Inqilab Logo

শুক্রবার ১৪ নভেম্বর ২০২৪, ৩০ কার্তিক ১৪৩১, ১২ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

বিনিয়োগ প্রবৃদ্ধিতে মুদ্রানীতির খড়গ

| প্রকাশের সময় : ২৭ জুলাই, ২০১৭, ১২:০০ এএম

সঞ্চয়পত্র নিয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের দৃষ্টিভঙ্গিতে দুশ্চিন্তায় বিনিয়োগকারীরা
অর্থনৈতিক রিপোর্টার : দেশে বিনিয়োগ বৃদ্ধির তুলনায় জনতুষ্টিকে প্রধান্য দিয়ে মুদ্রানীতির ভঙ্গি ঘোষণা করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এতে দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে রাখতে লাগাম টানা হয়েছে ঋণের প্রবৃদ্ধিতে। ঋণ প্রবাহে প্রবৃদ্ধি কমালে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে থাকবে- এমন সূত্রনির্ভর মুদ্রানীতি ঘোষণা করেছেন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর ফজলে কবির। এতে বিনিয়োগ কমে যাওয়ার বিষয়টা নিশ্চিত হলেও গতকাল মুদ্রানীতি ঘোষণাকালে তা নিয়ে চিন্তিত দেখা যায়নি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্তাদের। মুদ্রানীতি প্রণয়নের সঙ্গে জড়িত কর্মকর্তাদের সঙ্গে কাথা বলে জানা গেছে, দ্রব্যমূল্য বেড়ে গিয়ে আগামি বছরের নির্বাচনের আগে যাতে জনরোষ তৈরি না হয়- সে জন্যই বিনিয়োগ নিরুৎসাহিত করা হয়েছে জুলাই থেকে ডিসেম্বরের মুদ্রানীতিতে।
এদিকে সাধারণ মানুষের ‘শেষ সম্বল’ সঞ্চয়পত্র নিয়ে বিনিয়োগকারীদের দুশ্চিন্তায় ফেলে দিয়েছেন গভর্নর। মুদ্রানীতি ঘোষণাকালে অচিরেই সঞ্চয়পত্রগুলোর মুনাফা হার বিদ্যমান বাজার সুদহারের সঙ্গে সম্পর্কিত করার কথা বলেছেন তিনি।
২০১৭-১৮ অর্থবছরের প্রথমার্ধের (জুলাই-ডিসেম্বর) জন্য ঘোষিত মুদ্রানীতিতে সামগ্রিকভাবে ঋণ প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা কমানো হয়েছে। গত অর্থবছরের শেষার্ধের মুদ্রানীতিতে অভ্যন্তরীন খাতে যেখানে ঋণের প্রবৃদ্ধি প্রাক্কলন করা হয়েছিল ১৬ দশমিক ৪০ শতাংশ, সেখানে নতুন মুদ্রানীতিতে তা শূণ্য দশমিক ৬০ শতাংশ কমিয়ে ১৫ দশমিক ৮০ শতাংশ করা হয়েছে।
নতুন মুদ্রানীতিতে সামগ্রিক ঋণ প্রবৃদ্ধির পাশাপাশি সরকারি ও বেসরকারি উভয় খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা কমিয়ে ধরা হয়েছে। সর্বশেষ মুদ্রানীতিতে বেসরকারি খাতে ঋণের প্রবৃদ্ধি ধরা হয়েছিল ১৬ দশমিক ৫০ শতাংশ। নতুন মুদ্রানীতিতে এটি ২ শতাংশ কমিয়ে ১৬ দশমিক ৩০ শতাংশ করা হয়েছে।
২০১৭ সালের জুলাই-ডিসেম্বর সময়ের জন্য সরকারি খাতে ঋণের প্রবৃদ্ধি ধরা হয়েছে ১২ দশমিক ১০ শতাংশ। সর্বশেষ মুদ্রানীতিতে এই খাতে প্রবৃদ্ধি ধরা হয়েছিল ১৬ দশমিক ১০ শতাংশ। মূলত ঋণের চাহিদা কমে যাওয়ার কারণেই প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা আগের চেয়ে নামিয়ে আনা হয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রে জানা যায়, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত সময়ের মুদ্রানীতিতে অভ্যন্তরীন ঋণের প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা ১৬ দশমিক ৪০ শতাংশ ধরা হলেও মে পর্যন্ত বাস্তব প্রবৃদ্ধি হয়েছে মাত্র ১১ দশমিক ৩০ শতাংশ। অন্যদিকে বেসরকারি খাতে ১৬ দশমিক ৫০ শতাংশ ধরা হলেও গত মে মাস পর্যন্ত সময়ে প্রবৃদ্ধি হয় ১৬ শতাংশ। সরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধিও ছিল লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে অনেক পিছিয়ে।
চলতি অথর্বছরের জন্য গড় বার্ষিক ভোক্তা মূল্যস্ফীতি ৫ দশমিক ৫ শতাংশ পরিমিত রাখা ও ৭ দশমিক ৪ শতাংশ প্রকৃত দেশজ উৎপাদন বৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের বিবেচনায় রেখে মুদ্রানীতি প্রস্তুত করা হয়েছে।
সঞ্চয়পত্র প্রসঙ্গে ফজলে কবির বলেন, জাতীয় সঞ্চয় স্কীমের সঞ্চয়পত্রগুলোর বাজার সুদহারের সঙ্গে সংগতিহীন উচ্চ মুনাফা হার সরকারের জন্য অতিরিক্ত ব্যয়ভার সৃষ্টি করবে। একই সঙ্গে মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদী সরকারি-বেসরকারি প্রকল্পের অর্থায়নের জন্য গুরুত্বপূর্ণ বন্ড বাজারের বিকাশ বাধাগ্রস্ত করবে। মুদ্রানীতির কার্যকারিতার জন্য দরকারি সুষ্ঠু ট্রান্সমিশন চ্যানেলের বিকাশও বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। গভর্নরের মুদ্রানীতি ঘোষনণার পর সঞ্চয়পত্রের ওপর নির্ভরশীল, এমন মানুষেরা পড়েছেন দুশ্চিন্তায়। সূত্র মতে, স্বল্প আয়ের মানুষ ও অবসর প্রাপ্ত নাগরিকদের বড় অংশই সঞ্চয়পত্রের আয়ের উপর অনেকাংশেই নির্ভরশীল। তবে ক্ষুদ্র সঞ্চয়ীদের মধ্যে এগিয়ে নারীরাই। নিজের আয় ও সংসারের খরচ থেকে কিছু বাঁচিয়ে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র সঞ্চয় করার অভ্যাস তাঁদের বহুদিনের। বিপদে ভরসা এসব সঞ্চয়ই। কিন্তু ২০১৭-১৮ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেট ঘোষণার পর সবচেয়ে বেশি দুশ্চিন্তায় পড়েছেন এই নারীরাই। বাজেটে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতের ব্যাংক হিসাবের ওপর আবগারী শুল্ক বসানোর লক্ষ্য পূরণ না হলেও সঞ্চয়পত্রের সুদ হার কমিয়ে দেওয়ার ঘোষণা অবশেষে বাস্তবায়ন হতে যাচ্ছে। আর তাই এবার স্বল্প আয়ের মানুষ ও অবসর প্রাপ্ত নাগরিকদের সঞ্চয়ে খড়গ বসছে।
সঞ্চয়পত্র নিয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে গভর্নর বলেন, সঞ্চয়পত্র মধ্যম আয়ের লোকদের জন্য অনেক গুরুত্বপূর্ণ। তাদের একটু একটু সঞ্চয় একদিন উদ্যোক্তা হতে সহায়তা করে। এই জন্য সঞ্চয়পত্র সুদের হার নিয়ে সরকার অনেক চিন্তাভাবনা করছে; বিশেষ করে এটাকে একটি বিধিবদ্ধ ও যৌক্তিক হারের মধ্যে আনার ব্যাপারে প্রচেষ্টা চলছে। তিনি বলেন, এ ক্ষেত্রে সঞ্চয়পত্র বিক্রির ক্ষেত্রে একটি নির্দিষ্ট সীমা বেঁধে দেওয়া যেতে পারে কিংবা আমাদের আউটলেটগুলোতে ক্রেতার জাতীয় পরিচয়পত্রের সংযুক্তি থাকতে পারে। যাতে ১ জনে অধিক কিনছেন কি না তা সনাক্ত করা সম্ভব হয়। সূত্র মতে, বর্তমানে ৪ ধরনের সঞ্চয়পত্র আছে। এসব সঞ্চয়পত্রে সর্বনিম্ন সাড়ে ৯ শতাংশ থেকে সর্বোচ্চ সাড়ে ১১ শতাংশ সুদ দেওয়া হয়। অন্যদিকে ব্যাংকে আমানতের মেয়াদ ভেদে ৪ থেকে ৭ শতাংশ পর্যন্ত সুদ পাওয়া যায়।
বেসরকারি খাতকে তিনি ব্যাপক উৎসাহ দিতে চান উল্লেখ করে গভর্নর বলেন, দীর্ঘদিন ধরেই বিনিয়োগ একটা জায়গাতে আটকে থাকার কারণে বিনিয়োগের মন্দা কাটছে না। ফলে ব্যাংকগুলোতে প্রচুর অলস অর্থ পড়ে আছে। সেসব অর্থ বেসরকারি খাতের জন্য উত্তম জায়গা।
এসময় নতুন উদ্যোক্তা তৈরিতেও কেন্দ্রীয় ব্যাংক আরও কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ করবে বলে উল্লেখ করেন গভর্নর। ব্যাংক ঋণে সুদহার সংক্রান্ত এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘এটা ঠিক যে, আমানতের সুদ হার কমে যাওয়ায় মানুষ আমানত বিমুখ হচ্ছে, মানুষের সঞ্চয় প্রবণতা কমছে।’
মুদ্রানীতির কারণে পুঁজিবাজারে কোন ধরণের প্রভাব পড়বে কি না এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, পুঁজিবাজার নিয়ে বিএসইসি কাজ করছে। তবে মুদ্রানীতির কোনো প্রভাব বাজারে পড়বে বলে মনে হয় না। তারপরেও কোন প্রতিষ্ঠানের সমস্যা হলে সেটা তখন বিবেচনা করা হবে।
মুদ্রানীতি ঘোষণাকালে আরও উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশ ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নর আবু হেনা মোহাম্মদ রাজি হাসান, এস কে সুর চৌধুরী, প্রধান অর্থনীতিবিদ ফয়সাল আহমেদ, প্রধান অর্থনৈতিক উপদেষ্টা মো.আখতারুজ্জামান প্রমুখ।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: বিনিয়োগ


আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ