পটুয়াখালীর যুবক ক্বারী সাইয়্যেদ মুসতানজিদ বিল্লাহ রব্বানীর কোরআন তেলাওয়াতে মুগ্ধ যুক্তরাষ্ট্রবাসী
ইসলামি সভ্যতা ও সংস্কৃতি বিকাশে বাংলাদেশের অবদান অনস্বীকার্য। এদেশে ইসলামি সংস্কৃতি চর্চার ইতিহাস অনেক প্রাচীন।
কোরআন তেলাওয়াত-মোনাজাত ও ইফতারীতে শরিক হচ্ছেন মানুষ
নাছিম উল আলম : ভারতের পশ্চিমবঙ্গের বারাসতের ইছাপুর নবপল্লী গ্রামে বসু বাড়ীর ‘আমানতী মসজিদ’এর ইফতারীর বিশাল আয়োজনে শরিক হচ্ছেন সর্ব ধর্মের মানুষ। এ রমজানে মসজিদের ছাদে নিয়মিত ইফতারীর আয়োজনে শরিক স্থানীয় হিন্দুÑমুসলিম সকলেই। ইফতারীর সময়টিতে এখানে সর্ব ধর্মের মানুষের আনন্দের হাট মেলে। বসু বাড়ীর বর্তমান কর্ণধার দিপক বাবু বয়সের ভারে রোজা রাখতে না পারলেও তার ছেলে পার্থ সারথী বসু নিয়মিত রোজা রাখছেন। স্ত্রী পাপিয়া রোজ সেহেরীর সময় স্বামী পার্থ’র জন্য ঘুম থেকে উঠে হালকা খাবারেরও আয়োজন করছেন নিয়মিত। এজন্য কাছের বন্ধুদের কেউ কেউ দুষ্টুমি করে পার্থর নামের আগে ‘মোহম্মদ’ জুড়ে দিয়েও ডাকছেন। আর বাবা দিপক বসু সকালে ঘুম থেকে উঠে ছুটে আসেন তার বাড়ীর এ আমানতী মসজিদে। তার একটিই কথা ‘আমার ভাইয়েরা সারাদিন জলও স্পর্শ না করে ধর্ম পালন করছে, আমি সেখানে কি করে খাবার মুখে দেই?’ পুরো মসজিদের পরিস্কার পরিচ্ছন্নতা শুরুর মাধ্যমেই নিজের দিনের কর্মসূচী শুরু তার। বাংলাদেশের চট্টগ্রামের বিশিষ্ট ওলী-এ কামেল হজরত আমনত শাহ (রঃ)’র ভক্ত বসু পরিবার তাদের গুরুজীর নামানুসারে ঐ মসজিদের নাম রেখেছেন ‘আমানতী মসজিদ’। যা অনেক আগে থেকেই সর্ব ধর্মের মিলনস্থলে পরিনত হয়েছে।
নবপল্লীর বসু পরিবারের বাড়ীর এ জামে মসজিদের কাছে পীঠে কোন মুসলিম বসবাস না করলেও অদুরের মধ্যমগ্রাম, হৃদয়পুর, মসলন্দপুর থেকে প্রতিদিন অনেক মুসলিম এসে এখানে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ আদায় করেন। আর ইফতারীর সময় হিন্দু-মুসলিমের মিলন মেলায় পরিনত হচ্ছে নবপল্লীর এ আমানতী মসজিদ। এমনকি ইফতারীর আগে ইমাম আখতার আলী ছাহেব যখন পবিত্র কোরআন তেলাওয়াত করেন, তখন হিন্দু-মুসলিম সবাই তা শোনেন ভক্তিভরে। পার্থবাবুর দাবী, ‘অমি মানি কোরআন শুধু মুসলমানের নয়, তা সবার জন্যই হেদায়াতের বাণী। এমনকি পবিত্র লাইলাতুল কদরের দিন পাড়া-মহল্লায় চাঁদা তুলে রাতে এখানে সবার জন্য খাবারেরও আয়োজন করা হয়। যার সিংহভাগই দেন দিপক বাবু ও তার পরিবার। তবে নিরবে, নিঃশব্দে।
ভারতের পশ্চিমবঙ্গের উত্তর ২৪পরগনার জেলা সদর বারাসতের বাংলাদেশ সীমান্তবর্তি বনগাঁমুখি যশোর রোডের ডাক বাংলো মোড় থেকে মিনিট দশেকের পথ ইছাপুরের। সেখানের বনেদী বসু পরিবার এলাকার সবার প্রিয়। সব বিতর্কের উর্ধে এ পরিবারের বর্তমান কর্ণধার দিপক বাবু’র বাবা নিরোদ কৃষ্ঞ বসু ছিলেন বাংলাদেশের খুলনার আদিবাসী। খুলনার ফুলতায় নিজের বাড়ী হলেও তিনি ছিলেন চট্টগ্রাম বন্দরের কর্মকর্তা। নিরোদ কৃষ্ঞ’র পরিবার আবার চট্টগ্রামেরই হজরত আমানত শাহ(রঃ)-এর ভক্ত ছিলেন। এমনকি সততা, নিষ্ঠা ও কর্তব্যপরায়নতার কারনে তৎকালীন পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খানের হাত থেকে নিরোদ কৃষ্ঞ ‘খিদমত ই পাকিস্তান’এর মত উচ্চ মর্জাদা সম্পন্ন খেতাব লাভ করেছিলেন।
কিন্তু ১৯৬৪সালে স্থানীয় হাতে গোনা কিছু দুষ্ট লোকের কারনে তিনি মানষিকভাবে ভেঙে পড়েন। শেষ পর্যন্ত পরিবার পরিজন নিয়ে দেশ ত্যাগও করেন নিরোদ বাবু। সেসময় পশ্চিমবঙ্গের বারাসাতে বসবাসকারী জনৈক ওয়াজি উদ্দিন-এর সাথে বাড়ী ও জমি বিনিময় করে নিরোদ কৃষ্ঞ পাকাকিভাবেই ভারতে চলে যান।
ওয়াজিউদ্দিনের কাছ থেকে নেয়া বাড়ীতেই বিশাল কাঠ বাদাম গাছের ধারে অনেকটা পরিত্যক্তভাবেই ছিল টিনের ঘরের ঐ মসজিদটি। যাতে দীর্ঘদিন সংস্কারের কাজ হয়নি। ঝোপঝার পরিস্কার করে একদিন নিরোদ কৃষ্ঞ’র স্ত্রী লীলাবতি ভক্তিভরে ঐ মসজিদে বাতি জ্বালান। সে থেকে তার মনে এক ব্যপক পরিবর্তন ঘটে। পরিচ্ছন্ন মনে তিনি তার সন্তানদের অসিহত করেন, ‘এমসজিদের যেন কোন অমর্জদা না হয়, মসজিদে বাতিÑআগর বাতির কোন অভাব না হয়’। মায়ের এ আদেশকে শীরধার্য করে তার ছেলে দিপক বাবু ও নাতি পার্থ সারথি এ মসজিদকে তাদের মাথার মুকুট বানিয়ে রেখেছেন।
নিজ বংশের গুরু পীর ছাহেবের নামনুসারে নামকরন করেছেন ‘আমানতী মসজিদ’। দীর্ঘদিনের পুরনো এ মসজিদে টিনের বেড়া ও টালির চাল সরিয়ে সেখানে পাকা দালান ও ছাদ হয়েছে। এমনকি কতিপয় কথিত রাজনীতিবীদের হীন রাজনীতির স্বার্থে বাবরী মসজিদ ধ্বংশর সময় বারাসতের নবপল্লীর ঐ আমানতী মসজিদের আমুল সংস্কার চলছিল। টিনের বেড়া ও টালি সরিয়ে সেখানে ইটের গাথুনি চলছিল। সেসময় দিপক বাবু ও তার পরিবারের সকলে মিলে দিন-রাত মসজিদে পড়ে থেকে নির্মান কাজ তদারকির পাশাপশি পাহাড়াও দিয়েছেন। সকলেরই একটি দাবী ছিল, ‘ঘৃণ্য রাজনীতির কোন ছোয়া যেন এ মসজিদে না লাগে’। রাজনীতির ঝড় বাদলের কোন অভিঘাত এ মসজিদে ছোয়া লাগাতে পারেনি। এলাকাবাশীর কাছে এমসজিদ মহান আল্লাহ রাব্বুল আল আমীনের অশির্বাদ স্বরূপ।
আজ সে আমানতী মসজিদ শুধু আল্লাহর প্রার্থনার ঘরই নয়, তা সর্ব ধর্মের মিলনস্থলেও পরিনত হয়েছে। মসজিদের পাশ দিয়ে অন্য ধর্মের মানুষেরাও যাবার সময় ছালাম জানান ভক্তিভরে। এ গ্রামে কোন নতুন শিশুর মুখে ভাত দেয়ার জন্য ‘অন্যপ্রাসন’এর পরিবর্তে মসজিদের ইমাম ছাহেব মুখে পায়েস তুলে দিলেই সবাই খুশি। সেটাই তারা আশির্বাদ বলে মনে করেন। বসু বাড়ীর কোন নতুন বউ ঘরে ওঠার আগে মসজিদ আঙিনায় নিয়ে আসা হয়। ইমাম ছাহেব দোয়া করার পরেই তার গৃহ প্রবেস ঘটে। এমনকি এখানে কেউ মারা গেলে শষান যাত্রার আগে আমানতী মসজিদের আঙিনায় নিয়ে আসা হয়। ইমাম ছাহেব দোয়া করার পরেই শবযাত্রা শুরু হয়।
আমানতী মসজিদের দায়ভার গ্রহণে একাধীক ধর্মীয় সংগঠন এগিয়ে এলেও পার্থবাবু ও তার পরিবার তা সযতেœ ফিরিয়ে দিয়েছেন। সবিনয়ে নিজেদের অপরাগতা প্রকাশ করে বলেছেন, ‘প্রানের এমসজিদ কি করে ছেড়ে থাকব?’ এমনকি এখানের ইফতারেও কোন রাজনীতির ছোয়া লাগতে দেননি তিনি। এখানের ইফতারীতে তাই কোন নেতা-নেত্রীকে কখনো ডাকা হয়না। তার মতে ‘ইফতারীর আবার পার্টি কি ?’ এমনকি তিনি রোজাদারদেরও সব সময় জকজমক মোচ্ছব এড়িয়ে চলার পরমর্শ দেন। ব্যক্তি জীবনে কেরোসিনের ডিলার পার্থ বসু তার যৎ সামান্য আয় ও ব্যাংকে গচ্ছিত টাকার অনেকটাই এখনো উজার করছেন এ আমানতী মসজিদের পেছনে। বসু পরিবারের প্রতিটি সদস্যের জীবন ও মনের সাথে জড়িয়ে আছে আমনতী মসজিদ। এমসজিদের জন্য তাই তারা কারো কাছে হাতও পাতেন না। এ বসু পরিবারেরই সদস্য বোম্বের প্রখ্যাত চিত্র পরিচালক প্রয়াত দিলিপ কুমার বসু। তিনিও তার জীবদ্দশায় এ মসজিদের জন্য অনেক কিছু করে গেছেন। বস পরিবারের অনুকরনে স্থানীয় নব পল্লীর বহু হিন্দু পরিবারই এখন এমসজিদের ভক্ত। সব সা¤প্রদায়িকতার উর্ধে নিজেদের স্থান করে নিয়েছেন।
বসু পরিবার তাদের প্রানর ধন আমানতী মসজিদকে ধ্যান-জ্ঞান মনে করে তার সেবায় নিজেদের জীবনকেও উৎসর্গ করেছন। স¤প্রতি ভারতের একটি প্রখ্যাত বাংলা দৈনিকে আমানতী মসজিদ ও বসু পরিবার নিয়ে সচিত্র প্রতিবেদনও প্রকাশিত হয়েছে। ফলে এমসজিদ ও বসু পরিবার ইতোমধ্যে যথেষ্ঠ আলোচনায়ও উঠে এসেছে।
আল্লাহর ঘর আমানতী মসজিদ’কে বসু পরিবার যেভাবে আগলে আছেন, তা ইতোমধ্যে বড় ধরনের একটি উদহারনে পরিনত হয়েছে। এ উপমহাদেশে যদি এভাবে আরো উদহারন তৈরী হত, তবে স¤প্রদায়িক বিষ বাস্প কোন দিনই সমাজকে কলুষিত করত না। তাহলে, আমরা হয়ত নিজেদের প্রকৃতই মানুষ বলে দাবী করতে পারতাম। এ দাবী মহান বসু পরিবারের অনেক সদস্যরই।
বারাসতের অখ্যাত মহল্লা নবপল্লীর তিন কাঠা জমির ওপর আমানতী মসজিদ এবং বসু পরিবার সহ প্রতিবেশীরা নিরন্তর বলে চলেছেন ‘আমরা বাঁচলে এক সঙ্গেই বাঁচব’।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।