Inqilab Logo

শুক্রবার, ০৫ জুলাই ২০২৪, ২১ আষাঢ় ১৪৩১, ২৮ যিলহজ ১৪৪৫ হিজরী

চীন ও ভারত কি যুদ্ধের দ্বারপ্রান্তে

দোকলাম নিয়ে ঝাঁকুনি খেয়েছে দিল্লী প্রশাসন

| প্রকাশের সময় : ১৯ আগস্ট, ২০১৭, ১২:০০ এএম

ইনকুইজিটর ও গেøাবাল টাইমস : গত দু’মাস ধরে দুই পারমাণবিক শক্তিধর দেশ চীন ও ভারত বিরোধে জড়িয়ে পড়েছে যা উত্তর কোরিয়ার পারমাণবিক হুমকির কারণে অনেকটাই নজর এড়িয়ে গেছে। মধ্য জুনে চীনের পিপলস লিবারেশন আর্মির সাথে নির্মাণ কর্মীরা দোকলাম মালভূমিতে রাস্তা নির্মাণ শুরু করলে এ বিরোধ সৃষ্টি হয়। চীনা বিশ্লেষকরা বলছেন, দোকলাম নিয়ে চীনের সাথে বিরোধের কারণে দক্ষিণ এশিয়ায় ভারতের কর্তৃত্ব ঝাঁকুনি খেয়েছে। অন্যদিকে দোকলাম পরিস্থিতির প্রেক্ষিতে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে- চীন ও ভারত কি যুদ্ধের দ্বারপ্রান্তে?
ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মতে, চীনারা মাটি অপসারণের নির্মাণ যান ও অন্যান্য সরঞ্জাম নিয়ে ঐ এলাকায় প্রবেশ করে। তারপর তারা ঐ বিচ্ছিন্ন অঞ্চলে, যেখানকার অধিবাসীরা বেশিরভাগ ভুটানের মেষপালক এবং যা ক্ষুদ্র দেশটিরই অংশ, রাস্তা নির্মাণের চেষ্টা করে। পিএলএ ক্রুরা রাজকীয় ভুটান সেনাবাহিনীর একটি টহল দলের বাধার সম্মুখীন হয়। দু’দিন পর ভারতীয় সৈন্যরা ঐ এলাকায় পৌঁছে ও অবস্থান নেয়। তখন থেকে শত শত ভারতীয় সৈন্য চীনা সৈন্যদের বিপরীতে মুখোমুখি অবস্থানে রয়েছে।
ভারত ও ভুটান দীর্ঘদিনের বন্ধু। ভারত থিম্পুকে সামরিক সহায়তা দেয়। এক বিশ্লেষণে বলা হয় যে গত ১৭ বছর যাবত ভুটান ভারতের সবচেয়ে বড় বৈদেশিক ঋণ গ্রহিতা। ভুটান বিকাশমান জলবিদ্যুত শক্তি হওয়ায় ও কৌশলগত গুরুত্বপূর্ণ অবস্থানের কারণে ভারত এ ক্ষুদ্র দেশটিকে মূল্য দেয়।
দোকলাম নিয়ে বিরোধ শুরু হওয়ার পর দু’পক্ষ ভিন্ন ভিন্ন বক্তব্য দিয়েছে। চীন ও ভারতের মধ্যকার সম্পর্ক কয়েক দশকের মধ্যে সর্বনি¤œ পর্যায়ে পৌঁছেছে। ভারত বলেছে, এ সরক নির্মিত হলে তা চীনা সৈন্যদের শিলিগুড়ি করিডোরের কাছে নিয়ে আসবে যে সংকীর্ণ স্থান উত্তর পূর্ব ভারতকে দেশের বাকি অংশের সাথে সংযুক্ত রেখেছে। এদিকে চীন বলেছে যে দু’শরও বেশি সশস্ত্র ভারতীয় সৈন্য বুলডোজার নিয়ে চীনা ভূখন্ডের ১শ’ গজ অভ্যন্তরে অবস্থান করছে।
মঙ্গলবার এ বিরোধের বিস্তৃতির কথা জানা যায়। সীমান্তে সামরিক পরিস্থিতি বিষয়ে জ্ঞান রাখেন নয়া দিল্লীর এমন একটি সূত্র জানান যে দু’পক্ষ খন্ডযুদ্ধে লিপ্ত হয়েছিল। মনে হয়, লোহার রড ও পাথর নিয়ে চীনা সৈন্যদের একটি দল জম্মু ও কাশ্মীরের লাদাখ সীমান্ত অতিক্রম করে ভারতে ঢোকে। দু’পক্ষের মধ্যে তর্কাতর্কি ও পাথর ছোঁড়াছুড়িতে কয়েকজন সামান্য আহত হয়।
ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সুষমা স্বরাজ বলেছেন, দু’পক্ষের মধ্যে সংলাপের মাধ্যমেই শুধু এ বিরোধের নিরসন হতে পারে। তবে চীন দোকলাম এলাকায় একটি সড়ক নির্মাণে তার অধিকার রক্ষায় দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। চীন ও ভারতের মধ্যে ২,২০০ মাইল সীমান্ত নিয়ে এখনো বিরোধ রয়েছে। উল্লেখ্য, দু’দেশের মধ্যকার সীমান্ত বিরোধে এই প্রথমবার ভুটান জড়িয়ে পড়েছে।
চীন সাম্প্রতিক এই সীমান্ত বিরোধকে তার আঞ্চলিক অখন্ডতার প্রতি সরাসরি হামলা বলে আখ্যায়িত করায় আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকরা বেশি উদ্বিগ্ন। লন্ডনের রয়াল সার্ভিস ইন্সটিটিউটের বিশ্লেষক শশাংক যোশি বলেছেন, বিরোধের বিস্তৃতির আশংকা উড়িয়ে দেয়া আত্মতুষ্টি হবে। এ ঘটনা এমন সময়ে ঘটল যখন চীন এশিয়ায় তার প্রভাব ও সামরিক শক্তি জোরদার করতে চাইছে এবং অনেকেই ভারতকে সে দেশ হিসেবে দেখছেন যে চীনকে ঠেকাতে পারে।
এদিকে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দোকলাম বিরোধের কারণে ভারতের আঞ্চলিক আধিপত্য ঝাঁকুনি খেয়েছে। কারণ, দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলো যেগুলোর কয়েকটি ভারতের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে, তারা হয় নিরপেক্ষ রয়েছে অথবা চীনের পক্ষে কথা বলেছে।
সাংহাই সমাজ বিজ্ঞান একাডেমির আন্তর্জাতিক সম্পর্ক ইনস্টিটিউটের গবেষণা ফেলো হু ঝিয়ং বলেন, নেপাল, বাংলাদেশ, শ্রীলংকা ও মালদ্বীপসহ দক্ষিণ এশিয়ার বহু দেশের পররাষ্ট্র নীতি প্রণয়নে সব সময়ই ভারতের জোর প্রভাব রয়েছে। ভারত যখন সীমান্তে চীনকে উস্কানি দিচ্ছে তখন এসব দেশের কৌতূহলোদ্দীপক প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে যে দক্ষিণ এশিয়ায় ভারতের কর্তৃত্ব দৃঢ় নয় এবং এ সব দেশ ভারতের নিয়ন্ত্রণকে ঝাঁকুনি দেয়ার সুযোগ নিতে চায়।
সিনহুয়া বার্তা সংস্থার খবরে বলা হয়, বুধবার চীন ও নেপাল তাদের মধ্যে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক আরো জোরদার করতে বিশেষ করে চীন প্রস্তাবিত বেল্ট অ্যান্ড রোড উদ্যোগ কাঠামোর আওতায় দ্বিপাক্ষিক বাস্তবসম্মত সহযোগিতা বৃদ্ধি করতে সম্মত হয়েছে।
সফররত চীনা উপ প্রধানমন্ত্রী ওয়াং ইয়াং-এর সাথে এক বৈঠকে নেপালের প্রেসিডেন্ট বিদ্যা দেবী ভান্ডারি নেপালের জাতীয় উন্নয়ন ও বিপর্যয় উত্তর পুনর্গঠনে চীনের অব্যাহত সমর্থন ও সাহায্যের প্রশংসা করেন।
ভান্ডারি আরো উল্লেখ করেন যে চীন ও নেপালের মধ্যে বিভিন্ন ক্ষেত্রে উচ্চ পর্যায়ে যোগাযোগ ও দ্বিপক্ষীয় সহযোগিতা অব্যাহত থাকবে। নেপাল এক চীন নীতিতে অটল থাকবে বলে ভান্ডারি অঙ্গীকার করেন। তিনি বলেন, নেপাল তার মাটিতে কখনো চীন-বিরোধী তৎপরতা চালাতে দেবে না।
নেপালের পূর্ব সীমানা দোকলাম মালভূমি থেকে মাত্র কয়েক ডজন কিলোমিটার দূরে অবস্থিত।
ডিপ্লোম্যাট ম্যাগাজিনের সিনিয়র সম্পাদক বুধবার নয়া দিল্লী টেলিভিশনকে বলেন যে চীন জানে যে ক্ষুদ্র এশীয় দেশগুলোর সাথে তার চেকবুক কূটনীতি ভারতের জন্য একটি যন্ত্রণাদায়ক ব্যাপার।
চীনা বিশেষজ্ঞরা বলেন, ভারতের এলিটরা তাদের হিংসা প্রদর্শন করবে তাতে বিস্ময়ের কিছু নেই।
হু বলেন, ভারত কখনোই তার ক্ষুদ্র প্রতিবেশীদের সাথে সমতার আচরণ করেনি। ১৯৭৫ সালে সিকিমকে ভারতের অন্তর্ভুক্ত করার জন্য সে তার বিরাট সামরিক শক্তি ও প্রভাব ব্যবহার করে। নেপাল ২০১৫ সালে একটি নতুন সংবিধান কার্যকর করায় তাকে শাস্তি দিতে ভারত তার বিরুদ্ধে তেল অবরোধ আরোপ করে। ভারতের কর্তৃত্বের কারণে ভুটানের স্বাধীন কূটনীতিও নেই।
তিনি বলেন, ভারতের নিয়ন্ত্রণে থাকার কারণে চীন বা জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের আর কোনো সদস্য দেশের সাথে ভুটানের কূটনৈতিক সম্পর্ক নেই। দেশটিতে চীনের বেল্ট অ্যান্ড রোড বিনিয়োগও এ পর্যন্ত হয়নি।
হু বলেন, পাকিস্তান ছাড়া আর কোনো দক্ষিণ এশীয় দেশ ভারতকে না বলার সাহস করে না। তার মানে এই নয় যে এ সব দেশ ভারতের নিয়ন্ত্রণে ঝাঁকুনি দিতে চায় না। তারা জানে, ভারত ও চীনের মধ্যে কিভাবে এক নির্ভরযোগ্য অংশীদার গ্রহণ করতে হয়।
তিনি বলেন, বেল্ট অ্যান্ড রোড উদ্যোগ থেকে দক্ষিণ এশিয়ার বহু দেশ লাভবান হয়েছে। চীন-পাকিস্তান অর্থনৈতিক করিডোরের ফ্ল্যাগশিপ প্রকল্প থেকে পাকিস্তান সুফল পাবে। নেপাল, শ্রীলংকা , বাংলাদেশ ও মালদ্বীপ ও চীনের এ বিনিয়োগ ও অবকাঠামো প্রকল্পকে স্বাগত জানিয়েছে। এ সব দেশ দোকলাম বিরোধে নিরপেক্ষ রয়েছে। আর পাকিস্তান পরিষ্কার ভাবে চীনের প্রতি সমর্থন জানিয়েছে।
পাকিস্তানের সংবাদপত্র ডন জানায়, প্রেসিডেন্ট মামনুন হোসেন সোমবার চীনা ভূখন্ডে ভারতের অনুপ্রবেশের খবরে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। তিনি বলেন, পাকিস্তান এ ব্যাপারে চীনের অবস্থানকে পূর্ণভাবে সমর্থন করে।
মামনুন হোসেন প্রেসিডেন্ট হাউসে চীনের উপ প্রধানমন্ত্রী ওয়াং ইয়াংয়ের সাথে বৈঠক কালে বিষয়টি দক্ষতার সাথে মোকাবেলা করার জন্য চীনের প্রশংসা করেন। এক বিবৃতিতে তিনি তিব্বত স্বায়ত্ত শাসিত অঞ্চল, জিনজিয়াং উইঘুর স্বায়ত্ত শাসিত অঞ্চল ও দক্ষিণ চীন সাগর বিষয়ে চীনের পাশে থাকার পাকিস্তানের অবস্থান পুনর্ব্যক্ত করেন।
ভিত্তিহীন আস্থা
চীনা সমাজ বিজ্ঞান একাডেমির অধীনে ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব ইন্টার ন্যাশনাল স্ট্র্যাটেজির পরিচালক ইয়ে হাইলিন বৃহস্পতিবার গেøাবাল টাইমসকে বলেন, ভারতের তার নিজের ক্ষমতার উপর জোর আত্মবিশ^াস রয়েছে, বিশেষ করে নরেন্দ্র মোদি প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর। যদিও বিগত বছরগুলোতে ভারতের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি চীনের চেয়ে দ্রæততর। তা সত্তে¡ও ভারতের অর্থনীতি বিশে^র সপ্তম স্থানে রয়েছে এবং তার আকার চীনা অর্থনীতির এক পঞ্চমাংশ।
ইয়ে বলেন, ভিত্তিহীন আত্মবিশ^াসের জন্য ভারতকে ভীষণ মূল্য দিতে হবে। তিনি বলেন, ভারতের বৈশি^ক প্রভাব চীনের সাথে প্রতিযোগিতা করতে পারবে না, এমনকি দক্ষিণ এশিয়ায়ও নয়। চীন যদি ভারতকে এক প্রতিদ্ব›দ্বী হিসেবে চিহ্নিত করে থাকে তাহলে ভারতের কঠিন সময়ের সবে শুরু হয়েছে।

 



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ