বিজয় দিবসের কবিতা
তুমি বাংলা ছাড়ো আবদুল হাই শিকদাররক্তচোখের আগুন মেখে ঝলসে যাওয়া আমার বছরগুলোআজকে যখন হাতের মুঠোয়কণ্ঠনালীর খুনপিয়াসী
সায়ীদ আবুবকর
বাংলা সনের মূল নাম ছিল তারিখ-এ-এলাহী। মোগল সম্রাট আকবর ১৫৮৫ সালে তার রাজত্বকালের ২৯তম বর্ষের ১০ কিংবা ১১ মার্চ তারিখে এক ডিক্রি জারির মাধ্যমে তারিখ-এ-এলাহী প্রবর্তন করেন। সিংহাসনে আরোহণের পরপরই তিনি একটি বৈজ্ঞানিক, কর্মপোযোগী ও গ্রহণযোগ্য বর্ষপঞ্জি প্রবর্তনের প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করেন, যেখানে দিন ও মাসের হিসাবটা যথাযথ থাকবে। এ উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে তিনি তৎকালীন প্রখ্যাত বিজ্ঞানী ও জ্যোতির্বিদ আমীর ফতুল্লাহ শিরাজীকে নতুন বর্ষপঞ্জি তৈরির দায়িত্ব প্রদান করেন। বিখ্যাত পÐিত ও সম্রাট আকবরের মন্ত্রী আবুল ফজল এ সম্বন্ধে ব্যাখ্যা প্রদান করেন যে, হিজরি বর্ষপঞ্জি কৃষিকাজের জন্য মোটেই উপযোগী ছিল না কারণ চন্দ্র বছরের ৩১ বছর হয় সৌর বছরের ৩০ বছরের সমান। চন্দ্র বছরের হিসাবেই তখন কৃষকশ্রেণির কাছ থেকে রাজস্ব আদায় করা হতো অথচ চাষবাস নির্ভর করতো সৌর বছরের হিসাবের ওপর। চন্দ্র বছর হয় ৩৫৪ দিনে। সেখানে সৌর বছর হয় ৩৬৫ বা ৩৬৬ দিনে। ফলে দুটি বর্ষপঞ্জির মধ্যে ব্যবধান থেকে যায় বছরে ১১ বা ১২ দিন। বাংলা সনের জন্ম ঘটে সম্রাট আকবরের এই রাজস্ব আদায়ের আধুনিকীকরণের প্রেক্ষাপটে।
তারিখ-এ-এলাহীর বারো মাসের নাম ছিল কারবাদিন, আর্দি, বিসুয়া, কোর্দাদ, তীর, আমার্দাদ, শাহরিয়ার, আবান, আজুর, বাহাম ও ইস্কান্দার মিজ। কারো পক্ষে আসলে নিশ্চিত করে বলা সম্ভব নয় কখন এবং কীভাবে এসব নাম পরিবর্তিত হয়ে বৈশাখ, জ্যৈষ্ঠ, আষাঢ়, শ্রাবণ, ভাদ্র, আশ্বিন, কার্তিক, অগ্রহায়ণ, পৌষ, মাঘ, ফাল্গুন ও চৈত্র হয়। অনুমান করা হয়, বারোটি নক্ষত্রের নাম নিয়ে পরবর্তীকালে নামকরণ করা হয় বাংলা মাসের। বিশাখা নক্ষত্র থেকে বৈশাখ, জায়ীস্থা থেকে জ্যৈষ্ঠ, শার থেকে আষাঢ়, শ্রাবণী থেকে শ্রাবণ, ভদ্রপদ থেকে ভাদ্র, আশ্বায়িনী থেকে আশ্বিন, কার্তিকা থেকে কার্তিক, আগ্রায়হন থেকে অগ্রহায়ণ, পউস্যা থেকে পৌষ, ফাল্গুনী থেকে ফাল্গুন এবং চিত্রা নক্ষত্র থেকে চৈত্র।
পহেলা বৈশাখ বা বাংলা নতুন বছর উদযাপন প্রথাটাও কিন্তু আকবরেরই তৈরি। আকবরের সময়ে তার প্রবর্তিত ১৪টি উৎসব পালিত হতো মহা-সমারোহে। তার মধ্যে একটি ছিল নওরোজ বা নববর্ষ উৎসব। মজার ব্যাপার হলো, এই নওরোজ বা নববর্ষ উদযাপন অনুষ্ঠানেই রাজপুত্র সেলিম, পরে যিনি সম্রাট জাহাঙ্গীর নামে খ্যাত হন, মেহেরুন্নেছার প্রেমে পড়েন। এই মেহেরুন্নেছাই ইতিহাসের সেই বিখ্যাত নূরজাহাজ। এরকম আরেকটি নববর্ষের উৎসবে রাজপুত্র খুররম, পরবর্তীকালের সম্রাট শাহজাহান, খুঁজে পান তার জীবনসঙ্গিনী মমতজ মহলকে, যার জন্যে তিনি নির্মাণ করেন জগদ্বিখ্যাত তাজমহল। যদি এই নববর্ষ উৎসব না থাকতো, তাহলে আমরা হয়তো নূরজাহানকেও পেতাম না, বিশ্বের বিস্ময় তাজমহলও পেতাম না।
পহেলা বৈশাখ এখন বাঙালির প্রাণের উৎসব। বাংলার মুসলমান-হিন্দু-খ্রিস্টান-বৌদ্ধকে এক মঞ্চে আনার শাশ্বত কোনো উৎসব যদি থেকেই থাকে বাঙালির, তা এই পহেলা বৈশাখ। কালের পরিবর্তনে এ উৎসবের সঙ্গে যোগ হয়েছে নতুন নতুন উপাদান। পিঠাপুলি থেকে শুরু থেকে মাংস-পোলাও খাওয়া-খাওয়ির ব্যাপার স্যাপার তো আছেই, সেই সাথে আছে অত্যাবশ্যকীয় পান্তা-ইলিশের ঘনঘটা। এসব প্রতিযোগিতায় যেমনটি থেমে নেই শিশু-কিশোর-কিশোরীরা, তেমনই থেমে নেই তরুণ-তরুণী-বৃদ্ধ-বৃদ্ধারাও। ব্যবসায়ী-বণিকেরা যেমন নতুন হালখাতা খুলে এ দিবসকে উৎযাপন করেন নতুন আবেগে নতুন স্বপ্নে, তেমনি কবি-সাহিত্যিকদেরও জন্যে এ এক নতুন প্রেরণার উৎসব। বৈশাখকে তারা কল্পনা করেন যুগ-পরিবর্তনের প্রতীক হিসেবে। পুরাতন বছরের রোগশোক, অসুখবিসুখ, ব্যথা-ব্যর্থতা, জরাজীর্ণতাকে উড়িয়ে নিয়ে গিয়ে শুধু ভালবাসা-প্রেমে, শস্যে-সঙ্গীতে, সুখে-শান্তিতে যেন ভরে দেয় নতুন বছর তাদের জীবনের ঘরগোলা, এই থাকে তাদের একমাত্র আহŸান। এ কারণে বৈশাখ ধরা দেয় কবিদের কাছে রুদ্ররূপে। বৈশাখের রুদ্ররূপে তারা বিচলিত নন। বরং বৈশাখের কাল-বৈশাখীর জন্য তারা পথ চেয়ে থাকেন উদগ্রীব হয়ে, যাতে জীর্ণ পাতারা ঝরঝর করে ঝরে পড়ে, নতুন পল্লবে ভরে ওঠে জীবনের ডালপালা, নতুন রঙে, নতুন খুশিতে পরিপূর্ণ হয়ে যায় বাংলার জনপদ। নজরুল তাই গর্জে ওঠেন তার সন্ধ্যা কাব্যের ‘কাল-বৈশাখী’ কবিতায় তার স্বভাবসিদ্ধ অগ্নিঝরা কণ্ঠে :
বারেবারে যথা কাল-বৈশাখী ব্যর্থ হল রে পুব-হাওয়ায়
দধীচি-হাড়ের বজ্র-বহ্নি বারেবারে যথা নিভিয়া যায়,
কে পাগল সেথা যাস হাঁকিÑ
“বৈশাখী কাল-বৈশাখী!”
হেথা বৈশাখী-জ্বালা আছে শুধু, নাই বৈশাখী-ঝড় হেথায়
সে জ্বালায় শুধু নিজে পুড়ে মরি, পোড়াতে কারেও পারিনে, হায়।
কবি আক্ষেপ করেন এই বলে, বৈশাখ তার প্রকৃত রুদ্ররূপ ধরে আবির্ভূত হয়নি বলেই সারা দেশ আজও পুরাতন জং ধরা জরাজীর্ণতায় পরিপূর্ণ হয়ে আছে। তাই তার ক্ষোভ :
কাল-বৈশাখী আসেনি হেথায়, আসিলে মোদের তরু-শিরে
সিন্ধু-শকুন বসিত না আসি’ ভিড় করে আজ নদীতীরে।
জানি না কবে সে আসিবে ঝড়
ধূলায় লুটাবে শত্রæগড়,
আজিও মোদের কাটেনি ক’ শীত, আসেনি ফাগুন বন ঘিরে।
আজিও বলির কাঁসর ঘণ্টা বাজিয়া উঠেনি মন্দিরে।
জাগেনি রুদ্র, জাগিয়াছে শুধু অন্ধকারের প্রমথ-দল,
ললাট-অগ্নি নিবেছে শিবের ঝরিয়া জটার গঙ্গাজল।
জাগেনি শিবানীÑ জাগিয়াছে শিবা,
আঁধার সৃষ্টিÑ আসেনি ক’ দিবা,
এরি মাঝে হায়, কাল-বৈশাখী স্বপ্ন দেখিলে কে তোরা বল।
আসে যদি ঝড়, আসুক, কুলোর বাতাস কে দিবি অগ্রে চল।
রবীন্দ্রনাথও বৈশাখকে অবলোকন করেছেন রুদ্ররূপে। কল্পনা কাব্যের ‘বৈশাখ” কবিতায় বৈশাখকে তার সরাসরি সম্বোধন এ নামেই :
হে ভৈরব, হে রুদ্র বৈশাখ,
ধুলায় ধূসর রুক্ষ উড্ডীন পিঙ্গল জটাজাল,
তপ : ক্লিষ্ট তপ্ত তনু, মুখে তুলি বিষাণ ভয়াল
কারে দাও ডাকÑ
হে ভৈরব, হে রুদ্র বৈশাখ?
জ্বলিতেছে সম্মুখে তোমার
লোলুপ চিতাগ্নিশিখা লেহি লেহি বিরাট অম্বরÑ
নিখিলের পরিত্যক্ত মৃতস্ত‚প বিগত বৎসর
করি ভস্মসারÑ
চিতা জ্বলে সম্মুখে তোমার।
কবিতার শুরুতে কবি বৈশাখের রুক্ষ রূপ তুলে ধরেছেন। কিন্তু তিনি নজরুলের মতো বৈশাখের বজ্রকঠিন আঘাতের পক্ষপাতী নন। স্রেফ নির্বিঘœ শান্তির প্রার্থনায় তিনি মগ্ন :
হে বৈরাগী, করো শান্তিপাঠ।
উদার উদাস কণ্ঠ যাক ছুটে দক্ষিণে ও বামেÑ
যাক নদী পার হয়ে, যাক টলি গ্রাম হতে গ্রামে,
পূর্ণ করি মাঠ।
হে বৈরাগী, করো শান্তিপাঠ।
শান্ত ঋষির মতো বৈশাখের কাছে কবির আবেদন :
দুঃখ সুখ আশা ও নৈরাশ
তোমার ফুৎকারক্ষুব্ধ ধুলাসম উড়–ক গগনে,
ভরে দিক নিকুঞ্জের স্খলিত ফুলের গন্ধ-সনে
আকুল আকাশÑ
দুঃখ সুখ আশা ও নৈরাশ।
ছাড়ো ডাক, হে রুদ্র বৈশাখ!
ভাঙিয়া মধ্যহ্ণতন্দ্রা জাগি উঠি বাহিরিব দ্বারে,
চেয়ে রব প্রাণীশূন্য দগ্ধতৃণ দিগন্তের পারে
নিস্তব্ধ নির্বাকÑ
হে ভৈরব, হে রুদ্র বৈশাখ।
বৈশাখকে নিয়ে প্রচুর গান রচনা করেছেন রবীন্দ্রনাথ। বর্ষবরণের এ গানটি এখন বাঙালির প্রাণের সঙ্গীত :
এসো এসো, এসো হে বৈশাখ।
তাপসনিশ্বাসবায়ে মুমূর্ষুরে দাও উড়ায়ে,
বৎসরের আবর্জনা দূর হয়ে যাক।
যাক পুরাতন স্মৃতি, যাক ভুলে যাওয়া গীতি,
অশ্রæবাষ্প সুদূরে মিলাক।
মুছে যাক গøানি, ঘুচে যাক জরা,
অগ্নিস্নানে শুচি হোক ধরা।
রসের আবেশরাশি শুষ্ক করি দাও আসি
আনো আনো আনো তব প্রলয়ের শাঁখ।
মায়ার কুজ্ঝটিজাল যাক দূরে যাক।
রবীন্দ্র-নজরুলের পর বাংলা ভাষায় পহেলা বৈশাখকে নিয়ে যারা দীর্ঘতম কবিতা লিখে বিখ্যাত হয়েছেন, তাদের অন্যতম ফররুখ আহমদ। রবীন্দ্রনাথের সম্পূর্ণ বিপরীত মেরুতে বসে তিনি ‘বৈশাখ’ ও ‘বৈশাখের কালো ঘোড়া’ নামে যে-দুটি কবিতা রচনা করেন তা বৈশাখের কবিতায় নতুন মাত্রা দান করেছে। অনেকটা রবীন্দ্রনাথের আদলে রচিত হলেও ভিন্নতর বার্তা ও আলাদা কণ্ঠস্বর ধারণ করে আছে তার ‘বৈশাখ’ কবিতাটি। বৈশাখকে ফররুখও দেখেছেন রুদ্ররূপে। বৈশাখ তার কাছে মহাশক্তির প্রতীক, যা মহাকল্যাণ সাধনের জন্যেই আবির্ভূত হয়েছে মর্ত্য।ে শুরুতেই কবি বৈশাখকে সম্বোধন করেছেন এভাবে :
ধ্বংসের নকীব তুমি হে দূর্বার, দুর্ধর্ষ বৈশাখ
সময়ের বালুচরে তোমার কঠোর কণ্ঠে
শুনি আজ অকুণ্ঠিত প্রলয়ের ডাক।
কিন্তু তিনি যখন এরকম করে বলেন :
রোজ হাশরের দগ্ধ তপ্ত তাম্র মাঠ, বন, মৃত্যুপুরী, নিস্তব্ধ নির্বাক;
সূরে ইস্রাফিল কণ্ঠে পদ্মা মেঘনার তীরে
এস তুমি হে দৃপ্ত বৈশাখ।
তখন টের পাওয়া যায় নিজস্ব ঐতিহ্যের ঘরানায় থেকেই অবলোকন করেছেন তিনি বৈশাখকে। তার আহŸান অনেকটা নজরুলের মতো; বিপ্লবের স্বপ্নে তিনি বিভোর; তার দুচোখ জুড়ে জরাজীর্ণতাকে নিশ্চিহ্ন করে দেওয়ার তীব্র কামনা :
এস তুমি সাড়া দিয়ে বিজয়ী বীরের মতো, এস স্বর্ণ শ্যেন,
বাজায়ে নাকাড়া কাড়া এস তুমি দিগি¦জয়ী জুলকারনায়েন,
আচ্ছন্ন আকাশ নীলে ওড়ায়ে বিশাল ঝাÐা শক্তিমত্ত ও প্রাবল্যে প্রাণের
সকল প্রাকার বাধা চ‚র্ণ করি মুক্ত কর পৃথিবীতে সরণি প্রাণের,
সকল দীনতা, ক্লেদ লুপ্ত কর, জড়তার চিহ্ন মুছে যাক;
বিজয়ী বীরের মতো নির্ভীক সেনানী তুমি
এস ফিরে হে দৃপ্ত বৈশাখ।
ফররুখ যে-বৈশাখের কল্পনা করেছেন তার সাথে নজরুলের চেয়ে পি বি শেলির বেশি মিল পাওয়া যায়। শেলির ‘ওড টু দ্য ওয়েস্ট উয়িন্ড’ জগদ্বিখ্যাত বিপ্লবী কবিতা। শেলি ওয়েস্ট উয়িন্ডকে বিশাল শক্তির প্রতীক বলে মনে করেন; সে যখন পৃথিবীতে আগমন করে, আটলান্টিক মহাসাগর আতঙ্কিত হয়ে তার জন্যে রাস্তা করে দেয়; সে যখন আটলান্টিক মহাসাগরের উপর দিয়ে যাত্রা করার প্রস্তুতি নেয় তখন মহাসাগরের তলদেশে যত জলজ উদ্ভিদ আছে তারা ভয়ে থরথর করে কাঁপতে কাঁপতে ডালপালার সমস্ত পাতা ঝরিয়ে দেয়; এমনই ভয়ঙ্কর ওয়েস্ট উয়িন্ড। ফররুখ তার ‘বৈশাখের কালো ঘোড়া’ কবিতায় বৈশাখকে তেমনি মহাশক্তিধররূপে চিত্রায়িত করেছেন। ‘বৈশাখের কালো ঘোড়া’ ফররুখের একটি অনন্য সনেট। যেমন এর ছন্দের গাঁথুনি ও নিখুঁত অন্ত্যমিলের ব্যবহার তেমনই এর গুরুগম্ভীর বিষয়বস্তু, যা অসাধারণ চিত্রকল্পে সমৃদ্ধ হয়ে বাংলা ভাষার একটি অমূল্য শিল্প হয়ে উঠেছে।
বৈশাখের কালো ঘোড়া উঠে এলো। বন্দর, শহর
পার হয়ে সেই ঘোড়া যাবে দূর কোকাফ মুলুকে,
অথবা চলার তালে ছুটে যাবে কেবলি সম্মুখে
প্রচÐ আঘাতে পায়ে পিষে যাবে অরণ্য, প্রান্তর।
দূর সমুদ্রের বুকে নির্বাসিত যুগ যুগান্তর
শুনেছে ঘরের ডাক দূর দিগন্তের পার থেকে,
বাঁকায়ে বঙ্কিম গ্রীবা বজ্রের আওয়াজে উঠে ডেকে
শূন্যে ওড়ে বুকে নিয়ে সুলেমান নবীর স্বাক্ষর।
শূন্য হতে শূন্য স্তরেÑআরো ঊর্ধ্বে পরেনদা তাজীর
পাখার ষাপট শুনে শিহরায় পল্লীপথ, গ্রাম,
শ্বাস রুদ্ধ হয়ে আসে আতঙ্কে বিশাল পৃথিবীর;
ভেঙে পড়ে অরণ্যানি। ছেড়ে সুখশয্যার আরাম
অচেনা গতির স্রোতে হয় বন্দী এমন অধীর;
ঝড় বেগে ওড়ে ঘোড়া (জানি না তো সে ঘোড়ার নাম)।
সনেটটির আদ্যোপান্ত পাঠ করলে বুঝা যায় শেলির ‘ওড টু দ্য ওয়েস্ট উয়িন্ড’-এর তৃতীয় ভাগের সাথে এর যথেষ্ট মিল রয়েছে। ফররুখ বলেন : ” পরেনদা তাজীর/পাখার ষাপট শুনে শিহরায় পল্লীপথ, গ্রাম,/শ্বাস রুদ্ধ হয়ে আসে আতঙ্কে বিশাল পৃথিবীর;/
ভেঙে পড়ে অরণ্যানি।” শেলি বলেন : ‘ঞযড়ঁ/ঋড়ৎ যিড়ংব ঢ়ধঃয ঃযব অঃষধহঃরপ’ং ষবাবষ ঢ়ড়বিৎং/ঈষবধাব ঃযবসংবষাবং রহঃড় পযধংসং, যিরষব ভধৎ নবষড়/িঞযব ংবধ-নষড়ড়সং ধহফ ঃযব ড়ড়ুু ড়িড়ফং যিরপয বিধৎ/ঞযব ংধঢ়ষবংং ভড়ষরধমব ড়ভ ঃযব ড়পবধহ, শহড়/িঞযু াড়রপব, ধহফ ংঁফফবহষু মৎড়ি মৎবু রিঃয ভবধৎ,/অহফ ঃৎবসনষব ধহফ ফবংঢ়ড়রষ ঃযবসংবষাবং.’ ফররুখের কবিতার বিশেষত্ব হলো তিনি কখনও তার ঐতিহ্যের কথা বিস্মৃত হন না; তার সাহিত্যের সর্বত্র তিনি বেখে যেতে চান তার স্বকীয়তার ছাপ, যে কারণে এ সনেটে কবি নির্দ্বিধায় ব্যবহার করেছেন ’সুলেমান নবী’র প্রসঙ্গ, যা পাঠকের কাছে অপ্রাসঙ্গিক মনে হবে না কখনও।
রবীন্দ্রনাথেরই মতো সমস্ত বাঙালির হৃদয় কেঁদে ওঠে এই দিনে দুঃখক্লিষ্ট মানুষের যন্ত্রণায়। আমরা পান্তা-ইলিশ খেয়ে তৃপ্তির ঢেকুর তুলি বটে, কিন্তু জাতির দুঃখ-দুর্দশার কথা ভুলি না, নিপীড়িত মানবতার কথা ভুলি না। নতুন স্বপ্নে জ্বলজ্বল করে ওঠে আমাদেরও দুই চোখ, আমাদেরও হৃদয় নত হয় এই প্রার্থনায় :
মাঠ ঘাট বন
পুড়ছে যখন
অগ্নিখরায়
তাপে
পুড়ছে পৃথিবী
পুড়ছে জীবন
পারমাণবিক
পাপে
যখন মানুষ,
পশু ও পাখির
জীবন ওষ্ঠা-
গত
তখন বোশেখ
এলো পৃথিবীতে
হাতেমতায়ীর
মতো।
বোশেখ এসেছেÑ
ফুলবৃষ্টিতে
ধুয়ে যাক শোক-
তাপ
কালবৈশাখী
এনেছে সঙ্গে,
উড়ে যাক যত
পাপ।
পহেলা বৈশাখের এই আনন্দঘন দিনে যখন আমরা ধনী ও দরিদ্রের মধ্যে ব্যবধান কমিয়ে আনতে পারবো, সোনার বাংলাদেশ গড়ার স্বপ্নে উদ্দীপ্ত হতে পারবো সবাই একসাথে, কেবল তখনই সার্থক হবে আমাদের পান্তা-ইলিশ খাওয়া, রমনার বটমূলে গান গাওয়া আর বৈশাখের কবিতা পাঠ করা।
লেখক : কবি, সাহিত্য সমালোচক
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।