পটুয়াখালীর যুবক ক্বারী সাইয়্যেদ মুসতানজিদ বিল্লাহ রব্বানীর কোরআন তেলাওয়াতে মুগ্ধ যুক্তরাষ্ট্রবাসী
ইসলামি সভ্যতা ও সংস্কৃতি বিকাশে বাংলাদেশের অবদান অনস্বীকার্য। এদেশে ইসলামি সংস্কৃতি চর্চার ইতিহাস অনেক প্রাচীন।
সাখাওয়াত হোসেন : পাহাড়ধসে প্রাণহানী ও ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির নেপথ্যে কারণ চিহ্নিত করে এখনই প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করা না হলে ভবিষ্যতে আরো বড় ধরনের প্রাকৃতিক দুর্যোগের আশঙ্কা করছেন বিশেষজ্ঞরা। কোনো প্রকার নিয়মের তোয়াক্কা না করে পাহাড়ের ছোট ঘাস জ্বালিয়ে ন্যাড়া করে জুম চাষ ও অবাধে গাছ কেটে পাচার করছে পাহাড়ীরা। একশ্রেণীর সুবিধাভোগী পাহাড়ের মাটি ও গাছপালা কেটে নিয়ে নিজেদের স্বার্থ হাসিল করার কারণেই এখন বৃষ্টি হলে পাহাড় ধসে পড়ছে।
তিন পার্বত্য জেলায় বন উজাড়েও জড়িত রয়েছে শক্তিশালী কাঠ ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট। এই সিন্ডিকেটের কারণে আজ পার্বত্য জেলাগুলোর সবুজ পাহাড় পরিণত হয়েছে রীতিমতো ধ্বংসস্তুপে। স্থানীয় প্রশাসনের পক্ষ থেকে তাদের বিরুদ্ধে কোনো ধরনের পদক্ষেপ না নেয়ায় রাঙামাটি, বান্দরবান, খাগড়াছড়ি ও চট্টগ্রামের প্রভাবশালী পাহাড়ী চক্র ও কতিপয় বাঙালী বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। দিনের পর দিন পাহাড়ের উপর এ ধরনের পরিবেশ বিরোধী অত্যাচারের কারণে আজ পাহাড় ধসে পড়ছে। একদিকে নিহত হচ্ছে নারী, পুরুষ ও শিশু, অন্যদিকে দেশের অতি মূল্যবান প্রাকৃতিক সম্পদ ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে মারাত্মকভাবে। গত কয়েক দিনে পাহাড় ধসে তিন পার্বত্য জেলায় দেড়শতাধিক মানুষ নিহত হয়েছে। এখনো অনেককেই উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি। তিন পার্বত্য এলাকায় এক অমানবিক পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। পাহাড় ধসের কারণ নিয়ে গবেষণাকারী ও পার্বত্য এলাকার বাসিন্দারা বলছেন, পাহাড়ের গায়ের ঘাস পাহাড়কে বাঁচিয়ে রাখে। সেসব ঘাস ছেটে ফেলে মানুষের বসবাসের উপযোগী করতে গিয়ে ও গাছ কেটে বিক্রি করায় এ ধরনের ঘটনার সূচনা হয়েছে। বৃষ্টিপাত হলেই পাহাড় ধস হতো না, যদি না মানবসৃষ্ট কারণগুলো প্রভাবক না হতো।
একটি বেসরকারী প্রতিষ্ঠানের গবেষণায় বলা হয়েছে, পাহাড়ের গাছপালা কেটে ফেলা, মাটি কেটে ফেলা, প্রাকৃতিক খাল বা ঝরণার গতি পরিবর্তন এবং পাহাড়ের ঢালুতে অতিরিক্ত ভার দেয়া ধসের অন্যতম কারণ। একাধিক সূত্র জানা গেছে, প্রভাবশালী কতিপয় লোকজন কিংবা তাদের ছত্রছায়ায় থেকেই পাহাড়খেকোরা প্রতিনিয়ত মেতে ওঠে অশুভ খেলায়। যে কারণে একদিকে পাহাড়ে ঘটছে পরিবেশ বিপর্যয়। নিশ্চিহ্ন হয়ে যাচ্ছে অনেক পাহাড়। অন্যদিকে পাহাড়ের পাদদেশে আশ্রয় নেয়া হতদরিদ্র মানুষগুলো হচ্ছে পাহাড়খোকোদের অবৈধ উপার্জনের নির্মম বলি। প্রতি বছরই বর্ষা মৌসুমে ধসে পড়ছে পাহাড় ও মাটির নিচে চাপা পড়ছে মানুষ।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের মৃত্তিকা বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. খান তৌহিদ ওসমান সাংবাদিকদের বলেন, পাহাড়ি এলাকার বনজঙ্গল ধ্বংস করা হচ্ছে। কেটে ফেলা হচ্ছে গাছপালা। উজাড় করা হচ্ছে বন। অব্যাহত রয়েছে পাহাড় কেটে বসতি স্থাপন। এতে করে পাহাড়ের ‘অভ্যন্তরীণ বন্ধন’ দুর্বল হয়ে পড়ছে। এই দুর্বলতার কারণে টানা কয়েকদিনের বৃষ্টিতে চট্টগ্রাম ও পার্বত্য চট্টগ্রামে হুড়মুড় করে পাহাড় ভেঙে পড়েছে। ব্যাপক প্রাণহানির ঘটনা ঘটেছে। বনজঙ্গলে পরিপূর্ণ থাকার কারণে পাহাড়ে বনজ আমেজ থাকে। থাকে নিজস্ব একটা শক্তি। কিন্তু সেই শক্তিটা হারিয়ে ফেলছে পাহাড়। সৃষ্টি হচ্ছে ফাটল। যার কারণে অল্পবৃষ্টি বা অতিবৃষ্টিতে পানি ঢুকে পাহাড় ভারি হচ্ছে। ভার সইতে না পেরে ধসে পড়ছে। এ জন্য প্রকৃতি নয়; মানুষই দায়ী। এটা বন্ধ করা না হলে প্রকৃতির দান এই পাহাড়গুলো রক্ষা করা যাবে না। পরিবেশের ওপর সুদূরপ্রসারী নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। যার ক্ষতি মোকাবেলা করা কঠিন হবে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল ও পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক শহিদুল ইসলাম দৈনিক ইনকিলাবকে বলেন, পাহাড় ধসের কারণ প্রাকৃতিক ও মানবসৃষ্ট। বৃষ্টিপাত হলেই পাহাড় ধস হতো না, যদি না মানবসৃষ্ট কারণ তৈরি করা না হতো। পাহাড়ে যে ঘাস ও গাছ থাকে, সেগুলো কেটে ও আগুনে পুড়িয়ে ন্যাড়া করে দেয়ার কারণে শুষ্ক মৌসুমে ভেতরে ভেতরে এতটাই ফাটল তৈরি হয় যে, ভারি বৃষ্টিপাত হলেই ফাটলের ভেতর পানি ঢুকে মাটির স্তর নড়ে যায় এবং পাহাড় ধসে পড়ে। পাহাড়ধসে প্রানহানী ও ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির নেপথ্যে কারন চিহ্নিত করে এখনই প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহন করা না হলে ভবিষ্যতে আরো বড় ধরনের প্রাকৃতিক দুর্যোগের আশংকা রয়েছে। তিনি আরও বলেন, ধস যখন জনপদে নামে তখন আমাদের চোখে পড়ে। কিন্তু গবেষণা করতে গিয়ে দেখেছি, প্রচুর পাহাড় ধসে পড়ছে প্রতিবছর। পাহাড়গুলো যখন লিজ দেয়া হয়, তখন সেটা থাকে বন আচ্ছাদিত। কিন্তু লিজ নেন যিনি তিনি তার বাণিজ্যিক লক্ষ্য পূরণে প্রথমেই সেই বন উজাড় করেন। আর জনসংখ্যা বৃদ্ধির কারণে পাহাড় কেটে কেটে বসতি স্থাপন করা হয় অপরিকল্পিতভাবে। এক প্রশ্নের জবাবে অধ্যাপক শহিদুল ইসলাম দৈনিক ইনকিলাবকে বলেন, পাহাড়ে জুম চাষের নামে আনারসের বাগান ও কলা বাগান তৈরির নামে ঘাস ও গাছ কেটে ফেলা হচ্ছে। ঘাস থাকলে কার্পেটের মতো কাজ করতো এবং পানি উপরে দিয়ে নেমে যেত। আর এ ধরনের ধস হতো না। পাহাড় কেটে ন্যাড়া করে ফেলা বন্ধ করতে হবে। অন্যতায় এ ধরনের প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে রেহাই পাওয়া যাবে না। এদিকে সর্বশেষ পাহাড় ধসে বিপর্যয়ের পর বৃহস্পতিবার চট্টগ্রামের লালখান বাজার মতিঝরনার কয়েকটি ঝুঁকিপূর্ণ পাহাড় পরিদর্শন করেন সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। এ সময় তিনি বলেন, অনেক হয়েছে আর নয়। পাহাড় কেটে অপরিকল্পিত বসতি স্থাপন করা যাবে না। ঝুঁকিপূর্ণভাবে পাহাড়ের পাদদেশে বসবাসরতদের উচ্ছেদ করা হবে। পাহাড় কেটে বসতি স্থাপনে সুযোগ করে দেয়া কোনো পক্ষ যদি বাধা দিতে আসে তবে তাদের কঠোরভাবে দমন করা হবে। কারণ এটা লাখ লাখ মানুষের জীবনের ব্যাপার। পরিবেশ বিপর্যয়ের ব্যাপার। এ ক্ষেত্রে কোনো রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ সহ্য করা হবে না।
রাঙামাটির ব্যবসায়ী হামিদ উদ্দিন দৈনিক ইনকিলাবকে বলেন, বিগত কয়েক যুগ ধরে পাহাড় কাটার পাশাপাশি প্রকৃতির যতœ-আদরে পাহাড়ের গায়ে বেড়ে ওঠা নানা প্রজাতির বৃক্ষরাজিকে নির্বিচারে ধ্বংস করা হয়েছে। পাহাড় কেটে সমতল ভূমি তৈরি করে সেখানে মুনাফালোভী সিন্ডিকেট, তাদের ফায়দা হাসিলের চেষ্টায় ব্যস্ত। শুধু তাই নয়, পাহাড়ে পাহাড়িরা গাছ ও পাহাড় কেটে ঘর-বাড়ি তৈরি করছে অপরিকল্পিতভাবে। ফলে পাহাড় আর মাটি ধরে রাখতে পারছে না। পাহাড় ধসে নিহতের মধ্যে পাহাড়িদের সংখ্যাই বেশি। এ থেকেই বুঝা যায় পাহাড়ের ক্ষতি বাঙালীদের দ্বারা হচ্ছে না, হচ্ছে পাহাড়িদের দ্বারা।
তিান বলেন, সরকার তো সিদ্ধান্ত নেয় পাহাড়কে বাঁচানোর জন্য। কিন্তু সরকার দলের নেতাকর্মীদের কারণেই তা বাস্তবায়ন হয় না। রাজনৈতিক ছত্র-ছায়ায় থাকা ব্যক্তিরাই এ ধরনের কাজ করে থাকেন।
খাগড়াছড়ির আইনজীবি ও সমÑঅধিকারের সভাপতি মোঃ আব্দুল মালেক দৈনিক ইনকিলাবকে বলেন, পাহাড়িরা নির্বিচারে বন ধ্বংস করছে। এদের সাথে সামান্য বাঙালীও রয়েছে। পরিবেশ অধিদফতর ও পুলিশের উদাসীনতা, ক্ষেত্রবিশেষে তাদের রহস্যজনক সহযোগিতার কারণে পাহাড় রক্ষা করা যাচ্ছে না। প্রশাসনের কেউ কেউ রাজনৈতিক দলের শীর্ষ নেতাদের লেজুড়বৃত্তি করার কারণেও পাহাড় কাটা বা ধ্বংসের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারে না। পাহাড় রক্ষায় সরকার, রাজনৈতিক দলের নেতা, সরকারের বিভিন্ন সংস্থা ও প্রশাসনের সমন্বিত উদ্যোগ প্রয়োজন বলে তিনি জানান।
খাগড়াছড়ির ফল ব্যবসায়ী শামছুল ইসলাম দৈনিক ইনকিলাবকে বলেন, ছোটবেলায় বনজ বৃক্ষ ঘেরা পাহাড় দেখেছি। এখন সব কৃত্রিম বাগান। বড় প্রাকৃতিক বাগান নেই। পাহাড়ে যেসব গাছ লাগানো হয়েছে, তা মাটি ধরে রাখার উপযোগী নয়। আর যেখানে সেখানে পাহাড় কেটে ছোট ছোট রাস্তা তৈরি করা এবং বসতি স্থাপনের নজির গত বিশ-পঁচিশ বছরে ঘটেছে ব্যাপকহারে। ওপরে ন্যাড়া আর নিচে কেটে খোঁড়া বানানো পাহাড়গুলোই ভারি বর্ষণে ধসে পড়ছে। আগে দেখেছি, বসতি স্থাপনের উপযোগী কিনা তা দেখে শুনে জায়গা নির্ধারণ করতেন পাহিড়িরা। এই অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে বসতি স্থাপনের নজির এখন দেখা যায় না। এখন পাহাড়িরা সব জায়গা দখলে রাখতে চায় বলে তিনি মন্তব্য করেন।
এক গবেষণায় বলা হয়েছে, পাহাড় ধসের পেছনে প্রাকৃতিক কারণ এবং মানুষের বিভিন্ন কর্মকান্ড মূল প্রভাবক হিসেবে কাজ করে। প্রাকৃতিক কারণ হলো পাহাড়ের ঢাল যদি এমন হয় যে ঢালের কোনো অংশে বেশি গর্ত থাকে। তখন অতিবৃষ্টিতে ভূমি ধস হতে পারে। এ ছাড়া ভূমিকম্প, আগ্নেয়গিরির অগ্নুুৎপাত এবং পাহাড়ের পাদদেশের নদী ও সাগরের ঢেউ থেকেও পাহাড় ধস হতে পারে। আর মনুষ্য সৃষ্ট কারণ হিসেবে গবেষণায় বলা হয়েছে, পাহাড়ের গাছ পালা কেটে ফেলা, মাটি কেটে ফেলা, পাহাড়ে প্রাকৃতিক খাল বা ঝর্ণার গতি পরিবর্তন, পাহাড়ের ঢালুতে অতিরিক্ত ভার দেয়া এবং খনি খননের কারণে পাহাড় ধস হতে পারে। তবে আমাদের ভূতাত্তি¡করা বলছেন, বাংলাদেশে মূলত পাহাড়ের উপরের দিকে কঠিন শিলার অভাব, পাহাড়ের মাটি কেটে ফেলা এবং বড় গাছপালা কেটে ফেলার কারণেই পাহাড় ধস হয়ে থাকে। বাংলাদেশের পাহাড়গুলোতে কোন কঠিন শিলা নেই। তাই বৃষ্টির কারণে এ ধরনের মাটি পানি শুষে ফুলতে থাকে। তাছাড়া কঠিন শিলা না থাকায় মাটিগুলো নরম ও পিচ্ছিল হয়ে যায়। ফলে ভারি বর্ষণের সাথে সাথে মাটি ভেঙ্গে পড়ে। তাছাড়া যারা পাহাড়ে থাকেন তারা ঘর নির্মাণের জন্য পাহাড়ের সবচেয়ে শক্ত মাটির স্তরও কেটে ফেলেন। এতে পাহাড় ধসের শঙ্কা আরও তীব্র হয়।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।