পটুয়াখালীর যুবক ক্বারী সাইয়্যেদ মুসতানজিদ বিল্লাহ রব্বানীর কোরআন তেলাওয়াতে মুগ্ধ যুক্তরাষ্ট্রবাসী
ইসলামি সভ্যতা ও সংস্কৃতি বিকাশে বাংলাদেশের অবদান অনস্বীকার্য। এদেশে ইসলামি সংস্কৃতি চর্চার ইতিহাস অনেক প্রাচীন।
হাসান সোহেল : প্রস্তাবিত ২০১৭-১৮ অর্থবছরের বাজেটে ব্যাংক আমানতে আবগারী শুল্ক বা কর বাড়ানোয় জনসাধারণের মধ্যে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে। অর্থশাস্ত্রের পরিভাষায়, আবগারি শুল্ক হচ্ছে ‘পাপ কর’। তাই পুরো বাজেট নিয়ে মানুষের মধ্যে তেমন কোন মতামত না থাকলেও ব্যাংকে গচ্ছিত টাকায় ‘পাপ কর’ নিয়ে হতাশা প্রকাশ করেছে সাধারণ মানুষ। তাদের মতে, এতে ব্যাংকিং সেবা সংকুচিত হবে। আমানত রাখার অন্য কোন উপায় খুজবে নি¤œ ও মধ্য আয়ের গ্রাহকরা। ব্যাংক থেকে তুলে মাটির ব্যাংকে, বাসায় গচ্ছিত রাখার কথা ভাবছেন অনেকে। এতে ক্ষতির আশঙ্কাও করেছেন বিশেষজ্ঞরা। একাধিক আমানতকারী বলেন, নিরাপদ মাধ্যম হওয়ায় তারা অল্প অল্প করে ব্যাংকে টাকা জমান। যা পরবর্তীতে সন্তানের লেখা-পড়া এবং বিয়েসহ বিভিন্ন অনুষ্ঠানে খরচ করা হয়। সেখানেও আগামী অর্থবছরে সরকার আবগারি শুল্ক বসিয়ে দিয়েছে। তাই সরকারের আবগারি শুল্ক আরোপের প্রস্তাবে প্রায় এক কোটি আমানতকারী আতঙ্কে রয়েছেন।
জানা যায়, যুক্তরাজ্যে ব্যাংক আমানতের ওপর কোনো ধরনের আবগারি শুল্ক নেই। সুদের ওপর যে কর আছে, তা আয়কর। যুক্তরাষ্ট্র, ভারত ও সুইজারল্যান্ডেও ব্যাংক আমানতের ওপর আবগারি কর নেই। ভারতে ব্যাংক আমানতের ওপর সুদ হিসেবে বছরে যদি ১০ হাজার রুপি আয় হয়, তবেই তার ওপর কর প্রযোজ্য হয়। এমনকি যুক্তরাষ্ট্রে আয় হওয়া সুদের ওপর আয়কর আছে, আমানতের ওপর কোনো কর নেই। তাই অর্থমন্ত্রী রাজস্ব আদায় বাড়ানোর জন্য ব্যাংক আমানতের ওপর যে আবগারি কর আরোপ করেছেন, সে ধারণাটি কোত্থেকে এল, সেটাই একটি বড় প্রশ্ন হয়ে দেখা দিয়েছে সবার মাঝে। পৃথিবীর আর কোনো দেশে ব্যাংকে আমানত রাখাকে পাপ হিসেবে গণ্য করা কিংবা জনগোষ্ঠীকে ব্যাংকবিমুখ করতে কর আরোপ করা হয়েছে কিনা তা আসলে তিনিই জানেন।
এদিকে ব্যাংকে টাকা জমা বা তোলার ওপর আবগারি শুল্কের হার নিয়ে দুই রকম তথ্য পাওয়া গেছে। অর্থমন্ত্রী বাজেট বক্তব্যে যা বলেছেন, অর্থ আইনে বলা হয়েছে তার ভিন্ন কথা। ‘এক্সাইজ অ্যান্ড সল্ট অ্যাক্ট ১৯৪৪’-এর ই০৩২.০০-তে ব্যাংকে লেনদেনের ওপর আবগারি শুল্ক বসানোর কথা রয়েছে। অর্থমন্ত্রী বাজেট বক্তব্যে বলেছেন, এক লাখ টাকা পর্যন্ত শুল্কমুক্ত। এক লাখ এক টাকা থেকে ১০ লাখ পর্যন্ত আবগারি শুল্ক ৫০০ টাকার বদলে ৮০০ টাকা, ১০ লাখ টাকার ঊর্ধ্বে এক কোটি পর্যন্ত দেড় হাজার টাকার পরিবর্তে আড়াই হাজার টাকা, এক কোটির বেশি থেকে পাঁচ কোটি পর্যন্ত সাত হাজার ৫০০ টাকার পরিবর্তে ১২ হাজার টাকা এবং পাঁচ কোটির বেশি হলে ১৫ হাজারের বদলে ২৫ হাজার টাকা কাটা হবে। কিন্তু অর্থ আইন, ২০১৭-এ শুধু পাঁচ কোটি টাকার ওপর জমা ও তোলার ক্ষেত্রে ১৫ হাজার টাকার বদলে ৩০ হাজার টাকা কর্তনের কথা বলা আছে। এ ক্ষেত্রে আর কোনো ধরনের পরিবর্তনের তথ্য নেই। যদিও গতকাল ব্যবসায়ীদের সাথে এক অনুষ্ঠানে ব্যাংক আমানতে আবগারি শুল্ক না বাড়ানোর ইঙ্গিত দিয়েছেন অর্থ ও পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী এমএ মান্নান। তিনি বলেছেন, ব্যাংকের আবগারি শুল্ক বাড়ানোর বিষয়ে যে হারে সমালোচনা হচ্ছে তাতে সরকার প্রস্তাবিত আবগারি শুল্ক থেকে পেছনে ফিরবে। জাতীয় সংসদে এ নিয়ে অবশ্যই আলোচনা হবে। সে সময় ব্যাংকের আমানতের উপর শুল্ক পূর্বেরটা বহাল রাখা হতে পারে বলে জানান তিনি।
পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, এমনিতেই আমানতকারীরা সুদের হার কম পাচ্ছেন। এর সঙ্গে ১০ থেকে ১৫ শতাংশ উৎসে কর কেটে রাখাও হচ্ছে। তার ওপর আবার শুল্ক আরোপ করা হলে আমানতকারীরা শঙ্কায় থাকবেন, এটাই স্বাভাবিক। শুধু ব্যাংকে টাকা রাখবে-কেবল সেই কারণেই সরকার টাকা কেটে নেবে, এটা মেনে নেওয়া কঠিন। তিনি বলেন, এর ফলে এখন মানুষ ব্যাংক বিমুখ হবে। ঝুঁকিপূর্ণ বিভিন্ন স্থানে টাকা রাখা শুরু করবে। অস্বচ্ছ খাতে টাকা রাখবে। অনেকে টাকা দেশের বাইরেও নিয়ে যাবে। এই করারোপকে খারাপ ট্যাক্স উল্লেখ করে তিনি বলেন, এভাবে করারোপ করা কোনোভাবেই উচিত হয়নি। টাকা দরকার, কিন্তু তা যে কোনোভাবে নয়। অর্থমন্ত্রীর প্রস্তাব কার্যকর হলে আমানতকারীরা ব্যাংকে টাকা রাখতে নিরুৎসাহিত হবেন বলেও উল্লেখ করেন এই গবেষক।
সূত্র মতে, প্রস্তাবিত বাজেটে আগামী অর্থবছর থেকে দেশের যে কোনো ব্যাংকে টাকা জমা রাখার ক্ষেত্রে সরকারকে দেওয়া করের পরিমাণ বাড়ানো হয়েছে। আগে যে কোনো অ্যাকাউন্টে এক লাখ টাকা জমা করলে বা তুললে সরকারকে আবগারি শুল্ক হিসেবে বছরে ৫০০ টাকা দেওয়া লাগত। সেই টাকার পরিমাণ বেড়ে এখন হচ্ছে ৮০০ টাকা।
ব্যাংক কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, ব্যাংকে এক লাখ থেকে ১০ লাখ টাকা পর্যন্ত আবগারি শুল্ক (এক্সাইজ ডিউটি) যদি আটশ টাকা কেটে রাখা হয়, তাহলে আমানতকারী কোনও লাভই পাবেন না। আর সরকারি ব্যাংকে কেউ এক লাখ টাকা তিন মাস মেয়াদে এফডিআর করলে, মেয়াদ শেষে লাভের বদলে নিজের আসল টাকা থেকেই কম পাবেন গ্রাহক। তাই ব্যাংকের প্রতি গ্রাহকের আগ্রহ কমে যাবে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে এক লাখ টাকার ওপরে আমানত আছে এমন ব্যক্তির সংখ্যা ৮৩ লাখ ৪৫ হাজার ৩৬ জন। এর মধ্যে ১ থেকে ২ লাখ টাকা রেখেছেন ৩৩ লাখ ৬২ হাজার ৯১৪ জন। ২ লাখ থেকে ৩ লাখ টাকা রেখেছেন ১৩ লাখ ৮০ হাজার ৯৬৫ জন। ব্যাংকে ৩ লাখ থেকে ৪ লাখ টাকা পর্যন্ত রেখেছেন ৭ লাখ ৯১ হাজার ৮৯২ জন। ৪ লাখ থেকে ৫ লাখ টাকা রেখেছেন ৫ লাখ ৬৩ হাজার ৬০৩ জন। ৫ লাখ থেকে ১০ লাখ টাকার আমানত আছে ১২ লাখ ১৭ হাজার ৪৯৫ জন। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য মতে, বর্তমানে ব্যাংকগুলোর আমানতের গড় সুদ ৫ দশমিক ১ শতাংশের মধ্যে। এদিকে বর্তমানে মূল্যস্ফীতির হার ৫ থেকে সাড়ে ৫ শতাংশ।
রাজধানীতে প্রাইভেটকার চালক মামুন হোসেন বলেন, টানা-পোড়েনের সংসার। সন্তানের লেখাপড়ার জন্য প্রতিমাসে সামান্য কিছু টাকা আমানত রাখি। অথচ সরকারের চোখ সেখানেও পড়েছে। গরিবের আর বাঁচার রাস্তা রইলো না। সাইন বোর্ড এলাকার বাসিন্দা জাহিদ হোসেন বলেন, ব্যাংকে টাকা রাখলে যদি লোকসানই গুণতে হয়, তাহলে মাটির ব্যাংকে টাকা রাখবো। বেসরকারি চাকরিজীবি আসমা আক্তার বলেন, আগামী রোববারই ব্যাংক থেকে আমানতের টাকা উঠিয়ে অন্য কোথাও বিনিয়োগ করবো অথবা বিছানার নিচে রেখে দিবো।
বিদেশে টাকা পাচার ঠেকাতে ব্যাংকে রাখা টাকার ওপর আবগারি শুল্ক বসানো হয়েছে সরকারের একজন মন্ত্রীর এ উক্তির বিষয়টি উল্লেখ করে আসমা আক্তার বলেন, গরিব মানুষ টাকা পাচার করে না। তারা দশ, বিশ হাজার করে জমিয়ে তা পরিবারের উন্নয়নে এবং স্বাভাবিক জীবন-যাপনে ব্যয় করে। যাদের বেশি আছে তারাই পাচার করে। তাদের জন্য আলাদা আইন করতে পারতো। খোদ অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আব্দুল মুহিতও বলেছেন- সম্পদশালীদের কাছ থেকে কর আদায়ের জন্য ব্যাংক হিসাবে আবগারি শুল্ক বাড়ানো হয়েছে।
ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআই সভাপতি শফিউল ইসলাম মহিউদ্দিন বলেছেন, ব্যাংক আমানতের উপর আবগারি শুল্ক বাড়ানোয় আমানতকারী আমানত রাখতে নিরুৎসাহিত হবে। ব্যাংকগুলোর প্রধান নির্বাহীদের সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স, বাংলাদেশের (এবিবি) সাবেক চেয়ারম্যান ও মেঘনা ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক নুরুল আমিন বলেন, আবগারি শুল্ক বাড়ানোর প্রস্তাবে আমানতকারীরা নিরুৎসাহিত হবেন। তিনি বলেন, ব্যাংক সুদের হার এখন অনেক কম। এর ওপর এমনিতেই মূল্যস্ফীতি, উৎসে কর, মেইনট্যানেন্স চার্জ মিলিয়ে যা কেটে রাখা হয়, আমানতকারীর লাভ বলতে আর কিছুই থাকবে না।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, সরকারি ব্যাংকগুলো এখন সাড়ে ৪ থেকে ৫ শতাংশ সুদে মেয়াদি আমানত নিচ্ছে। বেসরকারি ও বিদেশি ব্যাংকগুলোর বেশিরভাগ সঞ্চয় স্কিমেও সুদের হার নেমে এসেছে একই পর্যায়ে। অনেক ব্যাংকের সুদের হার ৫ শতাংশের কম।
বাংলাদেশ ব্যাংকের গত মার্চ মাসের তথ্য অনুযায়ী, দেশে মোট ৫৭টি ব্যাংকে আমানত হিসাবের সংখ্যা প্রায় আট কোটি। এর মধ্যে আমানতের পরিমাণ নয় লাখ ১৪ হাজার কোটি টাকা। এর অর্ধেকের বেশি মেয়াদি আমানত। সঞ্চয়ী আমানত রয়েছে ২০ শতাংশের মতো।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ বলেন, যারা ব্যাংকে টাকা রাখেন, তারা একটি নির্দিষ্ট হারে কর দিয়ে থাকেন। ব্যাংকে যে টাকা আমানত থাকে, তা আয়কর রিটার্নে প্রদর্শিত হয় ও ট্যাক্স দেওয়া হয়। কাজেই একই টাকার ওপরে আবার ‘আবগারি শুল্ক’ নামে ট্যাক্স কেটে নেওয়া উচিত নয়। তিনি বলেন, এতে ব্যাংকের গ্রাহকদের মধ্যে অসন্তোষ সৃষ্টি হতে পারে। অন্যান্য সোর্স না বাড়িয়ে একই জায়গা থেকে বার বার ট্যাক্স নেওয়া কোনও ভালো লক্ষণ নয়।
উল্লেখ্য, জেলা শহরে গাঁজা, আফিম ও দেশীয় মদের মতো নেশাদ্রব্য বিক্রির জন্য সরকারের বিশেষ অনুমতিপ্রাপ্ত যে দু-একটি দোকান আছে, সেগুলো আবগারি দোকান হিসেবে পরিচিত। অর্থশাস্ত্রের পরিভাষায়, আবগারি শুল্ক হচ্ছে ‘পাপ কর’। অন্যান্য অভিধানে বলা হচ্ছে, দেশের ভেতরে উৎপাদিত পণ্য ও সেবার ওপর আবগারি কর আরোপ করা হয়ে থাকে। তবে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দেশীয় পণ্য এবং সেবার ওপর মূল্য সংযোজন কর (ভ্যাট) প্রথা চালু হওয়ার পর আবগারি শুল্ক শুধু ক্ষতিকর সামগ্রীর (নেশাদ্রব্য অথবা পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর জ্বালানি তেল) ওপর আরোপিত হয়। সমাজের ক্ষতি করে এমন সব দ্রব্য ভোগ করা থেকে মানুষকে নিবৃত্ত করা, নিদেনপক্ষে নিরুৎসাহিত করাই হচ্ছে এই আবগারি করের উদ্দেশ্য। আর সে জন্য এর খ্যাতি হচ্ছে ‘পাপ কর’ হিসেবে। যাঁরা বিড়ি-সিগারেট কিংবা জর্দা-তামাকের প্যাকেট বা কৌটা দেখেছেন, তাঁরা নিশ্চয়ই জানেন যে আবগারি পরিশোধের প্রমাণ হিসেবে ওসব পণ্যে আলাদা স্ট্যাম্প অথবা ব্যান্ডরোল ব্যবহৃত হয়। এই ‘পাপ কর’-এর কোনো তকমা যে ব্যাংকিং খাতের গ্রাহকদের বহন করতে হচ্ছে না, সেটা হয়তো অনেকের জন্য স্বস্তির বিষয় হতে পারে।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।