Inqilab Logo

রোববার, ২৮ এপ্রিল ২০২৪, ১৫ বৈশাখ ১৪৩১, ১৮ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

তৃতীয় বাণিজ্য নগরীর হাতছানি

| প্রকাশের সময় : ১৪ মে, ২০১৭, ১২:০০ এএম

মিজানুর রহমান তোতা : রাজধানী ঢাকা ও বণিজ্যিক রাজধানী চট্টগ্রামের পর দেশের তৃতীয় গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্য নগরী গড়ে তোলার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। শুধু সম্ভাবনা নয়, উজ্জ্বল সম্ভাবনা। এখন শুধু ঘোষণার অপেক্ষা। হাতছানি দেওয়ার এলাকাটি হলো অবিভক্ত বাংলার প্রথম জেলা, স্বাধীনতার প্রবেশদ্বার কৃষি, শিল্প, ব্যবসা-বাণিজ্যে সমৃদ্ধ যশোরে। যশোরকে তৃতীয় বাণিজ্যিক নগরী হিসেবেও গড়ে তোলার যাবতীয় সুযোগ-সুবিধা রয়েছে। কিন্তু ঘোষণার অভাবে পিছিয়ে পড়ছে। ইতোমধ্যে এখানে সৃষ্টি হয়েছে কৃষি ও শিল্পপণ্য উৎপাদনে রেকর্ড। অনেক পণ্য অভ্যন্তরীণ রফতানীতে বিরাট সাফল্য আসলেও বিদেশের বাজারে প্রবেশের সুযোগকে কাজে লাগানো যাচ্ছে না। কৃষিশিল্পসহ বাণিজ্যিক নগরী গড়ে তোলার প্রস্তাবনা ছিল বেশ আগে।  কিন্তু হয় হয় করে আর হয়নি। বর্তমান সময়ে সম্ভাবনা আরো উজ্জ্বল হয়েছে। যশোরের জনপ্রতিনিধি, চেম্বার অব কমার্সসহ বিভিন্ন সেক্টর থেকে জোরালো দাবি জানিয়ে আসছে সরকারের কাছে। সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় থেকে একাধিকবার সম্ভাবনার বিষয়ে খোঁজ খবরও নেওয়া হয়েছে। সংশ্লিষ্ট বিভাগের দায়িত্বশীল কর্মকর্তারাও একবাক্যে স্বীকার করেছেন যে, তৃতীয় বাণিজ্য নগরী করার উপযুক্ত পরিবেশ বিদ্যমান। এখন শুধু ঘোষণার অপেক্ষা।
কৃষি বিশেষজ্ঞ ও অর্থনীতিবিদসহ সংশ্লিষ্ট পন্ডিতদের বক্তব্য আন্তর্জাতিক চাহিদার সাথে সামঞ্জস্য রেখে কৃষি ও শিল্পপণ্য সরবরাহ প্রক্রিয়া জোরদার করতে হবে সরকারকে। বৈদেশিক বাজারে কৃষি ও শিল্পপণ্য ঢোকানো কিংবা রফতানী বাজার খুঁজে বের করার বিষয়টি একেবারেই ঢিলেঢালা। দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের মধ্যবর্তী স্থান যশোরকে বাণিজ্যিক নগরী গড়ে তুললে আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন ঘটবে বলে সংশ্লিষ্টদের অভিমত। এক্ষেত্রে যুক্তি হচ্ছে দেশের মোট চাহিদার সিংহভাগ সবজি, রজনীগন্ধা, মাছের রেণু পোনা, সাদা সোনা চিংড়ি, খেজুরের গুড় ও পাটালি, পাটজাত ও হস্তশিল্পপণ্য এবং নারকেলের ছোবড়া থেকে সাদা আঁশ তৈরী হয় এ অঞ্চলে। এছাড়া বাউ কুল, কলা, পান, সুপারী, নারকেল, কাঁচা তুলা ও ছবেদাসহ অনেক কৃষি পন্য উৎপাদনেও এসেছে অনেক সাফল্য। অযতœ ও অবহেলায় উৎপাদন হয় প্রচুর পরিমাণে ‘লোকাট’ বা আঁশ ফল। এসব পণ্যের ব্যাপক চাহিদা রয়েছে পার্শ্ববর্তী ভারতসহ বিভিন্ন দেশে। দেশের বৃহত্তম স্থলবন্দর রয়েছে যশোরের বেনাপোলে। শুধু বেনাপোল নয়, এ অঞ্চলে নৌ-বন্দর মংলা, দর্শনা ও ভোমরা স্থলবন্দর রয়েছে। রয়েছে নদীপথে দেশী ও বিদেশী পণ্যের আভ্যন্তরীণ রফতানীতে যশোরের নওয়াপড়ায় অন্যতম বৃহত্তম নদীবন্দর। যশোরে রয়েছে বিশাল এয়ারপোর্ট। কক্সবাজার থেকে যশোর, খুলনা, সাতক্ষীরা ও বাগেরহাটের জন্য চিংড়ি পোনা কার্গো বিমানে যশোর আসে। বিদেশের সাথে যশোর এয়ারপোর্টের কার্গো বিমান লিংক করে দিলে খুব সহজেই যশোরসহ দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের কৃষি ও শিল্পপণ্য বিদেশে রফতানী হবে। সরকার এ ব্যাপারে পদক্ষেপ নিলে সেটি হবে যুগান্তকারী ও প্রশংসনীয়। পাশাপাশি সমৃদ্ধ হবে বৈদেশিক মুদ্রা ভান্ডার।
সরেজমিনে মাঠে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, যশোরে সারাদেশের মোট চাহিদার ৬৫ ভাগেরও বেশী সবজি উৎপাদন হয়। বছরের পর বছর চাষীরা মাথার ঘাম পায়ে ফেলে শুধু সবজিই উৎপাদন করে থাকে। কিন্তু তাদের ভাগ্যের খুব একটা পরিবর্তন ঘটছে না। যশোরের সবজি বিদেশে রফতানী হয় নামকাওয়াস্তে। যশোরের সবজি যশোর থেকেই বিদেশে রফতানীর সুযোগ রয়েছে। এমন উদ্যোগ ইতিপূর্বে নেয়া হলেও বাস্তবে তা কার্যকর হয়নি। কৃষি শিল্পনগরী গড়ে তোলার প্রস্তাবনাটিও ঝুলে আছে। যশোর অঞ্চলে টমেটোর জুস ও অন্যান্য বারোমাসি ভেজিটেবল দিয়ে অত্যন্ত সস্তায় ফুড প্রোডাক্টস ইন্ডাস্ট্রি গড়ে তোলার যথেষ্ট সুযোগ রয়েছে। কিন্তু কাজে লাগানো হচ্ছে না। যশোরে রয়েছে রজনীগন্ধা, গøাডিওলাস, জার্বেরা, লাল গোলাপ, সাদা গোলাপ, হলুদ গোলাপ, গাঁদা, জবা, ঝাউ কলম, জুই ও লিলিয়ামসহ বিভিন্ন ফুল উৎপাদনের রেকর্ড। যশোরের ফুলের ব্যাপক চাহিদা রয়েছে বিদেশের বাজারে। সউদী আরব, দুবাই ও জর্ডানসহ কয়েকটি দেশে যশোরের ফুল রফতানী হয় ঠিকই কিন্তু তা ফুল হিসেবে নয়, সবজি হিসেবে। যশোরের গদখালী ফুলচাষী কল্যাণ সমিতির সভাপতি আব্দুর রহিম জানান, মানসম্পন্ন বীজ, চারা ও কলম ফুল চাষীদের মাঝে সরবরাহ এবং উৎপাদিত ফুল বিদেশে রফতানীর প্রতিবন্ধকতা দূর করার সরকারী উদ্যোগ নেই। যার কারণে বিরাট সম্ভাবনাকে বাস্তবে কাজে লাগানো যাচ্ছে না। এছাড়া যশোরের খেজুরের গুড়, মাছের রেণু পোনাসহ সকল কৃষি শিল্প পণ্য উৎপাদনের কেন্দ্রবিন্দু হচ্ছে যশোর। এখন শুধু দৃষ্টি দেওয়ার দরকার।
সুত্রমতে, যশোরকে বাণিজ্যিক নগরী ঘোষণা দিয়ে বেনাপোলসহ দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের নৌ ও স্থলবন্দর গুলোতে প্রয়োজনীয় অবকাঠামো গড়ে তুলে আমদানী ও রফতানীতে গতি সৃষ্টি করা খুবই জরুরি। দরকার এ অঞ্চলের কোন কোন পণ্য রফতানী করা যায় তা চিহ্নিত করা। এ অঞ্চলের অনেক পণ্য রয়েছে যা বিদেশের বাজারে ঢোকানো সম্ভব। কারণ অনেক কৃষি ও শিল্পপণ্যের ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। বেনাপোল দেশের বৃহত্তম স্থলবন্দর হওয়ায় গোটা দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে ব্যবসা-বাণিজ্য বেনাপোলকেন্দ্রিক হয়ে পড়েছে। সেখান থেকে সরকার প্রতিবছর হাজার হাজার কোটি টাকার রাজস্ব আয় করে থাকে। কিন্তু বেনাপোল ও যশোরের উন্নয়নে ওই টাকা কখনো ব্যয় হয় না। বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে আমদানী ও রফতানী বাণিজ্যে সমতা আনারও জোরদার উদ্যোগ অনুপস্থিত থাকছে। বাণিজ্যে নেই কোন প্রতিযোগিতা। ওপারের সুত্র জানায়, আগের চেয়ে অনেক নতুন পণ্য ভারতের বাজারে ঢুকছে। কিন্তু ভারতের বাজারে বাংলাদেশের কৃষি ও শিল্পপণ্য রফতানীর প্রাধান্য সৃষ্টির ক্ষেত্রেও বাস্তবভিত্তিক পদক্ষেপ নেই। রফতানীর সাথে জড়িত একাধিক সুত্র জানায়, যশোর অঞ্চলের রজনীগন্ধাসহ উন্নতমানের ফুল, মাছের রেণু পোনা, খেজুরের গুড় ও পাটালি, হস্তশিল্পপণ্য ও সবজিসহ কৃষি পণ্য ব্যাপক চাহিদা রয়েছে পশ্চিমবঙ্গে। কৃষি ও শিল্পপণ্য রফতানীর দিকে জোর দিলে শিল্প কলকারখানা, কৃষি ও কৃষকের অবাবিত উন্নয়ন ঘটতো। বেনাপোল, দর্শনা, নওয়াপাড়া ও ভোমরাকে ঘিরে ঢাকা ও চট্রগ্রামের পর খুব সহজেই দেশের তৃতীয় গুরুত্বপুর্ণ বাণিজ্য কেন্দ্র গড়ে তোলা সম্ভব।
ভৌগলিক দিক দিয়ে যশোর এ অঞ্চলের মধ্যস্থল হওয়ায় এই সম্ভাবনাটি দেখা দিয়েছে। বর্তমানে ব্যবসা-বাণিজ্যের সার্বিক পরিবেশ খুবই ভালো। দরকার শুধু সম্ভাবনাকে কাজে লাগিয়ে একটু এগিয়ে নেয়া। অথচ এ ব্যাপারে কোন পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে কিংবা নেয়া হবে এমন কোন তৎপরতা দেখা যাচ্ছে না। এদিকে, রফতানী উন্নয়ন ব্যুরোর একটি সুত্র জানায়, শুধু যশোর  অঞ্চলের নয়, আন্তর্জাতিক বাজারে কৃষি ও শিল্পপণ্য বিক্রির সুযোগকে কাজে লাগানো হলে বাড়বে বৈদেশিক মুদ্রা। বিশেষ করে যশোরের রজনীগন্ধাসহ ফুল সবজি হিসেবে নয়, ফুল হিসেবে এবং বিদেশের চাহিদানুযায়ী সবজি ও তাজা ফল রফতানী করা গেলে বৈদেশিক মুদ্রা আয়বৃদ্ধির পাশাপাশি কৃষির সম্ভাবনাময় খাতগুলো সমৃদ্ধ হতো। এলাকাটি গড়ে উঠতো নতুনভাবে, নতুন পরিচয়ে।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: বাণিজ্য নগরী
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ