Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

ভয়াবহ বন্যার পদধ্বনি

| প্রকাশের সময় : ২৮ জুলাই, ২০১৭, ১২:০০ এএম

হিমালয় চীন ভারতের উজানের অতিবৃষ্টিতে আগস্টে ফুঁসে উঠতে পারে প্রধান নদ-নদী, বিশেষজ্ঞদের মতে দুই কারণ : বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের পূর্বাভাস মাত্র পাঁচ দিনের : ভারত তথ্য পাঠায় মাত্র ৩-৪ দিন আগে : মুখ খুলছে না পাউবো
শফিউল আলম : এবার আরও ব্যাপক ও বড় ধরনের বন্যার পদধ্বনি দেখা দিয়েছে। অব্যাহত ভারী থেকে অতিভারী বর্ষণের হিমালয় পাদদেশীয় অঞ্চল চীন তিব্বত ভারত থেকে উজানের ঢলের চাপে মধ্য-আগস্টে কিংবা শেষ দিকে একযোগে ফুলে-ফুঁসে উঠতে পারে দেশের প্রধান নদ-নদীসমূহ। এতে করে ইতোমধ্যে বন্যা কবলিত বিস্তীর্ণ এলাকায় ধকল না কাটতেই ফের ভয়াবহ বন্যার আশঙ্কা রয়েছে। বিশেষজ্ঞ সূত্র জানায়, সাধারণত উজানে ভারতে টানা অতিবৃষ্টি হলে এবং এ কারণে গঙ্গা-পদ্মা, ব্রহ্মপুত্র-যমুনা, মেঘনা অববাহিকায় একযোগে অবিরাম পানি বৃদ্ধি পেতে থাকলেই বাংলাদেশে বড় আকারে বন্যা দেখা দেয়। কেননা প্রধান সবকটি নদ-নদীর উৎসস্থল ও মূল অববাহিকা (ক্যাচমেন্ট এরিয়া) হচ্ছে হিমালয়ান অঞ্চল চীন তিব্বত ভারতে। বাংলাদেশের প্রধান নদ-নদীসমূহের পানির ৮০ থেকে ৯০ ভাগ প্রবাহের উৎস হচ্ছে উপরোক্ত মূল অববাহিকায়। জুলাইয়ের বন্যা আগস্টেও বিলম্বিত হলে শঙ্কা আরও বৃদ্ধি পায়। এ বছর এসব নেতিবাচক আলামতই লক্ষ্য করা যাচ্ছে। তাছাড়া দেখা যায়, ৭, ৮ কিংবা ১০ বছর পর পর এদেশে ব্যাপক ও বড় ধরনের বন্যা সংঘটিত হয়েছে পর্যায়ক্রমিক অতীতে। বিগত ১৯৮৮, ১৯৯৮ ও ২০০৭ সালের ভয়াল বন্যা তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ। ২০০৭ সালের পর দেশে খুব বড় আকারের বন্যা হয়নি। সক্রিয় মৌসুমি বায়ু জোরালো থাকায় টানা অতিবর্ষণে গুজরাট, আসাম, রাজস্থান প্রদেশসহ উজানের দেশ ভারত ভয়াবহ বন্যা কবলিত হয়েছে।
আগস্টে সম্ভাব্য বড় ধরনের বন্যার আশঙ্কার পেছনে পানিসম্পদ বিশেষজ্ঞদের মতে দু’টি প্রধান কারণ বা ফ্যাক্টর বিবেচ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। এক. চলতি বর্ষায় বৃষ্টির নিয়ামক মৌসুমি বায়ু চীন, ভারত ও বাংলাদেশে অত্যধিক মাত্রায় এবং অনেক আগে থেকেই সক্রিয় রয়েছে। অনেক অঞ্চলে তা আরও জোরদার হতে পারে। ভারতীয় আবহাওয়া বিভাগ গত মে মাসেই আগের দেয়া পূর্বাভাস পরিবর্তন করে জানায় যে, আবহাওয়ার ‘এল-নিনো’ অবস্থা (বৃষ্টিপাত লাঘবকারী) কমে আসার ফলে দেশটিতে এবারের বর্ষা মৌসুমজুড়ে (জুন, জুলাই, আগস্ট) স্বাভাবিকের চেয়েও বেশিমাত্রায় বর্ষণ হবে। আর ভারতে অতিবৃষ্টির প্রভাব পড়বে বাংলাদেশের নদ-নদীর উজানের অববাহিকায়। দুই. বাংলাদেশের জলবায়ুর বৈশিষ্ট্য, মৌসুমি বায়ুমালা ও বন্যার প্রবণতা অনুযায়ী নিকট ও দূর অতীতকাল থেকেই ভয়াবহ ধরনের কিংবা ব্যাপক আকারে বন্যাগুলো সংঘটিত হয়েছিল জুলাইয়ের শেষ দিক থেকে পুরো আগস্ট মাসের মধ্যে এমনকি সেপ্টেম্বর পর্যন্ত। এ সময়টাই বন্যার জন্য ঐতিহাসিকভাবেও ঝুঁকিবহুল পিরিয়ড। গত জুন থেকে চলতি জুলাই পর্যন্ত দেশের বিভিন্ন স্থানে যে বন্যা সংঘটিত হয়েছে তা মূলত ‘ফ্ল্যাশ ফ্ল্যাড’। যা আগাম মৌসুমি বায়ুর সক্রিয়তায় অতিবর্ষণের কারণে হয়ে থাকে। সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞমহল সতর্ক করে বলছেন, এই জুলাইয়ের চলমান বন্যা যদি আগস্ট পর্যন্ত এমনকি সেপ্টেম্বরেও দীর্ঘায়িত হয় তাহলে তা বড় ধরনের বন্যার দিকে গড়াতে পারে।
এদিকে পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের কর্মকর্তা উপ-বিভাগীয় প্রকৌশলী সরদার উদয় রায়হান এবং নির্বাহী প্রকৌশলী মোঃ সাজ্জাদ হোসেনের কাছে গতকাল (বৃহস্পতিবার) এ বিষয়ে জানতে চাওয়া হলে তারা বলেছেন, আগস্টের সময়টা বন্যার ক্ষেত্রে এমনিতেই ঝুঁকির সময় হিসেবে বিবেচিত হয়। কেননা এ সময়ে দেশে অতীতে বড় ধরনের অধিকাংশ বন্যাগুলো সংঘটিত হয়েছে। যা ঐতিহাসিকভাবে (হিস্ট্রিক্যালি) বন্যার সময়কাল। তবে তারা জানান, পাউবোর বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ নদ-নদীর পানির সমতল পরিস্থিতি ও সম্ভাব্য বন্যা সম্পর্কে পূর্বাভাস প্রদান করতে পারে পাঁচ দিন আগে। এছাড়া পরীক্ষামূলকভাবে একটি বন্যার পূর্বাভাস দেয়া হয় দশ দিন আগে। কিন্তু এক মাস বা দুই মাসের কোন দীর্ঘমেয়াদি পূর্বাভাস ব্যবস্থা নেই। আগস্টে বন্যার আশঙ্কা সম্পর্কে তাদের কাছে সুনির্দিষ্ট তথ্য-উপাত্ত নেই বলেও জানান।
গত বুধবার পানিসম্পদ মন্ত্রী ব্যারিস্টার আনিসুল ইসলাম মাহমুদ ঢাকায় জেলা প্রশাসকদের সাথে অনুষ্ঠিত সভায় ও পরে সাংবাদিকদের বলেন, আগস্ট মাসের তৃতীয় সপ্তাহে দেশে বড় ধরনের বন্যার আশঙ্কা রয়েছে। এরজন্য পানি উন্নয়ন বোর্ড ও জেলা প্রশাসনকে সতর্ক থেকে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ এবং বন্যার আগে বাঁধগুলো মেরামতের নির্দেশ দেয়া হয়েছে। মন্ত্রী বলেন, বড় বন্যা হয় যখন যমুনা, পদ্মা ও মেঘনার পানি একসঙ্গে বৃদ্ধি পায়। আর সেই সাথে যদি অমাবস্যা থাকে তখন বন্যার প্রকোপ বেড়ে যায়। ইতোমধ্যে দ্বিগুণ বৃষ্টি হয়েছে। আমরা সতর্ক করেছি যে একটা বন্যার আশঙ্কা আছে। আর এই বন্যাটা হয় আগস্টের তৃতীয় সপ্তাহে। এরজন্য প্রস্তুতি রাখতে পাউবোকে বিশেষভাবে বলা হয়েছে।
অন্যদিকে আগস্টের তৃতীয় সপ্তাহে বন্যার আশঙ্কা নিয়ে পানিসম্পদ মন্ত্রীর বক্তব্য প্রসঙ্গে সরাসরি মুখ খুলতে চাইছেন না পাউবোর সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা। তারা শুধুই বলছেন, অতীতের দুর্যোগ অভিজ্ঞতায় আগস্ট মাসে বন্যার ঝুঁকি থাকে। তবে পাউবো বন্যার দীর্ঘমেয়াদি পূর্বাভাস দেয় না। আগামী ৫ দিনের পূর্বাভাস ও ১০ দিনের কিছু ক্ষেত্রে পরীক্ষামূলক পূর্বাভাস প্রদান করে থাকে। অপরদিকে আবহাওয়া বিভাগ চলতি জুলাই মাসে সক্রিয় মৌসুমি বায়ুর প্রভাবে অতি বর্ষণে দেশের উত্তরাঞ্চলের কিছু কিছু এলাকায় বন্যার আশঙ্কা কথা দীর্ঘমেয়াদি পূর্বাভাসে জানায়। তবে আগস্ট ও সেপ্টেম্বর মাসে বন্যার কোন পূর্বাভাস নেই। যদিও বঙ্গোপসাগরে জুলাই, আগস্ট ও সেপ্টেম্বর মাসে এক থেকে দু’টি করে মৌসুমি নিম্নচাপ সৃষ্টি হতে পারে বলে পূর্বাভাসে জানানো হয়।
এদিকে পাউবোর সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞ সূত্রে জানা গেছে, দেশের প্রধান নদ-নদীসমূহের মূল উৎস বা অববাহিকা মূলত ভারতে হলেও সেখানকার উজানের প্রবাহ সম্পর্কে পূর্বাভাস মিলছে না। ভারতের পক্ষ থেকে মাত্র ৩ থেকে ৪ দিন আগে এ সম্পর্কে তথ্য-উপাত্ত দেয়া হয়ে থাকে। ৪টি নদ-নদীর উজান অববাহিকার তাও মাত্র ৮টি পয়েন্টের। সেগুলো হচ্ছে- এক. ব্রহ্মপুত্র-যমুনার উজানভাগের অববাহিকায় ৪টি পয়েন্ট, উত্তর-পূর্ব ভারতের আসামের গুয়াহাটি, পান্ডু গোয়ালপাড়া ও ডুবড়ি। দুই. গঙ্গা অববাহিকায় ২টি পয়েন্ট, উজানের ফারাক্কা এবং সাইফগঞ্জ (বিহার)। তিন. সুরমা ও কুশিয়ারা নদীর উজানে বরাকের শিলচর। এবং চার. তিস্তার উজান ভাগের একটি উজান পয়েন্টের। অথচ ভারতের পক্ষ থেকে উজানের অববাহিকার নদ-নদীর সমতল বা প্রবাহের কারণে বাংলাদেশ বন্যা কবলিত হওয়া সম্পর্কে কোন ধরনের দীর্ঘমেয়াদি পূর্বাভাস প্রদান করছে না। যা পৃথিবীতে অধিকাংশ প্রতিবেশী দেশের মধ্যে তথ্য-উপাত্ত বিনিময় ও দীর্ঘমেয়াদি পূর্বাভাস আদান-প্রদানের ব্যবস্থা প্রচলিত রয়েছে।
এদিকে পানি বিশেষজ্ঞ সূত্রগুলো জানায়, বিগত ১৯৮৮, ১৯৯৮ ও ২০০৭ সালের বন্যা সংঘটিত হওয়ার সময়কালীন বর্ষারোহী মৌসুমি বায়ুমালার মতিগতির সাথে এবারও মিল খুঁজে পাওয়া যায়। এ বছর মৌসুমি বায়ু আগমন বেশ আগেভাগে হয়েছে। সক্রিয়তাও বাড়ছে। প্রধান নদ-নদীসমূহের সমতল বৃদ্ধির মাত্রা গত কয়েক বছরের তুলনায় এবার বেশি। সবচেয়ে বড় শঙ্কার দিকটি হলো চীন তিব্বত হিমালয়-অঞ্চলসহ ভারতের বিশেষত দেশটির গাঙ্গেয় পশ্চিমবঙ্গ এবং উত্তর-পূর্বাঞ্চলের আসাম, অরুণাচল, মেঘালয়, ত্রিপুরা রাজ্যে আসন্ন আরও ঘোরতর বর্ষার সময়ে (জুলাই-আগস্ট-সেপ্টেম্বর তথা শ্রাবণ-ভাদ্র) অবিরাম অতিবর্ষণ এবং সেই সাথে উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে বাংলাদেশের বিস্তীর্ণ অঞ্চল ব্যাপকভাবে বন্যা কবলিত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। গতকাল পর্যন্ত আন্তর্জাতিক আবহাওয়া নেটওয়ার্কের তথ্য-উপাত্ত অনুযায়ী চলতি মাসের শেষে ও আগস্টের গোড়াতে হিমালয় পাদদেশীয় অঞ্চলসহ ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে অতিবর্ষণের প্রবণতা রয়েছে। সেই অঞ্চলে ঢল বা বন্যার ধকল গিয়ে পড়তে পারে ভাটির দেশ হিসেবে বাংলাদেশের উপর। সা¤প্রতিক বন্যা এবং গত মার্চ-এপ্রিলে হাওর অঞ্চলের আকস্মিক বন্যা তার বড় দৃষ্টান্ত।
এদিকে আগস্টে বড় বন্যার শঙ্কা প্রসঙ্গে জানতে চাইলে পানিসম্পদ বিশেষজ্ঞ চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যায়ের অধ্যাপক ড. মোঃ রিয়াজ আখতার মল্লিক গতকাল ইনকিলাবকে জানিয়েছেন, আগামী আগস্ট মাসের প্রথমার্ধে এ অঞ্চলে সক্রিয় মৌসুমি বায়ুর প্রভাবে ভারী বর্ষণের সম্ভাবনা রয়েছে। অবশ্য তাতে সম্ভাব্য বন্যার আশঙ্কা সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট তথ্য-উপাত্ত পাওয়া যায়নি। তবে অতীতের ধারাবাহিকতায় আগস্ট মাসে বড় বন্যার জন্য এখনই প্রস্তুতি থাকা অপরিহার্য। তবে তার গবেষণার প্রসঙ্গে বলেছেন, বাংলাদেশে বৃষ্টিপাতের প্রবণতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। গত ৫০ বছরে গড় বৃষ্টিপাতের পরিমাণ বেড়ে গেছে ২শ’ থেকে ২৫০ মিলিমিটার পর্যন্ত। আর বার্ষিক বৃদ্ধিও পরিমাণ ৪ থেকে ৫ মিলিমিটার। বৃষ্টিপাতের চিরাচরিত ধারা পরিবর্তনের ক্ষেত্রে সবচেয়ে লক্ষ্যণীয় দিকটি হচ্ছে, সা¤প্রতিক সময়ে অল্প সময়ের মধ্যে অধিক বর্ষণ হচ্ছে। বৃষ্টিপাতের মাত্রা বা ইনটেনিসিটি বৃদ্ধির তা সূচক বহন করে।



 

Show all comments
  • তানিয়া ২৮ জুলাই, ২০১৭, ২:১৪ এএম says : 0
    সম্ভব্য বন্যাকবলিত এলাকার মানুষদেরকে সচেতন করতে হবে।
    Total Reply(0) Reply
  • জাব্বার ২৮ জুলাই, ২০১৭, ২:১৫ এএম says : 0
    সরকারকে জরুরী সহায়তা প্রদানের প্রস্তুতি নিতে হবে।
    Total Reply(0) Reply

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: ভয়াবহ

১৬ সেপ্টেম্বর, ২০২২

আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ