Inqilab Logo

সোমবার ১৮ নভেম্বর ২০২৪, ০৩ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১৫ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

অভিশাপের নাম ফিস্টুলা

| প্রকাশের সময় : ২৩ মে, ২০১৭, ১২:০০ এএম


দেশে ৭০ হাজার নারী ফিস্টুলায় আক্রান্ত, প্রতি বছর যোগ হচ্ছে দুই থেকে আড়াই হাজার : ভুল অস্ত্রোপচার ও অদক্ষ দাই’র কারণে বাড়ছে এই সংখ্যা
হাসান সোহেল : রহিমা বেগম (৪২)। বর্তমানে স্বামী পরিত্যক্তা। রংপুরের বদরগঞ্জ উপজেলার বামনা বাজার শেখ পাড়া গ্রামের বাসিন্দা। মাত্র ১২ বছর বয়সেই বিয়ে হয় একই গ্রামের জাফর আলীর সাথে। বিয়ের ঠিক ৩ মাসের মাথায় পেটে বাচ্চা আসে। বাচ্চা হওয়ার সময়ে একদিন একরাত আমি বাড়িতেই থাকি। তারপর আমাকে দিনাজপুরের হলদিবাড়ি হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে মরা বাচ্চা খালাস করে। ওই ডেলিভারীর সময়ে থেকেই আমার ফিস্টুলা অসুখ শুরু হয়। আমার স্বামী আমাকে তখনই ত্যাগ করে। এরপর থেকেই একাই পথ চলছি বলেন- রমিছা।
নারীর গর্ভধারণ থেকে শিশুর জš§দান পর্যন্ত একটি অত্যন্ত জটিল প্রক্রিয়া। এই প্রক্রিয়ায় কোনো ব্যতয় ঘটলে তা ওই নারীর জীবনের জন্য হয়ে উঠতে পারে, অভিশাপ স্বরূপ। আর তেমনই এক অভিশাপের নাম ফিস্টুলা। শুধু রমিছা নন, বর্তমানে দেশে প্রায় ৭০ হাজার নারী ফিস্টুলায় আক্রান্ত। প্রতিদিনই এ রোগে আক্রান্তের সংখ্যা বাড়ছে। আর এই বহরে গতি জোগাচ্ছে ভুল অস্ত্রোপচারজনিত ফিস্টুলা। দেশে প্রতিবছর আড়াই থেকে তিন হাজার নতুন ফিস্টুলা রোগী যোগ হচ্ছে। এ বছর ৩৭৯ জন রোগীকে ইতোমধ্যে অপারেশন করিয়েছেন চিকিৎসকরা।  এনজেন্ডারহেলথ্ বাংলাদেশের ‘ফিস্টুলা কেয়ার প্রকল্প’র গবেষণা প্রতিবেদন মতে, প্রতি হাজার বিবাহিত নারীর বিপরীতে বাংলাদেশে ফিস্টুলা-আক্রান্ত নারীর সংখ্যা ১ দশমিক ৭ জন। উপযুক্ত বয়সের আগে বিয়ে ও গর্ভধারণকারী নারীদের মধ্যে এ রোগের প্রবণতা বেশি বলেও এতে উল্লেখ করা হয়।
বিশেষজ্ঞরা জানান, প্রসবজনিত (বাধাগ্রস্ত প্রসব) কারণে ৭৬ শতাংশ এবং অস্ত্রোপচারজনিত কারণে ২৪ শতাংশ নারী ফিস্টুলায় আক্রান্ত হচ্ছেন। অস্ত্রোপচারজনিত কারণের ৮০ শতাংশ জরায়ু অপসারণে এবং ২০ শতাংশ সিজার পরবর্তী আঘাতের কারণে ফিস্টুলায় আক্রান্ত হচ্ছে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে অভিজ্ঞ চিকিৎসক দ্বারা অপারেশনের মাধ্যমে ৮০ থেকে ৮৩ ভাগ ফিস্টুলা ঠিক করা সম্ভব। তারা বলছেন, দেশে ইতিপূবে জাতীয় পর্যায়ে ফিস্টুলা বিষয়ে কোনো জরিপ চালানো হয়নি। তবে এবছর একটি জাতীয় জরিপের কাজ চলছে এবং এবছর ২০ থেকে ২৫শে মে দেশের ১৩ হাজার কমিউনিটি ক্লিনিকে ফিস্টুলা রোগীদের নাম নিবন্ধন করানো হবে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, গত ১০ বছরে দেশে ফিস্টুলা রোগী দ্বিগুণ হয়েছে। তাদের মতে, ফিস্টুলা প্রতিরোধ না করে শুধু চিকিৎসা দিয়ে এ জটিলতা দূর করা সম্ভব হবে না। দেশের চিকিৎসকদের মধ্যে গাইনি চিকিৎসক বেশি। এদের মধ্যে ফিস্টুলা চিকিৎসক নেই বললেই চলে। মাত্র ২৫ থেকে ৩০ জন সার্জন রয়েছেন। দেশে ৬৪ থেকে ৬৫ শতাংশ মায়েদের ডেলিভারি এখনও বাড়িতে হচ্ছে বলে বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন।
অপরদিকে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, যেসব দেশে দক্ষ ব্যক্তির সহায়তা ছাড়া বাড়িতে ৫০ শতাংশের বেশি সন্তান প্রসব হয় এবং জনসংখ্যার ঘনত্ব বেশি, সেসব দেশে বছরে দুই থেকে আড়াই হাজার নারী নতুন করে ফিস্টুলায় আক্রান্ত হন। এ হিসাবে বাংলাদেশে প্রতি বছর দুই থেকে আড়াই হাজার ফিস্টুলা রোগী বাড়ছে। তবে নারীরা লজ্জা পান এবং গোপন রাখেন বলে ফিস্টুলার সঠিক পরিসংখ্যান জানা কঠিন। বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার জরিপ মতে, বিশ্বে আনুমানিক ২ মিলিয়নেরও বেশি অর্থাৎ ২০ লাখ নারী ফিস্টুলা রোগে আক্রান্ত এবং প্রতিবছর আনুমানিক এক লাখেরও বেশি নারী নতুর করে এতে আক্রান্ত হচ্ছেন। বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়া ও উন্নয়নশীল দেশগুলোতে এর মাত্রা বেশি।
সূত্র জানায়, ন্যাশনাল ফিস্টুলা সেন্টার ও ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে বছরে ২৫০ থেকে ৩০০ ফিস্টুলা রোগী সেবা নিচ্ছেন। এখানে আগে ১৬টি বেড ছিল। কিন্তু দিন দিন রোগীর সংখ্যা বাড়ায় বর্তমানে বেড সংখ্যা বাড়িয়ে ৩৫ উন্নীত করা হয়েছে। অন্যদিকে, বর্তমানে বিএসএমএমইউতে ৬টি বেড নিয়ে আলাদাভাবে ফিস্টুলা সেন্টার তৈরি করা হয়েছে। সম্পূর্ণ বিনামূল্যে গত ২০১৫ সালের এপ্রিল থেকে এ সেন্টার থেকে এসব রোগীদের সেবা দেয়া হচ্ছে। প্রায় দু’বছরে দেড়শতাধিক জনের মতো রোগীকে সেবা দেয়া হয়েছে। সেন্টারে আসা রোগীরদের বেশির ভাগই দরিদ্র এবং গ্রামের বলে জানা গেছে।
বিশেষজ্ঞরা জানান, অসচেতনতার কারণে মূলত নারীরা ফিস্টুলা রোগে আক্রান্ত হন। বাংলাদেশ শিশুমৃত্যুর হারে সাফল্য অর্জন করলেও নিরাপদ প্রসব এখনো নিশ্চিত করা যায়নি। অসতর্কতা, মেয়েদের অল্প বয়সে বিয়ে হওয়া, অদক্ষ দাইয়ের হাতে সন্তান প্রসব, সঠিক সময়ে চিকিৎসকের কাছে না যাওয়া এবং পরিবারের অবহেলার কারণে এখনো দেশের অনেক মা প্রসবকালীন সময়ে সঠিক সেবা পান না। ফলে নারীরা ফিস্টুলা রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন।
প্রতিরোধ বিষয়ে চিকিৎসকরা জানান, ফিস্টুলা একটি নিরাময়যোগ্য শারীরিক সমস্যা। দক্ষ চিকিৎসকের তত্ত¡াবধানে এ সমস্যা নিরাময় সম্ভব। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে অভিজ্ঞ ডাক্তার দ্বারা অপারেশনের মাধ্যমে ফিস্টুলা ঠিক করা যায়। বাল্যবিয়েকে নারীজনিত ফিস্টুলার অন্যতম কারণ বলা হয়। বাল্যবিয়ে বন্ধে সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে। কম বয়সে গর্ভধারণ করলে ফিস্টুলা হওয়ার ঝুঁকি বেড়ে যায়। তাই উপযুক্ত পদ্ধতি গ্রহণ করে পরিণত বয়সে সন্তান নেয়া উচিত। উপযুক্ত প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত কর্মীর সহায়তায় প্রসব করালে ফিস্টুলা ঝুঁকি কম থাকে। বাধাগ্রস্ত প্রসবের ক্ষেত্রে দ্রæত স্বাস্থ্য কেন্দ্রে নিতে হবে।
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে জাতীয় ফিস্টুলা সেন্টারসহ দেশের ১১টি সরকারি মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে বিনামূল্যে ফিস্টুলা রোগীদের চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে। ঢাকা এবং যশোরের আদ-দ্বীন হাসপাতালে, টাঙ্গাইলের মির্জাপুরে কুমুদিনী হাসপাতালে এবং দিনাজপুরের পার্বতীপুরে ল্যাম্বসহ ৮টি বেসরকারি হাসপাতালে এনজেন্ডারহেলথ্ ফিস্টুলা রোগীদের চিকিৎসা সহায়তা দিচ্ছে। ঢাকায় এই রোগীদের জন্য একটি পুনর্বাসন কেন্দ্রও পরিচালিত হচ্ছে। সূত্র জানায়, নগরের ১৮/২ বকশীবাজারে প্রসবজনিত ফিস্টুলা রোগী চিকিৎসা, আরোগ্য ও পুনর্বাসন প্রকল্পের কার্যালয়। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সার্বিক তত্ত¡াবধানে ইউএনএফপিএর সহায়তায় পরিচালিত প্রকল্পের আওতায় এ পুনর্বাসন কেন্দ্রে ২৮ জন নারীর থাকার ব্যবস্থা আছে। কেন্দ্রের ভেতরেই বেকারি, সেলাই, রান্না, সবজির বাগান তৈরি, হাঁস মুরগি পালনসহ বিভিন্ন বিষয়ে প্রশিক্ষণ নেয়ার ব্যবস্থা আছে। প্রশিক্ষণ পেয়ে এক সময়ে সমাজচ্যুত এই নারীরা এখন অনেকটাই আত্মবিশ্বাসী।
ন্যাশনাল ফিস্টুলা সেন্টার ও ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের স্ত্রীরোগ ও প্রসূতিবিদ্যা বিভাগের  সাবেক বিভাগীয় প্রধান ডা. ফেরদৌসি ইসলাম লিপি জানান, বাড়িতে বাধাগ্রস্ত প্রসব কমাতে দরকার দক্ষ ধাত্রী। তাহলে ফিস্টুলা কমিয়ে আনা সম্ভব। প্রসবের সঠিক সময়ে পাটোগ্রাফ ব্যবহার করতে হবে। থাকতে হবে পূর্ব প্রস্তুতিও। মানুষের মধ্যে সচেতনতাই পারে এ রোগ থেকে মুক্তি দিতে।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) অবস এন্ড গাইনী বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. রেজাউল করিম কাজল বলেন, দেশে গাইনী চিকিৎসক বেশি হলেও ফিস্টুলা চিকিৎসক নেই বললেই চলে। কারন হিসেবে তিনি বলেন, ফিস্টুলা রিপিয়ারের চিকিৎসা অনেক কঠিন। প্রশিক্ষকও অনেক কম। তাছাড়া ফিস্টুলা সাধারণত দরিদ্র মানুষের বেশি হয়। যাদের চিকিৎসার মাধ্যমে অর্থ উপার্যনের সুযোগ অনেক কম। তাই এই ক্ষেত্রের চিকিৎসকদের আগ্রহ থাকে না। ডা. কাজল বলেন, ফিস্টুলা এমন একটি সমস্যা যা মানুষকে সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেয়। তাই সকল গাইনী চিকিৎসকের উচিত এসব রোগীদের সেবায় এগিয়ে আসা।
এনজেন্ডারহেলথ্ বাংলাদেশ’র ‘ফিস্টুলা কেয়ার প্লাস প্রকল্প’র প্রকল্প ম্যানেজার ডা. শেখ নাজমুল হুদা বলেন, ফিস্টুলা নিরাময়যোগ্য রোগ। সঠিক জায়গায় চিকিৎসা নিতে হবে। সচেতন হতে হবে। তিনি বলেন, আমাদের দেশে অস্ত্রোপচারজনিত ফিস্টুলা বাড়ছে, তা কমাতে হবে।
এ পরিস্থিতে আজ ২৩ মে অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও সরকারি ও বেসরকারি নানা আয়োজনে বিশ্ব ফিস্টুলা দিবস পালন করা হচ্ছে। এ বছর বিশ্ব ফিস্টুলা দিবসের প্রতিপাদ্য হচ্ছে-‘আশা, আরোগ্য এবং আত্ম-মর্যদা সবার জন্য।’ দিবসটি উপলক্ষ্যে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি সেমিনারের আয়োজন করা হয়েছে। এছাড়া ফিস্টুলা সম্পর্কে সচেতনতা বাড়াতে দেশব্যাপি বিভিন্ন কার্যক্রম হাতে নিয়েছে দাতা সংস্থা ইউনিএফপিএ।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ