Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

কাবার দুশমনদের ধ্বংস অনিবার্য-২

| প্রকাশের সময় : ১৫ জুলাই, ২০১৭, ১২:০০ এএম

রূহুল আমীন খান : কিন্তু একি! হারাম সীমা চিহ্নিত স্থানে এসে মাহমুদ থমকে দাঁড়াল, শুয়ে পড়ল। শত চেষ্টা করেও তাকে আর উঠানো গেল না। কাবার দিক থেকে মুখ ঘুরিয়ে দেয়া হলো তার ইয়েমেনের দিকে, চলতে শুরু করল সে স্বাভাবিকভাবে। আবার মুখ ঘুরিয়ে দেয়া হলো কাবার দিকে। কিন্তু ঐ সীমায় এসে সে বসে পড়ল পূর্ববৎ। তার সঙ্গে অন্য হস্তিরাও। চলছে সামনে আগানোর প্রচেষ্টা। এমন সময় দেখা গেল, লোহিত সাগরের দিক থেকে ধেয়ে আসছে ঝাঁকে ঝাঁকে (আবাবীল) পাখি। ছেয়ে ফেলল তারা বাহিনীর মাথার উপরের আকাশ। আবাবীল চঞ্চু ও পায়ে বয়ে আনা পাথর-কঙ্কর বর্ষণ করতে লাগল বৃষ্টি ধারার মতো। এবং ফা-জা‘আলাহুম কা‘আসফিম মাকুল- চর্বিত, ভক্ষিত তৃণের ন্যায় তারা ধ্বংস হয়ে গেল। এ ঘটনা প্রিয় নবী সল্লাল্লাহু আলাইহি ও সাল্লামের আবির্ভাবের মাত্র ৫০ দিন আগের। এ ঘটনা এতই প্রভাব সৃষ্টিকারী যে, আরবরা এ থেকে নতুন সাল গণনা শুরু করল এবং তার নামকরণ করল হস্তি সাল।
এই সেই কাবা। কাবা আছে। কাবা থাকবে মহাপ্রলয় পর্যন্ত স্বস্থানে সমর্যাদায়। মানব জাতির ধারায় আগমনের পূর্বেই এর ভিত্তি স্থাপিত। কাবার অন্য নাম বাক্কা। এই বাক্কা, মসজিদুল হারাম কাবা- হলো উম্মুল কোরা অর্থ যমিনের মা। মাটির জন্ম তখনো হয়নি, শুধু পানি আর পানি। সৃষ্টিকর্তা আল্লাহর মহাপরিকল্পনা অনুযায়ী ইচ্ছা জাগল তাঁর। প্রবাহিত হলো বাতাস। তৈরি হলো ফেনা, সেই ফেনাপুঞ্জ এক জায়গায় জমে রূপান্তরিত হলো মাটিতে। সেই মাটিই বাক্কা যার অপর নাম মক্কা। তার কেন্দ্রবিন্দু কাবা। উম্মুল কোরা- মৃত্তিকাজননী। ক্রমে সে মাটি সম্প্রসারিত হয়ে সৃষ্টি হলো পৃথিবীর ভ‚ভাগ, সপ্ত মহাদেশ।
অতিক্রান্ত হলো আদিপর্ব। পৃথিবী এখন সাগর, পাহাড়, মরু বিয়াবান, নদ-নদী, বন, বনানী, সবুজ শ্যামলিমায় সুশোভিত। আল্লাহর প্রতিনিধি বা খলিফাকে বরণ করতে স্বাগত জানাতে সম্পূর্ণ প্রস্তুত। আল্লাহ সৃষ্টি করলেন তাঁর খলিফা আদি মানব আদমকে। রাখলেন জান্নাতে। পরে নিষিদ্ধ ফল ভক্ষণের জন্য নামিয়ে দিলেন যমীনে। আদমকে নামালেন সরন্দীপে বা সিংহলে আর হাওয়াকে জেদ্দায়। দীর্ঘ পথ অতিক্রম করে আদম পৌঁছলেন মক্কা ভ‚মিতে। জেদ্দা থেকে মা হাওয়াও পৌঁছলেন মক্কার আরাফাতের ময়দানে, জাবালে রহমাত পাহাড়ের উপরে। মিলন হলো আদি পিতা আদি মাতার। আরাফাতের ময়দানেই মহামানবের মহামিলন কেন্দ্র। ৯ই জিলহজ তারিখে এখানে অবস্থান করে আদায় করতে হয় হজের প্রধান রুকন ওকূফে আরাফা।
আদমের আগমনের আগেই কাবাস্থলে আল্লাহর ফেরেশতারা তাঁর ঘর হিসেবে মিলে করত ইবাদত। বেহেশত ছেড়ে আসা আদমের তামান্না হলো যমিনে আল্লাহর ঘর প্রাপ্তির। আল্লাহ নির্দেশ দিলেন উম্মুল কোরা বাক্কায়, ঐ স্থানে তাঁর ঘর কাবা নির্মাণের সেই সঙ্গে প্রেরণ করলেন জান্নাতের স্মারক দু’টি জান্নাতি প্রস্তর। তার একটি হাজরে আসওয়াদ, অপরটি মাকামে ইবরাহীম।
গেল আদমের যুগ, শীসের যুগ, এলো নূহের যুগ। মানুষ লিপ্ত হলো মূর্তিপূজা, পাপাচারে। নূহ আ: তাদের বোঝালেন, ফেরাতে চেষ্টা করলেন, ৯৫০ বছর যাবৎ চেষ্টা অব্যাহত রাখলেন। কিন্তু ব্যর্থ হলেন। মাত্র স্বল্প ক’জন ছাড়া সকলেই নিমজ্জিত রইল কুফরীতে। আল্লাহ তখন মহাপ্লাবনের গজব পাঠিয়ে ধ্বংস করে দিলেন কাফিরদের। পবিত্র কাবার ভিত চাপা পড়ে গেল মাটির নিচে। আল্লাহর ইচ্ছা হলো আবার কাবাকে উন্মুক্ত করা, মক্কাকে জনমুখর করা এবং তাঁর হাবীবকে এখানে প্রেরণ করে বিশ্বব্যাপী তার দ্বীন কায়েম করা।
এলো ইবরাহীম আ:-এর যমানা। বাসস্থান তাঁর শামের ফিলিস্তিন এলাকায়। দু’স্ত্রী তাঁর। সন্তানহীন। অবশেষে ছোট সহধর্মিণী হাজেরার গর্ভে জন্ম নিলেন ইসমাঈল। বড় সহধর্মিণী সারার মনে তীব্রভাবে জন্ম নিলো স্বপত্মী বিদ্বেষ। তিনি দাবি জানালেন, হাজেরা ও তার সন্তানকে নির্বাসন দিতে। আল্লাহর ইচ্ছায় ইবরাহীম আ: তাতে রাজি হয়ে চলে এলেন শাম থেকে প্রায় হাজার মাইল দূরে উসর-ধূষর পার্বত্য মরু উপত্যকা মক্কায়। জনমানবহীন, তরুলতাশূন্য, ফলমূল, খাদ্য, পানিহীন হাহাকার ভরা এই পার্বত্য মরু উপত্যকায় হাজেরা ও ইসমাঈলকে নির্বাসন দিয়ে যখন তিনি শামের দিকে যাত্রা করলেন তখন দিশেহারা হয়ে পড়লেন হাজেরা। স্বামীর জামার আস্তিন টেনে ধরে অশ্রু¯œাত আবেগাপ্লুত কণ্ঠে বললেন, আমার মতো এক অবলা নারী ও দুগ্ধ পোষ্য এক শিশুকে এই ভয়াবহ স্থানে রেখে কোথায় যাচ্ছেন আপনি- স্বামী? ইবরাহীমের আ: হৃদয় তখন বেদনা ভারাক্রান্ত। প্রাণপ্রিয় স্ত্রী আর অশীতিপর বয়সের একমাত্র (তখন পর্যন্ত) সন্তানকে রেখে যেতে তিনি অশ্রুসজল হলেন। কিন্তু খোদার পরীক্ষায় হলেন উত্তীর্ণ। বললেন, সবর করো হাজেরা, এ যে আল্লাহর ইচ্ছা। এখানে আল্লাহর ঘর লুপ্ত আছে। আল্লাহ দেখবেন। হাত তুলে তিনি আল্লাহর দরবারে ফরিয়াদ জানালেন (কুরআনের ভাষায়) রাব্বানা ইন্নি আসকানত.... ‘হে আমার পরওয়ারদেগার! আমি আমার এক সন্তানকে তোমার পবিত্র গৃহের সন্নিকটে, এক ফল-সফলহীন উপত্যকায় বসবাসের জন্য রেখে গেলাম। হে আমার প্রতিপালক! যাতে তারা সালাত কায়েম করে। তুমি কিছু লোকের অন্তরকে তাদের প্রতি আকৃষ্ট অনুরাগী করে দাও এবং ফল-ফলাদি দ্বারা তাদের রিযকের ব্যবস্থা করো। যাতে তারা কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে। ১৪ : ইবরাহীম : ৩৭ আয়াত।
থাকলেন সেখানে হাজেরা, পানি নেই শিশু ইসমাঈরের প্রাণ ওষ্ঠাগত। তেষ্টায় দিশেহারা হাজেরা উন্মাদিনীর মতো দৌড়াদৌড়ি শুরু করলেন। একবার দৌড়ে গিয়ে ওঠেন পার্শ্ববর্তী সাফা পাহাড়ে আর একবার মারওয়া পাহাড়ে। আশা, কোনো কাফেলা যায় নাকি এ পথ ধরে। দু’পাহাড়ের মধ্যবর্তী স্থান অতিক্রম করেন অতিদ্রুত। এখান থেকে দৃষ্টিগোচর হয় না শিশুকে। না জানি প্রাণের যাদুকে নিয়ে যায় কোনো বন্য শেয়াল। এভাবে ৭ বার। না কাউকে দেখা যাচ্ছে না। নিরাশ হয়ে ফিরলেন ইসমাঈলের কাছে। এ কী দৃশ্য! শিশু ইসমাঈলের কচি পায়ের আঘাতে কঠিন পাথুরে যমিন ফেটে প্রবাহিত হচ্ছে পানির ফোয়ারা। ইসমাঈলকে পান করালেন সেই পবিত্র পানি। নিজেও পান করলেন। স্বতঃস্ফূর্ত সেই জলধারাকে আটকে রাখার জন্য তার চার দিকে পাথরের টুকরা দিয়ে কূপাকৃতি করলেন। এই হলো যমযম। যা বিশ্ববাসী মহা নিয়ামত হিসেবে পান করে চলেছে। পান করতে থাকবে কিয়ামত পর্যন্ত। এ পানি ফুরায় না, ফুরাবে না।
দুনিয়াতে আবে হায়াত আবে যমযম ধারা
এই সুধা পান করতে নিখিল বিশ্ব মাতোয়ারা \
ধন্য মাসুম শিশু ইসমাঈল ধন্য মা হাজেরা
আনলে ধরায় খোদার সওগাত জান্নাতী ফোয়ারা \
সারে জাহান পান করে হায় ফুরায়না তবু পানি
ক্ষুদ্র এ কূপ তবু যে এর নাই যে কূল-কিনারা \
আল্লাহপাক মা হাজেরার দৌড়াদৌড়িকে এতই পছন্দ করলেন যে, তা হজ ও ওমরাকারীদের ওপর ওয়াজিব করে দিলেন। আল্লাহর ফরমান ঃ
‘সাফা ও মারওয়া আল্লাহর নিদর্শনসমূহের অন্যতম। সুতরাং যে কেউ কাবা গৃহের হজ বা ওমরা সম্পন্ন করে এই দুটির মধ্যে দৌড়ালে তাতে কোনো পাপ হবে না। বরং কেউ স্বতঃস্ফূর্তভাবে এ নেক কাজ করলে আল্লাহ (তার) পুরস্কারদাতা, সর্বজ্ঞ। ২-সুরা কারা : ১৫৮ আয়াত।
এ সময়ে জুরহুম গোত্রের একটি বাণিজ্য কাফেলা সিরিয়ার দিকে যাচ্ছিল এ পথ ধরে। প্রয়োজনীয় পানির সন্ধান করতে করতে পেয়ে গেল যমযম কূপ আর তার পাশে মা হাজেরা ও শিশু ইসমাঈলকে। খুব পছন্দ হলো তাদের জায়গাটি। হাজেরার অনুমতি নিয়ে তারা বসতি স্থাপন করল এখানে। আবাদ হলো মক্কার শহর।
ইতোমধ্যে ইসমাঈল উপনীত হলেন কৈশরে। তখন মহান আল্লাহ ইবরাহীম খলীলকে নির্দেশ দিলেন কাবা পুনঃস্থাপনের। তিনি নির্দিষ্ট স্থানে খুঁজে পেলেন আদম আ: প্রতিষ্ঠিত কাবার ভিত। বাপ-বেটা মিলে গড়ে তুলতে লাগলেন কাবার প্রাচীর এবং দোয়া করতে থাকলেন- ‘রাব্বানা তাকাব্বাল মিন্না ইন্নাকা আনতাস সামিউল আলীম’- ‘হে আমাদের প্রতিপালক! তুমি আমাদের এ কাজকে কবুল করো, নিশ্চয়ই তুমি সর্ব¯্রােতা, সর্বজ্ঞাতা, হে আমাদের প্রতিপালক; তুমি আমাদের তোমার একান্ত অনুগত করো। আমাদের বংশধরদের থেকে তুমি এক অনুগত উম্মত বানিও।’
হে আমাদের প্রতিপালক! এক রাসূল পাঠিও যে তোমার আয়াতসমূহ তাদের নিকট তিলাওয়াত করবে, তাদেরকে কিতাব হিকমত শিক্ষা দিতে এবং তাদেরকে পবিত্র করবে। তুমি পরাক্রমশালী, প্রজ্ঞাময়’ ২-সুরা বাকারা : ১২৭ ও ১২৮ আয়াত।



 

Show all comments
  • ১৫ জুলাই, ২০১৭, ২:১১ এএম says : 0
    সুবাহানআল্লাহ্
    Total Reply(0) Reply
  • Rafey ১৫ জুলাই, ২০১৭, ১২:২২ পিএম says : 0
    Alhamdulillah
    Total Reply(0) Reply
  • ১৫ জুলাই, ২০১৭, ২:০৬ পিএম says : 0
    ALLHAMDULILLA
    Total Reply(0) Reply
  • পাবেল ১৫ জুলাই, ২০১৭, ৩:৪৮ পিএম says : 0
    অসম্ভব সুন্দর ও তথ্যবহুল একটি লেখা লেখক ও দৈনিক ইনকিলাবকে অসংখ্য ধন্যবাদ
    Total Reply(0) Reply
  • তামান্না ১৫ জুলাই, ২০১৭, ৩:৫০ পিএম says : 0
    অনেক দিন পরে রূহুল আমীন খান হুজুরের একটি ধারাবাহিক লেখা পেলাম। আপনার নিয়মিত লেখা পড়তে চাই।
    Total Reply(0) Reply

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: কাবা


আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ