পটুয়াখালীর যুবক ক্বারী সাইয়্যেদ মুসতানজিদ বিল্লাহ রব্বানীর কোরআন তেলাওয়াতে মুগ্ধ যুক্তরাষ্ট্রবাসী
ইসলামি সভ্যতা ও সংস্কৃতি বিকাশে বাংলাদেশের অবদান অনস্বীকার্য। এদেশে ইসলামি সংস্কৃতি চর্চার ইতিহাস অনেক প্রাচীন।
সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ সংসদ সদস্যদের অসঙ্গতভাবে তাদের অধিকারকে শৃঙ্খলিত করেছে। সংসদের কোনো ইস্যুতেই তারা দলীয় অবস্থানের বিরুদ্ধে কোনো অবস্থান নিতে পারেন না। সন্দেহ নেই ৭০ অনুচ্ছেদের উদ্দেশ্য হলো সরকারের স্থিতিশীলতা ও ধারাবাহিকতা রক্ষা করা। দলের সদস্যদের মধ্যে শৃঙ্খলা বজায় রাখা। কিন্তু সংসদ সদস্যদের যদি সন্দেহের চোখেই দেখা হয়; তাহলে তাদের কী করে উচ্চ আদালতের বিচারকদের অপসারণের মতো দায়িত্বশীল সিদ্ধান্ত নেয়ার কাজে ন্যস্ত করা যায়?
স্টালিন সরকার : সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী নিয়ে আপিল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশের পর রাজনীতিতে শুরু হয়েছে তোলপাড়। দেশের সংবিধান বিশেষজ্ঞ, আইনজীবী, রাজনৈতিক বিশ্লেষক, সুশীলসমাজের প্রতিনিধি, বিভিন্ন দলের নেতা এবং সাধারণ মানুষের মধ্যে এ নিয়ে চলছে তর্ক-বিতর্ক, আলোচনা-পর্যালোচনা। আপিল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ রায়ে ক্ষমতাসীন দলের কার্যত কিংকর্তব্যবিমূঢ় অবস্থা। আইনমন্ত্রী নীরব; দু’একজন বাদে অন্যান্য মন্ত্রী-এমপি ও অনুগত আইনজীবীরা ‘খামোশ’। তবে সরকারের ঘরে-বাইরে শরীক জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ দূত হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ বেদনাহত সুরে বলেছেন, ‘আদালতের রায় আমাদের মাথা হেঁট করে দিয়েছে। আদালত বলছে, এমন একটি পঙ্গু সমাজে আমরা আছি; সেখানে ভালো মানুষ আর ভালো স্বপ্ন দেখে না; কিন্তু খারাপ লোকেরা আরো লুটপাটের জন্য বেপরোয়া। এ রায়ে আমাদের সমাজের বাস্তব চিত্র ফুটে উঠেছে।’ সরকারের অংশীদার এরশাদ বেদনাহত হলেও রায়ের কঠোর সমালোচনা করে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত তার স্বভাবসুলভ ভাষায় বলেছেন, ‘আদালত যতবার ষোড়শ সংশোধনী বাতিল করবে, আমরা (সরকার) ততবার সংসদে বিল পাস করব। আমরা অনবরত সেটা করতে থাকব। জুডিশিয়াল কন্ডিশন আনটলারেবল। এদেরকে আমরা চাকরি দেই। তারা সংসদের উপর পোদ্দারী করবে?’
বিচারপতিদের এমন পর্যবেক্ষণে ৫ জানুয়ারির বিতর্কিত নির্বাচনে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকার নৈতিক অধিকার হারিয়েছে দাবি করে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনীর পূর্ণাঙ্গ রায় পর্যবেক্ষণের পর সরকারের ক্ষমতায় থাকার আর কোনো নৈতিক অধিকার নেই। সভ্য দেশ হলে এ রায়ের পর সরকার পদত্যাগ করত। সরকারের উচিৎ রায় আমলে নিয়ে অবিলম্বে পদত্যাগ করা।’ সাবেক আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ বলেছেন, ‘ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের রায় মেনে নিয়ে সরকারকে পদত্যাগ করা উচিত। রায়ে বলা হয়েছে সরকার রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে ধ্বংস করে দিয়েছে।’ সংবিধান বিশেষজ্ঞ ব্যারিস্টার মইনুল হোসেন বলেছেন, রায় নিয়ে নতুন করে বলার কিছু নেই; এটা প্রত্যাশিত; অভিনন্দনযোগ্য। আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য ও সাবেক আইনমন্ত্রী আবদুল মতিন খসরু বলেছেন, ‘এ রায়ে আমরা ক্ষুব্ধ, আহত এবং ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছি। সুপ্রিম কোর্ট বিচারের শেষ আশ্রয়স্থল। কিন্তু ষোড়শ সংশোধনী বাতিল রায়ে যেসব বিষয় আনা হয়েছে সেগুলো মামলার মূল বিচার্যের সঙ্গে অপ্রাসঙ্গিক। দেশের প্রধান বিচারপতির কাছ থেকে আমরা এটা কোনোভাবেই আশা করি না। সংবিধানের ১১১ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী সুপ্রিম কোর্টের রায় মানতে আমরা বাধ্য। তবে অসামঞ্জস্য বক্তব্য আমরা কোনোভাবেই আশা করিনি।’
ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের ৭৯৯ পৃষ্ঠার পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশের পর ক্ষমতাসীন দল সমর্থিত বুদ্ধিজীবী-পেশাজীবী ও সুবিধাভোগী সাংস্কৃতিসেবীরা নীরবতা পালন করলেও সর্বত্রই এ নিয়ে বিস্তর আলোচনা-পর্যালোচনা হচ্ছে। অনেকেই প্রধান বিচারপতিকে অভিনন্দন জানাচ্ছেন। বিচার বিভাগকে মানুষের একমাত্র ভরসাস্থল হিসেবে অবিহিত করে টেলিভিশনের টকশো এবং প্রিন্ট মিডিয়াগুলোতে রিপোর্ট, সাক্ষাৎকার, সম্পাদকীয়, উপ-সম্পাদকীয় ও কলাম লেখালেখি হচ্ছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুক, বøগ, টুইটার ও পাঠক মতামতে বিস্তর মন্তব্য, লাইক, শেয়ার দেয়া হচ্ছে। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের বুদ্ধিজীবী জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি প্রফেসর হারুন উর রশিদ কিছুটা হতাশা প্রকাশ করে সংবাদিকদের বলেছেন, ষোড়শ সংশোধনী বাতিল রায়ে রাজনীতির বিষয়টি অনেক বেশি সরলীকরণ করা হয়েছে। তবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি বিএনপিপন্থী বুদ্ধিজীবী প্রফেসর এমাজ উদ্দিন আহমদ রায়ের প্রশংসা করে বলেছেন, আদালতের পর্যবেক্ষণ সঠিক এবং আমারও পর্যবেক্ষণ একই। আবার রায় নিয়ে উচ্ছ¡াস প্রকাশ করলেও মিডিয়ায় এ নিয়ে মন্তব্য করতে আগ্রহ দেখাননি অনেক বুদ্ধিজীবী।
ষোড়শ সংশোধনী বাতিল করে আপিল বিভাগের দেয়া পূর্ণাঙ্গ রায়ে বিচারপতিরা সংবিধানের বিভিন্ন দিক খোলামেলা পর্যালোচনা-চুলচেরা বিশ্লেষণ করেছেন। প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার নেতৃত্বে আপিল বিভাগের এ বেঞ্চে ছিলেন ৭ সদস্য। বেঞ্চের অপর ৬ সদস্য হলেন বিচারপতি মো. আবদুল ওয়াহ্হাব মিঞা, বিচারপতি নাজমুন আরা সুলতানা, বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন, বিচারপতি ইমান আলী, বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী ও বিচারপতি মির্জা হোসেইন হায়দার। প্রধান বিচারপতি ছাড়া অন্য ৬ জনের মধ্যে ৫ জন বিচারপতি প্রধান বিচারপতির পর্যবেক্ষণের সঙ্গে একমত পোষণ করে নিজেরাও পৃথক পৃথক পর্যবেক্ষণ দিয়েছেন। শুধু বিচারপতি নাজমুন আরা সুলতানা প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার রায়ের সঙ্গে সহমত পোষণ করে নিজস্ব কোনো পর্যবেক্ষণ দেননি। বিচারপতিগণ রায়ের বিশ্লেষণে জনগণের ভোটাধিকার, নাগরিকের সাংবিধানিক অধিকার, শাসনব্যবস্থা, গণতন্ত্র, রাজনীতি, নির্বাচন কমিশন, সেনাশাসন, জাতীয় সংসদের সার্বভৌমত্ব, সংসদ ও বিচার বিভাগের সম্পর্ক, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা, বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়োগ, সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ, আইনের শাসন, রাজনৈতিক দলগুলোর আমিত্বের আচরণ, প্রশাসনে দলীয়করণ, নিয়োগ প্রক্রিয়ায় দুর্নীতি, সমাজের নৈতিক অবক্ষয়সহ নানা অসঙ্গতির চিত্র তুলে ধরেছেন। বিচারপতিদের জবাবদিহিতা ও ৩৯ দফা আচরণবিধি, সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল, বিচারপতিদের নিয়োগ, ক্ষমতার পৃথকীকরণের বিষয়াদি রায়ের পর্যালোচনায় এসেছে। দেশের রাজনীতি নিয়ে পর্যালোচনায় বলা হয়েছে, রাজনীতি এখন আর মুক্ত নয়। এটি এখন ‘বাণিজ্যে’ পরিণত হয়ে গেছে। আমাদের পূর্ব পুরুষরা গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র চেয়েছিলেন; ক্ষমতাধর দৈত্য জন্ম দিতে চাননি। অথচ এখন সেই দৈত্যই দেশের মানুষের জীবন দুর্বিষহ করে তুলেছে। প্রশাসনে নিয়োগে দলীয়করণ এমন পর্যায়ে গেছে যে, মেধা নয়; ক্ষমতা-দলীয় পরিচয়ের যোগ্যতাই চাকরি-সরকারি প্রতিষ্ঠান নিয়ন্ত্রণ চলছে। গণতন্ত্রের পূর্বশর্তই হলো জনগণের প্রত্যক্ষ ভোটে নির্বাচন; নির্বাচন কমিশনের প্রতিষ্ঠানিকীকরণ হয়নি ৪৪ বছরেও। উচ্চ আদালতের বিচারকদের অপসারণের ক্ষমতা আত্মঘাতীর মতো সংসদের হাতে দেয়া হয়েছে। কোনো একজন ব্যক্তির দ্বারা কোনো একটি দেশ বা জাতি তৈরি হয়নি, হয় না; অথচ এক ব্যক্তির বন্দনায় মশগুল আছি। সংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলো শক্তিশালীকরণ হয়নি। উচ্চ আদালতের বিচারক, নির্বাচন কমিশনার, মহাহিসাব নিরীক্ষক, পিএসসির সদস্যসহ সবকিছুতেই নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা। ক্ষমতার অপব্যবহার এবং দাম্ভিকতা দেখানোর ক্ষেত্রে বাধা দেয়ার মতো কোনো নজরদারী প্রতিষ্ঠান নেই। অথচ আমরা স্বাধীন জাতি। এমন একটি পঙ্গু সমাজে বসবাস করছি; যেখানে ভালো মানুষ আর ভালো স্বপ্ন দেখে না; মন্দিরা এগিয়ে যায়।
দেশের রাজনৈতিক দলগুলোর অভ্যন্তরীণ গণতন্ত্র চর্চা, নীতি কৌশল সংস্কৃতির নেতিবাচক বিবেচনা করে ‘আমি ও আমিত্ব’ শব্দটি ব্যবহার করে কঠোর সমালোচনা করেছেন। বর্তমান গণতন্ত্রকে মেকি হিসেবে অবিহিত করে প্রধান বিচারপতি পর্যালোচনায় লিখেছেন, আমাদের সংবিধানের ভিত্তি হচ্ছে, ‘আমরা জনগণ’ সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী। জাতীয় সংসদ সংবিধানের পরিপন্থী কোনো আইন প্রণয়ন করতে পারে না। কোনো আইন সংবিধানসম্মত কি না, তা বিচার করার অধিকার সংবিধান সুপ্রিম কোর্টকে দিয়েছে। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে দেশের সর্বস্তরের মানুষের অবদানের প্রসঙ্গ তুলে তিনি আরো লিখেছেন, আমরা একটি মুক্ত-স্বাধীন-সার্বভৌম দেশে বাস করি। অথচ নীরবে ঔদ্ধত্য এবং অজ্ঞতাকে আমরা প্রশ্রয় দিয়ে চলছি। কোনো একজন ব্যক্তি দ্বারা কোনো একটি দেশ-জাতি তৈরি হয়নি। আমরা যদি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নগরপরিকল্পনার দিকে তাকাই, তাহলে দেখি যেই ব্যক্তি তাদের নগরের পরিকল্পনা করেছেন, তাকেই তারা স্বীকৃতি দিয়েছে। অথচ আমরা অদূরদর্শী রাজনীতিকীকরণ ভাইরাসে আক্রান্ত। আমিত্বের রোগে এতোই বেশি আক্রান্ত যে সেখান থেকে বের হয়ে আমাদের নীতি-নির্ধারকেরা এমন একটি ভবিষ্যৎ কল্পনা করতে পারছেন না যা এক ব্যক্তি নয়; পুরো জাতির ভবিষ্যৎ জড়িত। আমিত্বের মতো বাজে রোগের কারণে আমাদের দেশের নীতি-নির্ধারকেরা সবকিছু ব্যক্তিকরণ করে ফেলেছেন। তারা ক্ষুদ্র-সংকীর্ণ দলীয় স্বার্থে একটি ভুয়া ও ‘মেকি গণতন্ত্র’ প্রতিষ্ঠা করেছেন। আর এটা তারা লজ্জাজনকভাবে সংবিধানের অন্যায্য সুবিধা নিয়ে করেছেন। ১৯৭১ সালে আমাদের শহীদেরা রক্ত দিয়ে সংবিধান লিখেছিলেন। সেই রক্তকে সম্মান দিতে ‘আমি একাই সব’ দৃষ্টিভঙ্গি পরিহার করে আত্মঘাতী দলীয় আনুগত্য বা অর্থবিত্ত নয়, জাতীয় জীবনের সর্বস্তরে প্রতিষ্ঠান তৈরিতে শুধু মেধার বিবেচনাকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিতে হবে।
৪৪ বছরেও নির্বাচন কমিশনের প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ হয়নি উল্লেখ করে জনগণের ভোটের অধিকার নিশ্চিত করতে নির্বাচন সর্বদাই অবাধ ও সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করার লক্ষ্যে নির্বাচন কমিশনের কাছে আরও বেশি ক্ষমতা এবং তার প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ করার নির্দেশনা দিয়ে প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা লিখেছেন, ‘এই আদালত লক্ষ্য করেছেন যে জাতীয় নির্বাচনে যারাই হেরে যায়; তারা নির্বাচনের নিরপেক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন তোলে এবং বিরোধী দল সংসদে সহযোগিতা করে না। দশম সংসদ নির্বাচনে একটি বড় রাজনৈতিক দল অংশ নেয়নি। এই আদালতের দৃষ্টিভঙ্গি ছিল অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন করতে সব ক্ষমতা দিয়ে নির্বাচন কমিশনকে শক্তিশালী করা। সরকারের কোনো হস্তক্ষেপ ছাড়াই নির্বাচন কমিশনের শূন্য পদগুলো স্বয়ংক্রিয়ভাবে পূরণ হবে। কিন্তু পরবর্তী সরকারগুলোর কেউ এ বিষয়ে কোনো পদক্ষেপ নেয়নি। এমনকি বিরোধী রাজনৈতিক দলও সংসদে কিংবা কোনো ফোরামে এই প্রশ্ন তোলেনি। নির্বাচন কমিশন ইস্যুতে দেয়া পর্যবেক্ষণ তথা প্রধান বিচারপতির মতের সঙ্গে সব বিচারপতিই একমত পোষণ করেছেন। গত ৩ আগস্ট বাংলাভিশন টিভিতে প্রচারিত ‘গণতন্ত্র এখন’ টকশোয় ইসি নিয়ে বিচারপতিদের এ পর্যবেক্ষণকে বাস্তবধর্মী অবিহিত করে মন্ত্রিপরিষদের সাবেক সচিব ড. সাদত হুসাইন, নির্বাচন বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক তোফায়েল আহমদ, নির্বাচন পর্যবেক্ষণ সংস্থা ব্রতীর নির্বাহী পরিচালক শারমিন মুরশিদ বলেন, নির্বাচন কমিশনকে শক্তিশালী করার যে নির্দেশনা দেয়া হয়েছে তা সুচিন্তিত। নিরপেক্ষ নির্বাচন করতে চাইলে এ সুপারিশ বাস্তবায়ন করা জরুরী। তারা প্রধান নির্বাচন কমিশনারকে সাহস করে রোডম্যাপ অনুযায়ী সবার কাছে গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের আয়োজন করা উচিত মত দেন।
রায়ের পর্যবেক্ষণে ‘বাংলাদেশের জাতীয় সংসদ সার্বভৌম নয়’ জোড়ালোভাবে এ মত প্রকাশ করা হয়েছে। প্রধান বিচারপতি পূর্ণাঙ্গ রায়ের পর্যালোচনায় লিখেছেন, বাংলাদেশে জাতীয় সংসদ ব্রিটিশ পার্লামেন্টের মতো সার্বভৌম নয়। বাংলাদেশের সংবিধানের কোথাও বলা হয়নি জাতীয় সংসদ সার্বভৌম। বাংলাদেশে সংসদ নয়, সার্বভৌম হচ্ছে জনগণ আর সংবিধান। সংসদের সার্বভৌম ক্ষমতা নিয়ে ভুল ধারণা রয়েছে সংবিধানে। সার্বভৌম হচ্ছেন শুধু জনগণ এবং সংবিধান। বাকি সব প্রতিষ্ঠান ও সংস্থা নেহাতই সংবিধানের উদ্দেশ্য বাস্তবায়নের হাতিয়ার মাত্র। সার্বভৌম ক্ষমতা কোনো ব্যক্তি-প্রতিষ্ঠানকে দেয়া হয়নি। সংসদীয় গণতন্ত্রে মন্ত্রিসভার আধিপত্য একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য। ক্ষমতাসীন দল যা চায় সংসদে বেশিরভাগ সদস্য তাকেই সমর্থন করেন। সংসদের পুরো নিয়ন্ত্রণ মন্ত্রিসভার হাতে। সংসদে কী আলোচনা হবে সেই সিদ্ধান্ত নেয় মন্ত্রিসভা। যেসব বিল সংসদের মাধ্যমে পাস হয় তা মন্ত্রিসভা হয়েই সংসদে আসে। স্বার্থান্বেষী ও সংগঠিত গোষ্ঠীগুলো তাদের স্বার্থ আদায়ে মন্ত্রীদের অব্যাহতভাবে চাপ দিতে থাকে, যাতে আইনে তাদের স্বার্থরক্ষা হয়। প্রধান বিচারপতির এই পর্যবেক্ষণের প্রতি সমর্থন জানিয়ে বিচারপতি আবদুল ওয়াহহাব মিঞা রায়ের পর্যবেক্ষণে প্রশ্ন তুলেছেন, সংসদ কি সার্বভৌম? তিনি নিজেই আবার জবাব দিয়েছেন। লিখেছেন, একদল লোক এ দাবি করছেন। বিজ্ঞ অ্যাটর্নি জেনারেলও একই কথা বলেছেন। এটা সত্য যে, ব্রিটিশ পার্লামেন্ট কিছু ক্ষেত্রে সার্বভৌম। সেখানে কোনো লিখিত সংবিধান নেই। বাংলাদেশ ১৯৭২ সালেই লিখিত সংবিধান পায়। এতে বলা হয়েছে, রাষ্ট্রের ৩টি বিভাগ-নির্বাহী, আইন ও বিচার বিভাগ। সেখানে কারও ওপর কাউকে শ্রেষ্ঠত্ব-আধিপত্য দেয়া হয়নি। ফলে সংবিধান ও দেশের জনগণই শুধু সার্বভৌম। বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন লিখেছেন, সংসদীয় গণতন্ত্র আছেÑ এমন কয়েকটি দেশে সাংবিধানিক আইনে সংসদের সার্বভৌমত্বের ধারণা রয়েছে। এতে বলা হয়, আইন বিভাগের চূড়ান্ত সার্বভৌম ক্ষমতা রয়েছে। নির্বাহী ও বিচার বিভাগসহ সরকারের অন্যান্য বিভাগের চেয়ে এটি সুপ্রিম। আইন বিভাগ আইনের যে কোনো পরিবর্তন ও বিধান বাতিল করতে পারে। আমাদের দেশের সংবিধান অনুসারে জাতীয় সংসদ নয়, সার্বভৌম হচ্ছে সংবিধান। বিচারপতি মোহাম্মদ ইমান আলী লিখেছেন, সার্বভৌম মানে সর্বময় ক্ষমতা। সংসদ সার্বভৌম মানে হচ্ছে, সংসদ যে কোনো বিষয়ে আইন প্রণয়ন করতে পারে। তবে ব্রিটেনের ওয়েন্ট মিনিস্টারে যেটা সম্ভব আমাদের সংসদের সেটা সম্ভব নয়। সংবিধান সংসদকে যে ক্ষমতা দিয়েছে কোনো আইন প্রণয়নে সেই সীমা অতিক্রম করা হয়েছে মনে হলে বিচার বিভাগ তাকে অবৈধ বা এখতিয়ারবহির্ভূত ঘোষণা করতে পারে।
২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচন প্রসঙ্গ উল্লেখ না করলেও রায়ে প্রধান বিচারপতি লিখেছেন, জাতীয় সংসদ নির্বাচন যদি নিরপেক্ষভাবে এবং কোনো হস্তক্ষেপ ছাড়াই স্বাধীনভাবে না হতে পারে, তাহলে গণতন্ত্র বিকশিত হতে পারে না। গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের অনুপস্থিতিতে একটি গ্রহণযোগ্য সংসদও প্রতিষ্ঠিত হতে পারে না। সে কারণে আমাদের নির্বাচন প্রক্রিয়া এবং সংসদ এখনো শিশু অবস্থায় রয়ে গেছে। জনগণ এ দু’টি প্রতিষ্ঠানের ওপর আস্থা অর্পণ করতে পারছে না। এ দুটি প্রতিষ্ঠান যদি জনগণের আস্থা এবং শ্রদ্ধা অর্জনের জন্য প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ থেকে বিরত থাকে, তাহলে কোনো গ্রহণযোগ্য নির্বাচন হতে পারে না। একটি অবাধ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের অভাবে বিজ্ঞ রাজনীতিবিদদের দিয়ে সংসদ গঠিত হতে পারে না, বরং তা সংসদের নিজের প্রাতিষ্ঠানিকীকরণকে ব্যাহত করতে পারে। আর সংসদ যথেষ্ট পরিপক্বতা অর্জন না করলে, উচ্চ আদালতের বিচারকদের অপসারণ করার ক্ষমতা সংসদের কাছে ন্যস্ত করা হবে আত্মঘাতী। সংসদের কাছে বিচার বিভাগের জবাবদিহি করা উচিত নয়; বরং রাজনৈতিক দলগুলোর উচিত হবে জাতীয় নির্বাচনে তাদের প্রার্থী বাছাইয়ে সতর্ক হওয়া। যেসব দেশে বিচারপতিদের সংসদীয় অভিশংসনের ব্যবস্থা রয়েছে; সেসব দেশের গণতন্ত্র আমাদের তুলনায় বয়ঃপ্রাপ্ত হলেও সেখানে ওই ব্যবস্থা কার্যকরভাবে প্রয়োগ সম্ভব হয়নি।
সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ সম্পর্কে প্রধান বিচারপতি লিখেছেন, এই অনুচ্ছেদ সংসদ সদস্যদের অসঙ্গতভাবে তাদের অধিকারকে শৃঙ্খলিত করেছে। সংসদের কোনো ইস্যুতেই তারা দলীয় অবস্থানের বিরুদ্ধে কোনো অবস্থান নিতে পারেন না। সংবিধানের ৯৫(২)গ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী কোনো আইন না করা সুপ্রিম কোর্টের বিচারক নিয়োগে নির্বাহী বিভাগকে একটি বিশেষ সুবিধা দিয়েছে। আর ১১৫ ও ১১৬ অনুচ্ছেদ ’৭২-এর সংবিধানে ফিরে না যাওয়া পর্যন্ত বিচার বিভাগের স্বাধীনতায় নির্বাহী বিভাগের প্রভাব পড়বে। কোনো সন্দেহ নেই ৭০ অনুচ্ছেদের উদ্দেশ্য হলো সরকারের স্থিতিশীলতা ও ধারাবাহিকতা রক্ষা করা। দলের সদস্যদের মধ্যে শৃঙ্খলা বজায় রাখা। কিন্তু সংসদ সদস্যদের যদি সন্দেহের চোখেই দেখা হয়; তাহলে তাদের কী করে উচ্চ আদালতের বিচারকদের অপসারণের মতো দায়িত্বশীল সিদ্ধান্ত নেওয়ার কাজে ন্যস্ত করা যায়?
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।