ইভিএম-এ ভোট কেন?
আগামী জাতীয় নির্বাচনে ইভিএম-এ ১৫০ আসনে ভোট গ্রহণের পরিকল্পনার কথা জানিয়েছেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার। কাকতালীয় কিনা জানি না, ১৫০ সংখ্যাটা আমাদের এর আগে চিনিয়েছিলেন রকিবুল
মহিউদ্দিন খান মোহন
বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর প্রশ্ন করেছেন, ‘সরকার আসলে চালাচ্ছে কে? রাজনৈতিক নেতারা, আওয়ামী লীগের লোকেরা, নাকি গোয়েন্দা বাহিনীর লোকেরা?’ বিএনপি চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়ার অফিসে পুলিশি তল্লাশির প্রতিবাদে গত ২৭ মে ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন মিলনায়তনে জাতীয়তাবাদী যুবদল আয়োজিত সভায় বক্তৃতা করতে গিয়ে এ প্রশ্ন করেন তিনি। মির্জা আলমগীরের মন্তব্য বা প্রশ্নকে অবান্তর কিংবা অসঙ্গত বলা যাবে না। কেননা, বেগম খালেদা জিয়ার অফিসে পুলিশি তল্লাশি যেভাবে চালানো হয়েছে, তারপর সে সম্পর্কে পুলিশ কর্মকর্তা এবং মন্ত্রীরা যেসব কথা বলেছেন তাতে এ প্রশ্ন উঠতেই পারে।
বেগম খালেদা জিয়া কোনো সাধারণ রাজনৈতিক নেতা নন। তিনি দেশের দুই বৃহৎ দলের একটির প্রধান। তাছাড়া তিনি এ দেশের তিনবার নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী এবং দুই মেয়াদে জাতীয় সংসদে বিরোধী দলীয় নেতা ছিলেন। ফলে তার রাজনৈতিক কার্যালয়ে পুলিশি তল্লাশি চালানোর ঘটনাকে হালকাভাবে নেয়ার সুযোগ আছে বলে মনে হয় না। বলা বাহুল্য, উক্ত তল্লাশির ঘটনা সারাদেশে ব্যাপক তোলপাড় সৃষ্টি করেছে এবং জনমনে প্রচÐ ক্ষোভের জন্ম দিয়েছে। তারা ঘটনাটিকে ভালোভাবে নেয়নি। এ বিষয়ে বিশিষ্টজনদের যেসব অভিমত গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে, তা থেকে এ ঘটনায় সৃষ্ট নেতিবাচক প্রতিক্রিয়ার বিষয়টি অনুমান করা যায়। এমন একজন শীর্ষ রাজনৈতিক নেতার অফিসে হঠাৎ পুলিশি তল্লাশির নেপথ্য কারণ জানতে দেশবাসীর কৌতূহলী হয়ে ওঠা স্বাভাবিক। কিন্তু এ সম্পর্কে সরকারের তরফ থেকে এখন পর্যন্ত আনুষ্ঠানিক কোনো বক্তব্য বা ব্যাখ্যা পাওয়া যায় নি। কার নির্দেশে ওই তল্লাশি চালানো হয়েছিল তাও পরিষ্কার করেনি কর্তৃপক্ষ। তবে, অওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের অবশ্য বলেছেন যে, গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতেই ওই অভিযান চালানো হয়েছিল। কিন্তু কি সে গোয়েন্দা তথ্য সে সম্পর্কে সরকার কিছুই বলেনি। আর সেজন্যই ব্যাপক তল্লাশি চালিয়ে পুলিশের ‘রিক্তহস্তে’ ফিরে যাওয়া অপারেশনটি নিয়ে নানা জল্পনা কল্পনা চলছে। অনেকেই বিশ্বাস করেন যে, ওটা ছিল একটি সাজানো নাটক, যার অন্তর্নিহিত উদ্দেশ্য ছিল নতুন কোনো ‘ষড়যন্ত্রে’র নীল নকশার উদঘাটন।
জনৈক মন্ত্রী বলেছেন, তল্লাশির ঘটনাটি সরকারের উপর মহলের জ্ঞাতসারে হয়নি। এ বক্তব্য কারো কাছেই গহণযোগ্য হয়নি। কেননা, বেগম খালেদা জিয়ার মতো একজন শীর্ষ নেতার অফিসে পুলিশি তল্লাশি চালানোর গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের সিদ্ধান্ত নি¤œ পর্যায়ের কর্মকর্তারা নিয়েছেন, এটা বিশ্বাসযোগ্য নয়। যদিও পুলিশ বলেছে একটি বেনামী অভিযোগের ভিত্তিতে তারা আদালতের ওয়ারেন্ট নিয়েই অভিযান চালিয়েছিল। কিন্তু একটি উড়ো চিঠিকে আমলে নিয়ে এ ধরনের অভিযান চালানো কতোটা আইনসিদ্ধ সে প্রশ্নও এড়িয়ে যাওয়া যাবে না। এটা এখন স্পষ্ট যে, ওই ঘটনার দায় সরকার এড়াতে চাচ্ছে। আর সেজন্যই সরকারের দায়িত্বশীল ব্যক্তিরা ‘গোয়েন্দা তথ্যের ঢাল’ ব্যবহার করার চেষ্টা করছেন। কিন্তু তাতে সরকার তার দায় এড়াতে পারবে বলে মনে হয় না। হয় সরকারকে বলতে হবে সরকারের সিদ্ধান্ত মোতাবেক পুলিশ কাজ করেছে, আর তা নাহলে অতিউৎসাহী হয়ে যেসব পুলিশ কর্মকর্তা এ ন্যাক্কারজনক ঘটনার জন্ম দিয়েছে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে। কিন্তু বাস্তবতা এই যে, সরকার দু’টির একটিও করবে না। প্রথমটি করবে না রাজনৈতিক হয়রানির অভিযোগে অভিযুক্ত হওয়ার ভয়ে। আর দ্বিতীয়টি করবে না তাদের পুলিশ নির্ভরতার কারণে।
শুধুমাত্র বিএনপি চেয়ারপার্সনের অফিসে তল্লাশির ঘটনায়ই নয়, আরো অনেক ঘটানাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, সরকারের ভিতরে আরেকটি সরকার রয়েছে। সুপ্রিমকোর্ট অঙ্গনে গ্রিক দেবী থেমিসের মূর্তি স্থাপন, অপসারণ এবং পুনঃস্থাপনের ঘটনা তার জাজ্বল্যমান উদাহরণ। অনেক প্রতিবাদ- বিক্ষোভের পর মূর্তিটিকে সুপ্রিম কোর্টের মূল ভবনের সামনে থেকে অপসারণ করা হলো। তা নিয়ে কয়েকটি ক্ষুদ্র সংগঠন প্রতিবাদ জানালো। তাদের প্রতিবাদের প্রতি ‘সম্মান প্রদর্শন’ করে দু’দিনের মাথায় সেটাকে আবার সুপ্রিম কোর্ট এনেক্স ভবনের সামনে পুনঃস্থাপন করা হয়েছে। যতদূর জানা গেছে, প্রধানমন্ত্রীর ইচ্ছা এবং নির্দেশেই ওই মূর্তি অপসারণ করা হয়েছিল। কেননা, তিনি ইতোপূর্বে ওই মূর্তির বিষয়ে উষ্মা প্রকাশ করে বাংলাদেশের বিচারালয়ের আঙ্গিনায় ওটার আবশ্যকতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিলেন। তাহলে পুনরায় ওটাকে কার ইচ্ছা এবং নির্দেশে পুনঃস্থাপন করা হলো? এ প্রশ্নের জবাব এখনও পাওয়া যায়নি। তাহলে কি এ ক্ষেত্রে ‘সর্প হইয়া দংশন কর, ওঝা হইয়া ঝাড়’ নীতি অবলম্বন করা হয়েছে? প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে অপসারিত মূর্তি কার বা কাদের নির্দেশে পুনঃস্থাপন করা হয়েছে তাদের পরিচয় প্রকাশ এবং প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশ অমান্যকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা দরকার। প্রধানমন্ত্রীর ভাবমর্যাদা রক্ষার জন্যই এ পদক্ষেপ নেয়া জরুরি। আর তা নাহলে প্রশ্নটা জনমনে ঘুরপাক খেতেই থাকবে, কে এমন শক্তিধর ব্যক্তি যিনি প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশ অমান্য করার ক্ষমতা রাখেন? আর তখনই অবধারিতভাবে প্রশ্নটি এসে যাবে, সরকারের ভেতরে কি তাহলে আরেকটি সরকার আছে?
লক্ষ্য করা যাচ্ছে, মেয়াদের সাড়ে তিন বছরের মাথায় এসে সরকারের ভেতরে এক ধরনের অস্থিরতা-সমন্বয়হীনতা ক্রমশ যেন বাড়ছে। চারদিকে কেমন যেন এলোমেলো অবস্থা। পত্র-পত্রিকায় সেসব খবর প্রতিনিয়তই উঠে আসছে। সারাদেশে দলীয় নেতাকর্মীদের কোন্দল, সংঘাত-সংঘর্ষ, হানাহানি এখন নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা। নেতাকর্মীদের শান্ত ও ঐক্যবদ্ধ রাখতে সাধারণ সম্পাদকের অবিরত কঠোর বক্তৃতা, নির্বাচনে পরাজিত হলে ভয়ঙ্কর পরিনতির কথা তাদেরকে স্মরণ করিয়ে দেয়া ইত্যাদি ক্ষমতাসীন দলটির অভ্যন্তরে এক ধরনের অস্থিরতা বিরাজ করারই ইঙ্গিত দেয়। রাজনৈতিক অভিজ্ঞমহল এটাকে অজানা আশঙ্কায় ‘থরহরি কম্প’ অবস্থা হিসেবে অভিহিত করছেন। কেউ কেউ বলছেন, আওয়ামী লীগ তাদের গত নয় বছরের আমলনামা পাঠ করে এখন শঙ্কিত। নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু হলে জনগণ কী রায় দেবে সেটা ভেবে তারা এখন অনেকটাই দুশ্চিন্তাগ্রস্ত। কারণ, তাদের শাসনামলে এমন কিছু ঘটনা দেশের বিভিন্ন স্থানে ঘটেছে, তাতে ভোট ব্যাংকে নাড়া পড়েছে। জাতীয় পর্যায়ে দৃশ্যমান অনেক উন্নয়ন অগ্রগতি হলেও তৃণমূল পর্যায়ে আওয়ামী লীগ ও অঙ্গ সংগঠনের নেতাকর্মীদের কীর্তিকলাপ জনমনে বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছে। ফলে ব্যালটে সিল মারার সময় ভোটাররা দ্বিতীয়বার চিন্তা করতে পারে, এমন আশঙ্কা ক্ষমতাসীন মহল যে করছে তা এখন স্পষ্ট।
অন্যদিকে প্রশাসনের এক শ্রেণির কর্মকর্তা কর্মচারীর ‘মোর ক্যাথলিক দ্যান দ্য পোপ’ অবস্থা সৃষ্টি করেছে নতুন সমস্যা। এরা আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মীদের চেয়েও বেশি আওয়ামী লীগার। জনপ্রশাসন হোক বা পুলিশ প্রশাসন, সবখানেই এ অতি আওয়ামী লীগারদের উপস্থিতি দৃশ্যমান। এরা সরকারি কর্মকর্তার চেয়ে আওয়ামী লীগ সমর্থক, পরিচয় দিতে বেশি আগ্রহী। এরা ধরে আনতে বললে বেঁধে আনে, আর বেঁধে আনতে বললে মারতে মারতে আনে। এদের কারণে গত কয়েক বছরে যেসব ঘটনা ঘটেছে তাতে সরকারকে বারবার পড়তে হয়েছে বিব্রতকর অবস্থায়।
‘আমের চেয়ে আঁটি বড়’ বলে একটি প্রবাদ আছে আমাদের দেশে। বর্তমান প্রশাসনের কর্মকর্তাদের কায়কারবার দেখে সে প্রবাদকেই মনে পড়ছে বারবার। প্রজাতন্ত্রের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা ক্ষমতাসীন সরকারের নির্দেশ অনুযায়ী কাজ করবে এটা স্বীকৃত বিধি। সরকারের পরিকল্পনা বাস্তবায়ন, কর্মসূচী সফল করার ক্ষেত্রে প্রজাতন্ত্রের কর্মকর্তাদের ভূমিকাও গুরুত্বপূর্ণ। তাই বলে তারা রাজনৈতিক কর্মীর ন্যায় কাজ করবে সেটা গ্রহণযোগ্য নয়। কিন্তু বর্তমানে সেটাই হচ্ছে। এজন্যই দেশের বিভিন্নস্থানে ঘটছে ন্যাক্কারজনক ঘটনাবলী। ইয়াবা ব্যবসার জন্য কুপরিচিত একজন এমপি আদালত কর্তৃক সাজাপ্রাপ্ত হবার পরও যখন সরকার প্রধানের মঞ্চে আসন পায়, তখন তো নানা প্রশ্ন উঠেতেই পারে। কারণ প্রধানমন্ত্রীর জ্ঞাতসারে একজন সাজাপ্রাপ্ত ব্যক্তি তার সঙ্গে ঘুরে বেড়াবে বা মঞ্চে উঠবে এটা বিশ্বাস করা জনগণের জন্য কঠিন। অথচ ঘটেছে সেটাই।
আসলে একটি রাজনৈতিক সরকার যখন নিজের ওপর আস্থা হারিয়ে ফেলে তখনই অতিমাত্রায় নির্ভরশীল হয়ে পড়ে প্রশাসনের ওপর। প্রশাসনকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে রাজনীতির মাঠ দখলে রাখতে চায় বিরোধী দলকে দমনের মাধ্যমে। আর সরকারের সে দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে প্রশাসনের অভ্যন্তরের কিছু সংখ্যক ব্যক্তি নিজেদের করে তোলে অপরিহার্য এবং তৈরি করে আরেকটি সরকার। তারা এমন সব কাজ করে যেগুলোর ফলাফল সরকারের বিপক্ষে যায়। কিন্তু নিজেদের দুর্বলতার কারণে সরকার ওইসব কর্মকর্তার বিষয়ে কোনো পদক্ষেপ নিতে পারে না। এভাবে সরকার হয়ে পড়ে প্রশাসন নির্ভর, পরিণত হয় স্বৈরাচারে। গণতন্ত্র হয়ে পড়ে অর্থহীন অর্থাৎ রাষ্ট্র হয়ে পড়ে গণতন্ত্রহীন। বলাটা অসঙ্গত নয় যে, বাংলাদেশে বর্তমানে সে অবস্থাই বিরাজ করছে।
লেখক : সাংবাদিক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।