Inqilab Logo

শুক্রবার ১৪ নভেম্বর ২০২৪, ৩০ কার্তিক ১৪৩১, ১২ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

জাতীয় বীজাগার জরুরি

| প্রকাশের সময় : ১৮ মে, ২০১৭, ১২:০০ এএম


মিজানুর রহমান তোতা : খেয়ালী আবহাওয়া ও প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলা করে  কর্মবীর কৃষক কৃষিপণ্য উৎপাদন করে চলেছেন। হাড়ভাঙ্গা পরিশ্রম করে কখনো লাভবান হন, আবার কখনো হন লোকসান। যে কোন ফসলের প্রাণশক্তি হচ্ছে বীজ। কিন্তু বিষয়টির দিকে যতটা নজর দেওয়ার দরকার ছিল, ততটা হচ্ছে না। এই অভিযোগ কর্মবীর কৃষকদের। কৃষি বিশেষজ্ঞ ও বিজ্ঞানীসহ কৃষির সাথে সংশ্লিষ্টরাও একবাক্যে স্বীকার করবেন, উন্নতমানের বীজ কৃষি বিপ্ল­বের মূল উৎস। খাদ্য নিরাপত্তা গড়ে তোলার প্রথম ধাপ হচ্ছে কৃষকদের উন্নতমানের ও চাহিদানুযায়ী বীজের নিশ্চয়তা। সুত্রমতে, জোরালো দৃষ্টি দেওয়ার অভাবে প্রায় প্রতিটি আবাদ মৌসুমেই উন্নমানের বীজ সংকট দেখা দেয়। করতে হয় বীজ সংকট মোকাবিলা। অথচ সরকারী ব্যবস্থাপনা গড়ে তোলা হলে খুব সহজেই বীজের চাহিদা পুরণ করা সম্ভব। দেশে চাহিদানুযায়ী বীজ উৎপাদনের যথেষ্ট সুযোগও বিদ্যমান। এই অভিমত কৃষি বিশেষজ্ঞ, বিজ্ঞানী ও বীজ গবেষকদের।  
তাদের মতে, বিএডিসির বীজ উৎপাদন খামারগুলোতে অবকাঠামো নির্মাণ, আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার, উন্নতমানের কৃষি যন্ত্রপাতি সরবরাহ, জনবল বৃদ্ধি, গোডাউন ও প্রসেসিং সেন্টারের সংখ্যা বৃদ্ধি, পর্যাপ্ত বীজ পরীক্ষাগার, বীজ উৎপাদন ও বিপননে কৃষিজাত পণ্যের আবাদ ও উৎপাদনে সহায়ক নীতিমালা তৈরী, চাহিদানুযায়ী বাজেট বরাদ্দ এবং মাটি ও আবহাওয়া উপযোগী নতুন নতুন জাত উদ্ভাবনসহ সংশ্লিষ্ট বিষয়ে পরিকল্পনা গ্রহণ করা হলে কৃষি প্রধান বাংলাদেশে গড়ে তোলা সম্ভব হবে জাতীয় বীজাগার। কৃষকদের সুবিধার্থে জেলায় জেলায় ফার্মার্স সীড সেন্টার স্থাপনের পদক্ষেপ নেওয়া হলে কৃষিখাতে বৈপ্ল­বিক পরিবর্তন ঘটবে। বীজ নিয়ে কৃষকের দুশ্চিন্তা লাঘব হবে। তারা পাবেন আশানুরুপ ফলন। একইসাথে খাদ্য নিরাপত্তাও নিশ্চিত করার পথ সুগম হবে।
সুত্রমতে, নানা কারণে এ ব্যাপারে পরিকল্পনা আছে। কিন্তু বাস্তবায়ন হচ্ছে না। সারা দেশে মাত্র ৫টি ফার্মার্স সীড সেন্টার আছে। এতে হাতেগোনা অল্পসংখ্যক কৃষক নিজেদের বীজ সংরক্ষণের সুযোগ পায়। ওই ৫টি সীড সেন্টার হচ্ছে পটুয়াখালী, গোপালগঞ্জ, শেরপুরের নখলা, মৌলভীবাজারের কুলাউড়া ও সিলেটের শ্রীমঙ্গল। সেখানেও সব ফসলের বীজ রাখার ব্যবস্থা নেই। কৃষকরা সাধারণত বরাবরের মতো নিজস্ব ফর্মুলায় বীজ সংরক্ষণ করে থাকে কমবেশী। এবার বোরো ধানের বীজ সহজে সাধারণ কৃষকদের পক্ষে সংরক্ষণ হবে না বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। কারণ বøাস্ট রোগ ও পাহাড়ী ঢল ও বৃষ্টিতে অনেক ধান নষ্ট হয়ে গেছে। সংশ্লিষ্ট একাধিক সুত্র জানায়, বিএডিসির মোট ২৩টি বীজ উৎপাদন খামার, ১৪টি বীজ প্রক্রিয়াজাতকরণ কেন্দ্র ও কৃষকপর্যায়ে কন্টাক্ট গ্রোয়ার্সের ৩১টি প্রকল্প রয়েছে। সুত্র জানায়, সারা দেশে ধান, গম, ডাল, আলু, সবজি ও পাটসহ সব ধরণের ফসল আবাদ ও উৎপাদনের ক্ষেত্রে বিশাল সম্ভাবনার দ্বার খুলে যাবে। সংশ্লিষ্ট সুত্রের রেকর্ড অনুয়ায়ী বিএডিসি গড়ে সর্বোচ্চ ১৫ শতাংশ বীজ সরবরাহ করতে পারে। সবমিলিয়ে দেশে প্রায় ৯লাখ মেট্রিক টন বীজের চাহিদা রয়েছে। বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন কর্পোরেশনের (বিএডিসি) মাধ্যমে বর্তমানে বীজ সরবরাহ করা সম্ভব হয় সর্বোচ্চ মাত্র দেড় লাখ মেট্রিক টন।
এশিয়ার বৃহত্তম বীজ উৎপাদন খামার রয়েছে বাংলাদেশে। খামারটি যশোর ও ঝিনাইদহের সীমান্তবর্তী দত্তনগরে। সুত্রমতে, দত্তনগরসহ কয়েকজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা অত্যন্ত জোর দিয়েই বলেছেন, বিএডিসির খামারগুলোতে আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার করে পরিকল্পিতভাবে বীজ উৎপাদন করা হলে প্রতিবছর বীজের মোট চাহিদার সিংহভাগই পুরণ করা সম্ভব। সুত্রমতে, এসব ব্যাপারে পদক্ষেপ নেয়া হলে আবাদ মৌসুমে বীজ সংকট দেখা দেবে না। বিভিন্ন বীজ আমদানীর জন্য বৈদেশিক মুদ্রাও ব্যয় হবে না।
কৃষি স¤প্রসারণ অধিদপ্তর ও বিএডিসিসহ সংশ্লিষ্ট বিভাগ সুত্রে জানা গেছে, ঝিনাইদহ সীমান্তের দত্তনগর, মেহেরপুরের বারাদী, ঝিনাইদহের সাধুহাটি, ফরিদপুর, টাঙ্গাইল, বরিশাল, পাবনা ও খুলনাসহ সারাদেশে মোট ২৩টি বড় বীজ উৎপাদন খামার আছে। এছাড়া পৃথকভাবে ডোমারে আলু বীজ, মেহেরপুরের চিতলা ও দিনাজপুরের নরসিপুরে পাটবীজ ও মেহেরপুর ও রংপুরে সবজি বীজ খামার রয়েছে। বিএডিসি (বীজ) ব্যবস্থাপকের দপ্তর সুত্রে জানা গেছে, প্রতিটি আবাদ মৌসুমে কৃষিজাত পণ্যের সব ধরণের বীজ সরবরাহ করা হয়ে থাকে কমবেশী। যা খুবই উন্নতমানের। কিন্তু  বীজের পরিমাণ বৃদ্ধির পদক্ষেপ নেয়ার বিষয়টি বরাবরই অনুপস্থিত রয়েছে। বিদেশী জাতের চেয়ে দেশীয় বীজ মাটি ও আবহাওয়া উপযোগী হওয়ায় ফসলের ফলন আরো ভালো হবে। তাই সর্বাগ্রে কৃষকদের বীজ চাহিদা নিখুঁতভাবে নিরুপণ করে বীজ উৎপাদনের দিকে জোর দিতে হবে। কয়েকজন আদর্শ কৃষক জানিয়েছেন, আমদানীকৃত হাইব্রিড জাতের বীজে মাঝে মধ্যেই ফলন মার খাচ্ছে কৃষক।
বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইন্সটিটিউটের একটি সুত্র জানায়, একসময় বাংলাদেশের বিভিন্ন এলাকায়  কালোজিরা, বাদশাভোগ, লতিশাইল, ঝিঙেশাইল, শিয়াললেজী, মোহনভোগ, লালবিন্নি ও পঙ্গীরাজসহ শতাধিক জাতের ধান আবাদ ও উৎপাদন হতো। যার স্বাদ ও গন্ধই ছিল আলাদা। আগের সব জাতই প্রায় হারিয়ে যাচ্ছে। কৃষি বিশেষজ্ঞগণ বলেছেন, বীজ নিয়ে হেলাফেলার কোন সুযোগ নেই। ভালো ফলনের জন্য উন্নতমানের বীজ অত্যাবশ্যক। তাছাড়া দেশের মধ্যেই একেক এলাকায় এক এক ধরণের বীজের প্রয়োজন হয়। যেমন উপকুলীয় অঞ্চলে লবন সহিঞ্চু ধানসহ খাদ্রশস্যের বীজ না হলে ফলন আশানুরূপ হয় না। এক্ষেত্রে বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইন্সটিটিউটের জেনেটিক রিসোর্স বিভাগ পেট্রা প্রকল্পের মাধ্যমে লবন সহিঞ্চু ধানের জাত সংগ্রহ ও সংরক্ষণ এবং উদ্ভাবনের গবেষণা করে সফল হয়েছে। সুত্রমতে, গবেষণা ও সংরক্ষণের অভাবে অনেক জাত হারিয়ে গেছে। যা পুনরুদ্ধারে একটি প্রকল্প গ্রহণ করা যেতে পারে বলে কৃষি বিশেষজ্ঞগণ অভিমত ব্যক্ত করেছেন।
বিএডিসি’র একাধিক সুত্রে জানা গেছে, নতুন করে বীজ নীতিমালা করে রিসার্চ ইন্সটিটিউটের পাশাপাশি বিএডিসি’র খামারগুলোতে রিসার্চ সেল খুলে দরকার নতুন নতুন জাত উদ্ভাবনের সুযোগ সৃষ্টি করা। তাছাড়া বিএডিসি’র খামারগুলোতে আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার ও উন্নতমানের কৃষি যন্ত্রপাতি দেয়া ছাড়াও অবহেলিত খামারগুলোর রাস্তাঘাট মেরামত ও সংস্কার, ড্রেনেজ ব্যবস্থার উন্নয়ন ও সমস্যাদির সমাধানের ব্যবস্থা নেয়া হলে বীজ উৎপাদনে বিরাট সাফল্য অর্জন করতে সক্ষম হবে বিএডিসি’র খামারগুলো। সেইসাথে দরকার জেলায় জেলায় ফার্মার্স সীড সেন্টার গড়ে তোলা।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: বীজাগার
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ