র কুমার সিনহা হিন্দু নন।
আওয়ামী লীগ যখন বিরোধী দলে থাকে তখন বিচার বিভাগের স্বাধীনতা অসাম্প্রদায়িকতা, বিচার বিভাগ থেকে রাজনীতিকে সম্পূর্ণ আলাদা রাখা ইত্যাদি গাল ভরা বুলি আওড়ায়। কিন্তু ক্ষমতায় গেলেই তার ভোল সম্পূর্ণ পাল্টে যায়। একথা অবিশ্বাস্য হলেও সত্য যে, এক সময়কার ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগের অন্যতম নেতা এবং বর্তমানে খাদ্যমন্ত্রী কামরুল ইসলাম ১৯ অগাস্ট শনিবার বলেছেন যে, এই আওয়ামী লীগ আমলেই ১৯৯৯ সালে সুরেন্দ্র কুমার সিনহাকে রাজনৈতিক বিবেচনায় বিচারপতি নিয়োগ করা হয়েছে। তখন প্রধানমন্ত্রী ছিলেন শেখ হাসিনা। কামরুল ইসলাম বলেন যে, শেখ হাসিনা অনুভব করেছিলেন যে সংখ্যালঘু সম্প্রদায় থেকে হাইকোর্ট ও সুপ্রিম কোর্টে বিচারক নেওয়া দরকার। সেই বিবেচনাতেই তিনি এসকে সিনহাকে হাইকোর্টের বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ দান করেন। এই খবরটি ছাপা হয়েছে রবিবার দৈনিক ‘প্রথম আলোর’ দ্বিতীয় পৃষ্ঠায়। এখানে কামরুল ইসলাম উকিল হওয়া সত্তে¡ও একটি আইনগত ভুল ধারণা দিয়েছেন। আইনজীবী হিসাবে তিনি বিলক্ষণ জানেন যে, বিচারপতি নিয়োগ দেন প্রেসিডেন্ট। আর অন্যান্য বিচারপতিকেও নিয়োগ দেন প্রেসিডেন্ট। তবে তার আগে তাদের নাম রেকমেন্ড করে চিফ জাস্টিস প্রেসিডেন্টের কাছে পাঠান। চিফ জাস্টিসের সুপারিশকৃত নামগুলো থেকেই প্রেসিডেন্ট চূড়ান্তভাবে বিচারপতি নির্বাচন করেন। এক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রী যদি কোনো প্রভাব বিস্তার করতে চান তাহলে তাকে সেটা করতে হয় পরোক্ষভাবে। কিন্তু প্রত্যক্ষভাবে বা সরাসরি প্রধানমন্ত্রী কোনো বিচারক নিয়োগ দিতে পারেন না। অন্তত সংবিধানে সেই ব্যবস্থা নেই। এ ব্যাপারে সংবিধানের বিধান অত্যন্ত স্পষ্ট। সংবিধানের ৯৫ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘প্রধান বিচারপতি রাষ্ট্রপতি কর্তৃক নিযুক্ত হইবেন এবং প্রধান বিচারপতির সহিত পরামর্শ করিয়া রাষ্ট্রপতি অন্যান্য বিচারককে নিয়োগ দান করিবেন।’ এখানে কোথাও প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে প্রধানমন্ত্রীর ভূমিকা সম্পর্কে কোনো কিছু উল্লেখ নেই। এখানে প্রধানমন্ত্রীর কথা কামরুল ইসলাম কোত্থেকে পেলেন সেটি তিনিই জানেন।
\ দুই \
অবশ্য কামরুল ইসলামের পক্ষে সব কিছুই বলা সম্ভব। এই কামরুল ইসলামই কিছু দিন আগে প্রধান বিচারপতিকে একটি আল্টিমেটাম দিয়েছেন। সেই চরমপত্রে তিনি বলেছেন যে, প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা যদি এক মাসের মধ্যে পদত্যাগ না করেন তাহলে এক মাস পর তার পদত্যাগের জন্য তুমুল আন্দোলন করা হবে। আইনকানুন সম্পর্কে যাদের সাধারণ জ্ঞান আছে এবং যারা রাষ্ট্রীয় ব্যাপার-স্যাপার সম্পর্কে সামান্যতম ধারণাও রাখেন তারা জানেন যে, বিচার বিভাগ বিশেষ করে উচ্চ আদালত এবং তার বিচারপতি সম্পর্কে কোনো রকম হুমকি-ধামকি দেওয়া যায় না। যারা এই রকম বেপরোয়া উক্তি করেন তাদের তাৎক্ষণিকভাবে গ্রেফতার করা উচিত এবং আদালত অবমাননার দায়ে তাদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা উচিত।
আর একজন সাবেক মন্ত্রী হলেন সাহারা খাতুন। তিনি ছিলেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। যখন তিনি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ছিলেন তখন সাগর-রুনি খুন হয়। তিনি অকুস্থলে গিয়ে ঘোষণা করেন যে, ৪৮ ঘণ্টার মধ্যেই খুনিদেরকে গ্রেফতার করা হবে। তারপর ৪৮ ঘণ্টা তো দূরের কথা, ৪ বছর পার হয়ে গেছে। আজ পর্যন্ত খুনিদের টিকিটিও স্পর্শ করা যায়নি। সেই সাহারা খাতুন সেদিন আইনজীবীদের সমাবেশে দাবি করেছেন যে, প্রধান বিচারপতি সিনহাকে অবিলম্বে পদত্যাগ করতে হবে। যদি তিনি পদত্যাগ না করেন তাহলে তার অফিস এবং বাসভবন ঘেরাও করা হবে। একজন প্রাক্তন মন্ত্রী, তাও আবার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, কীভাবে বলেন যে, প্রধান বিচারপতির অফিস এবং বাসভবন ঘেরাও করা হবে? প্রধান বিচারপতির বাসভবন তো দূরের কথা, জনতাকে তার বাসভবনের ত্রিসীমানাতেও ঘেঁষতে দেওয়া হয় না। এটিই নিয়ম। দীর্ঘকাল ধরে সারা পৃথিবীতে এই নিয়মটিই চলে আসছে। যারা এই নিয়মটি ভঙ্গ করে তাদেরকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কঠোর হস্তে দমন করে। কিন্তু বাংলাদেশে এখন পর্যন্ত দেখা যাচ্ছে যে, কামরুল ইসলাম বা সাহার খাতুনের কেশাগ্রও স্পর্শ করা হয়নি।
\ তিন \
কার কথা বলবো, আর কার কথা বলবো না। ব্যারিস্টার ফজলে নূর তাপস খুব ভোকাল নন। কিন্তু আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরে তিনি অত্যন্ত প্রভাবশালী ব্যক্তি। তিনি মরহুম শেখ ফজলুল হক মণির পুত্র। সেই তাপস সাহেবও সুপ্রিম কোর্ট প্রাঙ্গণে প্রধান বিচারপতির বিরুদ্ধে বিক্ষোভ কর্মসূচি চালিয়ে যাচ্ছেন এবং সারাদেশে প্রধান বিচারপতি বিরোধী বিক্ষোভ ছড়িয়ে দিচ্ছেন। তাপস সাহেবের প্রতি পূর্ণ শ্রদ্ধা রেখেই বলছি, তিনি তো একজন ব্যারিস্টার এবং তিনি লন্ডন থেকে ব্যারিস্টারি পাশ করে এসেছেন। তিনি তো ভালো করেই জানেন যে, চিফ জাস্টিস বা উচ্চ আদালতের বিচারপতিদের বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে কোনো আন্দোলন বা বিক্ষোভ করা যায় না। তারপরেও তো এগুলো হচ্ছে।
আমরা জানি না, আওয়ামী লীগ তথা সরকার এখন কী চায়? তারা কি চায় যে এসকে সিনহা আর প্রধান বিচারপতি না থাকুন? কিন্তু সেটি কীভাবে সম্ভব? প্রধান বিচারপতি সিনহা যদি নিজ থেকে সরে না যান তাহলে কীভাবে তাকে অপসারণ করবেন? আমি কোনো উকিল-মোক্তার বা ব্যারিস্টার নই। তবে আমার ক্ষুদ্র জ্ঞান দিয়ে আমি বাংলাদেশের সংবিধান পড়েছি। একবার নয়, কয়েক বার পড়েছি। আমি যেটুকু বুঝেছি তাতে মনে হয় যে, প্রেসিডেন্ট প্রধান বিচারপতিকে নিয়োগ দিতে পারেন। কিন্তু একবার নিয়োগ দেওয়ার পর আর তাকে সরানো যায় না। ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের পর সেই রাস্তা তো চিরতরে বন্ধ হয়ে গেছে। ইতোমধ্যেই সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল পুনরুজ্জীবিত হয়েছে। সেই সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলেরও প্রধান হলেন চিফ জাস্টিস। সদস্য হলেন পরবর্তী সিনিয়র মোস্ট দুইজন জাস্টিস। এই তিন জনই তো ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের রায়ে স্বাক্ষর করেছেন। তারা কীভাবে সিনহা সাহেবকে সরাবেন? কোন অভিযোগে?
কিন্তু বাজারে জোর গুজব যে এসকে সিনহার সাথে সরকারের সম্পর্ক চরম তিক্ততার পর্যায়ে চলে গেছে। তারা যে কোনো মূল্যে সিনহার কবল থেকে মুক্তি চায়। এজন্য সংবিধানের সমস্ত ফাঁক-ফোকর খোঁজা হচ্ছে। কোনো ফাঁক গলে যদি চিফ জাস্টিসের আসনটি শুন্য করা যায়। অনেক খোঁজা-খুঁজি করে সন্ধান পাওয়া গেছে সংবিধানের ৯৭ অনুচ্ছেদ। এই অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘প্রধান বিচারপতির পদ শূন্য হইলে কিংবা অনুপস্থিত, অসুস্থতা বা অন্য কোন কারণে প্রধান বিচারপতি তাঁহার দায়িত্ব পালনে অসমর্থ বলিয়া রাষ্ট্রপতির নিকট সন্তোষজনকভাবে প্রতীয়মান হইলে ক্ষেত্রমত অন্য কোন ব্যক্তি অনুরূপ পদে যোগদান না করা পর্যন্ত কিংবা প্রধান বিচারপতি স্বীয় কার্যভার পুনরায় গ্রহণ না করা পর্যন্ত আপীল বিভাগের অন্যান্য বিচারকের মধ্যে যিনি কর্মে প্রবীণতম, তিনি অনুরূপ কার্যভার পালন করিবেন।’
এই অনুচ্ছেদ থেকে দেখা যাচ্ছে, প্রধান বিচারপতি যদি অনুপস্থিত থাকেন, অথবা অসুস্থ থাকেন অথবা দায়িত্ব পালনে অসমর্থ হন একমাত্র তখনই তিনি সাময়িক ছুটিতে যেতে পারেন। তাও ছুটি থেকে ফিরে এসে আবার তিনি দায়িত্ব গ্রহণ করবেন।
বর্তমান প্রধান বিচারপতির চাকরি আছে আর মাত্র ৬ মাস। এখন পর্যন্ত তিনি অসুস্থ নন, অনুপস্থিত নন এবং দায়িত্ব পালনে অসমর্থও নন। সুতরাং তার রিপ্লেসমেন্টও সম্ভব নয়। তার ক্ষেত্রে ৯৭ অনুচ্ছেদ প্রযোজ্য নয়। সরকারকে এভাবেই চলতে হবে আরও ৬ মাস। তবে প্রশ্ন হলো, সরকারের এই প্রচন্ড চাপ কি এসকে সিনহা সহ্য করতে পারবেন? পারলে কতদিন? যদি পারেন তাহলে এক কথা। আর যদি না পারেন তাহলে বাংলাদেশের বিচার বিভাগের ইতিহাস, বিশেষ করে উচ্চ আদালতের ইতিহাস, আগামীতে অন্যভাবে লেখা হবে।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।