Inqilab Logo

সোমবার, ২৯ এপ্রিল ২০২৪, ১৬ বৈশাখ ১৪৩১, ১৯ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

মার খাচ্ছে আবাদ ও উৎপাদন

গবেষণা প্রযুক্তি কৃষকের দোরগোড়ায় পৌঁছাচ্ছে না

| প্রকাশের সময় : ১৩ মে, ২০১৭, ১২:০০ এএম

মিজানুর রহমান তোতা : ‘সরকার তো কমবেশী আমাদের জন্য ভালো ভালো উদ্যোগ নেয়, কখন কি ফসল উৎপাদন হবে, কিভাবে হবে এসব জ্ঞান দেওয়ার জন্য কৃষি শিক্ষার ব্যবস্থা করে, কৃষি গবেষণার ফল মাঠে পৌছানোর নির্দেশ দেয়, অনেকস্থানে কৃষি তথ্যকেন্দ্রও স্থাপন করেছে, কিন্তু এর সুফল কৃষকরা সাধারণত পায় না। সরকারী কৃষি কর্মকর্তারা যথাযথ দায়িত্ব পালন করেন না। বেশীরভাগক্ষেত্রেই তারা নামকাওয়াস্তে দায়িত্ব পালন করে, যার জন্য মাঠে মার খায় কৃষক। ফসল উৎপাদন করে উপযুক্ত মূল্য ঘরে তুলতে পারে না। কথাগুলো আক্ষেপ করে বললেন, যশোরের শার্শা উপজেলার ডিহি ইউনিয়নের শালকোনা গ্রামের কৃষক বাবুল আকতার ও হাবিবুর রহমান ডাবলু।
শুধু ওই কৃষকের অভিযোগ নয়, যশোর, খুলনা, ঝিনাইদহ, মাগুরা, চুয়াডাঙ্গা, কুস্টিয়া ও নড়াইলসহ দেশের বিভিন্ন এলাকার সাধারণ কৃষকের একই ধরণের অভিযোগ। তাদের কথা, সরকার কৃষির উন্নয়নে ও কৃষকের স্বার্থে যেসব কর্মসূচী নিয়ে থাকে তার যথাযথ কৃষকের দোরগোড়ায় পৌছানোর বিষয়টি অনুপস্থিত থাকছে। কৃষকের নিজস্ব অভিজ্ঞতা থেকে গতানুগতিক ধারায় বেশীরভাগ কৃষি আবাদ ও উৎপাদন হচ্ছে। কোথাও কোথাও কর্মনূচী একটু আধটু পালন করে ঢালাও প্রচার চালিয়ে তা সকল কৃষকের কাছে পৌছেছে এমন দাবি করা হয়। কৃষকের ঘরে ঘরে সার, প্রযুক্তি নিয়মানুযায়ী পৌছাচ্ছে কিনা তা দেখার কেউ নেই। উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তাদের হাত পা বাধা তারা কর্মকর্তাদের অব্যবস্থা অনিয়ম দুর্নীতি দেখেও কোন প্রতিবাদ করতে পারে না। বহু ডিলার কৃষকের হাতে পৌঁছে দেওয়ার প্রতিশ্রæতিতে মাসে মাসে সার তোলেন। তারা বাফার স্টকের গেটেই কালোবাজারে বিক্রি করে নিজের পকেট ভারী করে। ইউনিয়নে ইউনিয়নে সার তুলে কৃষকের কাছে দিচ্ছে কিনা তা না জেনেই প্রত্যায়ন দিচ্ছেন কৃষি কর্মকর্তারা। এতে সাধারণ কৃষক বেশী মূল্যে বাজার থেকে ক্রয় করে বাড়তি বোঝা টানছেন। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, যশোর সদর উপজেলায় সার ডিলারদের দুর্নীতির অভিযোগ ওপেনসিক্রেট। পৌরসভা ও উপশহরে আবাদ হয় না বললেই চলে সেখানেও ইউনিয়নভিত্তিক বরাদ্দকৃত সার উত্তোলন দেখানো হয় মাসে মাসে। তদন্ত করলে সব জেলা ও উপজেলাতেই এমন অসংখ্য প্রমাণ মিলবে। এসব ঘটনায় কৃষক বড়ই হতাশ। সবচেয়ে গাফিলতি রয়েছে কৃষি গবেষণার। নিত্যনতুন পদ্ধতি ও কৃষি বিজ্ঞানীদের গবেষণার আধুনিক প্রযুক্তি মাঠে পৌছাচ্ছে না বলে বিস্তর অভিযোগ রয়েছে। কৃষি বিশেষজ্ঞ ও বিজ্ঞানীদের কথা, কৃষি বিপ্লব ঘটানোর সরকারী পদক্ষেপ বাস্তবায়ন হলে কৃষি ও কৃষকের চেহারা আরো পাল্টে যেত।
কখন কি ফসল কোন জমিতে কিভাবে আবাদ করতে হবে, কোনটা লাভজনক, সারের মাত্রা কি হবে, পোকা-মাকড়ের আক্রমণ ঠেকাতেই বা কি ব্যবস্থা, মাঠের দাম আর বাজার দাম কি, কোন সময়ে ফসল বিক্রি করলে কৃষকরা লাভবান হবে-এসব তথ্যাদি জানার অভাবে কৃষক ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন পদে পদে। কৃষি মন্ত্রণালয়ের কৃষি তথ্য সার্ভিস সুত্র জানায়, যশোরসহ সারাদেশে ১০টি কৃষি অঞ্চলে কৃষি তথ্য ও যোগাযোগ কেন্দ্র স্থাপিত হয়েছে বেশ আগে। দাবি করা হয় ওই কেন্দ্রের আওতায় গড়ে উঠেছে এলাকাভিত্তিক সহস্রাধিক কৃষি ক্লাব। অজস্র কৃষক এর সুবিধা পাচ্ছেন। ক্লাবগুলোও সরকারের দেয়া কৃষি তথ্য ও যোগাযোগ কেন্দ্রের যাবতীয় সুযোগ পাচ্ছেন। কিন্তু বাস্তবে কৃষক ন্যুনতম সুবিধা পাচ্ছেন না। এর একটা বড়প্রমাণ গেল মৌসুমে বোরো আবাদ চরমভাবে মার খেয়েছে। কৃষি তথ্য যথাসময়ে না পৌছায় কৃষকরা  ধানে বøাস্ট রোগে আক্রমণের ব্যাপারে সতর্ক হতে পারেননি। রক্ষা করতে পারেননি ধান। যার কারণে  এবার বোরো উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা পুরণ হয়নি। পাহাড়ি ঢল ও বøাস্ট রোগে এবং প্রাকৃতিক দুর্যোগে  বিরাট ক্ষতি হয়েছে সারাদেশের কৃষকের। সারাদেশে প্রায় ৪ লাখ হেক্টর জমির ধান পানিতে তলিয়ে নষ্ট হয়েছে। হাজার হাজার হেক্টর জমির থোড়মুখী ধান বœাস্টে আক্রান্ড হয় মাঠপর্যায়ের কৃষি কর্মকর্তাদের চোখের সামনেই। অথচ কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর এটি স্বীকার করতে চায় না। সংশ্লিষ্ট সুত্র জানায়, সারাদেশে বোরো আবাদের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয় ৪৮ লাখ হেক্টর জমি। আবাদ হয় ৪৭লাখ ৯৬হাজার হেক্টর জমি। উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয় ১ কোটি ৯০লাখ মেট্রিক টন চাল। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের একজন দায়িত্বল কর্মকর্তা নামপ্রকাশ করতে নিষেধ করে বলেন, কোনভাবেই লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হবে না এবার। সুত্রমতে, সময়মতো রোগবালাই প্রতিরোধে ব্যবস্থা না নেয়া, মাঠ কর্মকর্তারা মাঠে নেমে পরামর্শ না দেয়া, প্রাকৃতিক বিপর্যয় এবং উপযুক্ত মূল্য না পাওয়ায় মার খেতে খেতে কৃষকের দেয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়ায় আগ্রহ হারাচ্ছে ধান উৎপাদনে।
একসময় কোন প্রযুক্তিই সাধারণত মাঠে যেত না। আসলে আবহমানকাল থেকে কৃষকরা চাষাবাদ করত গতানুগতিক ধারায়। তাতে কৃষিতে বিরাট উন্নয়ন না হলেও ক্ষতি ও লোকসানের মাত্রা ছিল অনেকটাই কম। এখন অনেক পরিবর্তন ঘটছে। পাল্টে যাচ্ছে চাষাবাদ পদ্ধতিও। এখন কৃষি গবেষণাগার থেকে প্রযুক্তি মাঠে যাবার বিধান রয়েছে। অতিমাত্রায় ব্যবহারও হচ্ছে আধুনিক প্রযুক্তি। কিন্তু আধুনিক পদ্ধতির নিয়ম কানুন যথাযথভাবে প্রয়োগ না হওয়ায় চোখের পলকে বড় ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়ায় মাঝেমধ্যে। যা সামাল দেওয়া সম্ভব হয় না। ত্রাহি অবস্থা হয় ক্ষতি পুরণ করতে কৃষকের। সেজন্য সরকারের মাঠপর্যায়ের কমকর্তাদের দায়িত্বপালনে যতœবান হওয়ার  জরুরি নিদের্শনা দেওয়া দরকার বলে কৃষি বিশেষজ্ঞ ও বিজ্ঞানীরা অভিমত ব্যক্ত করেছেন।
কৃষি তথ্য সার্ভিস খামারবাড়ীর পরিচালকের দপ্তর সুত্রের দাবি, কৃষকদের সামগ্রিক স্বার্থ রক্ষায় দেশের কৃষি বিজ্ঞানী ও কৃষিবিদসহ আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন বিজ্ঞানীদের সমন্বয়ে মাঝেমধ্যেই দেশের এলাকার মাঠে গিয়ে প্রযুক্তি সম্পর্কে জ্ঞানদান করা হচ্ছে। কিন্তু সারাদেশে একযোগে কি এমন কর্মসচী মাঠে পৌছাচ্ছে-এই প্রশ্নের জবাব দিতে পারেনি তারা। তাছাড়া কৃষি গবেষণা ইন্সটিটিউট, কৃষি স¤প্রসারণ অধিদপ্তর ও মৃত্তিকা সম্পদ ইন্সটিটিউটসহ কৃষি মন্ত্রণালয়ের অধীনস্থ সকল বিভাগের মধ্যে সমন্বয় নেই বলে অভিযোগ। তথ্যানুসন্ধানে জানা যায়, দেশের অনান্য এলাকার মতো দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ১০ জেলার কৃষি তথ্য ও প্রযুক্তি বাস্তবায়ন কেন্দ্র স্থাপিত হয় যশোরের গ্রাম গাইদঘাটে। এলাকাটি এমনিতেই আগে থেকেই সবজিসহ বিভিন্ন ফসল উৎপাদনে রেকর্ড সৃষ্টি করে। সেখানে চালু করা হয় কীটনাশকের বদলে পোকা মারার ফাঁদ। ‘ফেরোমন ট্রাপ’ এই পদ্ধতি যশোরের আর কোথাও সম্প্রসারিত হয়নি।  গাইদঘাটেও পদ্ধতি প্রয়োগে ভাটা পড়েছে।
সুত্র জানায়, যশোরের  মতো দেশের বিভিন্নস্থানে কৃষি মন্ত্রণালয় কৃষি তথ্য সার্ভিস কেন্দ্র স্থাপন করেছে। কেন্দ্র পরিচালনার জন্য কম্পিউটার, প্রজেক্টর, ওয়েব ক্যামেরা, ইন্টারনেট, ল্যাপটপ, প্রিন্টার, আসবাবপত্র, জেনারেটর ও কৃষি তথ্য সংক্রান্ত বই সরবরাহ করা হয়। পরবর্তীতে তা কৃষকের খুব একটা কাজে আসছে না বেশীরভাগ এলাকায়। কথা ছিল, কৃষি তথ্য ও যোগাযোগ কেন্দ্র থেকে কৃষকদের জানিয়ে দেয়া হবে ফসল আবাদ পদ্ধতি, সার প্রয়োগ, পরিচর্যা, বাজার দর, কোন সময়ে কোন জমিতে কোন ফসল আবাদ হলে সুবিধা হবে, মাটির উর্বরা শক্তির রিপোর্টসহ কৃষি বিষয়ক যাবতীয় তথ্য। এতে কৃষকরা বিরাট উপকার পাবে। বাস্তবে উদ্দেশ্য যথাযথ বাস্তবায়ন হয়নি।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: উৎপাদন

২২ ডিসেম্বর, ২০২২
৬ অক্টোবর, ২০২২
৩০ জুলাই, ২০২২

আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ