ইভিএম-এ ভোট কেন?
আগামী জাতীয় নির্বাচনে ইভিএম-এ ১৫০ আসনে ভোট গ্রহণের পরিকল্পনার কথা জানিয়েছেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার। কাকতালীয় কিনা জানি না, ১৫০ সংখ্যাটা আমাদের এর আগে চিনিয়েছিলেন রকিবুল
মো. ওসমান গনি : বাংলাদেশ নদী মাতৃক দেশ। এদেশে রয়েছে অসংখ্য নদ-নদী। পদ্মা, মেঘনা, যমুনা, বুড়িগঙ্গা ও ব্রহ্মপুত্র নদী। আর নদীগুলো সঠিক রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে মরতে বসছে। আবার অনেক নদ-নদী হয়ে গেছে বিষাক্ত। নদীর বিষাক্ত পানি হয়েছে মানুষের জন্য ভয়ংকর। রাজধানী ঢাকা গড়ে উঠেছে বুড়িগঙ্গার তীরে। এক সময় বুড়িগঙ্গার অপার সৌন্দর্য মুগ্ধ করেছে সবাইকে। কিন্তু কালক্রমে ঢাকা বিস্তৃত হলেও ক্ষয় হয়েছে বুড়িগঙ্গার। নাব্য হারিয়ে কমে গেছে পানির প্রবাহ। এখন বুড়িগঙ্গা পরিণত হয়েছে দূষিত নদীতে। আর এই দূষণে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে সাধারণ মানুষ। নদীমাতৃক বাংলাদেশের নদীগুলোর প্রায় প্রতিটি মানুষের আক্রমণের শিকার। দখল, ভরাট, আবর্জনা নিক্ষেপ ইত্যাদি কারণে নদীগুলো গতি ও ছন্দ হারিয়ে ফেলেছে। এগুলো ¯্রােতহীন হয়ে আবর্জনার ভাগাড়ে রূপ নিয়েছে।
ঢাকা ঘিরে থাকা চার নদী শীতলক্ষ্যা, তুরাগ, বালু ও বুড়িগঙ্গা প্রায় একই দশায় পড়েছে। এগুলোতে পানির চেয়ে বর্জ্যই বেশি। মাত্রাতিরিক্ত দূষণে এ নদীগুলোর পানিও রং হারিয়ে ফেলেছে। বর্জ্যরে মিশ্রণে নদীগুলোর পানি কালো, নীল বা লাল হয়ে গেছে। এ চার নদীকে সরকার ‘প্রতিবেশ সঙ্কটাপন্ন’ ঘোষণা করেছে। আর বিশ্বব্যাংক বুড়িগঙ্গাকে অভিহিত করেছে ‘মরা নদী’ নামে। শিল্পের বর্জ্য বুড়িগঙ্গা নদীকে দুষিত করে চলেছে প্রতিনিয়ত। বুড়িগঙ্গাকে দূষণমুক্ত করার জন্য যত কথাই বলা হোক, শিল্প, মানব ও নৌযানের বর্জ্য পতন সম্পূর্ণভাবে বন্ধ করতে না পারলে বুড়িগঙ্গাকে দূষণমুক্ত করা অসম্ভব।
বুড়িগঙ্গা, শীতলক্ষ্যাসহ ঢাকার চারপাশের নদীগুলো এতটাই দূষিত যে, এসব নদীর পানি এখন শোধনেরও অনুপযোগী হয়ে পড়েছে। নদীগুলোতে এক সময় প্রচুর মাছ ছিল। অথচ এখন শুধু মাছ নয়, কোনো জলজ প্রাণীই টিকে থাকতে পারছে না।
বুড়িগঙ্গার দূষণে পুরান ঢাকার বাতাস হাইড্রোজেন, সালফাইড, অ্যামোনিয়া, নাইট্রোজেন যৌগের গন্ধে ভারি হয়ে থাকে সবসময়। চামড়া রং করার কাজে ব্যবহৃত রঞ্জকগুলোও মানবস্বাস্থ্যের জন্য খুবই ক্ষতিকর। সদরঘাট এবং এর আশপাশের এলাকার দুই প্রান্তে অনেক দূর পর্যন্ত এখন নদীর পানি কালো ও দুর্গন্ধযুক্ত। বাংলাদেশ-চীন মৈত্রী সেতু (বাবুবাজার) এলাকায় নদী দূষণের ভয়াবহ দৃশ্য দেখা যায়। সেখানে নর্দমা হয়ে নদীতে যাচ্ছে ঘন ও তরল বর্জ্য। নৌযানে চলাচলের সময় বুড়িগঙ্গার পানির উৎকট গন্ধে নাকে-মুখে রুমালচাপা না দিয়ে চলার উপায় থাকছে না যাত্রীদের। সদরঘাটে বুড়িগঙ্গার পানি কুচকুচে কালো। হাজারীবাগে রক্তের মতো লাল। তুরাগের পানি কোথাও কালো, কোথাও গাঢ় নীল বর্ণ। টঙ্গীতে বালু নদের পানি ধূসর। ঐতিহ্যবাহী ঢাকা শহর হারাচ্ছে তার সৌন্দর্য এবং প্রায় সোয়াকোটি অধ্যুষিত এই শহরের মানুষ রয়েছে মারাত্মক স্বাস্থ্য হুমকির মধ্যে।
রাজধানীর ভেতরে-বাইরে দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে ১৮টি ছোট-বড় নদী। এর সবই আজ বিপন্ন। স¤প্রতি ভূমি মন্ত্রণালয়ের এক জরিপে বলা হয় ঢাকার অভ্যন্তরের ৪৩টি খালের সীমানা খাতা-কলমে থাকলেও বাস্তবে অস্তিত্ব নেই। অন্যদিকে অস্তিত্ব বাঁচাতে লড়ছে বুড়িগঙ্গা, বালু, তুরাগ ও শীতলক্ষ্যা। একদিকে অবৈধ স্থাপনা, অন্যদিকে কলকারখানার দূষিত উপাদানও নগরবাসীর বর্জ্য নদীর মৃত্যু ঘটাচ্ছে।
নদী দূষণ কমাতে ৬ জানুয়ারি ২০১৩ খ্রিস্টাব্দ বর্জ্যবিরোধী অভিযান শুরু করেছিল বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআইডবিøউটিএ)। ১৭ দিনের অভিযানে বুড়িগঙ্গায় সবচেয়ে দূষিত বাদামতলী থেকে কামরাঙ্গীরচর এলাকার তলদেশ এবং ওপরের অংশ থেকে ৬৫ হাজার টন বর্জ্য অপসারণ করা হয়েছিল। এরপর বেশ কয়েক বছর কেটে গেছে, আর কোনো দৃশ্যমান অভিযান নেই। বিআইডব্লিউটিএর হিসাবে, কলকারখানার বর্জ্য, পলিথিন ও মানববর্জ্য জমা হয়ে বুড়িগঙ্গার তলদেশে ১০ থেকে ১২ ফুট স্তর পড়েছে। এতে নদীর নাব্য হ্রাসের পাশাপাশি এর পানিও ব্যবহারের অনুপযোগী হয়ে পড়েছে। এ অবস্থাতেই নদীর বর্জ্য অপসারণ শুরু করা হয়েছিল। বুড়িগঙ্গা ও তুরাগের বিভিন্ন স্থানের বর্জ্য অপসারণ, সচেতনতামূলক কর্মসূচি ও যন্ত্রপাতি কেনার জন্য প্রায় সাড়ে ২১ কোটি টাকার একটি প্রকল্প নেয়া হয়েছিল। পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়ের জলবায়ু পরিবর্তন ট্রাস্ট তহবিল থেকে এ অর্থ জোগানের ব্যবস্থা হয়। এ থেকে খরচ করা হয়েছিল প্রায় সোয়া পাঁচ কোটি টাকা।
বিপুল জনসংখ্যা অধ্যুষিত ঢাকা শহরের পর্যাপ্ত স্যানিটেশন ব্যবস্থা না থাকার কারণে প্রতিদিন প্রায় ১৫ লাখ ঘনমিটারেরও বেশি পয়োঃবর্জ্যরে প্রায় সবটাই উন্মুক্ত খাল, নদী, নর্দমা বেয়ে অপরিশোধিত অবস্থায় বুড়িগঙ্গায় এসে পড়ছে। টঙ্গী, বাড্ডা প্রভৃতি অঞ্চলের বর্জ্য চলে যাচ্ছে বালু ও তুরাগে। বুড়িগঙ্গার দূষণমাত্রা এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, নদীর পাশ দিয়ে হাঁটা যায় না। মাত্রাতিরিক্ত এই দূষণের ফলে রাজধানীর (জাতিসংঘের ওয়াল্ড আরবানাইজেশন প্রসপেক্টের রিপোর্ট অনুযায়ী বর্তমানে ঢাকার জনসংখ্যা) এক কোটি ৭০ লাখ। মানুষের স্বাস্থ্য এখন হুমকির সম্মুখীন। দূষণের ফলে ভূ-উপরিভাগের পানি ব্যবহারের অনুপযোগী হওয়ায় আমাদের নির্ভর করতে হচ্ছে ভূ-গর্ভস্থ পানির উপর। বর্তমানে ঢাকা ওয়াসা যে পরিমাণ পানি সরবরাহ করছে, তার শতকরা ৮৬ ভাগই ভূ-গর্ভস্থ স্তর থেকে তোলা হচ্ছে। ফলে ভূ-গর্ভস্থ পানির স্তর প্রতিবছর দুই থেকে তিন মিটার নিচে নেমে যাচ্ছে। এভাবে চলতে থাকলে এক সময় নগরবাসীর জন্য বিশুদ্ধ পানি সরবরাহ করা অসম্ভব হয়ে পড়বে। অন্যদিকে নদীর তীর বা আশপাশের বসবাসকারি লোকজন গোসল, রান্নাবান্নাসহ বিভিন্ন কাজে নদীর পানি ব্যবহার করায় ডায়রিয়া, কলেরাসহ নানাবিধ স্বাস্থ্য সমস্যায় ভুগছে।
নদী রক্ষায় বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও দফতরের সমন্বয়ের আবশ্যকতা বোধ করছি। বলাবাহুল্য, নদী দখল ও দূষণ রোধে সরাসরি দায়িত্ব প্রায় ১৫টি মন্ত্রণালয়ের। পরিবেশ অধিদফতরের কাজের আওতায় রয়েছে নদীর পানি দূষণ রোধ করা। বিআইডবিøউটিএর দায়িত্ব তীরের অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করা। নদীর পানির কর্তৃপক্ষ পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়, তলদেশের কর্তৃপক্ষ ভূমি মন্ত্রণালয় এবং পাড়ের মালিক নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়। সেখানে যে কোনো উন্নয়ন কাজ করতে গেলেই দ্বারস্থ হতে হয় পরিকল্পনা ও অর্থ মন্ত্রণালয়ের। আর দখলমুক্ত রাখতে প্রয়োজন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সক্রিয় ভূমিকা। কিন্তু মন্ত্রণালয়গুলোর সমন্বয়ের অভাবে নদী দখল এবং দূষণ কোনোটাই রোধ করা যাচ্ছে না। নদী দূষণের পরিণতিতে জনস্বাস্থ্যের বিষয়টিও জরুরিভাবে আমলে নেয়ার দাবি রাখে। প্রতিদিন ক্রোমিয়াম, পারদ, ক্লোরিন, নানা ধরনের এসি দস্তা, নিকেল, সিসা, ফসফোজিপসাম, ক্যাডমিয়াম, লোগাম অ্যালকালি মিশ্রিত বর্জ্যরে কারণে নদীগুলো প্রায় মাছশূন্য হয়ে গেছে। লাখ লাখ মানুষ পরিবেশ দূষণের শিকার হয়ে জন্ডিস, ডায়রিয়া, উচ্চ রক্তচাপ, মূত্রনালী ও কিডনি, চর্মরোগসহ ক্যান্সারের মতো ভয়াবহ রোগে আক্রান্ত হতে শুরু করেছে। এসব নদীর পানি ব্যবহারকারী বেশিরভাগ মানুষই চর্মরোগে আক্রান্ত হচ্ছেন।
‘নদী দূষণ বন্ধে করণীয়’ শীর্ষক এক সভায় ওয়াসা দাবি করেছে, বুড়িগঙ্গায় ওয়াসার বর্জ্য যায় না। যা যায়, তা ঢাকাবাসীর অবৈধ সংযোগের কারণে। ওয়াসার ৩০ ভাগ পয়োনালার মাধ্যমে পায় ৩০ ভাগ বর্জ্য পাগলা শোধনাগারে যায়। বাকি ৭০ ভাগ এলাকার বাড়িগুলোর নিয়ম অনুযায়ী সেপটিক ট্যাঙ্ক করার কথা, এ জন্য ওয়াসা তাদের কাছ থেকে পয়োবিলও নেয় না। কিন্তু রাতের বেলায় বিভিন্ন বাড়ির শৌচাগার থেকে অবৈধ সংযোগ দেয়া হয় ওয়াসার বৃষ্টির পানি যাওয়ার ড্রেনেজ (স্টর্ম সুয়ার) লাইনের সঙ্গে। ড্রেনের লাইনের মাধ্যমে সেসব বর্জ্য বুড়িগঙ্গাকে প্রতিনিয়ত দূষিত করছে।
রাজধানী ঢাকা হতে পারত পৃথিবীর আরেক লন্ডন। যার চারিপাশে রয়েছে বুড়িগঙ্গা, শীতলক্ষ্যা, তুরাগের মতো নদী। প্রতিনিয়ত পরিচর্যায় হতে পারত পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ মনোমুগ্ধকর পরিবেশ, প্রকৃতির অপরূপ সৌন্দর্য ভরপুর এক শ্রেষ্ঠ রাজধানী। অথচ, এর অবস্থান বর্তমানে পৃথিবীর দূষিত শহরগুলোর মধ্যে দ্বিতীয়। এটা আমাদের জন্য লজ্জাজনক। এক্ষেত্রে জনস্বাস্থ্য, পরিবেশ, অর্থনীতি, সামাজিকতা সবদিক বিবেচনায় পদক্ষেপ না নিলে দুরূহ পরিণতি যে অবধারিত, তা আর ব্যাখ্যার অপেক্ষা রাখে না। ঢাকার নদী এখন অসুস্থ ও মৃতপ্রায়, এর নাব্য ফিরিয়ে আনতে পুনরায় খননের বিকল্প নেই। ঢাকার নদীকে বাঁচাতে সকলকে সচেতন হতে হবে। যেহেতু পানির আরেক নাম জীবন আর ওয়াসা বুড়িগঙ্গার পানিকে শোধন করেই রাজধানীবাসীকে সরবরাহ করছে। সেহেতু আমাদের সুস্থভাবে বেঁচে থাকতে হলে দূষণমুক্ত নদী, এমনকি রাজধানীকে বসবাসের উপযোগী করে তুলতে নদী বাঁচিয়ে কার্যকর ভূমিকা রাখা যেতে পারেব। এ বিষয়ে সরকারের কার্যকর ভূমিকা আরও গতিশীল হবে বলে দেশের বিশিষ্টজনরা মনে করেন। নদীকে দূষণমুক্ত করতে হলে সরকারের পাশাপাশি আমাদের দেশের সচেতন মহলকে এগিয়ে আসতে হবে। আইন করে দেশের কোনো সমস্যারই সমাধান করা সম্ভব না। আইনের প্রতি আমাদের সকলকে শ্রদ্ধা দেখিয়ে আগে আমাদের মনমানসিকতার পরিবর্তন করতে হবে। আমাদের কিছু সংখ্যক লোকের অবহেলার জন্য সকল মানুষ যন্ত্রণা ভোগ করুক তা হতে পারে না। নদ-নদী পরিষ্কার ও পরিছন্ন রাখা আমার, আপনার, সকলের দায়িত্ব।
লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।