Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

চায়ের বাজার চাঙ্গা উৎপাদন মন্দা

| প্রকাশের সময় : ১৪ মে, ২০১৭, ১২:০০ এএম


‘রঙ ঘ্রাণ স্বাদে’ উৎকর্ষতার তাগিদ : উত্তরাঞ্চল ও পার্বত্য চট্টগ্রামে বাড়ছে আবাদ : নিম্নমানের চা আমদানি ও চোরাচালানে বিরূপ প্রভাব    

শফিউল আলম : চায়ের বাজার চাঙ্গা রয়েছে। তবে বছরের গোড়াতে উৎপাদনে বিরাজ করছে মন্দাদশা। দেশের ঐতিহ্যবাহী ও অর্থকরী চা শিল্পখাত ঘুরে দাঁড়ানোর সুযোগ অনেক। এতে কর্মসংস্থানের পরিধিও আরো বাড়তে পারে। এরজন্য চা-প্রধান দেশসমূহের অনুসরণে উন্নততর জাতের চা আবাদ অর্থাৎ ‘রঙ, ঘ্রাণ ও স্বাদ’ এই তিনটি ক্ষেত্রে উৎকর্ষতা নিশ্চিত করার তাগিদ দিয়েছেন এ শিল্পখাতের অভিজ্ঞজনেরা। কেননা আন্তর্জাতিক চা বাজারে এই তিনটি বৈশিষ্ট্যকেই সর্বাধিক গুরুত্ব দেয়া হয়ে থাকে। সেই সাথে ভারত থেকে প্রতিনিয়ত নিম্নমানের চা আমদানি ও চোরাচালানের কারণে এ শিল্পে পড়ছে বিরূপ প্রভাব। অবশ্য দেশের উত্তরাঞ্চল ও পার্বত্য চট্টগ্রামে চায়ের আবাদ বৃদ্ধি পাচ্ছে। এরফলে চা শিল্প অতীত গৌরবে ফিরে যেতে পারে। আবাদ আরো প্রসারিত হলে বাংলাদেশের হাতছাড়া হয়ে যাওয়া রফতানি বাজার আবারও ফিরে পাওয়া সম্ভব।  
এদিকে বন্দরনগরী চট্টগ্রামের আগ্রাবাদ বাণিজ্যিক এলাকায় অবস্থিত অর্ধশতাধিক বছরের ঐতিহ্যের ধারক দেশের একমাত্র আন্তর্জাতিক চা নিলাম বাজারে সর্বশেষ গত ৯ মে পর্যন্ত চা বিকিকিনির হিসাব অনুযায়ী, চায়ের বাজার তেজী। তবে উৎপাদনে এখন মন্দা। চলতি চা বিপণন মওসুমের এ যাবত তিনটি নিলামে বিপণনের চায়ের গড় মূল্য কেজিপ্রতি ৭.০৮ টাকা বৃদ্ধি পেয়েছে। এ বছর চায়ের গড় মূল্য ১৯৮.২০ টাকা। এ যাবত বিক্রি হয়েছে ১৬ লাখ ১৭ হাজার ৩২২ কেজি পাতা ও গুঁড়ো চা। তবে গতবছর এ সময়ে বিক্রির পরিমাণ ছিল ২৪ লাখ ৬৩ হাজার ৬৫৫ কেজি চা। চলতি বছরের প্রথম তিন মাসে (জানুয়ারি-মার্চ) চা উৎপাদিত হয়েছে ২৮ লাখ কেজি। অথচ গতবছর এ সময়ে উৎপাদনের পরিমাণ ৩৮ লাখ কেজি।
তবে চট্টগ্রাম চা নিলাম বাজারে ২০১৬-১৭ সালের বিপণন মওসুমের গত ৪৬টি নিলামে মোট চা বিক্রি হয় ৭ কোটি ৬৯ লাখ ৯২ হাজার ৭৫৪ কেজি। গতবছর (২০১৫-১৬ সালে) এ সময়ে চা বিক্রির পরিমাণ ৬ কোটি ২৩ লাখ ৭৪ হাজার ২৫০ কেজি। অর্থাৎ এবার বাড়তি চা উৎপাদিত হয়েছে এক কোটি ৪৬ লাখ ১৮ হাজার ৫০৪ কেজি। এ বছর চায়ের গড় মূল্যও বেড়ে গেছে। গতবছর বিক্রি হয় গড়ে কেজি ১৮৭.২৩ টাকা দরে। এবার তা ১৯১.০৫ টাকা। গড় মূল্য বৃদ্ধি পেয়েছে কেজিপ্রতি ৩.৮২ টাকা।        
সর্বশেষ গত ৯ মে’র নিলাম বাজারে বেশক’টি শীর্ষ দরের চা বিকিকনি হয়। এরমধ্যে প্রতিকেজি হিসাবে ক্লিবডন ওয়েব ২৫৮ টাকা, মধুপুর জিবিওপি ২৭২ টাকা, বিএনপিএফ-চানবাগ ১৯৫ টাকা, ডিএমক্লোন-রাঙাপানি ১৯৭ টাকা, মধুপুর-আরডি ক্লোন ২৩৯ টাকা, মধুপুর-ডাস্ট ২৫৮ টাকা, মধুপুর-সিডি ২৮৬ টাকা, ফুলবাড়ি ২০৩ টাকা দরে বিক্রি হয়।
চা শিল্পে অনেক সম্ভাবনা          
সুদূর অতীতে এদেশের মসলিন বস্ত্র কিংবা নিকট অতীতে পাট, চামড়া শিল্পের মতোই সুপ্রাচীন শিল্প ও বাণিজ্য খাত চা। এগিয়ে চলেছে সম্ভাবনার হাতছানি দিয়ে। চা শিল্প এখন আর অবহেলিত নয়। প্রচলিত এই রফতানি পণ্যটি তার সুবিশাল বাজার সহসাই ফিরে পেতে পারে। কিন্তু তা এখনও অধরা রয়ে গেছে। তবে চায়ের উন্নয়ন ও আধুনিকায়নে সময়োপযোগী উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে। যাতে বনেদী চা শিল্প অচিরেই ঘুরে দাঁড়াতে পারবে এবং জাতীয় অর্থনীতিতে শ্রমনিবিড় চা খাত রাখবে আরও ব্যাপক অবদান এমনটি প্রত্যাশা শিল্পোদ্যোক্তাদের। কেননা অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক বাজারে চায়ের চাহিদা বেড়েই চলেছে।       
এ মুহূর্তে চা খাতের রয়েছে প্রায় সোয়া ২ হাজার কোটি টাকার জমজমাট বাজার। সেই সঙ্গে দেশের উত্তরাঞ্চল ও পার্বত্য চট্টগ্রামে বিস্তৃত হচ্ছে চায়ের আবাদ। চট্টগ্রামের সেকেলে বাগানগুলো সতেজ করা হচ্ছে। চট্টগ্রামের মিরসাইয়ের পাহাড়-টিলাভূমিতেও চা চাষের সম্ভাবনা ফুটে উঠেছে। এর মাঝে রয়েছে আরও ব্যাপকভিত্তিক কর্মসংস্থানের সুযোগ। কিছুটা হলেও আধুনিকতার ছোঁয়া লেগেছে চা আবাদ ও উৎপাদন প্রক্রিয়ায়। শিল্পোদ্যোক্তারা জানান, পরিমিত হারে বৃষ্টিপাত চায়ের আবাদ ও উৎপাদনের জন্য অপরিহার্য। সেই সাথে নতুন নতুন চা আবাদের এলাকা প্রসার, উন্নত জাতের ক্লোন চায়ের চারা লাগানোর হার বৃদ্ধি, সীমিত আকারে হলেও শ্রমিকদের প্রণোদনা প্রদানের ধারা বজায় থাকলে চা শিল্পে আসবে গতি। বিগত ১০ বছরে দেশের উত্তরাঞ্চল ও পার্বত্য এলাকায় ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র পরিসরে প্রায় ১৫ হাজার হেক্টর জমিতে চায়ের বাড়তি আবাদ করা হয়েছে। সেখানে উন্নততর ক্লোন জাতের চায়ের চারাগাছ লাগানো হয়েছে। ফলনও ভাল হচ্ছে।  
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, দেশে ও বিদেশে চা পানের চাহিদা ক্রমাগত বাড়লেও সেই সমানুপাতে বাংলাদেশে বাড়ছে না চা উৎপাদন। দেশে চা পানের চাহিদা বার্ষিক ৫-৭ শতাংশ হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে। উৎপাদন খরচ ও চাহিদা বৃদ্ধির সমানুপাতে অভ্যন্তরীণ বাজারদর সারাবছরই থাকে চাঙ্গা। কিন্তু চা আবাদ ও উৎপাদনে এক ধরনের স্থবিরতা কাটেনি। পণ্যটির রফতানি হ্রাস পেতে পেতে এখন মাত্র ১.৪৫ ভাগে নেমেছে। তাও আবার রফতানিকারক অথবা তাদের কোটা ব্যবহার করে স্থানীয় প্যাকেটিয়াররা চা কিনে নিয়ে থাকে। রফতানি সংকুচিত হতে হতে এখন প্রায় শূণ্যের কোটায়। এ সুযোগে বাংলাদেশের চায়ের বাজার আয়ত্ত করে নিয়েছে অন্যসব দেশ। বরং দেশে সীমিত পরিসরে চা এখন আমদানি করা হচ্ছে। যা বেশিরভাগই নিম্নমানের। দেদারসে ভারতীয় চা চোরাচালানে আসছে।   
বন্দরনগরী চট্টগ্রামে ৬৮ বছরের সুপ্রাচীন আন্তর্জাতিক চা নিলাম বাজারে বিদেশি আমদানিকারক কিংবা তাদের প্রতিনিধিরা তেমন কেউ এখন আর অংশ নেয় না। আফগানিস্তান, পাকিস্তান, ইরান, রাশিয়ার মতো বাংলাদেশে উৎপাদিত চায়ের প্রধান সবক’টি ক্রেতাদেশ দীর্ঘদিন বাজার থেকে উধাও। এর পেছনে রয়েছে প্রধানত চারটি কারণ। সেগুলো হচ্ছে- চায়ের স্থানীয় বাজার দর চড়া থাকা, উন্নত জাতের চায়ের আবাদ প্রসারে এখনও অনগ্রসরতা, আধুনিক যুগোপযোগী প্রযুক্তি ও গুণগত মানের উৎকর্ষতা (রঙ, ঘ্রাণ ও স্বাদ) বৃদ্ধির জন্য ব্যাপক উদ্যোগের অভাব, উৎপাদনে স্থবিরতা।
বাংলাদেশে উৎপাদিত চা দু’দশক আগেও ২০-২২টি দেশে রফতানি করা হতো নিয়মিতভাবে। অন্যতম প্রধান ক্রেতাদেশ পাকিস্তান, আফগানিস্তানন, যুক্তরাজ্য, সোভিয়েত ইউনিয়ন বা সিআইএসভূক্ত দেশগুলো, সমগ্র মধ্যপ্রাচ্য, পূর্ব ইউরোপের দেশসমূহ, মিসর, পোল্যান্ড, নেদারল্যান্ড দীর্ঘদিন মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। তারা ভারতসহ বিকল্প চা উৎপাদক দেশগুলোর দিকেই ঝুঁকেছে। বাংলাদেশ থেকে চা কেনার জন্য পুরনো ক্রেতা বিভিন্ন দেশ শুল্কমুক্ত রফতানি, অগ্রিম পেমেন্টসহ সুযোগ-সুবিধা ঘোষনা করলেও তা কাজে আসেনি।
দেশে সচল ১৫৮টি চা বাগানের জমি রয়েছে ২ লাখ ৮০ হাজার ১শ’ ৭০ একর। এর অধিকাংশই বৃহত্তর সিলেটে অবস্থিত। এরপর রয়েছে চট্টগ্রাম, পার্বত্য চট্টগ্রাম ও উত্তরাঞ্চল। অনেক বাগানের বিরাট অংশই চা চাষের আওতায় নেই। আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে ভারত, মালয়েশিয়া, কেনিয়া, শ্রীলংকার মতো বিভিন্ন চা উৎপাদনকারী দেশে চা শিল্প অনেকদূর এগিয়ে গেছে। বাংলাদেশ এখনও পিছিয়ে। এসব কারণে বার্ষিক উৎপাদন ৬ কোটি কিংবা সাড়ে ৬ কোটি কেজিতেই ওঠানামা করছে।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: চা


আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ