Inqilab Logo

সোমবার, ০৮ জুলাই ২০২৪, ২৪ আষাঢ় ১৪৩১, ০১ মুহাররম ১৪৪৬ হিজরী

২৫ জেলায় বানভাসি মানুষের দুর্ভোগ : ত্রাণের জন্য হাহাকার

পঞ্চায়েত হাবিব | প্রকাশের সময় : ১৭ আগস্ট, ২০১৭, ১২:০০ এএম

সরকারি ত্রাণ তৎপরতা কম
দেশের ২৫টি জেলা এখন বন্যার কবলে। তিস্তা, ধরলা ও ব্রহ্মপুত্র নদের পানি কিছুটা কমলেও উত্তরাঞ্চলজুড়ে বানভাসী মানুষের দূর্ভোগ বেড়েছে। আশ্রয় কেন্দ্রে আশ্রিত বানভাসীদের আশ্রয়ের ৫ দিন অতিবাহিত হয়েও গতকাল বুধবার পর্যন্ত অনেক জেলায় সরকারি বা বেসরকারি ভাবে এক মুঠো ত্রাণ সামগ্রী পৌঁছেনি তাদের মাঝে। তাই তারা অর্ধাহারে-অনাহারে দিনাতিপাত করছে।
চলতি বন্যায় দেশের ৯৬ উপজেলার ৬২৩ ইউনিয়নের সাত লাখ ৫২ হাজার ৩৪৯টি পরিবারের ৩৩ লাখ লোক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ২২ জেলা এখন বন্যার কবলে এবং ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের সংখ্যা এখন ৩৩ লাখ ২৭ হাজার বলে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তরের তথ্য। এবছর দ্বিতীয় দফা বন্যা উত্তর ও উত্তর-পূর্বাঞ্চল ছাড়িয়ে এখন মধ্যাঞ্চলে বিস্তৃত হচ্ছে। উত্তর ও উত্তর-পূর্বাঞ্চলে বন্যা এবং প্রাকৃতিক দুর্যোগে এই পর্যন্ত ১০৭ জনের মৃত্যু হয়েছে বলে জানিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তরের নিয়ন্ত্রণ কক্ষের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা নাজনীন শামীমা ইনকিলাবকে জানান, বিকাল ৫টা পর্যন্ত মাঠ কর্মকর্তাদের কাছ থেকে ক্ষতিগ্রস্ত ২২ জেলার তথ্য পেয়েছেন । এসব জেলায় বন্যায় ৮ লাখ ৭০ হাজার ৫২টি পরিবারের ৩৩ লাখ ২৬ হাজার ৮৬৪ জন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। যদিও বেসরকারিভাবে মৃত্যুর সংখ্যা আরো বেশি বলে জানা গেছে। তবে দেশের বিভিন্ন উপজেলা ও ইউপি চেয়ারম্যান অভিযোগ করেছেন সরকারি ত্রাণ পযাপ্ত নয়। যা দেয় তা সকালের খাবার হলে বিকেলে হয়না।
বন্যার্তদের জন্য সরকারের ত্রাণ তৎপরতা নেই বলে অভিযোগ করেছেন বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম-মহাসচিব অ্যাডভোকটে রুহুল কবির রিজভী। তিনি বলেন, বন্যায় মানুষ খাদ্য পাচ্ছে না। আর চাঁদা তুলে খিচুড়ি রান্না করে শোকের নামে উৎসব হচ্ছে। এদিকে গত ৩ আগষ্ট থেকে ১৬ আগষ্ট পর্যন্ত ৪০ জেলায় ৪হাজার ৪’শ৫০ মে:টন চাল এবং এক কোটি ৭৪ লাখ ৫০ হাজার টাকা দেয়া হয়েছে বলে মন্ত্রণালয় থেকে জানানো হয়েছে। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের ভারপ্রাপ্ত সচিব গোলাম মোস্তফা ইনকিলাবকে বলেন, দেশের উত্তরাঞ্চলের মানুষজন নদী পাড়ি দিতে এবং সাঁকো ব্যবহারে অভ্যন্ত নয়। তাদের অনেকে সাঁতারও জানেন না। এ কারণেই বেশির ভাগ মৃত্যু হয়েছে। সচিব জানান, দিনাজপুর, রংপুর, কুড়িগ্রাম, লালমনিরহাট, নীলফামারীসহ উত্তরাঞ্চলের ২২টি জেলা বন্যাকবলিত। তিনি জানান, বন্যার সর্বশেষ পরিস্থিতি জানাতে মন্ত্রণালয়ে দুটি নিয়ন্ত্রণকক্ষ খোলা হয়েছে। তিনি বলেন, বন্যা প্রলম্বিত হলেও সরকারের পর্যাপ্ত প্রস্ততি আছে। যথেষ্ট পরিমাণ ত্রাণ রয়েছে এবং তা সরবরাহ করা হবে। শুকনা খাবার বিতরণ অব্যাহত আছে।
সরকার ছয় লাখের মত মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত বললেও, বিভিন্ন জেলার ডিসিদের পাঠানো তথ্য যাচ্ছে মোট ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের সংখ্যা ১৫ লাখ ছাড়িয়ে গেছে এর মাঝে। বিভিন্ন এলাকায় স্কুল কলেজ মাদরাসায় আশ্রয় কেন্দ্র খোলা হয়েছে হাজার খানেক, যেগুলোতে এখন আর মানুষের ধারণক্ষমতাও নেই। বানের জল ধেয়ে যাচ্ছে আরও নতুন এলাকার দিকে। কুড়িগ্রামের উলিপুরে নদের পানি কিছুটা কমলেও বানভাসী মানুষের দূর্ভোগ বেড়েছে। আশ্রয় কেন্দ্রে আশ্রিত বানভাসীদের আশ্রয়ের ৫ দিন অতিবাহিত হয়েও গতকাল বুধবার পর্যন্ত সরকারি বা বেসরকারি ভাবে এক মুঠো ত্রাণ সামগ্রী পৌঁছেনি তাদের মাঝে। তাই তারা অর্ধাহারে-অনাহারে দিনাতিপাত করছে। কোন সংবাদকর্মী তাদের খোঁজ-খবর নিতে গেলে ছুটে আসছে ত্রাণের আশায়। উলিপুর উপজেলার হাতিয়া ইউনিয়নের অনন্তপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, অনন্তপুর উচ্চ বিদ্যালয়, অনন্তপুর মহা বিদ্যালয় ও হাতিয়া ভবেশ আশ্রয় কেন্দ্র গতকাল সরেজমিনে ঘুরে বানভাসীদের এসব দূর্ভোগের কথাগুলো জানা যায়। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ঘোষিত ২৩টি আশ্রয় কেন্দ্রের মধ্যে উল্লিখিত ৩টি কেন্দ্রে প্রায় ৫ শতাধীক বন্যার্ত মানুষ গরু-বাছুর ছাগল-ভেড়া হাঁস-মোরগীসহ গাদাগাদি করে সববাস করতে দেখা গেছে। কলাতিপাড়া গ্রামের ৮০ বছরের বৃদ্ধ বাহের আলীর সঙ্গে কথা হয়। তিনি জানান, ধরলা ও ব্রহ্মপুত্র নদে তার শেষ সম্বল বাড়ী ভিটে টুকুও বিলীন হয়ে গেছে। বাঁধের রাস্তার পার্শ্বে ঝুপড়ী ঘরে বসবাস করতেন তিনি। সেখানেও ঠাঁই হয়নি তাঁর। অবশেষে অনন্তপুর আশ্রয় কেন্দ্রে ঠাঁই নেন। ৫ দিন অতিবাহিত হলেও এক মুঠো ত্রাণ জোটেনি তাঁর ভাঙ্গে। কম্পোপালের ঘাটের ৭০ বছরের সাবুল মিয়া, দাগারকুঠি গ্রামের ৭৮ বছরের বিষু চন্দ্র দাস,৭০ বছরের পঁচানী বালা, মাধব চন্দ্র দাস (৫০), কুকিল চন্দ্র দাস (৫০), সুদির চন্দ্র দাস (৩৫) ও কলাতিপাড়া গ্রামের নূরবক্ত (৫৫) একই কথা বলেন। এসব বানভাসী মানুষের দূর্ভোগের চিত্র স্ব-চক্ষে দেখলে দুমড়ে-মুছড়ে যায় হৃদয়। উলিপুর উপজেলা ধরলা,ব্রহ্মপুত্র ও তিস্তা নদী বেষ্টিত ৮টি ইউনিয়নের প্রায় ৬০ হাজার মানুষ স্বরণকালের এ ভয়াবহ বন্যার কবলে পড়েছে। এ নদী পাড়ের দূর্গত মানুষের দূর্ভোগ চরমে পৌঁছেছে। পাচ্ছেনা তারা শুকনো খাবার, বিশুদ্ধ পানি ও স্বাস্থ্য সেবা। এপর্যন্ত পানিতে ডুবে ও ভেসে ৩ জন মারা যাওয়ার খবর পাওয়া গেছে। সংশ্লিষ্ট স্বাস্থ্য বিভাগ মেডিকেল টিম গঠন করার কথা জানালেও মাঠ পর্যায়ে খুঁজে পাওয়া যায়নি তাদের। বন্যায় আক্রান্ত ইউনিয়ন গুলো হচ্ছে, দলদলিয়া, থেতরাই, গুনাইগাছ, বজরা, হাতিয়া, বুড়াবুড়ী, বেগমগঞ্জ ও সাহেবের আলগা। এর মধ্যে বেগমগঞ্জ ও সাহেবের আলগা ইউনিয়ন দু’টি ধরলা ও ব্রহ্মপুত্র নদ দ্বারা বেষ্টিত দ্বীপচর। এ দু’টি ইউনিয়নের মানুষ গুলোর দূর্ভোগ সব চেয়ে বেশী। অন্য ৬টি ইউনিয়নের সিংহ ভাগ তিস্তা, ধরলা ও ব্রহ্মপুত্র নদে বিলীন হয়ে গেছে। ভিটে-মাটি সহায় সম্বলহারা মানুষ গুলো দিশেহারা হয়ে পরেছে। উপজেলা নির্বাহী অফিসার মোহাম্মদ শফিকুল ইসলামের ভাষ্যমতে ৮টি ইউনিয়নের জন্য প্রাপ্ত বরাদ্দ ৫২ মেট্রিক টন চাল বিতরণের কথা বলা হলেও ভূক্তভোগীদের কাছে সঠিক ভাবে পৌঁছেনি বলে একাধীক সূত্রে জানা গেছে। হাতিয়া ইউ,পি চেয়ারম্যান আবুল হোসেন জানান, আমার ইউনিয়নে ৭-৮ হাজার মানুষ বন্যার কবলে পরেছে। আর আমাকে ৫ মেট্রিক টন চাল বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। ১০ কেজি করে ৫’শ মানুষকে বিতরণ করলে শেষ হরে। বাকী লোকদের কি দেব ? এছাড়া, হাতিয়া ইউনিয়নের দক্ষিণ সীমান্ত খেকে বুড়াবুড়ী ইউনিয়নের উত্তর সীমান্ত দলদলিয়া ইউনিয়নের বজরা ইউনিয়নের দক্ষিণ সীমান্ত পর্যন্ত প্রায় ৪০ কিঃমিঃ বাঁধের রাস্তায় ঠাঁই নেয়া কয়েক হাজার বানভাসী মানুষের আহাজারীর শেষ নেই।
বিভিন্ন জেলার প্রশাসকরাই খোদ বলছেন, এবারের বন্যার ভয়াবহতা এর আগের বন্যাগুলোকে ছাড়িয়েগেছে। কুড়িগ্রামের সদর উপজেলার বাসিন্দা বাসন্তী রানী তার পুরো পরিবার নিয়ে আশ্রয় নিয়েছেন হেলি-প্যাডে। কাছাকাছি আশ্রয় কেন্দ্রে এখন আর লোক ধারণের জায়গা নেই। তাই তিনদিন ধরে এভাবে হেলি-প্যাডের উঁচু জায়গায় কোনোরকমে দিন কাটাচ্ছে। আমার ঘরে এক-বুক পানি। আমি আমার ছেলে- মেয়ে স্বামীসহ তিনদিন ধরে এভাবে সাঁতরে আসছি। কোনো রকমে ছোট ছেলেকে এই দোকান থেকে কোনোমতে রুটি কিনে খাওয়াইছি। তার মত অনেকের পরিবার এখন এভাবে যে যেখানে পারছেন উঁচু জায়গায় গিয়ে আশ্রয় নিচ্ছেন। সরকারি হিসেবে বন্যায় দেশের বিভিন্ন এলাকায় মারা গেছে এ পর্যন্ত ৩২ জন। সবচেয়ে বেশি মানুষ মারা গেছে দিনাজপুর জেলাতে। কর্মকর্তারা বলছেন পানিতে ডুবে এবং সাপের কামড়েও মানুষের মৃত্যুর ঘটনা ঘটছে।
দিনাজপুর জেলা প্রশাসক মীর খায়রুল আলম ইনকিলাককে বলেন, সেখানে সেনাবাহিনীর সাহায্য নিয়ে উদ্ধার কাজ শুরু হয়েছে। এখন পর্যন্ত ৩৫৯টি আশ্রয়কেন্দ্র খুলেছি। এগুলোতে ১ লাখ ৭০ হাজারের বেশি মানুষকে আশ্রয় দেয়া হয়েছে। এ পর্যন্ত ১৪ জন মারা গেছে। বন্যা দূরবর্তী এলাকায় যারা পানি-বন্দী তাদের সেনাবাহিনীর সহায়তায় উদ্ধার করা হচ্ছে। সবচেয়ে বড় অনিরাপদ অবস্থায় রয়েছে শিশু নারী ও বয়স্করা। কিন্তু জুলাই মাসে একদফা বন্যার পর আগস্ট মাসের শেষে যে আবার বন্যা হতে পারে সে ধরনের আশঙ্কা ছিল। ডিসি বলছেন, সব ধরনের প্রস্তুতি থাকা সত্তে¡ও এবারের বন্যার ভয়াবহতা এর আগের বন্যাগুলোকে ছাড়িয়েগেছে।
লালমনিরহাট জেলার ডিসি বলেন, এবারের বন্যাটা ৮৮র বন্যাকে ছড়িগেছে। আগে যাদের বাসায় পানি ওঠেনি তাদের বাসাতেও এবার পানি উঠে মোটামুটি তারা পানি-বন্দী হয়ে গেছে। তিনি জানান, জেলায় ১০৮টি আশ্রয় কেন্দ্র খোলা হয়েছে। সেখানে প্রায় ত্রিশ হাজার মানুষ রয়েছে। এছাড়া দুই আড়াই হাজার গবাদি পশুকে নিরাপদে নিয়ে আসা হয়েছে। তবে এই কর্মকর্তা জানান, গরু-ছাগল, হাঁস-মুরগি ফেলে রেখে অনেকেই প্রাথমিকভাবে নিরাপদ আশ্রয় যেতে চায়না। একেবারে শেষমুহুর্তে পানির তীব্রতা দেখে ঘর ছাড়ছেন। কুড়িগ্রামের জেলা প্রশাসক আবু সালেহ ফেরদৌস খান ইনকিলাবকে বলেন, জেলার তিনশত আশ্রয় কেন্দ্রে ১৪ হাজারের ওপর মানুষ আশ্রয় নিয়েছে। এ জেলায় মৎস খামার পুকুরে মাছ ভেসে গেছে অনেক। গরু-ছাগল, হাঁস-মুরগি ফেলে রেখে অনেকেই প্রাথমিকভাবে নিরাপদ আশ্রয় যেতে চায়না।
বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম-মহাসচিব অ্যাডভোকটে রুহুল কবির রিজভী বলেন, বন্যার্তদের জন্য সরকারের ত্রাণ তৎপরতা নেই। বন্যায় মানুষ খাদ্য পাচ্ছে না। আর চাঁদা তুলে খিচুড়ি রান্না করে শোকের নামে উৎসব হচ্ছে। তিনি বলেন, অসংখ্য মানুষ এখনো পানিবন্দি এবং তারা যে রান্না করে খাবে, চাল-ডাল দিলেও কোনো কিছু করতে পারছে না। কোথাও থেকে রান্না করে নিয়ে যাবে সেই উপায় নেই। রেল লাইন ভেসে গেছে, রাস্তা-ঘাট ভেসে গেছে। রিজভী বলেন, দেশের গুদামের চাল নেই, গম নেই। মানুষের কাছে ত্রাণ পৌঁছাচ্ছে না। অথচ তারা (সরকার) মুখে তুবড়ি ছুটাচ্ছে, মুখে তুবড়ি ছুটিয়ে তারা আসল কোনো সার্ভিস দিচ্ছেন না, লিপ সার্ভিস দিয়ে যাচ্ছে।
ঠাকুরগাঁ জেলার রানী সস্কর উপজেলা চেয়ারম্যান বলেন, সরকারি ভাবে যেসব ত্রাণ বরাদ্দ য়ো হচ্ছে তা ত্রাণ পযাপ্ত নয়। যা দেয় তা সকালের খাবার হলে বিকেলে হয়না। আমার এলাকার অনেক মানুষ যাচ্ছে না।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: ত্রাণ


আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ