Inqilab Logo

সোমবার, ০১ জুলাই ২০২৪, ১৭ আষাঢ় ১৪৩১, ২৪ যিলহজ ১৪৪৫ হিজরী

তিস্তার পানি অন্যত্র নিচ্ছে ভারত

| প্রকাশের সময় : ১১ এপ্রিল, ২০১৭, ১২:০০ এএম

ভাটিতে ধুধু বালুচর
নজির হোসেন নজু সৈয়দপুর (নীলফামারী) থেকে : বার বার সম্ভাবনা জাগিয়ে আবার থেমে গেল তিস্তা নদীর পানি বণ্টন চুক্তি। রোববার (৯ এপ্রিল) ভারতের পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জী সাফ জানিয়ে দিলেন তিস্তা নদীর পানি দেয়া সম্ভব না। অন্য নদীর পানি দিতে তার কোন আপত্তি নেই। মমতার এই ঘোষণায় আপাতত ঝুলে গেল তিস্তা চুক্তি। আর যত দেরি হবে এই চুক্তি বাস্তবায়নে ততো হাহাকার বাড়বে তিস্তা পাড়ের লাখো মানুষের। পানির অভাবে তিস্তা পাড়ের জমিগুলো ধুধু বালুচরে পরিণত হয়েছে আর চিন্তিত কৃষক মাথায় হাত দিয়ে চোখে সর্ষের ফুল দেখছে।
প্রকৃতির কোলে সৃষ্টি এক কালের স্রোতস্বিনী পাহাড়ি কন্যা তিস্তা, মানুষের হাতে মৃত্যুই যেন তার অমোঘ নিয়তি হয়ে দাঁড়িয়েছে। উজানে ভারতের পশ্চিমবঙ্গের জলপাইগুঁড়ি জেলার গজলডোবা নামক স্থানে এবং নীলফামারীর ডিমলা উপজেলার দোয়ানীতে ব্যারেজ নির্মাণ করে এ নদীর উচ্ছল দুর্বার গতিকে রোধ করে দেয়া হয়েছে। ভারতের গজলডোবা ব্যারেজের দৈর্ঘ্য ৯শ’ ২১ দশমিক ৫৩ মিটার। এতে গেট রয়েছে ৪৫টি। প্রতিটির দৈর্ঘ ১৮ দশমিক ২৫ মিটার। নীলফামারীর জেলার ডিমলা উপজেলার দোয়ানীতে নির্মিত তিস্তা ব্যারেজের দৈর্ঘ্য ৬শ’ ১৫ মিটার। এতে গেট রয়েছে ৪৪টি।
ভারতের পশ্চিমবঙ্গ সরকার বছরের পর বছর বিভিন্ন ক্যানেলের মাধ্যমে স্রোত ঘুরিয়ে দিয়ে তিস্তার বুক থেকে তুলে নেয়া হচ্ছে পানি। মরে যাচ্ছে তিস্তা। উজান থেকে ভাটিতে যেখানে এসে তিস্তা যমুনার মিলেছে, এই ১শ’ ১২ কিলোমিটার নদীকে ঘিরে দু’পাড়ের যেসব মানুষ গড়ে তুলেছিল বসতি ও জীবিকা, প্রকৃতি জলরঙে এঁকেছিল সবুজের ছবি। এখন তা ক্রমেই মিলিয়ে যাচ্ছে। কৃষি ও নৌ যোগাযোগের ক্ষেত্রে দেখা দিয়েছে মারাত্মক প্রতিক্রিয়া। বিপন্ন হয়ে পড়েছে পরিবেশ। মরুকরণ প্রক্রিয়া দ্রæততর হওয়ায় মরে যাচ্ছে গাছপালা। হারিয়ে যাচ্ছে জীববৈচিত্র। তিস্তা অববাহিকায় বসবাসকারী লাখ লাখ মানুষের জীবনে নেমে এসেছে হাহাকার। নদীর স্বাভাবিক প্রবাহ ধরে রাখতে যেখানে প্রয়োজন ১০ হাজার কিউসেক পানি সেখানে শুধু ব্যারেজ এলাকায় পাওয়া যাচ্ছে মাত্র ৪শ’ ৫০ থেকে ২ হাজার ৭শ’ কিউসেক পানি। তিস্তা ব্র²পুত্র-যমুনার উপনদী। উত্তর সিকিমের পার্বত্য অঞ্চলে এর উৎপত্তি। পার্বত্য অঞ্চলে এর প্রবাহ সৃষ্টি করেছে এক অপরূপ দৃশ্যের। লাচেন ও লাচং নামের দুই পর্বত স্রোতধারাই তিস্তার উৎস। এই দুই স্রোতধারা সিকিমের চুংথাং এসে মিলেছে। চুংথাং এর ভাটিতে তিস্তা আস্তে আস্তে প্রশস্ত হতে থাকে। সিংতামে এর প্রস্থ ৪৩ মিটার। চুংথাং এবং সিংতামের মধ্যে বহু পর্বত স্রোত তিস্তাকে সমৃদ্ধ করেছে। এগুলোর মধ্যে রাংনিচু, ডিসকু, তালাংচু ও চাকুংচু প্রধান। রাংনিচু একটি বড় উপনদী। তিস্তার সাথে এটি সিংতামে মিলেছে। অন্য তিনটি মিলেছে গ্যাংটকের কাছে। সিংতাম থেকে এটি দক্ষিণ-পূর্ব দিকে প্রবাহিত থাকে এবং রাংপোচু নদীর যুক্ত হয়ে দক্ষিণ-পশ্চিমে এসে মেলিবাজারে রঙ্গিত নদীর সাথে মিলিত হয়। মেলিবাজার থেকে নদীটি দক্ষিণ-পূর্ব দিকে প্রবাহিত হতে থাকে। পাহাড় থেকে উৎপন্ন হয়ে তিস্তা জলপাইগুঁড়ি জেলার সিবকের নিকট সমতল ভূমিতে নেমে এসেছে। সিবক শহরের কাছে এসে তিস্তা প্রশস্ত হয় এবং বিভিন্ন খাতে প্রবাহিত হতে থাকে। সিবকের ভাটিতে লিশ, সিশ, চেল ও নেংরা পার্বত্য স্রোতধারা তিস্তার সাথে যুক্ত হয়। জলপাইগুঁড়ি জেলার মোট ৫৬ কিলোমিটার পথ অতিক্রম করে তিস্তা নীলফামারী জেলার ডিমলা উপজেলার সাতনাই গ্রামের মাইল খানেক উত্তর দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করে। বাংলাদেশে ১শ’ ১২ কিলোমিটার পথ প্রবাহিত হয়ে তিস্তা চিলমারীতে যমুনার সাথে মিলিত হয়। গড়ে নদীটি ১শ’ ৬০ কিলোমিটার প্রশস্ত। বাংলাদেশের তিস্তা বাঁধ এলাকা থেকে ১শ’ কিলোমিটার উজানে ভারতের পশ্চিমবঙ্গের জলপাইগুড়ি জেলার গজলডোবা নামকস্থানে ১শ’ কোটি রুপি ব্যয়ে একটি বাঁধ নির্মাণ করে। এ বাঁধ দিয়ে ভারত একটি খালের সাহায্যে তিস্তার শুকনো মৌসুমের প্রবাহ থেকে ১ হাজার ৫শ’ কিউসেক পানি মহানন্দা নদীতে নিয়ে যাচ্ছে। মহানন্দায় ব্যারেজ নির্মাণ করে ১০টি লক গেটের মাধ্যমে পানি আটকানো হচ্ছে। তিস্তা-মহানন্দা সংযোগ খাল থেকে জলপাইগুড়ি, দার্জিলিং, পশ্চিম দিনাজপুর, কোচবিহার মালদহ জেলার কৃষি জমিতে সেচের পানি নিয়ে যাওয়া হচ্ছে।
আগেই বলা হয়েছে, গজলডোবায় নির্মিত বাঁধটি বাংলাদেশের তিস্তাবাঁধ এলাকার উজানে অবস্থিত। তিস্তা-মহানন্দা লিংক ক্যানেল এ অঞ্চলের পরিবেশ নষ্ট করবে বলে বিশেষজ্ঞগণ মত প্রকাশ করেছেন। তারা বলেছেন, বৈকণ্ঠপুর বনাঞ্চল মানুষের জন্য আশীর্বাদ। এ তিস্তা-মহানন্দা লিংক ক্যানেল বয়ে গেছে বৈকন্ঠপুর বনাঞ্চলের মধ্য দিয়ে। বনাঞ্চল বিনষ্ট হওয়ায় এর বিরুপ প্রতিক্রিয়া একদিন দেখা দেবেই। প্রতিক্রিয়ায় পরিবেশের উপড় আঘাত আসবে সবচেয়ে বেশি। এ বাঁধের সাহায্যে পানি প্রত্যাহার করায় বাংলাদেশের তিস্তা ব্যারেজ প্রকল্প প্রায় অকার্যকর হয়ে পড়েছে। তিস্তার পানির প্রবাহ অস্বাভাবিক হারে কমে গেছে। তিস্তা তার নাব্যতা হারিয়ে শীর্ণ, কঙ্কালসার। নদীর পাড়ের স্থানীয় মানুষ জানায়, নদী ভরাট হয়ে যাওয়ায় একটু বর্ষা হলেই দু’কূল ছাপিয়ে ফুঁসে ওঠে তিস্তা। ঘরবাড়ি সব উজার করে ফেলে। এভাবে বার বার ভাঙনে নিঃস্ব হয়ে পরে লাখো মানুষ। নদী শুকিয়ে যাওয়ায় মৎসজীবীরা তাদের বাপ-দাদার পুরনো পেশা ছেড়ে শহরে গিয়ে হয়ে পড়েছে ছিন্নমূল। ছোট ছোট খেয়াঘাট বন্ধ হয়ে যাওয়ায় চরাঞ্চলের যোগাযোগ ব্যবস্থা একেবারে অচল হয়ে পড়েছে। নৌকাগুলো তুলে রাখতে বাধ্য হচ্ছে। সেই সাথে হারিয়ে যাচ্ছে রঙিন পালের নৌকাগুলো।
তিস্তা পাড়ের শমসের আলী জানান, তিস্তার ভাঙনে তার ২০ বিঘা জমি নদী গর্ভে বিলীন হয়। এখন সে নিঃস্ব। এভাবে অনেক শমসের হারিয়েছে ধানী জমি, বসতভিটা। পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়ায় ভূগর্ভের গভীর থেকে স্যালো ও গভীর নলকূপ দিয়ে ব্যাপক পানি উত্তোলন করায় মাটির স্তরের মধ্যবর্তী শূন্য স্থানে বাতাস প্রবেশ করছে। ফলে ভূগর্ভে অক্সিজেনের প্রবেশ ঘটছে। এ অক্সিজেন লৌহ ও আর্সেনিক যৌগের (আর্সেনোপাইরাইট) সঙ্গে বিক্রিয়ার ফলে মুক্ত আর্সেনিকের সৃষ্টি হচ্ছে বলে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে।
পানি উন্নয়ন বোর্ড সূত্রে জানা গেছে, এখন পর্যন্ত ২৫-৩০ হাজার ঘরবাড়ি তিস্তার গর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। বসতভিটা হারিয়ে নদীর তীরবর্তী স্থান থেকে বিতাড়িত হয়েছে প্রায় ১৫ সহস্রাধিক মানুষ। এই জনপদকে বাঁচাতে অতিদ্রæত তিস্তা চুক্তির বাস্তবায়নসহ কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে নয়তো আরো লাখো মানুষকে খাবারের পথে নামতে হতে পারে।



 

Show all comments
  • তুষার ১১ এপ্রিল, ২০১৭, ৩:২৭ এএম says : 0
    এগুলো নিয়ে কি আমাদের সরকারের কোন মাথাব্যাথা নেই ?
    Total Reply(0) Reply
  • Prìñçè Ràñá ১১ এপ্রিল, ২০১৭, ১:১৬ পিএম says : 0
    মমতা যতদিন ক্ষমতায় থাকবে ততদিন বাংলাদেশ তিস্তার পানি পাবে না।এই মমতা চরম বেইমান আর চরম স্বার্থপর সে বাংলাদেশ কে দেখতেই পারে না।
    Total Reply(0) Reply
  • Mohammed Shah Alam Khan ১১ এপ্রিল, ২০১৭, ৭:২৭ পিএম says : 0
    মমতা মানে মায়া বা দয়া বলা যায় “মা” সমস্ত মায়া মমতা লুকিয়ে থাকে মায়ের ভিতর আর মায়ের মত মমতা আর কাওর নেই তাই আমরা মেয়েদের নাম রেখে থাকি মমতা মানে “মা”। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দপাধ্যায়ের নাম মমতা কিন্তু প্রকৃতই কি তিনি এই নামের মর্যাদা রখেছেন??? মুখ্যমন্ত্রী এখন আর বাঙ্গালী নন তিনি এখন বনেছে একজনের মাতা তাই অন্যজন নাখেয়ে মরে গেল কিনা সেদিকে পরোয়া নেই মায়ের। তিনি যে প্রকৃত মা হবার যোগ্য নন এটা তিনি এই পানির সমস্যায় প্রমান করে দিয়েছেন যে, তিনি এক চোখা নারী তার দুই চোখ নেই!!! তিনি একজন সংকীর্ণ মনা নারী তাই না??? নাহলে তিনি পানি আটকাতে পারে??? বাংলায় পড়েছি পানির অপর নাম জীবন। যে নারী জীবন নিয়ে খেলা করে সে নারী মা হয় কি ভাবে??? এসব বলে অরন্যে রোদন করে কোন লাভ নেই।
    Total Reply(0) Reply
  • Fakhar uddin ১১ এপ্রিল, ২০১৭, ১১:৩২ পিএম says : 0
    বিচার মানি তবে তালগাছ আমার
    Total Reply(0) Reply

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: তিস্তা


আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ