পটুয়াখালীর যুবক ক্বারী সাইয়্যেদ মুসতানজিদ বিল্লাহ রব্বানীর কোরআন তেলাওয়াতে মুগ্ধ যুক্তরাষ্ট্রবাসী
ইসলামি সভ্যতা ও সংস্কৃতি বিকাশে বাংলাদেশের অবদান অনস্বীকার্য। এদেশে ইসলামি সংস্কৃতি চর্চার ইতিহাস অনেক প্রাচীন।
উবায়দুর রহমান খান নদভী : বহু বিতর্কের অবসান ঘটল। অবশেষে সুপ্রিম কোর্টের সামনে থেকে মূর্তি অপসারণ করা হয়েছে। ৯২ ভাগ মানুষের বিশ^াস, চেতনা ও জীবন ধারার বিপরীতে গ্রিক দেবীমূর্তি ভাস্কর্য আকারে যারাই স্থাপন করে থাকুক এর অপসারণের মাধ্যমে দেশের প্রধান বিচারালয় তার স্বাভাবিক চেহারায় ফিরে এসেছে। শিরক ও বিরূপ সংস্কৃতির আবহ থেকে মুক্তি লাভ করেছে জাতীয় ঈদগাহ ময়দান। কঠিন এ বিষয়টি পবিত্র রমজানের আগেই সংঘটিত হওয়ায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে আন্তরিক মোবারকবাদ। তিনি শুরু থেকেই এর বিরোধী ছিলেন। ভাস্কর্যটিও তার পছন্দ হয়নি। গ্রিক দেবীমূর্তি থেমিসকে শাড়ি পরিয়ে উপস্থাপন করা ও হাতে তরবারি ধরিয়ে দেয়া শিল্পের ক্ষেত্রেও ছিল মোটাদাগের ত্রæটি। তাছাড়া দেশের আলেম-উলামাদের তিনি আশ^স্ত করেছিলেন যে, সুপ্রিম কোর্ট তথা প্রধান বিচারপতিকে বলে তিনি এটি সরানোর ব্যবস্থা করবেন। তিনি কথা রেখেছেন, তাকে আবারো ধন্যবাদ। অভিনন্দন প্রধান বিচারপতিকেও, যিনি সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের অনুভ‚তির প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে বিষয়টির একটি সুরাহা খুঁজে বের করেছেন। যদি বাংলাদেশকে তার অকৃত্রিম চেতনা, মূল্যবোধ ও স্বাভাবিক সংস্কৃতির আদলে নির্মাণ করা যায়, তাহলে এ দেশে সংশ্লিষ্টরা সর্বোচ্চ ও অর্থবহ জনপ্রিয়তা পেতে পারেন।
কিছু লোক সকল সমাজেই এমন থাকে, যারা বোঝে না বোঝে কেবল ঝমেলাই বাধায়। মনে মনে সিদ্ধান্ত নিয়ে কাজ করে, পরে কাজটি অন্যায়, অযৌক্তিক ও অবাঞ্ছিত সাব্যস্ত হলে মনে মনেই দুঃখ পায়, পরাজিত হয় এবং হাপিত্যেশ করে নিজেদের মূঢ়তাকে আরো প্রকট করে তোলে। এমনই একটি ঘটনা ছিল বাংলাদেশের সুপ্রিম কোর্টের সামনে ভাস্কর্যের নামে গ্রিক দেবী থেমিসের মূর্তি স্থাপন। শিল্পি মৃণাল হক এর আগেও তার কিছু ভাস্কর্য ভুল জায়গায় স্থাপন করে নিন্দিত হয়েছেন। এ নিন্দা তার ভাস্কর্যের নয়, ভুল জায়গায় স্থাপনের। যেমন তার অনেকগুলো শিল্পকর্ম রাজধানীতে বহাল হয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশের প্রবেশদ্বার হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের মুখে, জাতীয় হাজী ক্যাম্পের মিলনকেন্দ্রে ও বাইতুস সালাম জামে মসজিদ ও মাদরাসার নাক বরাবর তিনি স্থাপন করেছিলেন একতারা হাতে লালন ফকিরের মূর্তি। এরপর তৌহিদী জনতা ও আলেম-উলামাদের প্রতিবাদের মুখে তিনি তা অপসারণে বাধ্য হন। এখানে ত্রæটি শিল্পীর নয়, যে কর্তৃপক্ষ তার শিল্পকর্মটি স্থান-কাল-পাত্র না বুঝে দেশ ও জনগণের মাথায় চাপিয়ে দিয়েছিলেন; ত্রæটি তাদের। এরপর এই মৃণাল হকই বর্ণিত জায়গাটির উপযোগী একটি নতুন ভাস্কর্য তৈরি করে সেখানে বসিয়েছেন। এর কোনো নিন্দা ও প্রতিবাদ তো ধর্মপ্রাণ মুসলমান ও আলেমসমাজ করেনি। এতে বোঝা যায়, তৌহিদী জনতা ও আলেমসমাজ সুকুমারবৃত্তি, সৌন্দর্য বা শিল্পসাধনার বিরোধী নন। তারা বিরোধী জাতীয় স্বাতন্ত্র, স্বকীয়তা, আত্মপরিচয় ও সংস্কৃতি অঙ্গনে সংঘটিত অব্যাহত জালিয়াতির। ৯২ ভাগ মানুষের অনুভ‚তিকে আঘাত করার হীন অপচেষ্টার।
দেশের প্রধান বিচারালয় ৬৮ বছর কোনো মূর্তি ছাড়া চলতে পারল। হঠাৎ ছয় মাস আগে এর সম্মুখস্থ ন্যায়ের প্রতীক দাঁড়িপাল্লা ঢেকে দিয়ে পৌরাণিক কাহিনীর দেবীমূর্তি স্থাপন কেন জরুরি হয়ে পড়ল তা দেশবাসীর বোঝে আসেনি। গ্রিকদের বিশ^াস অনুযায়ী দেবী থেমিস ন্যায় বিচারের প্রতীক। কিন্তু বিশে^র কয়টি রাষ্ট্রে প্রধান বিচারালয়ের সামনে তার মূর্তি আছে? খ্রিষ্টান রাষ্ট্র, মূর্তিতে বিশ^াসী জাতিসমূহের রাষ্ট্র বা উন্নত দেশে যা করা হয়নি তা শতকরা প্রায় ৯৫ জন বিশ^াসী মানুষের দেশে কোন যুক্তিতে স্থাপন করা হলো, এর জবাব সংশ্লিষ্টরাও খুঁজে পাবেন না। বলা হচ্ছে, এটি গ্রিক দেবীর মূর্তি নয়। বাঙালি নারীর মূর্তি। তাহলে প্রশ্ন এসে যায়, দাঁড়িপাল্লা উঁচিয়ে ধরে অন্য হাতে তরবারি ধারণ করা নারীটি কি তাহলে ভারতবর্ষের কোনো দেবী? আবার মূর্তি বললে কেউ কেউ অখুশি হন। তারা বলতে চান, এটি মূর্তি নয়; ভাস্কর্য। তারা কি বাংলা অভিধানে এ দুটি শব্দের অর্থ ভালো করে দেখেছেন?
কেউ কেউ মূর্তি অপসারণের দাবি তোলায় হেফাজতে ইসলামকে দোষারূপ করছে। হেফাজতের যখন জন্মও হয়নি তখনো তো মূর্তি সংস্কৃতি, বস্তু ও পদার্থ পূজা, শিরকনির্ভর অপসংস্কৃতির বিরুদ্ধে এ দেশের মুসলমানরা সোচ্চার ছিলেন। কেউ কেউ বলছেন, প্রধানমন্ত্রী হেফাজতের সাথে আপোষ করেছেন, সরকার আলেম-উলামাদের সাথে আঁতাত করেছে। যুক্তি হিসেবে তারা বলছেন, হেফাজতের দাবি মেনে নিয়ে সরকার পাঠ্যসূচিতে পরিবর্তন এনেছে। কিন্তুপাঠ্যসূচিতে কী পরিবর্তন আনা হয়েছে তা তারা ভেঙে বলেন না। অথচ তথাকথিত প্রগতিবাদী আগ্রাসনে পাঠ্যসূচি যে সাম্প্রদায়িকতা ও নাস্তিক্যবাদের নির্মম শিকারে পরিণত হয়েছিল, তা নিয়ে কোনো মন্তব্য করেন না তারা। আর বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানের দাবির মুখে প্রধানমন্ত্রী পাঠ্যসূচিকে তার স্বাভাবিক পূর্বাবস্থায় ফিরিয়ে আনায় তারা প্রধানমন্ত্রীকে যাচ্ছেতাই বলে যাচ্ছে। সরকার তার বিপুলসংখ্যক নাগরিকের দাবি পূরণ করায় একে তারা আঁতাত আখ্যা দিচ্ছে। দুঃখ হয়, কিছু জ্ঞানপাপী, চক্ষুষ্মান অন্ধ ব্যক্তির জন্য যারা বাস্তবতার বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে গণধিকৃত জীবন বেছে নিয়েছে। বাংলাদেশ যত দ্রæত এদের অপচ্ছায়া থেকে মুক্ত হবে, ততই দেশ ও জাতির জন্য মঙ্গল।
ভেবে বিস্মিত হতে হয়, কেউ একজন তার পছন্দমতো দুয়েকজনকে সাথে নিয়ে একটি মূর্তি বসিয়ে দিলো। যখন এ কাজটি অসঙ্গত বা অনিয়ম বলে সাব্যস্ত হবে, তখন তারা তারস্বরে চিৎকার জুড়ে দেবে যে, আমাদের স্বাধীনতা অর্থহীন হয়ে গেল, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও মূল্যবোধ ভ‚লুণ্ঠিত হয়ে গেল, হেফাজতের কাছে সরকার মাথা নত করল। যদিও হেফাজত বলতে বাংলাদেশের মুসলমান জনগোষ্ঠীর ধর্মীয় অনুভ‚তির প্রবক্তা একটি প্লাটফর্মকে বোঝায়। এমনকি পাঁচ-সাতজন মিলে মিছিল বের করে বলবে, বংলার মাটিতে অপশক্তির ঠাঁই নাই। অর্থাৎ তারা বলতে চান যে, তারা পাঁচ-সাতজন মিলে যে অপকর্মটি করেছে সেটিই বাংলাদেশ, সেটিই স্বাধীনতার চেতনা, সেটিই মুক্তযুদ্ধের মূল্যবোধ আর বাংলাদেশের শতকরা ৯৫ জন মানুষ যা চাইবে তা ভুল। ১৫ কোটি মানুষের এ দেশে ঠাঁই নেই। ঠাঁই আছে শুধু ওই পাঁচ-সাতজনের, আর তাদের পেছনে থাকা এক আধ পার্সেন্ট মানুষের।
আমাকে অসংখ্য ফোন রিসিভ করতে হয়েছে গত চব্বিশ ঘণ্টায়। বিভিন্ন দলের নেতা, মিডিয়ার প্রতিনিধিরা, অনলাইন পোর্টালের লোকজন, আলেম-উলামা-ইমাম-খতিব-পীর-মাশায়েখ, দেশে ও বিদেশের নানা শ্রেণী-পেশার অসংখ্য পরিচিত মানুষের। নানা প্রশ্নের জবাবে সংক্ষেপে অনেক কথাই বলা হয়েছে। ভেবেছি, পত্রিকার পাতায় মতামত তুলে ধরি। যাতে সবাই একসাথে বিষয়টি সম্পর্কে আমাদের মূল্যায়ন জেনে যান। হঠাৎ ছয় মাস আগে যখন রাতারাতি সুপ্রিম কোর্টের সামনে একটি বাজে ধরনের দেখতে ভাস্কর্য স্থাপিত হয়, তখন এর ছবি ও সংবাদ দৈনিক ইনকিলাব প্রকাশ করে। নির্মোহ এই ট্রিটমেন্টেই দেখা দেয় মিশ্র প্রতিক্রিয়া। আলোচনা-সমালোচনার মধ্য দিয়ে কিছু লোকের ভ্রান্ত আবেগ ও অতি উৎসাহ নগ্ন হয়ে ধরা পড়ে। সমাজে প্রতিষ্ঠিত ও দায়িত্বশীল এসব লোক এই ঠুনকো মূর্তিটিকে বলে বসেন স্বাধীনতার প্রতীক, মুক্তিযুদ্ধের চেতনার মশাল, প্রগতিশীলতার আইকন ও বাঙালি জাতির মান-সম্মানের প্রশ্ন। দুঃখ হয় এদের জন্য, যারা দেশ ও জাতির অমূল্য ভাবনা ও চেতনাগুলোকে যেখানে সেখানে ব্যবহার করে এতটা খেলো বানিয়ে ফেলেছেন। আর ধর্মপ্রাণ ১৫ কোটি মুসলমান ও তাদের ধর্মীয় মুরব্বি আলেম-উলামা, পীর-মাশায়েখগণ তাদের সহজ-সরল ইনোসেন্ট ভাষায় নিজেদের অভিব্যক্তি প্রকাশ করেন। বলেন, শতকরা ৯২ ভাগ মুসলমানের সর্বোচ্চ বিচারালয়ের সামনে, পাশাপাশি জাতীয় ঈদগাহের একান্ত পাশে, ঢাকার ইসলাম প্রচারের অগ্রপথিক শায়খ শরফুদ্দীন চিশতী রহ.-এর সাধনার জায়গা ও মসজিদের এরিয়ায় বিনা কারণে, বিনা বিবেচনায় স্থাপিত এই ভাস্কর্যটি অবিলম্বে সরিয়ে ফেলা হোক। সবার ভাষা তো আর এক নয়, তবে ভাব এক ও অভিন্ন। ইসলামী নানা সংগঠন আল্টিমেটাম দেয় রমজানের চাঁদ উঠার আগেই মূর্তি সরানো হোক। কেউ বলেন, মূর্তি সরানো না হলে মানুষ জাতীয় ঈদগাহে ঈদের জামাত বয়কট করবে।
পুলিশের কাছে অনেকে অনুমতি চেয়েছেন সুপ্রিম কোর্টপানে বিক্ষোভ মিছিল নিয়ে যেতে। সংশ্লিষ্ট এলাকায় মানববন্ধন করতে। কিন্তু জাতীয় সংবেদনশীল জায়গা হওয়ায় ধর্মপ্রাণ মানুষ কোনো কঠিন আন্দোলন বা নিয়ম ভেঙে বিক্ষোভ করেনি। অথচ মূর্তি অপসারণের পর গুটিকয়েক লোক প্রতিবাদের নামে যে জঙ্গিভাব দেখাল, তা ছিল খুবই দৃষ্টিকটু। জুমার নামাজও তাদের কাছে কোনো বিষয় নয়। বিষয় নয় সুপ্রিম কোর্ট। তারা ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়কে আন্দোলনের নিরাপদ জায়গা ধরে নিয়েছে। অথচ এ সিদ্ধান্ত প্রধান বিচারপতির। বাস্তবায়ন করেছে সুপ্রিম কোর্ট। প্রগতিশীল নাম নেয়ায় তারা যা করবে, তাই ঠিক। মনে হয়, মজলুম মুসলমান ও ধর্মপ্রাণ মানুষের বুকে রক্তক্ষরণও এ দেশে একটি দোষ। তাদের অহিংস আন্দোলন বা নির্দোষ প্রতিবাদও এদেশে অপরাধ আর প্রগতিশীল নাম ধারণ করে যাই করা হোক না কেন, সব জায়েজ। তাদের সাত খুন মাফ। ৯২ ভাগ মানুষের কোনো দাবি পূরণ করলে তা হয়ে যায় সরকারের জন্য আপস বা আঁতাত। একসময় ঢাকা বার মূর্তি স্থাপনের নিন্দা জানিয়েছে। আইনজীবী সমিতি প্রতিবাদ করেছে। সবদিক বিবেচনা করে প্রধান বিচারপতি যথাসময় আইনজীবী নেতৃবৃন্দ ও বিশিষ্ট আইনজ্ঞদের সাথে পরামর্শ করে রমজানের দুদিন আগে শিল্পীর তত্ত¡াবধানে মূর্তিটি অপসারণের ব্যবস্থা নেন। তিনি শান্তি শৃঙ্খলা বজায় রাখার জন্য ও বাংলাদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের অনুভ‚তির প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে এ সিদ্ধান্ত নেয়ায় দেশবাসীর কাছে ধন্যবাদার্হ হয়েছেন। এতে তিনি প্রধান বিচারপতি ও সুপ্রিম কোর্টকে একটি অযাচিত বিতর্ক থেকে মুক্ত করলেন। আমরা আশা করব, বাংলাদেশের দায়িত্বশীল প্রতিটি ব্যক্তিই জনগণের প্রকৃত চাহিদা, রুচি, অভিমত বিবেচনা করে প্রতিটি কাজ করবেন। ন্যায়বিচার, সুশাসন, উন্নয়ন ও শান্তির জন্য এর বিকল্প নেই।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।