পটুয়াখালীর যুবক ক্বারী সাইয়্যেদ মুসতানজিদ বিল্লাহ রব্বানীর কোরআন তেলাওয়াতে মুগ্ধ যুক্তরাষ্ট্রবাসী
ইসলামি সভ্যতা ও সংস্কৃতি বিকাশে বাংলাদেশের অবদান অনস্বীকার্য। এদেশে ইসলামি সংস্কৃতি চর্চার ইতিহাস অনেক প্রাচীন।
জামালউদ্দিন বারী : দেশের জাতীয় সংস্কৃতিতে ধর্মের অবস্থান এবং চিরায়ত বাঙ্গালিত্ব নিয়ে একটি দ্বা›িদ্বক অবস্থান দীর্ঘদিনের। আমাদের একশ্রেনীর বুদ্ধিজীবী ও তথাকথিত সুশীল সমাজের সেক্যুলার মতাদশির্ক কেউ কেউ এ দেশের লোকায়ত সংস্কৃতিতে ইসলামি ঐতিহ্যকে অচ্ছুত প্রমাণ করতেই যেন আগ্রহী। তারা নানা উপলক্ষ্যে হিন্দুয়ানি এবং বিজাতীয় সংস্কৃতিকেই চিরায়ত বাঙ্গালী সংস্কৃতি বলে সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানের উপর চাপিয়ে দিতে চায়। কেউ কেউ তো থেমিসের মূর্তি সরানোর খেদ ঝাড়তে গিয়ে মসজিদ না রাখার পক্ষেও কথা বলেন। তবে ধর্মের কল বাতাসে নড়ে। যে সংস্কৃতির বোধ ও বিশ্বাসএ দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের আত্মার গভীরে প্রোথিত তাকে উপড়ে ফেলার শক্তি কোন বিজাতীয় প্রতিভ’ শক্তির নেই। এ কারণেই বহুজাতিক কপোর্রেট কোম্পানীগুলো যেমন রমজান ও ঈদের সময় নিজের পণ্যের বিজ্ঞাপণে ইসলামি ঐতিহ্য মূল্যবোধের সংমিশ্রণ ঘটিয়ে বাজার ধরার চেষ্টা করে থাকে। একইভাবে তথাকথিত সেক্যুলার ও ভিন্ন মতাবলম্বি ব্যক্তি ও সংস্থাকেও রমজানে শানদার ইফতার পার্টির আয়োজন করে থাকে। সাম্প্রতিক সময়ে কোন কোন সংগঠন ও সংস্থাকে শহরের নামিদামি হোটেল- রেস্তোঁরায় সেহেরি পার্টিও দিতে দেখা যাচ্ছে। বাংলাদেশের ধর্মীয় ও সামাজিক-রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে ইফতার মাহফিল বা পার্টি আয়োজনের অনেক পুরনো ঐতিহ্য থাকলেও সেহেরী পার্টি একেবারেই নতুন ধারনা এবং সংযোজন। ইফতার পার্টি যদি হতে পারে সেহেরি পার্টিও হতেই পারে। দুই দিন দশক আগেও ইফতার পার্টি আজকের মত এমন বিস্তৃত সামাজিক-রাজনৈতিক আবহে বিদ্যমান ছিলনা। ভবিষ্যতে হয়তো নাগরিক সংস্কৃতিতে ইফতার পার্টির পাশাপাশি সেহেরি পার্টিও আরো ব্যাপকতা লাভ করবে। আপ্যায়ন ও সামাজিক-রাজনৈতিক সংস্কৃতির মেলবন্ধন হিসেবে আমরা রোজার মাসে ইফতার ও সেহেরি পার্টিকে বেছে নিলেও আমাদের মনে রাখতে হবে যে, এটি ইসলামের অন্যতম মৌলিক স্তম্ভ সিয়াম সাধনার অনুসঙ্গ। কোরআন মজিদে রোজা বা সিয়াম সাধনাকে তাকওয়া বা খোদাভীতির মাধ্যমে পারলৌকিক শান্তি ও ক্ষমার পথ হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছে। রমজানের মূল শিক্ষা হচ্ছে সুবহে সাদিকের আগে থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত সব ধরনের পানাহার থেকে বিরত থাকার পাশাপাশি, ইন্দিয়পরায়ণতা, অশ্লীলতা ও মিথ্যাচার থেকে বিরত থাকা। আক্ষরিক অর্থে এর নাম আত্মসংযম। আমাদের সাম্প্রতিক সামাজিক সংস্কৃতিতে গ্রাম এবং রাজধানীসহ বিভাগীয় শহরগুলোতে যে সব ইফতার মাহফিল হচ্ছে, সেখানে প্রায় সব রাজনৈতিক দল, সামাজিক সংগঠন, ধর্মীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও পেশাজীবী সংগঠনের সর্বস্তরের নেতাকর্মীদের যেমন সম্মিলনের পাশাপাশি এসব ইফতার মাহফিলে রাজনৈতিক আলোচনো-সমালোচনার পাশাপাশি রমজানের গুরুত্ব এবং ইসলামের গুরুত্বপূর্ণ আক্বিদা সম্পর্কেও আলোচনা হয়ে থাকে। সংগত কারণে এসব মাহফিলে ধর্মীয় ব্যক্তিত্ব, আলেম ও ওলামা মাশায়েখদের সম্মানজনক উপস্থিতিও লক্ষ্যনীয়। আমাদের রাষ্ট্র ও সমাজ যখন সেক্যুলার কালচারের প্রতিযোগিতায় নেমে পড়েছে, ঠিক তখনো রমজান মাসে কোটি মানুষের ধর্মীয় আবেগকে মূল্য দিতে বাধ্য হচ্ছে দেশের প্রায় সব রাজনৈতিক মতাদর্শের প্লাটফর্মকেই। এভাবেই সাম্প্রতিক সাংবাৎসরিক রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে রমজান মাস এবং ইফতার মাহফিল নতুন মাত্রা যোগ করে চলেছে। আগে পরে যা’ই ঘটুক, রমজান মাসের তিরিশ দিনই রাজধানী ঢাকাসহ বিভাগীয় শহরগুলোর ছোটবড় মিলনায়তনগুলো ইফতার মাহফিল কেন্দ্রিক সামাজিক-রাজনৈতিক মিলনমেলায় পরিনত হতে দেখা যাচ্ছে। আগামী বছর অনুষ্ঠিতব্য জাতীয় নির্বাচনের রোডম্যাপ, জনমত গঠন, কর্মীদের সাথে যোগাযোগ এবং সম্ভাব্য প্রার্থীরা নিজেদের আভাস ও ইচ্ছার প্রতিফলন ঘটাচ্ছেন ইফতার মাহফিলে। রোজার মাসে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল,সামাজিক ও পেশাজীবী সংগঠনের তরফে আয়োজিত ইফতার পার্টি বা মাহফিলের সঠিক সংখ্যা বা পরিসংখ্যান নিরূপণ করা হয়তো সম্ভব নয়। কয়েক বছর আগে দেশের দ্বিতীয় সারির একটি রাজনৈতিক দলের ঢাকা মহানগর কমিটি রমজানের ৩০ দিনে প্রায় ৬ হাজার ইফতার পার্টির আয়োজন করেছিল বলে সে সময় প্রকাশিত একটি রিপোর্টে জানা যায়। আগামী জাতীয় নির্বাচনকে সামনে রেখে ক্ষমতাসীন আওয়ামিলীগ এবং প্রধান বিরোধিদল বিএনপি’র কেন্দ্র থেকে শুরু করে প্রায় প্রতিটি স্থানীয় ও অঙ্গ সংগঠনের পক্ষ থেকে আয়োজিত মাসব্যাপি ইফতার মাহফিলে রাজনীতিই মূখ্য বিষয়। তবে এই ইফতার রাজনীতিতে কোটি কোটি টাকা খরচ করে যে রসনা চর্চা হয় সেখানে তৃণমূল রাজনীতির অনেক নি¤œ আয়ের মানুষেরও ক্ষুন্নিবৃত্তি হয়ে থাকে। অনেক বছর ধরেই রমজান মাসের একেবারে শুরুতে বিরোধিদল বিএনপি’র চেয়ারপারসন ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া বিশাল আয়োজনে এতিম ও আলেমদের জন্য ইফতার মাহফিলের আয়োজন করছেন ঘটা করে। এরপর ধারাবাহিকভাবে সাংবাদিক-পেশাজীবী, ক’টনীতিক ও রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের সাথে ইফতারের আয়োজনে যোগ দিচ্ছেন। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামিলীগ নেতা শেখ হাসিনাও অনুরূপভাবে গণভবনে ইফতার মাহফিলের আয়োজন করছেন। এভাবেই ইসলামের একটি ধর্মীয় বিধান আমাদের সামাজিক-রাজনৈতিক সংস্কৃতির অংশে পরিনত হচ্ছে। এবার রমজানের শুরুতে বিরোধিদল বিএনপি’র একটি ইফতার মাহফিলে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে দাওয়াত করা হয়েছিল বলে পত্রিকায় খবর বেরিয়েছিল। সে ইফতার মাহফিলে প্রধানমন্ত্রী না গেলেও ইফতারির রাজনীতিতে দুই প্রধান রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ নেতার মধ্যে পরস্পরকে দাওয়াত দেয়ার এই কালচারকে আমাদের চলমান রাজনৈতিক বাস্তবতার একটি ইতিবাচক দিক হিসেবেই বিবেচনা করতে হবে। অতএব ইফতার সংস্কৃতির ধর্মীয়, সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক দিক রয়েছে। সব ক্ষেত্রেই এই সংস্কৃতি সমাজে রাজনীতিতে ও অর্থনীতিতে ইতিবাচক প্রভাব রাখছে। ইফতার সংস্কৃতি যেভাবে জনপ্রিয়তা পাচ্ছে ও সমাজে বিস্তৃত হচ্ছে এ নিয়ে একশ্রেনীর মানুষের খেদও যেন বেড়ে যাচ্ছে। কেউ কেউ পত্রিকায় কলাম লিখেও ইফতারির ব্যাপকতা নিয়ে উষ্মা প্রকাশ করছেন। ঢাকার একজন সাবেক বিএনপি নেতা যিনি নিজেই রাজনৈতিক দল গঠন করেছেন, তিনি মনে করেন যারা ধর্মের রাজনীতিতে বিশ্বাস করেননা তাদের ইফতার রাজনীতিকে ‘ভন্ডামি। তিনি নিজের দলের পক্ষ থেকে কোন ইফতার পার্টি করবেননা বলে ঘোষনা দিয়েছিলেন। কর্মী-সমর্থকহীন নামসর্বস্ব দলের নেতা হলে মাঝে মাঝে ¯্রােতের বিপরীতে গিয়ে কথা বলে চমক সৃষ্টি করা যায়। এই নেতার বক্তব্যের জবাবে এমন বক্তব্য দিয়েছেন একজন সাধারণ পাঠক। ইফতারির অনুষ্ঠান না করার আনুষ্ঠানিক ঘোষনাকেও প্রচার পাওয়ার জন্য এক ধরনের রাজনৈতিক স্ট্যান্টবাজি বলে ধরে নেয়া যায়। গত মঙ্গলবার সিপিপি বাসদ সহ বাম মোর্চার নেতারা জ্বালানী মন্ত্রনালয় ঘেরাও কর্মসূচিতে অংশগ্রহন করে দেয়া বক্তব্যে হাওরাঞ্চলের কোটি মানুষের সেহেরি ও ইফতার জুটছেনা বলে দাবী করে তারা সেখানকার জলমহালগুলোর ইজারা বন্ধ রাখার আহŸান জানিয়েছেন। বাম দলগুলো নিজেদের ধর্মনিরপেক্ষ দাবী করার পরও এই রমজান মাসে দেশের নব্বুইভাগ মানুষের সেহেরি ও ইফতারির সংস্কৃতিকে উপেক্ষা করতে পারেননি। এটাই হচ্ছে এই সময়ের সামাজিক-রাজনৈতিক বাস্তবতা। কিন্তু যারা ধর্মকে আমাদের জাতিসত্বার অঙ্গ বলে মনে করেন, যারা ধর্ম নিয়ে রাজনীতি করেন, যারা নিজেদের ধর্মনিরপেক্ষ দাবী করেও মদিনা সনদের ভিত্তিতে দেশ চালানোর রাজনৈতিক বক্তব্য দেন তারা ইফতারির মাহফিল ও সমাবেশকে নিজেদের রাজনৈতিক সমাবেশে পরিনত করতেই পারেন। তবে সিয়াম সাধনার মাসে ধর্মপ্রান মুসলমানদের কাছে ইফতারির আগের সময়টি পবিত্র ও দোয়া কবুলের সময় বলে বিশ্বাস করেন। রাজনৈতিক দলগুলো ইফতারির আয়োজনকে তাদের নেতা-কর্মী ও সমর্থকদের সম্মিলন ও ভুঁড়িভোজের অজুহাত হিসেবে ব্যবহার করতে চান করুন। তবে ইফতারির মাহফিলের ধর্মীয় ভাবগাম্ভীর্য ও পবিত্রতা ক্ষুন্ন হোক এমনটা কোন সাধারণ মুসলমানও প্রত্যাশা করেননা। রাজনৈতিক দলের ইফতার মাহফিলে আগামী নির্বাচনসহ জাতীয় বাজেট ও সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের প্রত্যাশার কথাগুলো উঠে আসাটা অস্বাভাবিক নয়। তবে ইফতারির মত একটি ধর্মীয় অনুষ্ঠানে ধর্মীয় আলোচনার চেয়ে দোষারোপ ও গলাবাজির রাজনৈতিক বক্তব্য বেশী থাকলে তা’ ইফতারির রিচুয়ালকেই ক্ষতিগ্রস্ত করে। আজ আমাদের সমাজে যে নৈতিক অবক্ষয়, রাজনৈতিক অসহিষ্ণুতা, দুর্নীতি-দস্যুতা বেড়ে চলেছে এই রমজানের সিয়াম সাধনার পাশাপাশি ইফতারির মাহফিলগুলোতে সে সব বিষয়ে ধর্মের নির্দেশনা ও জনসচেতনতা গড়ে তোলার কার্যকর উদ্যোগ নেয়া যেতে পারে। সত্যিকার অর্থে ইসলামি মূল্যবোধে বিশ্বাসী হলে রমজান মাসে ইফতারির রাজনীতি অথবা রাজনৈতিক ইফতার পার্টি ইসলামের আলোয় আলোকিত এক নতুন ধারার কল্যাণমুখী রাজনীতির সুফল বয়ে আনতে পারে।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।