Inqilab Logo

শুক্রবার ০৮ নভেম্বর ২০২৪, ২৩ কার্তিক ১৪৩১, ০৫ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

রাস্তায় ছিনতাইকারী অসহায় নগরবাসী

প্রকাশের সময় : ৭ মার্চ, ২০১৬, ১২:০০ এএম

স্টাফ রিপোর্টার : অসহায় হয়ে পড়ছেন নগরবাসী। রাস্তায় বেরুলেই ছিনতাইকারীদের কবলে পড়তে হয়। এ আতঙ্ক সারাক্ষণ তাড়া করে পথচারীদের। তারা বলছেন, রাজধানীতে বেড়ে গেছে চুরি, ছিনতাই ও ডাকাতির ঘটনা। প্রতিদিনই নগরীর কোনো না কোনো এলাকায় ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটছে। ছিনতাইকারীদের  গুলি ও ছুরিকাঘাতে আহত হচ্ছেন সাধারণ মানুষ। গত ১৫ দিনে নগরীর বিভিন্ন এলাকায় ছিনতাইকারীদের গুলিতে নিহত হয়েছেন ৭ জন,  ছুরিকাঘাতে মারা গেছেন ৯ জন। আহত হয়েছেন কমপক্ষে ৩৭ জন। সম্প্রতি নগরীর বেশ কয়েকটি ছিনতাইয়ের ঘটনায় পুলিশ ও ভুক্তভোগীদের সঙ্গে কথা বলে এমন তথ্য জানা গেছে। তবে হাসপাতাল সূত্র বলছে, চলতি বছরের দুই মাস ৫ দিনে ছিনতাইকারীদের কবলে পড়ে আহত হয়ে চিকিৎসা নিয়েছেন কমপক্ষে ৫ শতাধিক নারী-পুরুষ।
জানা যায়, রাজধানীসহ সারাদেশেই বেড়ে গেছে ছিনতাইয়ের ঘটনা। প্রায় প্রতিদিনই রাজধানীর কোনো না কোনো স্থানে ছিনতাইকারীদের শিকার হচ্ছেন সাধারণ মানুষ। তবে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা বলছেন, ছিনতাইকারীদের দৌরাত্ম্য আগের মতো নেই। বর্তমানে বিভিন্ন সড়কে পুলিশের তল্লাশি চৌকি বসানোসহ পেট্রোল ডিউটি করার কারণে ছিনতাই অনেক কমেছে। তাদের দাবি, ছিনতাইকারীদের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থানে রয়েছেন আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা। ছিনতাইকারীদের গ্রেফতারে প্রতিদিনই অভিযান চালানো হচ্ছে।
এদিকে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে সূত্রে জানা গেছে, অজ্ঞান পার্টির খপ্পরে পড়ে প্রতিদিন গড়ে ৮-৯ জন হাসপাতালে ভর্তি হচ্ছেন। গত জানুয়ারি মাসে ৪৩০ নারী-পুরুষ অজ্ঞান পার্টির খপ্পরে পড়ে সর্বস্ব খুইয়েছেন। গত ফেব্রুয়ারি মাসে ঢাকা মহানগরীতে ছিনতাইকারীদের গুলিতে ১৩১ জন আহত হয়েছেন। এ সময়ের মধ্যে বিকাশ কর্মকর্তা, ব্যবসায়ী ও ব্যাংক কর্মকর্তাসহ বিভিন্ন ব্যক্তির কাছ থেকে নগদ টাকাসহ মূল্যবান কাগজপত্র ছিনিয়ে নিয়েছে ছিনতাইকারীরা।
রাজধানীর আগারগাঁও এলাকার  তালতলা সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় ও মহিলা কলেজের সামনে গত শনিবার বেলা আড়াইটার দিকে বিকাশ ব্যবসায়ীর ১৫ লাখ টাকা ছিনতাই হয়। একটি মাইক্রোবাসে করে টাকাসহ বিকাশের তিনজন কর্মী যাচ্ছিলেন। এ সময় দুইটি মোটরসাইকেলে করে মোট ছয়জন দুর্বৃত্ত মাইক্রোবাসটি ঘিরে এলোপাথাড়ি গুলি করে বিকাশকর্মীদের কাছে থাকা ১৫ লাখ টাকা নিয়ে পালিয়ে যায়। বিকাশের সিকিউরিটি ইনচার্জ সাইদুর রহমান এ সময় পায়ে গুলিবিদ্ধ হন। গুলিবিদ্ধ সাইদুর রহমানকে জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন প্রতিষ্ঠানে (নিটোর) ভর্তি করা হয়।  এর আগের দিন রাজধানীর বাড্ডা এলাকায় ছিনতাইকারীর ছুরিকাঘাতে আহত মদন চন্দ্র রায় মধু (২৮) নামে এক দিনমজুরের মৃত্যু হয়েছে। মধু দিনাজপুর জেলার কোতোয়ালি থানার মুড়ালিপুর গ্রামের নারায়ণ চন্দ্র রায়ের ছেলে।
শুক্রবার মধ্যরাতে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তার মৃত্যু হয়। গত শুক্রবার কাঁচামাল আড়তের কর্মচারী আব্দুর রশিদ (৩২) ভোরে রিকশাযোগে কারওয়ানবাজার থেকে মহাখালী যাচ্ছিলেন। পথে  তেজগাঁও বিজি প্রেসের সামনের রাস্তায় পৌঁছলে সাদা রঙের একটি প্রাইভেটকারে থাকা ছিনইকারীরা তার রিকশার গতিরোধ করে। এ সময় ছিনতাইকারীরা তার হাতে ছুরিকাঘাত করে সঙ্গে থাকা ষোল হাজার টাকা নিয়ে পালিয়ে যায়। পরে তেজগাঁও থানার এএসআই জাহাঙ্গীর তাকে উদ্ধার করে ঢামেক হাসপাতালে নিয়ে যান।
জানা গেছে, গত শুক্রবার বাড্ডায় যাত্রীবেশে সিএনজিতে উঠে চালককে অজ্ঞান করে সিএনজি ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটে। জ্ঞান ফিরলে ওই সিএনজির চালক আনোয়ারুল ইসলাম (৩৪) জানান, সকালে মেরুল বাড্ডা এলাকা থেকে তিন যুবক তার সিএনজি ভাড়া করে। পথিমধ্যে যাত্রীদের নির্দেশে তিনি সিএনজি থামান। সিএনজি থামনোমাত্র ওই যুবকরা তার চোখে-মুখে অচেতন করার মলম মাখিয়ে সিএনজিটি নিয়ে পালিয়ে যায়। পরে পুলিশ তাকে উদ্ধার করে ঢামেক হাসপাতালে নিয়ে যায়। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, রাস্তা, মার্কেট, বিকাশের দোকানের সামনে, ও ব্যাংকের সামনে ওঁৎ পেতে থাকে ছিনতাইকারীরা। সুবিধামতো সময়ে পেছন থেকে গুলি বা ছুরিকাঘাত করে ছিনতাই করে নেয় টাকার ব্যাগ। কখনো কখনো পিস্তলের বাঁট দিয়ে মাথায় আঘাত করে ও ককটেল ফাটিয়ে ছিনতাই করে। আবার কখনো রিকশাযোগে যাওয়া যাত্রীদের পাশ দিয়ে  মোটরসাইকেলযোগে ছিনিয়ে নেয় ব্যাগ। যানজটে আটকে পড়া মানুষদের রিকশায় থাকা অবস্থায় সামনে ও দুই পাশে তিনটি  মোটরসাইকেল ঠেকিয়ে ছিনতাই করা হয়। বাসের জানালার পাশে বসে ফোনে কথা বলার সময় ছোঁ মেরে মোবাইল ফোন বা অলঙ্কার ছিনতাই করা হয়। আবার কখনো কখনো যাত্রীভর্তি গাড়িতে পকেট মারে এসব সংঘবদ্ধ অপরাধী।
 অবশ্য এসব কায়দা ছাড়াও মলম পার্টি ও অজ্ঞান পার্টিসহ বিভিন্ন সংঘবদ্ধ চক্র নগরীতে নানা কায়দায় মানুষকে সর্বসান্ত করছে। ভুক্তভোগীরা ঘটনাস্থলে যেমন কোনো সহায়তা পান না,  তেমনি ঘটনার পর থানায় গেলেও তারা কোনো প্রতিকার পান না। ফলে ছিনতাইকারীদের আতঙ্কে ঢাকার রাজপথে সবসময় শঙ্কা নিয়েই চলাফেরা করেন নগদরবাসী।
 ডিএমপি তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের গত দুই মাস ৫ দিনে রাজধানীর ৪৯টি থানা এলাকায় ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটেছে ৫৯টি। এসব ঘটনায় বিভিন্ন থানায় মামলা হয়েছে মাত্র ২৮টি এবং ঘটনার সঙ্গে জড়িত সন্দেহভাজনসহ বেশ কয়েকজনকে  গ্রেফতার করতে সক্ষম হয়েছে পুলিশ। তা ছাড়া, গ্রেফতারকৃত ছিনতাইকারীদের তথ্য অনুযায়ী, বিভিন্ন জায়গায় অভিযান চালিয়ে ছুরি, ককটেল, শটগান ও গুলি, বিষাক্ত মলম, চেতনানাশক কেমিক্যাল এবং নেশাজাতীয় দ্রব্যসহ অন্যান্য সরঞ্জাম উদ্ধার করেছে পুলিশ ও র‌্যাব।
অনুসন্ধানে দেখে গেছে, রাজধানীতে গুলি বা ছুরিকাঘাত করে ছিনতাইয়ের ঘটনা সবচেয়ে বেশি ঘটেছে। গত দুই মাসে ৫৯টি ছিনতাইয়ের ঘটনার মধ্যে গুলি করে ছিনতাই করা হয়েছে ১৯টি। ছুরিকাঘাত করে ২৪টি এবং ছিনিয়ে নেয়ার ঘটনা ৫টি। এর মধ্যে গত কয়েক দিন আগে কাফরুল থানা এলাকায় দিনেদুপুরে গুলি করে মুজিবর নামে এক ব্যবসায়ীর কাছ থেকে ৫ লাখ টাকা ছিনতাই করে দুর্বৃত্তরা। এরকম ঘটনায় তাৎক্ষণিকভাবে থানায় মামলা হলেও লুণ্ঠিত টাকা আর উদ্ধার হয় না। ফলে ভুক্তোভোগীদের অনেকেই নিঃস্ব হয়ে পথে বসেছেন।
 এ বিষয়ে জানতে চাইলে গোয়েন্দা বিভাগের উপ-কমিশনার (পূর্ব) মাহবুব আলম জানান, কম-বেশি টাকা বহনের ক্ষেত্রে পুলিশের সহায়তা নিতে ব্যবসায়ীদের বলা হয়েছে। বিকাশের  লোকদের সঙ্গে এ ব্যাপারে বসাও হয়েছে। তবুও তারা পুলিশের সহায়তা নিচ্ছেন না। এমনকি নিজেরাও সাবধান হচ্ছেন না। আর ছিনতাই হওয়া টাকা একেবারে যে উদ্ধার হচ্ছে না তা নয়, কম-বেশি তো উদ্ধার হচ্ছেই।
অভিযোগ রয়েছে, ভুক্তভোগীরা থানায় গিয়ে ঠিকমতো সহায়তা পান না। মামলা না নিয়ে হারিয়েছে বলে সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করতে তাদেরকে পরামর্শ দেয়া হয়। আর মামলা হলেও ছিনতাই করা টাকা উদ্ধার বা অপরাধীরা খুব কমই ধরা পড়ছে বলে সংশ্লিষ্টদের অভিমত। গত বৃহস্পতিবার রাতে রাজধানীর মালিবাগের সোহাগ কাউন্টারের সামনে ছিনতাইকারীদের কবলে পড়েন ইশতিয়াক আহম্মেদ (৫২) নামে এক পথচারী। তাকে ছুরিকাঘাত করে ৪০ হাজার টাকা ছিনতাই করে দুর্বৃত্তরা। ইশতিয়াকের স্ত্রী সালমা বেগম জানান, তার স্বামী বাড্ডার আকু বোর্ড বিল্ডার্স নামক একটি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন। রাতে একটি অনুষ্ঠানে মৌচাকে গিয়েছিলেন তিনি। সেখান থেকে রিকশায় বাসায় ফেরার পথে মালিবাগ সোহাগ কাউন্টারের সামনে এলে ৩-৪ জন ছিনতাইকারী তার পেটে ছুরিকাঘাত করে ৪০ হাজার টাকা নিয়ে যায়। পরে স্থানীয়রা তাকে উদ্ধার করে স্থানীয় খিদমা হাসপাতালে নিয়ে যায়। সেখানে অবস্থার অবনতি হওয়ায় তাকে উদ্ধার করে ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।
এর আগে গত বুধবার রাতে রাজধানীর শাহ আলীর এফ-ব্লকের ১০ নম্বর সড়কে গুঁড়োদুধ ব্যবসায়ী মঈন উদ্দিনকে গুলি করে ৫ লাখ টাকা ছিনিয়ে নেয় দুর্বৃত্তরা। তিনি পায়ে ও পিঠে গুলিবিদ্ধ হন। পরে তাকে উদ্ধার করে কল্যাণপুরের ইবনে সিনা  মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।
শাহ আলী থানার ওসি এ কে এম শাহীন  জানান, মঈন উদ্দিন ডানো গুঁড়োদুধের ডিলার। এফ-ব্লকেই তার ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান। রাতে হেঁটে বাসায় ফেরার সময় কয়েকজন যুবক একটি প্রাইভেটকারে এসে তার পথ আটকায়। পরে তার পায়ে ও পিঠে গুলি করে তার ব্যাগটি ছিনিয়ে নিয়ে চলে যায়। ওই ব্যাগে ৫ লাখ টাকা ছিল বলে তার স্ত্রী দাবি করেছেন।
এর আগে গত ৫ জানুয়ারি দুপুরে নারায়ণগঞ্জের ফায়ার প্রিমিয়ার সিমেন্ট কোম্পানির গাড়ি আটকে চালকসহ তিনজনকে গুলি করে ২৮ লাখ ৪৭ হাজার টাকা ছিনতাই করে দুর্বৃত্তরা। এ ঘটনায় গুলিবিদ্ধ হন গাড়িচালক রজ্জব আলী। অপর দু’জন নিরাপত্তা প্রহরী আবুল বাশার ও অ্যাকাউন্টস অফিসার রমিজউদ্দিনকে ধারালো অস্ত্র দিয়ে কুপিয়ে আহত করা হয়। পরে তাদের ঢামেক হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।
গত ৩ জানুয়ারি সাভার বাজার রোডে দিন-দুপুরে মিঠুন চক্রবর্তী নামের এক ব্যবসায়ীকে কুপিয়ে ও গুলি করে ২৮ লাখ টাকা ছিনতাই করে দুর্বৃত্তরা। এ সময় ব্যবসায়ীর সঙ্গে থাকা তার  ছোট ভাই শুভ চক্রবর্তীও গুরুতর আহত হন।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: রাস্তায় ছিনতাইকারী অসহায় নগরবাসী
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ