Inqilab Logo

শুক্রবার, ২৮ জুন ২০২৪, ১৪ আষাঢ় ১৪৩১, ২১ যিলহজ ১৪৪৫ হিজরী

স্বাস্থ্য সেক্টরে চলছে চরম নৈরাজ্য

সুচিকিৎসা পেতে বৃহত্তর খুলনাঞ্চলের রোগীরা ভারতমুখী

| প্রকাশের সময় : ৬ আগস্ট, ২০১৭, ১২:০০ এএম

প্রাইভেট চেম্বারগুলোয় চলছে কমিশন বাণিজ্য
আবু হেনা মুক্তি : বৃহত্তর খুলনাঞ্চলের চিকিৎসা সেবা ভেঙ্গে পড়েছে। দালালদের দৌরাত্ম, অসাধু কর্মকর্তাদের দুর্নীতি, দলবাজির কারণে কর্তব্যে অবহেলা, ওষুধ কোম্পানীর রিপ্রেজেনটিভদের কারিশমা আর ডাক্তাদের বাণিজ্যিক মনোভাবে তৃণমুলের স্বাস্থ্য সেবা আজ প্রশ্নবিদ্ধ। মফস্বলের সরকারী হাসপাতালে দুপুরের পর অধিকাংশ ডাক্তাররা থাকেনা। নিস্ব -অসহায় মানুষগুলো সরকারের সাপ্লাইকৃত উন্নতমানের ওষুধ পায়না। আর মধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্তরা প্রতিদিন ছুটছে ভারতে। চিকিৎসার নামে চলছে শুভংকরের ফাঁকি। প্রাইভেট ক্লিনিকগুলোতে অধিকাংশ ক্ষেত্রে চলছে কসাইবৃত্ত। অধিকাংশ চিকিৎসকদের এখন মানবিক মুল্যবোধ শুন্যের কোঠায়। চিকিৎসকদের প্রতি কোন আস্থা নেই সাধারণ মানুষের। বিশেষায়িত হাসপাতালগুলোতে সিরিয়ালের নামে চলছে ক্ষমতা ও লেনদেন বাণিজ্য। মফস্বলের সেই ছাত্র এখন ডাক্তার হয়ে মফস্বলকেই যেন চেনেনা। থাকতে চায় না উপজেলা কমপ্লেক্সগুলোতে। সবার এম্বিশ্যান হাই। ফলে খুলনাঞ্চলের গোটা স্বাস্থ্য সেক্টরে চলছে এখন চরম নৈরাজ্য।
সূত্রমতে, খুলনা আবু নাসের বিশেষায়িত হাসপাতালে রোগীদের ভিড় অবর্ণনীয়। সিট নেই আবার তদবীর আর টাকা হলেই সিট মিলে যায় মুহুর্তেই। যে অপারেশন বাইরের ক্লিনিকে এই হাসপাতালের ডাক্তাররাই করছেন। সেই রোগী আবু নাসেরে আসলে নানা অজুহাতে প্রাইভেট ক্লিনিকে পাঠানো হয়। এটি নিত্যদিনের ঘটনা। খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পৃথক ভবন নির্মান এবং ১০ কোটি টাকার যন্ত্রপাতি পড়ে থাকলেও আমলাতান্ত্রিক জটিলতায় পূর্ণাঙ্গভাবে ৭ বছরেও চালু হয়নি ক্যান্সার ইন্সটিটিউট। খুলনার কোনো সরকারি হাসপাতালে এখন পর্যন্ত পূর্নাঙ্গ ইনসেপ্টিভ কেয়ার ইউনিট (আইসিইউ) নেই। সরকারি স্বাস্থ্যসেবার কেন্দ্রগুলোতে নানামুখী সংকট, অনিয়ম, দুর্নীতি ও নৈরাজ্য চলছে। আবার বেসরকারি হাসপাতাল-ক্লিনিক-ডায়াগনস্টিক সেন্টার ও চিকিৎসকের প্রাইভেট চেম্বারগুলোয় চলছে সীমাহীন বাণিজ্য। বেসরকারি ক্লিনিক ও ডায়াগনিস্টিক সেন্টারের ডাক্তাররা দু’হাতে কামাচ্ছেন সাধারণ মানুষের রক্ত চুষে কমিশনের টাকা। গোটা খুলনাঞ্চল জুড়ে চলছে মার্কেটিং ম্যানেজার ও প্রতিনিধিদের দৌরাত্ম। ছলে বলে কলে কৌশলে তারা রোগীদের ম্যানেজ করে সরকারী হাসপাতালের বদলে পাঠাচ্ছে প্রাইভেট ক্লিনিকে। মফস্বলের অনেক সরকারী ডাক্তারও তাদের কমিশন বাণিজ্যের কারণে পাঠিয়ে দিচ্ছে বেসরকারি হাসপাতাল নামধারী কসাইখানাগুলোতে। আর বিবেকবর্জিত অনেক ডাক্তারই চেম্বারে বসে নানা কৌশলে নিরীহ অসহায় রোগীদের নানা টেস্টের নামে সর্বস্ব লুটে নিচ্ছে।
ইনকিলাব থেকে এক অনুসন্ধানে জানা যায়, সাধারণত প্রশাব পায়খানা, রক্ত, কফের মত পরীক্ষার জন্য রোগীর কাছ থেকে আদায় করা ফি ২০-৩০ শতাংশ কমিশন নেন চিকিৎসকরা। অন্যান্য পরীক্ষা ও প্রযুক্তিভেদে ৩০-৫০ শতাংশ কমিশন দেয়া হয়। হাসপাতালে রোগী পাঠানোর ক্ষেত্রে সাধারণত ১০-২০ শতাংশ, থেরাপির ক্ষেত্রে সাধারণত ২০-২৫ শতাংশ পর্যন্ত কমিশন দেয়া হয়। কমিশনের টাকা কেউ নেন মাসে, কেউ সপ্তাহে আর কেউ দিনে। এছাড়া কেউ নেন নগদ আবার কেউ নেন চেকে বা নিজের ব্যাংক একাউন্টে। এছাড়া ঔষুধ লেখার জন্য আগে থেকেই ঔষুধ কোম্পানীর কাছ থেকে কমিশনের নামে নানা রকম সুযোগ সুবিধা নেয়ার পাশাপাশি সা¤প্রতিক সময় বিদেশী বা চোরাইপথে আসা দামীয় ঔষুধ থেকেও কমিশন পেয়ে থাকেন প্যাকেজের আওতায় চিকিৎসা করা বেশিরভাগ চিকিৎসক। একজন মার্কেটিং এক্সিকিউটিভ বলেন, খুব কম সংখ্যাক ডাক্তার পাওয়া যায় যাদের আমরা প্রভাবিত করতে পারিনা বা কমিশন নেন না। এছাড়া আজকাল ডাক্তাররা ভারতের অনুমোদন বিহীন ফুড সাপ্লিমেন্ট প্রেসক্রিপশনে লিখছে। ফুড সাপ্লিমেন্ট এখন ওষুধের দোকানে হরহামেশা বিক্রি হচ্ছে। ফুড সাপ্লিমেন্ট সাপ্লাইয়ের চক্রটি ডাক্তাদের মোটা অংকের কমিশন দিচ্ছে।
সূত্রমতে, উপকুলীয় জনপদের এক বিশাল জনগোষ্ঠি নিয়মিত সরকারী হাসপাতালের সেবা গ্রহন করে থাকে। অনুসন্ধানে জানা যায়, নিম্নবিত্তের এই বৃহৎ জনগোষ্ঠি মানসম্মত স্বাস্থ্য সেবার পরিবর্তে বিভিন্নভাবে প্রতারিত ও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। সহায় সম্বল হারিয়ে ভুল চিকিৎসায় অনেকে পথে বসছে। স¤প্রতি চিকিৎসা সেবায় অপরাধ দমনে র‌্যাব ও পুলিশের কয়েকটি সফল অভিযান পরিচালিত হয়েছে। খুলনা জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে বেশ কয়েকটি ভ্রাম্যমান আদালত পরিচালিত হয়। এতে নামী দামী বেসরকারী চিকিৎসা প্রতিষ্ঠানের গোমর ফাঁক হয়ে যায়। তবে সরকারী হাসপাতাল গুলো রয়ে যায় অদৃশ্য কারণে ধরা ছোয়ার বাইরে। এছাড়া একবার অভিযানের পর ফলোআপ না থাকায় কোন বাস্তবমুখী সুদূর প্রসারী ফলাফল পাওয়া যাচ্ছে না। অথচ রোগীদের দুর্ভোগ লাঘবে স্বাস্থ্য বিভাগের কার্যকর তেমন কোনো পদক্ষেপ নিতে দেখা যায়নি। সরকারি সম্ভাবনাময় সুযোগ-সুবিধা থাকার পরও দক্ষিণ অঞ্চলবাসী মানসম্মত স্বাস্থ্য সেবা থেকে বঞ্চিত বলে আখ্যায়িত করে ক্ষুব্ধ মত প্রকাশ করেছেন খুলনার বিশিষ্টজনেরা। বিএমএ’র সাবেক কেন্দ্রীয় মহাসচিব ও খুলনার কৃতি সন্তান ডা: গাজী আব্দুল হক বলেন, কমিশন বাণিজ্যের জন্য কেবল চিকিৎসকদের দায়ী করলে চলবে না। সংশ্লিষ্ট সবাই এর জন্য দায়ী। তবে সংশ্লিষ্ট সব সেক্টর থেকে যার যার মত করে এ কমিশন বাণিজ্য বন্ধে এগিয়ে আসতে হবে। আর সরকারের দায়িত্বশীল কর্তৃপক্ষকে এ ক্ষেত্রে কার্যকর ভূমিকা রাখতে হবে। প্রয়োজন মনিটরিং ও দায়ীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া। বিশেষ করে ডাক্তারদের নৈতিকতা চর্চার বিষয়ে বিএমডিসি, ঔষুধ কোম্পানীর ক্ষেত্রে ঔষুধ প্রশাসন অধিদপ্তর, হাসপাতাল বা ডায়াগনিষ্টিক সেন্টারের ক্ষেত্রে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর এই কমিশন বাণিজ্য ঠেকাতে গুরুত্বপূর্ন ভূমিকা রাখতে পারে।
খুলনা-২ আসনের সংসদ সদস্য আলহাজ্ব মিজানুর রহমান মিজান বলেন, স্বাস্থ্য সেবা জনগনের দোরগোড়ায় পৌঁছে দিতে সরকার বদ্ধপরিকর। বিশেষ করে খুলনা তথা দক্ষিণাঞ্চলের উন্নয়নে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সুনজর রয়েছে। তার আত্মীয়-স্বজনরাও খুলনাতে চিকিৎসা সেবা গ্রহণ করে থাকেন। শহীদ শেখ আবু নাসের বিশেষায়িত হাসপতাল, খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ও খুলনা জেনারেল হাসপাতাল, উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সসহ সরকারি স্বাস্থ্য সেবা কেন্দ্রগুলোতে রোগীদের দুর্ভোগের চিত্র দেখে মর্মাহত হয়েছি। খুলনা সিটি কর্পোরেশনের মেয়র আলহাজ্ব মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান মনি বলেন, স্বাস্থ্য সেবা জনগনের মৌলিক অধিকার। স্বাস্থ্য সেবা নিশ্চিত করা সরকারের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব। একই সাথে স্বাস্থ্য বিভাগের সকল ব্যাধি নিরাময় করাও সরকারের ওপর জনগনের অর্পিত দায়িত্ব। অবিলম্বে খুলনার স্বাস্থ্যসেবার বেহালদশা দূর হোক সেই প্রত্যাশা করি। খুলনা-২ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য নজরুল ইসলাম মঞ্জু বলেন, অনির্বাচিত সরকারের দ্বারা দেশপ্রেম ও জনসেবা অসম্ভব। ক্ষমতাসীন দলের মদদপুষ্ঠ ব্যক্তিরা শুধু স্বাস্থ্য বিভাগ নয়, প্রতিটি সেক্টরে সীমাহীন লুটপাটে ব্যস্ত। সরকারি হাসপাতালগুলোয় যাদের বিরুদ্ধে অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে অবিলম্বে তাদের অপসারণ করে সাংবিধানিক অধিকার জনগণের স্বাস্থ্য সেবা নিশ্চিত করা উচিত। বাংলাদেশ মেডিকেল এসোসিয়েশনের (বিএমএ) খুলনার সভাপতি ডাঃ শেখ বাহারুল আলম বলেন, সরকারি সুযোগ-সুবিধা আর রোগীদের স্বাস্থ্য সেবা ভয়ঙ্করভাবে ভারসাম্যহীন। জনবল, উপকরণ ও আর্থিক সংকট এবং চিকিৎসকদের পুঁজিমুখী মনোভাব প্রকট। সরকারি সুযোগ-সুবিধা দিলেই হবে না, রাষ্ট্রকে জনগণের স্বাস্থ্য সেবা নিশ্চিত করতে হবে।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: স্বাস্থ্য


আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ