Inqilab Logo

সোমবার ২৫ নভেম্বর ২০২৪, ১০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২২ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

তৃণমূলে শৃঙ্খলা ফেরাতে শেখ হাসিনার হস্তক্ষেপ কামনা জেলা নেতাদের

| প্রকাশের সময় : ২১ মে, ২০১৭, ১২:১০ এএম

স্টাফ রিপোর্টার : আওয়ামী লীগের ২০তম জাতীয় সম্মেলনের পর প্রথম বর্ধিত সভায় তৃণমূল নেতাদের কথায় অনৈক্য ও হতাশার সুর স্পষ্ট হয়েছে। দলীয় এমপি-মন্ত্রী ও প্রভাবশালী কিছুর নেতার কারণে ত্যাগী নেতারা কোনঠাসা হয়ে পড়েছে। এমপি-মন্ত্রীরা বিশেষ বলয় গড়ে তুলে জামায়াত-শিবিরকে দলের ভেড়াচ্ছেন। আগামীতে বিচার বিশ্লেষণ করে দলীয় মনোনয়ন দিতে হবে। না হলে দলের জন্য সুখকর অবস্থান থাকবে না। তৃণমূলে শৃঙ্খলা ভেঙ্গে পড়েছে-এখন থেকে এই ভেঙ্গে পড়া শৃঙ্খলা এখনই ফেরাতে দলীয় সভানেত্রীর হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন জেলা নেতারা।
গতকাল শনিবার সকালে গণভবনে আওয়ামী লীগের বর্ধিত সভায় এ দাবি উঠে আসে দলটির তৃণমূল নেতৃত্বের বক্তব্যে। সেখানে সংসদ সদস্যদের সঙ্গে নেতাকর্মীদের দূরত্বের বিষয়টিও উঠে আসে। এ ছাড়াও নেতারা দলের ভেতরে অনুপ্রবেশকারীদের ব্যাপারে নানা অভিযোগ উত্থাপন করেন।  
তৃণমূলের আট নেতার বক্তব্য শেষ হলে সমাপনী বক্তব্যে দলীয় সভানেত্রী শেখ হাসিনা বলেন, প্রত্যেক সংসদ সদস্যকে নিজ জেলার নেতাদের সঙ্গে মিলেমিশে কাজ করতে হবে। সকাল ১০ টায় গণভবনের পশ্চিম মাঠে অস্থায়ী মঞ্চে আসনে দলীয় সভানেত্রী শেখ হাসিনা। দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের সুচনা বক্তব্যের মাধ্যমে বর্ধিত সভার কার্যক্রম শুরু হয়। এরপর পবিত্র ধর্মগ্রন্থ থেকে পাঠ করা হয়। তারপর শোক প্রস্তাব উত্থাপন করেন আওয়ামী লীগের দপ্তর সম্পাদক আবদুস সোবহান গোলাপ। বর্ধিত সভার উদ্বোধন করেন আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা। এসময় তিনি সদস্য সংগ্রহ, নবায়ন কার্যক্রমের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধনও করেন। আওয়ামী লীগের সদস্য ফরম নির্ধারিত মুল্য ২০ টাকার পরিবর্তনে ৫০০ টাকা দিয়ে নিজের ফরম পুরণ করেন শেখ হাসিনা। এরপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টেলিভিশন ও চলচ্চিত্র অধ্যয়ন বিভাগের শিক্ষক এ জেএম শফিউল আলম ভ‚ঁইয়া ও সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ফারজানা বেগম আওয়ামী লীগের নতুন সদস্য হন। একইভাবে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরও সদস্য পদ নবায়ন করেন।  এরপর আওয়ামী লীগের গঠনতন্ত্র ও ঘোষণাপত্রের মোড়ক উšে§াচন করেন দলীয় সভানেত্রী। আট বিভাগের আট জেলার নেতাদের হাতে ল্যাপটপ তুলে দেন তিনি। ৭৮টি সাংগঠনিক জেলায় একটি করে ল্যাপটপ বিতরণ করা হয়। দলের প্রচার সম্পাদক ড. হাছান মাহমুদ ও উপ প্রচার আমিনুল ইসলাম আমিনের পরিচালনায় সারাদেশ থেকে আসা আট বিভাগের আট জন নেতা বক্তব্য রাখেন। শেখ হাসিনা মঞ্চে বসে থেকে সবার বক্তব্য শোনেন। পরে সবার অভিযোগ, অনুযোগ ও পরামর্শের জবাব দেন তিনি। রূদ্ধদ্বার এই সভায় উপস্থিত একাধিক সূত্র এসব তথ্য নিশ্চিত করে। সুচনা বক্তব্য দেন দলের সাধারণ সম্পাদক সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের।  
খুলনা জেলার সভাপতি হারুন উর রশীদ বলেন, দলের মধ্যে শৃঙ্খলা এনে দিলে ‘শেখ হাসিনার সরকার, বার বার দরকার’ এই শ্লোগানও দিতে হবে না। তিনি বলেন, আমরা বিভিন্ন সময়ে স্থানীয় সরকার নির্বাচনগুলোতে দেখেছি আপনি (শেখ হাসিনা) মনোনয়ন দেন। কিন্তু নৌকার বিরুদ্ধে আরেক জন দাঁড়িয়ে যায়। তাই শৃঙ্খলা অত্যন্ত জরুরি হয়ে পড়েছে। দলের বিরুদ্ধে যদি আমিও যাই, আমার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিন।
তিনি বলেন, আমার দায়িত্বপ্রাপ্ত জেলায় সহযোগী সংগঠনের কমিটি হয় অথচ আমি জানি না। সহযোগী সংগঠনের সবাই কমিটি দেন ঢাকায় বসে। তিনি প্রধানমন্ত্রীর কাছে অনুযোগের সুরে বলেন, কয়দিন আগে ছাত্রলীগের কমিটি নিয়ে কেন্দ্রীয় সভাপতি সাইফুর রহমান সোহাগ ও এসএম জাকির হোসেনের সঙ্গে কথা বলি। তারা বলেন, ‘দেখছি।’ এরপর আরও সময় চলে যায়। এভাবেই চলছে সবগুলো সহযোগী সংগঠন। তিনি বলেন, দলের স্পোকসম্যান (মুখপাত্র) যাতে একজন হয়। দলের সিদ্ধান্ত একজনই বলবেন। বেশি লোক দলীয় সিদ্ধান্ত নিয়ে কথা বললে আমরা বিব্রত হই।  
সভায় রংপুর বিভাগের পক্ষে রংপুর জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক রেজাউল করিম রাজু বলেন, ‘এমপিরা নির্বাচিত হয়ে বলয়ের বাইরে যেতে পারেন না। আর বলয়ের কারণে অমুককে তমুককে দিয়ে কমিটি দেয়া হয। জামায়াত-শিবিরের নেতাকর্মীরা আওয়ামী লীগের পতাকাতলে সমবেত হয়। তারা কাদের ছত্রছায়ায় আওয়ামী লীগে ঢুকছে সেটা তদন্ত করে দেখতে হবে। এগুলো শক্ত হাতে দমন না করলে আমার মত আওয়ামী লীগের নিবেদিত নেতারা টিকে থাকতে পারবে না। তিনি বলেন, আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মাঝে মধ্যে এমন কথা বলেন তখন আমরা ভীত হয়ে পড়ি। দল বুঝি আর ক্ষমতায় আসবে না। তাছাড়া উনার বক্তব্যে দলীয় বিভেদ স্পষ্ট হয়ে উঠে।  
চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলার সভাপতি মোসলেম উদ্দিন বলেন, আমাদের সরকারের টানা দুই মেয়াদে ক্ষমতায় থাকার ফলে যে উন্নয়ন হয়েছে সে হিসাবে আমরা জাগরণ সৃষ্টি করতে পারিনি। সংসদ সদস্যদের সঙ্গে সংগঠনের নেতাকর্মীদের সৃষ্ট দূরত্ব তৈরি হয়েছে। এই দূরত্ব কাটিয়ে তুলতে শেখ হাসিনার দৃষ্টি আকর্ষণ করেন তিনি। দলীয় মুখপাত্রের বিষয়ে তিনি বলেন, স্পোকসম্যানের কথায় আমরা যদি বিভ্রান্ত হই তাহলে দলের আরও ক্ষতি হবে। এই বিষয়টিও শেখ হাসিনাকে ভেবে দেখতে বলেন তিনি।
সহযোগী সবগুলো সংগঠনের অসহযোগিতার কথা তুলে ধরে মোসলেম উদ্দিন বলেন, সহযোগী সংগঠনগুলো বিপরীতমুখী হলে আমরা যারা আওয়ামী লীগের দায়িত্ব পালন করি তারা কিভাবে কাজ করবো? সহযোগী সংগঠন সম্পর্কে উষ্মা প্রকাশ করে তিনি বলেন, সহযোগী সংগঠনগুলোকে এখান (ঢাকা) থেকে বিপরীতমুখী করা হলে অসুবিধা হয়। দীর্ঘদিন আমরা ছাত্রলীগের কমিটি গঠন করতে পারি না। তবে বিভাগীয় দায়িত্বপ্রাপ্ত যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও সাংগঠনিক সম্পাদক আমাদের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখেন। আমাদের সমস্যা হলে পরামার্শ গ্রহন করি এবং সমাধান করার চেষ্টা করছি বলেও উল্লেখ করেন তিনি।
এমপিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ তুলে মোসলেম বলেন, এমপি সাহেব থানা আইন-শৃঙ্খলা কমিটিতে আওয়ামী লীগের সভাপতিকে রাখতে চান না। কেন্দ্রীয় নেতাদের সমালোচনা করে তিনি বলেন, অনেক সংগঠনকে দোকান বলা হয়। কেন্দ্রীয় নেতারাই তাদের ১৫/২০ জনকে নিয়ে রাস্তায় দাঁড়িয়ে যান।
ময়মনসিংহ বিভাগের পক্ষে ময়মনসিংহ জেলার সভাপতি জহিরুল হক খোকা বলেন, আগামী নির্বাচনে জাতীয়ভাবে কাজকর্মই শুধু জনগণ বিবেচনা করবে না, বিবেচনা করবে স্থানীয়ভাবে এমপিরা কী করছেন, সেই প্রশ্ন আসবে? সেদিকেও খেয়াল রাখতে হবে। স্থানীয় নির্বাচনগুলোতে দেখেছি অশুভ প্রতিযোগিতা। আমরা একদল আপনার নেতৃত্বে এগিয়ে যাচ্ছি, আরেক দল আপনাকে পিছনের দিকে টানছে।
খোকা বলেন, আমাদের ভেতরে বেশিরভাগ বিরোধ আদর্শের নয়, ব্যক্তিত্বের নেতৃত্বের। এসব বিরোধ মিটিয়ে ফেলতে হবে। তৃণমূলের প্রবীণ এই নেতা বলেন, নেত্রী ৭৫ সালে একজন খন্দকার মোশতাক ছিল। আজকে আওয়ামী লীগের রন্ধ্রে রন্ধ্রে খন্দকার মোশতাক ঢুকে পড়েছে। নেত্রী আপনি যদি শক্ত হাতে ধরতে না পারেন; তাহলে আমরা টিকতে পারব না। এদের থেকে সাবধান থাকতে হবে।
সিলেট মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি বদরুদ্দিন কামরান বলেন, আমাদের সিলেট বিভাগে মোট ২০টি আসন। সেখানে যারা প্রার্থীদের বিজয়ী করতে তৃণমূলের প্রত্যেক নেতাকর্মীর ঘাম ঝরেছে। কিন্তু বিজয়ী হয়ে সেসব সংসদ সদস্যদের মধ্যে সাধারণ মানুষ ও নেতাকর্মীদের ফারাক তৈরি হয়েছে। ফলে আগামীতে চুলচেরা বিশ্লেষণ করে মনোনয়ন দেবেন।
ঢাকা বিভাগের পক্ষে টাঙ্গাইল জেলার সভাপতি ফজলুর রহমান ফারুক বলেন, আমরা ঐক্যবদ্ধ থাকব, নেতৃত্ব নিয়ে প্রতিযোগিতায় যাব না। এক ও অভিন্ন থেকে এগিয়ে যাই। কেউ ভিন্ন চিন্তায় ভিন্ন হব না।
রাজশাহী জেলার সভাপতি ওমর ফারুক চৌধুরী বলেন, দ্ব›দ্ব আছে, তবে দ্ব›েদ্বর কথা নয় আমি বলব ঐক্যের কথা। দ্ব›দ্ব^ থাকতেই পারে তবে নিরসনের উপায় বের করতে হবে।
বরিশাল বিভাগের পক্ষ থেকে বরিশাল জেলা শাখার সভাপতি আবুল হাসনাত আব্দুল্লাহ বলেন, আমরা বরিশাল বিভাগে ঐক্যবদ্ধ। তবে কোথাও কোন বিভেদ থাকলে, ভুল বোঝাবেঝি থাকলে মীমাংসা হবে না কেন?।
তাদের বক্তব্য শোনার পর প্রত্যেক সংসদ সদস্যকে নিজ জেলার নেতাদের সঙ্গে মিলেমিশে কাজ করার নির্দেশ দেন দলীয় সভানেত্রী। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, আমার কাছে তথ্য আছে, দল ভারির জন্যে অন্য দল থেকে সুবিধাবাদীদের দলে টানা হচ্ছে, এদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে।
তৃণমূল নেতাদের উদ্দেশে শেখ হাসিনা বলেন, মনে রাখবেন, এরা দলে ঢোকে কমিশন খাওয়ার লোভে। দলে ঢুকে এরা এত বেশি শক্তিশালী হয়ে যায় যে এদের কনুইয়ের গুঁতায় আমার দলের নিবেদিতরা টিকতে পারে না।’ প্রত্যেক সংসদ সদস্যকে নিজ জেলার নেতাদের সঙ্গে মিলেমিশে কাজ করতে হবে নির্দেশ প্রদান করে দলীয় সভানেত্রী শেখ হাসিনা বলেন,  আমি সার্ভে করে দেখেছি প্রত্যেকে নিজ নিজ এলাকায় গ্রæপ করার স্বার্থে, দল ভারি করার স্বার্থে বিএনপি-জামায়াতের দাগীদের-যারা আমাদের নেতাকর্মীদের ২০০১ সালের নির্বাচনের পরে অত্যাচার নির্যাতন করেছেন তাদের টেনেছে। এরা দলের ভেতরে এসে দলের ক্ষতি করে। এমনকি আমাদের দলের নেতাকর্মীদের হত্যার সঙ্গে পর্যন্ত জড়িত হয়। 



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: শেখ হাসিনা


আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ