Inqilab Logo

সোমবার ১৮ নভেম্বর ২০২৪, ০৩ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১৫ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

বিদ্যুৎ যাতনায় অতিষ্ঠ চট্টগ্রামবাসী

| প্রকাশের সময় : ২৭ মে, ২০১৭, ১২:০০ এএম

ট্রান্সফরমারসহ হরেক যন্ত্রপাতি বিগড়ে যাচ্ছে : ঘন ঘন বিভ্রাট ও লোডশেডিং : তারাবিহ সাহরী-ইফতার নিয়ে সবার দুশ্চিন্তা : ব্যবসা-বাণিজ্যে বিরূপ প্রভাব
শফিউল আলম : নিত্যদিনের মতোই গতকালের (শুক্রবার) একটি খÐচিত্র। ‘জরুরী মেরামত ও সংরক্ষণ’ কাজের জন্য পিডিবির পূর্ব-ঘোষণা ছিল পাথরঘাটা বিতরণ বিভাগের আওতায় বন্দরনগরীর ফিরিঙ্গিবাজার-কোতোয়ালী, কোরবানীগঞ্জ হয়ে চকবাজার পর্যন্ত সকাল ৬টা থেকে ১১টা বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ থাকবে। বিদ্যুৎ আসে সাড়ে ৬ ঘণ্টা পর সকাল সাড়ে ১১টায়। কিন্তু প্রায় আধাঘন্টা পর আবারও বিদ্যুৎ চলে যায় নগরীর ঘনবসতিপূর্ণ এই বিশাল এলাকাজুড়ে। কেন বিদ্যুৎ চলে গেল মেরামতে ফের গÐগোল নাকি লোডশেডিং এর কোনো জবাব মেলেনি। তবে শুক্রবার ছুটির দিনেও ভ্যাপসা গরমে-ঘামে (৩৫ ডিগ্রি সে. তাপমাত্রায়) হাঁপাতে হয়েছে লাখ লাখ নগরবাসীকে! আজও (শনিবার) চট্টগ্রাম মহানগরী ও শহরতলীর নিউমুরিং, রামপুর, বারবকুÐ বিতরণ বিভাগের আওতায় অনেক এলাকায় ৪ থেকে ৭ ঘণ্টা পর্যন্ত বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধের নোটিশ দেয়া হয়েছে।
এমনিভাবে প্রতিনিয়ত বিদ্যুৎ বিভ্রাট, দায়সারা জোড়াতালি মেরামত আর লোডশেডিংয়ের যাতনায় চরম অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছে চট্টগ্রামবাসী। কোথাও না কোথাও ট্রান্সফরমার, সিটি, ব্রেকার কিংবা সঞ্চালন লাইনসহ হরেক কলকব্জা ও যন্ত্রপাতি যখন তখন বিগড়ে যাচ্ছে। এসব যন্ত্রপাতি বিকল হলে সংশ্লিষ্ট এলাকার গ্রাহকরা বাধ্য হয়ে চাঁদা তুলে মেরামতের ‘ব্যবস্থা’র নেপথ্যে পিডিবির একশ্রেণীর অসৎ কর্মকর্তা-কর্মচারীর জমজমাট পকেট বাণিজ্যের অভিযোগেরও শেষ নেই। নগরীজুড়ে ঘন ঘন লোডশেডিং আর বিভ্রাট বেড়ে গিয়ে জনদুর্ভোগ গত তিন বছরের চেয়েও এবার ভয়াবহ পর্যায়ে পৌঁছে গেছে। জ্যৈষ্ঠের কাঠফাটা গরমের সাথে পাল্লা দিয়ে গত ৮-১০ দিন যাবত চট্টগ্রাম অঞ্চলে বিদ্যুতের ভোগান্তি ক্রমাগতভাবে বেড়েছে। এ অবস্থায় আজ (শনিবার) দিবাগত রাত থেকে মাহে রমজানের নিয়মিত তারাবিহ নামাজ, সাহরী-ইফতারের সময়টাতে বিদ্যুৎ থাকবে কিনা তা নিয়ে সবার মাঝেই দুশ্চিন্তা-উৎকণ্ঠা ভর করেছে। গতকাল জুমার নামাজের সময় অনেক মসজিদে বিদ্যুৎ ও পানি ছিল না। মুসল্লিরা ঘরে-বাইরে থেকে অজু সেরে নামাজে আসতে হয়েছে। অনেক মসজিদে ফ্যান চলেছে মুসল্লিদের টাকায় সংগ্রহ করা জেনারেটর দিয়ে।
প্রায় ৬০ লাখ জনসংখ্যা অধ্যুষিত ১২০ বর্গমাইল আয়তনের চট্টগ্রাম মহানগরীজুড়ে বিদ্যুতের ভোগান্তি চরম আকার ধারণ করেছে। ঘোষিত লোডশেডিংয়ের চেয়ে বিভ্রাটের কারণেই অধিকাংশ এলাকা পালাক্রমে থাকছে বিদ্যুবিহীন। ট্রান্সফরমার, সিটি, ব্রেকার কিংবা সঞ্চালন লাইনসহ বিভিন্ন ধরনের যন্ত্রপাতি হঠাৎ বিকল হয়ে যাওয়ার ফলেই এমনটি ঘটছে বেশি হারে। একেকটি এলাকায় একবার বিদ্যুৎ চলে গেলে ফের আসতে সময় লাগে ১ থেকে ক্ষেত্রবিশেষে ৪-৬ ঘন্টা পর্যন্ত। আবার সেই বিদ্যুৎ থাকছে মাত্র এক-দুই এমনকি মাত্র আধাঘন্টার জন্য। মধ্যরাতে শেষ রাতেও দফায় দফায় বিদ্যুতের ঘন ঘন বিভ্রাট আর লোডশেডিং থেকে নিস্তার নেই। এভাবে বৃহত্তর চট্টগ্রামে চলছে বিদ্যুতের যেন আকাল। প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলের অবস্থা আরও ভয়াবহ। সেখানে বিদ্যুৎ সরবরাহ থাকে সারাদিনে মাত্র দুয়েক ঘণ্টা। কাপ্তাই পানি বিদ্যুৎকেন্দ্রের বিদ্যুৎ আসে রাঙ্গুনিয়ার উপর সঞ্চালন লাইন দিয়ে। আর সেখানেই দিনে-রাতে ঘণ্টার পর ঘন্টা লোডশেডিং চলছে। এভাবে চট্টগ্রাম অঞ্চলের সর্বত্রই বিদ্যুৎ সঙ্কটে স্বাভাবিক জীবনযাত্রা বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে। দেশের বাণিজ্যিক রাজধানী খ্যাত বন্দরনগরীতে ব্যবসা-বাণিজ্যে ধস শুধুই নয়, লালবাতি জ্বলার উপক্রম। রফতানিমুখী তৈরী পোশাক শিল্প, হিমায়িত খাদ্য প্ল্যান্টসহ কল-কারখানায় উৎপাদনের চাকা যখন-তখন থমকে যাচ্ছে। শিক্ষার্থীদের পড়াশোনায় মারাত্মক ব্যাঘাত ঘটছে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা এখন চরম বিরক্ত। দিনে ও রাতে ডিজেল চালিত জেনারেটরের একটানা ‘ঘড় ঘড়’ আওয়াজে গোটা নগরী বিশেষত মার্কেট, বেসরকারি অফিস পাড়া, ব্যাংক-বীমা, ব্যবসা-বাণিজ্যকেন্দ্রগুলো রূপ নিয়েছে মোটর গ্যারেজের মতো।
এদিকে গতকাল বন্দরনগরীতে বিদ্যুতের প্রি-পেমেন্ট মিটারিং ভেন্ডিং স্টেশন উদ্বোধনকালে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ এমপি চট্টগ্রামে প্রি-পেইড মিটারিং চালুতে অতি ধীরগতির আড়ালে দুর্নীতিবাজদের বিদ্যুৎ চুরি, কর্তাদের চরম অবহেলায় সাব-স্টেশনগুলো জঙ্গল বানিয়ে রাখা, যেখানে সেখানে তার ফেলে রাখা এবং গ্রাহকদের হয়রানিতে তীব্র অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন। এসব অনিয়ম থেকে বেরিয়ে আসার জন্য পিডিবির শীর্ষ কর্মকর্তাদের উদ্দেশে কড়া বার্তা দিয়ে গেছেন বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী।
বিদ্যুৎ ভোগান্তির চরম নাজুক পরিস্থিতিতে চট্টগ্রামে এবার পবিত্র রোজার মাসজুড়ে কী অবস্থা দাঁড়াবে তা নিয়ে গ্রাহকদের দুশ্চিন্তা বেড়েই চলেছে। বিদ্যুতের আসা-যাওয়ার খেলায় সাধারণ দরিদ্র জনগোষ্ঠি থেকে শুরু করে চাটগাঁর ব্যবসায়ী-শিল্পপতি সবাই ত্যক্ত-বিরক্ত। লোডশেডিং ছাড়াও চট্টগ্রামের সর্বত্র পিডিবির জেনারেটর, সিটি, ব্রেকার প্রভৃতি বিকল হয়ে পড়া নিত্যনৈমিত্তিক ‘রোগে’ পরিণত হয়েছে। উপরন্তু বিদ্যুৎ বিভাগের সংঘবদ্ধ দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা-কর্মচারীদের যোগসাজশে হরেক অপকৌশলে ব্যাপকহারে বিদ্যুৎ চুরির অভিযোগ দীর্ঘদিনের। অথচ এতে জড়িতরা সবসময়ই থেকে যাচ্ছে ধরা-ছোঁয়ার বাইরে। নেই কোন প্রতিকার। চট্টগ্রামে লোডশেডিংয়ের সাথে এসব কারণে ঘন ঘন চেপে বসেছে অসহনীয় বিভ্রাটের মধ্যদিয়ে ‘লোকাল শেডিং’। বিদ্যুৎ সঙ্কটের সাথে পাল্লা দিয়ে বন্দরনগরীজুড়ে পানির সঙ্কটও বেড়েই চলেছে। কেননা ওয়াসার সরবরাহ মিলছে না বা ওয়াসার গ্রাহকের বাইরে আরও বিপুল জনগোষ্ঠি যারা আছেন, তারা নিজেদের উদ্যোগে পানির সংস্থানে রাখা গভীর-অগভীর নলকুপ ও পানির পাম্পগুলো সচল রাখতে পারছেন না।
বৃহত্তর চট্টগ্রাম অঞ্চলে বিদ্যুতের চাহিদা দৈনিক সাড়ে ৭শ’ মেগাওয়াট। বর্তমানে লোডশেডিং হচ্ছে গড়ে ১৪০ থেকে ২৭৫ মেগাওয়াট পর্যন্ত। হিসাবে লোডশেডিং খুব কম মনে হলেও লোডশেডিংয়ের সাথে চট্টগ্রাম মহানগরী ও বৃহত্তর জেলার সর্বত্রই বিদ্যুতের সঞ্চালন লাইনে তাবৎ ত্রæটি-বিচ্যুতি, ট্রান্সফরমারসহ যন্ত্রপাতি অকেজো, পুরনো, জরাজীর্ণ বেহালদশার কারণে বিভ্রাটেই ঘন্টার পর ঘণ্টা বিদ্যুতবিহীন হয়ে পড়ছে অনেক এলাকা। জোড়াতালি মেরামতেও কাজ হচ্ছে না। রমজানকে ঘিরে বিদ্যুৎ বিভাগের অসৎ কতিপয় কর্মকর্তা-কর্মচারী ট্রান্সফরমার ও বিভিন্ন যন্ত্রপাতি বিকল হওয়া নিয়ে বাণিজ্য করছে গ্রাহকদের রীতিমতো জিম্মি করে। অনেক এলাকায় গ্রাহকরা বাধ্য হয়ে চাঁদা তুলে বিদ্যুৎ বিভাগের লোকজনের হাতে তুলে দিয়ে ট্রান্সফরমার মেরামত করাচ্ছে। ঘন ঘন অনেক এলাকায় কেনইবা ট্রান্সফরমার বিকল হয়ে যাচ্ছে তা নিয়েও গ্রাহকদের প্রশ্ন ও নানা জল্পনা রয়েছে। বিদ্যুৎ সঙ্কটে চট্টগ্রামে ব্যবসা-বাণিজ্য ও শিল্প-কারখানায় উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। রফতানিমুখী পোশাক কারখানাগুলোর নিরবচ্ছিন্ন উৎপাদন চালু রাখা যাচ্ছে না। রফতানিমুখী মৎস্য-চিংড়িসহ হিমায়িত খাদ্যপণ্যের চালান সংরক্ষণ ব্যাহত হচ্ছে। তাছাড়া চট্টগ্রামের মুরাদপুরভিত্তিক ঢাকার ধোলাইখালের মতো অটোমোবাইল ও বিভিন্ন ধরনের যন্ত্রপাতি তৈরি ও মেরামতের ওয়ার্কশপগুলোতে উৎপাদন ব্যবস্থা হয়ে পড়েছে বিপর্যস্ত। এমনকি ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী-দোকানিরাও বিদ্যুৎ বিভ্রাটের শিকার।

 



 

Show all comments
  • Zahid Hossen ২৭ মে, ২০১৭, ১:৪৯ এএম says : 0
    চট্টগ্রাম দীঘদিন ষাবত বিদুত সঙ্কট এ ভূগছে । গ্রাহকদের কষ্টের শেয নাই। আমরা এর সমাধান চাই।
    Total Reply(0) Reply
  • Nurul Hoqe Gazi ২৭ মে, ২০১৭, ১০:৫৭ এএম says : 0
    Govt should take immediate action to solve serious power crisis in the port city Chittagong.
    Total Reply(0) Reply

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: বিদ্যুৎ

১৯ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩
১৮ জানুয়ারি, ২০২৩

আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ