Inqilab Logo

রোববার, ০৭ জুলাই ২০২৪, ২৩ আষাঢ় ১৪৩১, ৩০ যিলহজ ১৪৪৫ হিজরী

যুক্তরাষ্ট্রে শিখরা ক্রমবর্ধমান বৈরিতার সম্মুখীন

| প্রকাশের সময় : ১৫ জুন, ২০১৭, ১২:০০ এএম

লস অ্যাঞ্জেলেস টাইমস : যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়ার বেকারসফিল্ড শহর। বলমিত সিং তার ১৩ বছরের জ্ঞাতি ভাইকে জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানাতে বার্গার দোকানর বাইরে বেরিয়ে আসার পর তার পথ আটকায় এক অচেনা লোক। লোকটি বলে, ‘তাহলে তুমি এ দেশটাকে উড়িয়ে দিতে যাচ্ছ? তুমি এ দেশটাকে উড়িয়ে দেয়ার চেষ্টা করছ ?’ সে সিং-এর মুখের লম্বা দাড়ি ও মাথার পাগড়ি লক্ষ্য করে হাতে থাকা গøাসের মদ ছুঁড়ে দেয়। তারপর সিংকে হত্যার হুমকি দেয় লোকটি। কাছের খোলা জায়গায় ডজন খানেক লোক বসেছিল। সিং তাদের মুখের দিকে তাকিয়ে দেখেন। কেউ একটি কথাও বলল না। তিনি জীবনে আর কখনো এত একা বোধ করেননি।
১১ সেপ্টেম্বরের হামলা রিয়েল এস্টেট এজেন্ট ৩১ বছর বয়স্ক বলমিত সিংকে আর সব শিখের মতই লক্ষ্যবস্তু করে। তাকে মুসলিম বলে ভুল করা হতে থাকে। শিখ সম্প্রদায়ের নেতারা বলেন, ২০১৬-র প্রেসিডেন্ট নির্বাচন এবং ট্রাম্প প্রশাসনের প্রস্তাবিত অভিবাসন ও ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞার পর শিখদের প্রতি বিদ্বেষ বেড়েছে। তারা বলেন, এসব পদক্ষেপ জোর বিদেশী ভীতিতে আরো ইন্ধন যুগিয়েছে।
উত্তর ভারতের পাঞ্জাব অঞ্চল ও পাকিস্তানের পূর্বাঞ্চল হল শিখদের আদিভূমি। শিখ ধর্ম বিশে^র পঞ্চম বৃহত্তম ধর্ম।
এফবিআই ২০১৫ সালে প্রথমবারের মত শিখ বিরোধী, আরব বিরোধী ও হিন্দু বিরোধী হেট ক্রাইম সম্পর্কে ডাটা সংগ্রহ শুরু করে। শিখ সম্প্রদায় কয়েক বছর ধরে এসব অপরাধের সঠিক ভাবে সনাক্ত করা চেষ্টা করছিল। এফবিআই-র অতি সাম্প্রতিক রিপোর্টে এসব ঘটনার মাত্র ৬টিকে শিখ বিরোধী অপরাধ বলে চিহ্নিত করা হয়। তবে ব্যুরো বলেছে, সঠিক তথ্য পেতে কয়েক বছর লেগে যাবে।
শিখ অ্যাডভোকেসি গ্রæপগুলো বলেছে, এ ধরনের ঘটনাগুলো রিপোর্ট করা হয় না কিংবা অন্য ঘৃণাজনিত হামলা যেমন বৈষম্য বা হেট স্পিচ-এর অন্তর্ভুক্ত হয় না। এফবিআই রিপোর্ট মতে, বহু শহরই এ ধরনের অপরাধ রিপোর্ট করে না বা কোনো হেট ক্রাইম হয়নি বলে জানায়। অ্যাডভোকেসি গ্রæপ সাউথ এশিয়ান আমেরিকানস লিভিং টুগেদার -এর নির্বাহী পরিচালক সুমন রঘুনাথন বলেন, এসব হামলা, ভীতি প্রদর্শন বা শত্রæতার জোয়ারের কারণ হচ্ছে শিখরা মুসলমান বলে ধারণা।
শিখ কোয়ালিশনের অন্তর্বর্তীকালীন এমডি অব প্রোগ্রামস রাজদীপ সিং জলি বলেন, অ্যাডভোকেসি গ্রুপ শিখরা সর্বোচ্চ ঝুঁকিতে আছে কিনা তা নির্ধারণের জন্য মুসলিম বিরোধী হেট ক্রাইমের ডাটা ব্যবহার করেছে। তিনি বলেন, এ মুহূর্তে শিখ বিরোধী হেট ক্রাইমের ঝুঁকি বেশী। যে কোনো সময় অভিবাসন বিরোধী কথাবার্তা জোরদার হতে পারে।
যদিও কিছু ক্ষেত্রে শিখদের উপর ভুল ধারণা থেকে হামলা চালানো হয়েছে, হামলাকারীরা তাদের মুসলমান বা মধ্যপ্রাচ্যের লোক মনে করেছে, বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এর বেশীরভাগই হয়েছে চামড়ার গাঢ় রং, দাড়ি ও পাগড়ির কারণে।
এ বছর কানসাস, ওয়াশিংটন ও সাউথ ক্যারোলিনায় দুই শিখ ও অন্য আরো দু’জন ভারতীয়কে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে। এ গুলোর মধ্যে দু’টি ঘটনায় হত্যাকারীদের কাছ থেকে একই ধরনের কথা শোনা গেছেÑ তোমাদের দেশে ফিরে যাও।
কম্যুনিটি সদস্যরা শিখবাদ সম্পর্কে সাধারণ মানুষকে শেখানোর চেষ্টা করছেন। তারা সচেতনতা মূলক প্রচার অভিযানে মুসলমান বা অন্যদের আক্রমণ না করে নিজেদের আলাদা বৈশিষ্ট্যের কথা বলছেন।
মান সিং খালসা তার উপর হামলা প্রসঙ্গে জানান, ক্যালিফোর্নিয়ার রিচমন্ডে সিগন্যালে লাল বাতি জ¦লার পর তিনি গাড়ি থামান। তার পিছনে একটি সাদা ফোর্ড এফ-১৫০ পিকআপ ট্রাক এসে থামে। তাতে কয়েকজন লোক ছিল। তারা তার দিকে বিয়ারের ক্যান ছুঁড়তে থাকে। সবুজ বাতি জ¦লার পর তিনি গাড়ি ছাড়েন ও ৯১১-তে রিং করেন। ট্রাকটি তার পিছনে রওনা হয়। পরবর্তী লালবাতিতে দু’জন লোক পিকআপ থেকে নেমে তার গাড়ির দিকে দৌড়ে আসে। তারা গাড়ির খোলা জানালা দিয়ে তার মুখে ঘুসি মারে ও চিৎকার করে গালি দিতে থাকে। তারা তার এক গোছা চুল কেটে নেয়। তার আঙ্গুলে ছুরিকাঘাত করে । তিনি নিজেকে রক্ষার চেষ্টা করেন। পরে তার আঙ্গুল কেটে বাদ দিতে হয়।
তিনি বলেন, আমার চুল কেটে হামলাকারীরা শুধু আমাকে শারীরিক ভাবে হামলাই করেনি, তারা আমার মর্যাদা, আমার চেতনা, আমার বিশ^াস, আমার ধর্ম আমার গোটা সম্প্রদায়কে হামলা করেছে।
২০০১ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর বলবির সিং সোধি আরিজোনার মেসায় তার গ্যাস স্টেশনের বাইরে ল্যান্ডস্কেপারের সাথে ফুলের গাছ লাগাচ্ছিলেন। তার মাথায় পাগড়ি ছিল। ফ্রাংক রোক (৪২) নামে এক ব্যক্তি তার পিকআপ নিয়ে জায়গাটি অতিক্রমের সময় একটি .৩৮ হ্যান্ডগান থেকে গুলি চালায়। সোধি কয়েকবার গুলিবিদ্ধ হন। তিনি হচ্ছেন ৯/১১-র পরে নিহত প্রথম শিখ। হামলার আগে রোক একজন ওয়েটারকে বলেছিল যে সব আরবকে হত্যা করা উচিত। সে কয়েকজন ইরানিকে গলা কেটে হত্যা করতে চায়। সোধির ভাই বলেন, হত্যাকারী তার দাড়ি ও পাগড়ি দেখে ভুল বুঝেছিল।
উইসকনসিনে গণহত্যার পর কম্যুনিটি অ্যাডভোকেসির প্রেক্ষিতে এফবিআই শিখদের বিরুদ্ধে হেট ক্রাইম সম্পর্কে তদন্ত করতে শুরু করে। উইসকনসিনে ৬ জন নিহত ও ৩ জন গুরুতর আহত হয়। হামলাকারী নিজের মাথায় গুলি করে আত্মহত্যা করে।
শিখদের উপর এর পর কয়েকবার হামলা হয়। কিন্তু ফেব্রæয়ারিতে কানসাসে গোলাগুলির ঘটনা ভারতীয় কম্যুনিটিকে প্রান্তসীমায় নিয়ে আসে। এ হামলায় এক ব্যক্তি দু’জনকে গুলি করে হত্যা করে যে মনে করেছিল সে ইরানিদের গুলি করছে।
শিখ নাগরিক অধিকার প্রবক্তা ভ্যালেরি কাউর বলেন, বিদেশী ভীতি বিরাজ করার মধ্যে ভুল পরিচয়ের শিকার হয়ে শুধু শিখরা নয়, আমাদের সকল কম্যুনিটি হামলার শিকার হচ্ছে।
তিনি বলেন, বাদামি রং, দাড়িওয়ালা ও পাগড়ি পরা কেউ যদি নিজেকে শিখ বলে ও মুসলিম না বলে তাহলে খুব সামান্যই পার্থক্য করা যায়। হামলাকারীরা আমাদের অ-আমেরিকান ভাবে।
ক্যালস্টেট সান বার্নার্ডিনো সেন্টার ফর দি স্টাডি অব হেট অ্যান্ড এক্সটিমিজম-এর পরিচালক ব্রায়ান লেভিন বলেন, অভিবাসন বিষয়ে ট্রাম্পের কথাবার্তা অবশ্যই হেট ক্রাইম বৃদ্ধির কারণ নয়। তবে রাজনৈতিক কথাবার্তা ও ক্রাইমের মধ্যে সম্পর্ক থাকতে পারে।
লেভিন বলেন, ৯/১১-র পরে তৎকালীন প্রেসিডেন্ট জর্জ বুশ সহিষ্ণুতার আবেদন জানানোর পর দেশব্যাপী মুসলিম বিরোধী হেটক্রাইম নাটকীয়ভাবে হ্রাস পায়। এটা আবার লাফিয়ে বৃদ্ধি পায় যখন ট্রাম্প ২০১৫ সালের ডিসেম্বরে সান বার্নার্দিনো সন্ত্রাসী হামলার পর প্রথম মুসলিম নিষেধাজ্ঞার প্রস্তাব করেন।
তিনি বলেন, তখন মুসলিম বিরোধী হেটক্রাইমের সাখ্যা ছিল মাসে ১৩। কিন্তু ট্রাম্পের বক্তৃতার ৫ দিন পর তা বেড়ে মাসে ১৫টিতে দাঁড়ায়। তিনি বলেন, শিখরাও এর শিকার হচ্ছে।
ট্রাম্পের প্রথম ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞার পর বলমিত সিং-এর পরিবারে তারা কিভাবে নিজেদের আমেরিকান বলে প্রমাণ করবে সেটাই প্রধান বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। তারা গাড়িতে পাসপোর্টের কপি এবং ফোনে স্ক্যান করা কপি রাখার সিদ্ধান্ত নেন। কেউ হয়রানি করত পারে এ আশংকায় তারা তাদের ছোট বোনকে প্যানিক বাটন কিনে দেন।
সিং বেকারসফিল্ডে তার পিতা-মাতা, দাদা-দাদী ও বোনদের সাথ বাস করেন। তিনি বলেন, আমরা হঠাৎ করেই আবিষ্কার করলাম যে আমরা কে তা যথেষ্ট নয়, আমাদেরকে প্রমাণ করতে হবে আমরা কে।
যুক্তরাষ্টে ৫ লাখ শিখ বাস করেন। তাদের বেশিরভাগই থাকেন ক্যালিফোর্নিয়া ও নিউইয়র্কে।
৯/১১-র কয়েকদিন পরই বলবির সিং সোধি, তার ভাই রানা ও গুরুদোয়ারার অন্যান্য সদস্যরা জনগণকে শিখদের সম্পর্কে শিক্ষা দেয়ার জন্য রোববারে সংবাদ সম্মেলন করার পরিকল্পনা করেছিলেন। আগের দিন সোধি তার ভাইকে ডেকে পাঠান ও গ্যাস স্টেশনে উত্তোলনের জন্য আমেরিকার পতাকা আনতে বলেন। তার ৩০ মিনিট পর তিরি নিহত হন।
তার ভাই রানা সোধি বলেন, ১৯৮৪ সালে নয়া দিল্লীতে শিখরা প্রকাশ্যে নির্যাতিত হওয়ার সময় বহু সংখ্যক শিখ আমেরিকা চলে আসে। কিন্তু আমেরিকাতে আমরা এমন কিছু আশা করিনি।
আমেরিকায় শিখদের বিরুদ্ধে সংঘটিত অপরাধের বিবরণঃ
সেপ্টেম্বর ২০০১Ñ ৯/১১-র অব্যবহিত পর আরিজোনার মেসায় বলবির সিং সোদি হত্যা ঘটে।
মার্চ-২০১১Ñ ক্যালিফের্নিয়া এলক গ্রোভে হাঁটতে বের হওয়া দু’জন বৃদ্ধি শিখকে গুলি করে হত্যা করা হয়।
আগস্ট-২০১২Ñ উইসকনসিনের ওক ক্রিকে এক বন্দুকধারী এক গুরু দোয়ারার উপর গুলি চালায়।
সেপ্টেম্বর-২০১৫Ñ এক কিশোর এক শিখকে সন্ত্রাসী ও বিন লাদেন বলে আখ্যায়িত করে তাকে বেধড়ক কিল-ঘুিস মারে।
সেপ্টেম্বরÑ ক্যালিফোর্নিয়ার রিচমন্ডে ট্র্যফিক সিগন্যালে এক শিখকে মারপিট ও তার চুল কেটে নেয়া হয়।
ফেব্রæয়ারি- কানসাসের ওলাথে একটি বারে দু’জন ভারতীয়কে গুলি করা হয় এবং তারা গুরুতর আহত হয়। তারা তাদের দেশে ফিরে যেতে বলে।
মার্চ-ওয়াশিংটন ও সাউথ ক্যারোলিনায় ২ শিখকে গুলি করা হয়। সাউথ ক্যারোলিনার ঘাতক নিহত হয়।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ