Inqilab Logo

রোববার ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ০৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২১ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

পাহাড়ে ধস আতঙ্ক

চট্টগ্রামে মৃত্যুফাঁদে লাখো মানুষের বসতি : অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ শুরু : ধরাছোঁয়ার বাইরে দখলদার ভূমি দস্যুরা

রফিকুল ইসলাম সেলিম | প্রকাশের সময় : ২০ জুন, ২০২২, ১২:০১ এএম

টানা বর্ষণ অব্যাহত থাকায় বন্দরনগরীসহ বৃহত্তর চট্টগ্রামে পাহাড় টিলায় বসবাসকারীদের মাঝে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে। যে কোনো সময় পাহাড় ধসে প্রাণহানির আশঙ্কায় জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে পাহাড়ের কোলে মৃত্যুঝুঁকিতে থাকা লোকজনকে নিরাপদে সরিয়ে নেওয়ার পাশাপাশি অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ শুরু হয়েছে। তবে গতকাল রোববার কিছু স্থাপনা উচ্ছেদ আর কয়েকশ’ বাসিন্দাকে সরিয়ে নেওয়া হলেও পাহাড় টিলায় মৃত্যুফাঁদে এখনো লাখো মানুষ রয়েছে। মহানগরী ও এর আশপাশের এলাকা ছাড়াও জেলার সীতাকুণ্ড, হাটহাজারী, রাঙ্গুনিয়া বোয়ালখালীসহ বৃহত্তর চট্টগ্রামের শত শত পাহাড় টিলায় অবৈধ বসতি অক্ষত রয়ে গেছে। এসব পাহাড়ে কত মানুষের বসবাস তার প্রকৃত সংখ্যাও অজানা। বর্ষার শুরুতে শুক্রবার মধ্যরাতে নগরীর আকবর শাহ ও ফয়েজ লেক এলাকায় পৃথক দুটি পাহাড় ধসে চারজনের প্রাণহানি এবং ১১ জন আহত হওয়ার পর টনক নড়ে প্রশাসনের। শুরু হয় লোকজনকে নিরাপদে সরিয়ে নেওয়ার তোড়জোড় । প্রতি বছর বর্ষার শুরুতে প্রশাসন কিছুটা নড়েচড়ে বসলেও বর্ষা শেষে সবকিছু চলে আগের মতো। নতুন নতুন পাহাড়ে বিস্তৃত হয় পাহাড় খেকো ভূমি দস্যুদের থাবা। তাদের অবৈধ স্থাপনায় ভাড়া দিয়ে পরিবার পরিজন নিয়ে বসবাস করেন স্বল্প আয়ের হতদরিদ্র মানুষ। প্রতি বছর পাহাড় ধসে বেঘোরে মানুষ মরে আর ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে যায় দখলদারেরা।

এদিকে গতকাল দিনভর চট্টগ্রামে থেমে থেমে হালকা থেকে মাঝারি ধরনের বৃষ্টিপাত হয়েছে। পতেঙ্গা আবহাওয়া অফিসে বিকেল ৩টা পর্যন্ত ১০৯ দশমিক ৪ মি মি বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে। আমবাগান অফিস থেকে জানানো হয় বিকেল ৩টা থেকে ৬টা পর্যন্ত নগরীতে ৬১ মি. মি. বৃষ্টিপাত হয়েছে। আজ সোমবারও টানা বর্ষণ অব্যাহত থাকবে বলে আবহাওয়া অফিস থেকে জানানো হয়েছে। অবিরাম বর্ষণের কারণে পাহাড় ধসের সতর্কতা জারি করা হয়েছে। টানা বৃষ্টির সাথে প্রবল জোয়ারে নগরীর বিভিন্ন এলাকায় প্লাবিত হয়েছে। গতকাল দ্বিতীয় দিনের মতো বসত ঘর, দোকানপাট, আড়তে পানি ঢুকে পড়ে। পানিবদ্ধতায় অনেক এলাকায় নগরবাসী চরম দুর্ভোগের শিকার হন। নগরীতে চলছে উন্নয়নের খোঁড়াখুঁড়ি। প্রধান প্রধান সড়ক থেকে শুরু করে অলিগলিতে ব্যাপক রাস্তা কাটাকাটির কারণে সড়কে এখন কাদা পানিতে সয়লাভ। রাস্তায় নেমেই দুর্ভোগে পড়তে হচ্ছে। কয়েক ঘণ্টার বৃষ্টিতে তলিয়ে যাচ্ছে নগরীর বিভিন্ন এলাকা। খাল, নালা নর্দমা সংস্কার না করায় পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থা বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে। পানিবদ্ধতা নিরসনে নগরীতে ছয় হাজার কোটি টাকার প্রকল্প চলমান রয়েছে। সিটি কর্পোরেশন বলছে প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য নগরীর বেশিরভাগ খালে বাঁধ নির্মাণ করা হয়েছে। এসব বাঁধ বর্ষার আগে অপসারণ না করায় পানি নিষ্কাশনে সমস্যা হচ্ছে। এর খেসারত দিতে হচ্ছে নগরবাসীকে। তবে প্রকল্প বাস্তবায়নকারী সিডিএর কর্মকর্তারা বলছেন, প্রকল্প বাস্তবায়নের কারণে এখন কম সময়ে পানি সরে যাচ্ছে। পানিবদ্ধতা হলেও তা বেশি সময় স্থায়ী হচ্ছে না।

নগরীতে পাহাড় কাটা অব্যাহত থাকায় বৃষ্টির সাথে পাহাড়ি ঢলে নেমে আসা বালু মাটিতে খাল নালা দ্রুত ভরাট হয়ে যাওয়ায় পানি আটকা পড়ছে। আবার খাল নালা হয়ে পাহাড় থেকে নেমে আসা কাদা বালুর সাথে নগরবাসীর বর্জ্য কর্ণফুলীতে গিয়ে পড়ছে। তলদেশ ভরাট হয়ে যাওয়ায় চরম বিপর্যয়েরমুখে চট্টগ্রাম বন্দরের ধারক কর্ণফুলী নদী। এত কিছুর পরেও প্রকৃতি ও পরিবেশ সুরক্ষায় পাহাড় নিধন বন্ধের কোন উদ্যোগ নেই। বিগত ২০০৭ সালের ১১ জুন চট্টগ্রামের পৃথক সাতটি স্থানে পাহাড় ধসসহ ভয়াবহ প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে ১২৭ জনের প্রাণহানির পর গঠিত তদন্ত কমিটি পাহাড় কাটা রোধে বেশকিছু সুপারিশ করে। পাহাড়ধসে প্রাণহানির জন্য গঠিত কমিটি ৩৬টি সুপারিশ করে। একই ঘটনায় সিডিএমপির (সরকারের সমন্বিত দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কর্মসূচি) পক্ষ থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর মাকসুদ কামালকে প্রধান করেও গঠিত হয় তদন্ত কমিটি। এ কমিটির ২২ দফা সুপারিশ ছিল। অর্থাৎ ২০০৭ সালের প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের ঘটনাকে ঘিরে গঠিত তদন্ত কমিটিগুলোর ৭২টি সুপারিশ করে। যার বেশিরভাগই বাস্তবায়ন হয়নি গত ১৫ বছরে। ফলে প্রায় প্রতিবছরই পাহাড় ধসে প্রাণহানির ঘটনা ঘটে। ২০০৮ সাল থেকে এ পর্যন্ত প্রাণহানি ঘটে আরো ১২০ জনের। সবমিলিয়ে গত ১৫ বছরে নগরীর ও আশেপাশে পাহাড় ধসে ২৪৭ জন প্রাণ হারায়। সুপারিশগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল ঝুঁকিপূর্ণ পাহাড়ে বসতি স্থাপন নিষিদ্ধ করা। ২০০৭ সালের পাহাড় ধসের পর চট্টগ্রাম বিভাগীয় কমিশনারকে আহ্বায়ক এবং অতিরিক্ত জেলা প্রশাসককে (রাজস্ব) সদস্য সচিব করে গঠন করা হয় ‘পাহাড় ব্যবস্থাপনা কমিটি’। এ পর্যন্ত ২৭টি সভা করেছে ওই কমিটি। প্রতিটি সভায় পাহাড়ে ঝুঁকিপূর্ণভাবে যারা বসবাস করে তাদের উচ্ছেদের সিদ্ধান্ত হয়। এছাড়া অবৈধভাবে বসবাসকারীদের বাসায় অবৈধ ইউটিলিটি সার্ভিস অর্থাৎ বিদ্যুৎ, গ্যাস ও পানির সংযোগ বিচ্ছিন্ন করারও সিদ্ধান্ত হয়। কমিটির সর্বশেষ সভা হয়েছে গত ২৭ মার্চ। ওই সভায়ও একই সিদ্ধান্ত হয়েছিল। তবে কোন সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন হয় না। নগরীতে পাহাড়ে অবৈধ স্থাপনা কত এবং বসবাসকারীর সংখ্যা কত তার হিসাব নেই প্রশাসনের কাছে। তবে ২০১৫ সালে করা সর্বশেষ তালিকা অনুযায়ী, নগরীতে ২৮টি ঝুঁকিপূর্ণ পাহাড় আছে। এরমধ্যে ১৭টি অতিঝুঁকিপূর্ণ পাহাড়ে ৮৩৫ পরিবার বসবাস করে। ১৭ পাহাড়ের মধ্যে ব্যক্তিমালিকানাধীন ১০ পাহাড়ে অবৈধভাবে বাস করছে ৫৩১ পরিবার। সরকারি বিভিন্ন সংস্থার মালিকানাধীন ৭ পাহাড়ে বাস করছে ৩০৪ পরিবার। তবে গত কয়েক বছরে বর্ষাকালে উচ্ছেদ অভিযান চালায় জেলা প্রশাসন। অবশ্য ওসব অবৈধ বসবাসকারীরা আবারো ফিরে আসে পাহাড়ে। স্থানীয়দের তথ্য অনুযায়ী, গত কয়েক বছরে এ সংখ্যা বেড়েছে। মহানগরীর বাইরে উপজেলা পর্যায়ে পাহাড়ে বসবাসকারীদের কোন তথ্য নেই প্রশাসনের কাছে।

এদিকে গতকাল পাহাড়ে অবৈধ ও ঝুঁকিপূর্ণ বসবাসকারীদের বিরুদ্ধে উচ্ছেদ অভিযানের শুরুতে করেছে জেলা প্রশাসন পাহাড়ের পাদদেশে ১৮০টি স্থাপনা উচ্ছেদ করেছে। সকাল সাড়ে ১০টা থেকে বিকেল পর্যন্ত পূর্ব ফিরোজশাহের ১ নম্বর ঝিল এলাকায় ঝুঁকিপূর্ণ এসব অবৈধ স্থাপনা অপসারণ করা হয়। উচ্ছেদ অভিযান পরিদর্শনকালে জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ মমিনুর রহমান বলেন, পাহাড়ে অবৈধ ও ঝুঁকিপূর্ণ যেসব স্থাপনা উচ্ছেদ করা হচ্ছে সেখানে পুনরায় কেউ যাতে দখলে নিয়ে স্থাপনা নির্মাণ করতে না পারে সেজন্য কাঁটাতার দিয়ে সীমানা নির্ধারণ করে গাছ লাগানো হবে। অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করে সেখানে কাঁটাতারের বেড়া দিয়ে সীমা নির্ধারণ করা হবে। অভিযান অব্যাহত থাকবে বলেও জানান তিনি।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: পাহাড়ে ধস আতঙ্ক

২০ জুন, ২০২২
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ