হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির খড়গ : আসামের এনআরসি এবং বাংলাদেশ
কিশোর শিক্ষার্থীদের নিরাপদ সড়ক দাবীর আন্দোলনে ঢাকাসহ সারাদেশে তীব্র রাজনৈতিক উত্তেজনা ও অনিশ্চয়তা দেখা যাচ্ছিল,
জামালউদ্দিন বারী : চলমান যুগকে আমরা তথ্য প্রযুক্তির যুগ বলে অভিহিত করছি। যদিও তথ্যই জ্ঞানের পুরোটা নয়। শুধুমাত্র ডেটা বা তথ্যই একজন মানুষকে সুশিক্ষিত, জ্ঞানী বা প্রজ্ঞাবান করে তুলতে পারে না। তবে দেশে দেশে, জাতিতে জাতিতে যে ভূ-রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক আধিপত্যবাদী লড়াই চলছে, সেখানে তথ্য একটি বড় সম্পদে পরিণত হয়েছে। যার কাছে প্রতিপক্ষের যত বেশি তথ্য আছে সে তত বেশি অগ্রগামী, শক্তিশালী ও সমৃদ্ধ হিসেবে পরিগণিত হচ্ছে। তথ্য সংগ্রহ এবং সংরক্ষণে তথ্যপ্রযুক্তি এখন একমাত্র আশ্রয় স্থল। এ কারণে তথ্য প্রযুক্তির নব নব উদ্ভাবন এবং তথ্যপ্রযুক্তির জ্ঞান ও সৃজনশীলতা অর্থনৈতিকভাবে অনেক বেশি সম্ভাবনাময় ক্ষেত্র হয়ে উঠেছে। এক সময় সোনার খনী, তেলের খনি, মূল্যবান রতœরাজির খনি অথবা ভা-ার রাজা, মহারাজা ও শেখদের সম্পদ ও অর্থনৈতিক সামর্থ্যরে উৎস হিসেবে বিবেচিত হত। এখনো জ্বালানি তেল, লোহা, সোনা-রূপা ও হিরা জহরতের বিনিময় মূল্য অটুট থাকলেও তথ্য এবং তথ্যপ্রযুক্তির অর্থনৈতিক সম্ভাবনা অনেক বেশি বিস্তৃত ও সার্বজনীন হয়ে উঠেছে। এ কারণে তথ্য সংগ্রহ, তথ্য পাচার, তথ্যের বাণিজ্য, তথ্যের যুদ্ধ অনেক বেশি আলোচিত ও সক্রিয় বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। আজকে বিশ্বের শ্রেষ্ঠ ধনীর তালিকায় বছরের পর বছর ধরে স্থান পাচ্ছেন বিলগেটসের মত তথ্যপ্রযুক্তি খাতের উদ্যোক্তা। প্রথম জীবনে কর্পদকশূন্য ব্যক্তিরা তথ্য প্রযুক্তির উদ্ভাবনী প্রতিভা এবং এর বাণিজ্যিক সাফল্যের হাত ধরে বিল গেটস, মার্ক জাকারবার্গ, স্টিব জব্স বিশ্বের প্রথম ও সেরা ধনীদের তালিকায় স্থান করে নিতে সক্ষম হচ্ছেন। তথ্য নিয়ে সাম্রাজ্যবাদ ও কর্পোরেট পুঁজিবাদের গাঁটছড়া এবং দ্বন্দ্বও চলমান বিশ্ববাস্তবতার এক অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে উঠেছে। মোবাইলফোন, স্মার্টফোন, ইন্টারনেটে পাতা হচ্ছে বিশ্বের প্রতিটি মানুষের ব্যক্তিগত তথ্যের মহাফাঁদ। এমনিতেই আমরা চাই বা না চাই নানাভাবে মোবাইল ফোন অপারেটর, আএসপি (ইন্টারনেট সার্ভিস প্রোভাইডার), ইয়াহু, গুগল, ফেইসবুক, টুইটারসহ ইন্টারনেটের নানা অ্যাপসের মাধ্যমে নিজের অজান্তেই অনেক ব্যক্তিগত তথ্য ও ডকুমেন্টস দিয়ে দিচ্ছি। কোটি কোটি মানুষের ব্যক্তিগত তথ্যের মহাভা-ার যাদের দখলে তারা অনেক বড় সম্পদের অধিকারী। এই সম্পদের দখল নিয়েই এখন তথ্যপ্রযুক্তির পশ্চিমা কর্পোরেট কোম্পানির সাথে সাম্রাজ্যবাদের মধ্যে এক প্রকার ঠা-া-গরম লড়াই শুরু হয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সামাজিক-রাজনৈতিক সেলিব্রেটি থেকে শুরু করে সাধারণ নাগরিক, এমনকি বাংলাদেশের মত তৃতীয় বিশ্বের দরিদ্র দেশের নাগরিকরাও এই লড়াইয়ের সাবজেক্ট হয়ে দাঁড়াচ্ছে। তথ্যের টার্গেট এবং তথ্যের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক প্রতিযোগিতা বেড়ে যাওয়ার পাশাপাশি তথ্য সংক্রান্ত অপরাধ (সাইবার ক্রাইম)ও বেড়ে চলেছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় গোয়েন্দা সংস্থা (এনএসএ), ফেডারেল তদন্ত সংস্থা (এফবিআই), কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা (সিআইএ)’র মত প্রতিষ্ঠানগুলো যখন সারাবিশ্বের মানুষকে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিকভাবে নিয়ন্ত্রণের জন্য তাদের ব্যক্তিগত তথ্য ভা-ারের দখল নিতে টেলিফোনে আড়িপাতা, বিভিন্ন ইন্টারনেট ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ও কোম্পানির সার্ভারে হানা দেয়ার মত অবৈধ-অনৈতিক পন্থা অবলম্বন করছে, তখন এডওর্য়াড স্নোডেন, জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জদের মত তথ্যপ্রযুক্তিতে দক্ষ ও সমৃদ্ধ মুক্তমনা মার্কিনীরা মার্কিন সরকারের এসব অবৈধ তৎপরতার তথ্য ফাঁস করে দিয়ে মোস্ট ওয়ানটেড শত্রুতে পরিণত হচ্ছেন। এভাবেই উন্মোচিত হচ্ছে তথ্য প্রযুক্তি সেবা এবং তথ্যের লড়াইয়ের ভেতরকার বিস্ময়কর চেহারাটি। ড্রাগ বা সোনা চোরাচালানের চেয়ে তথ্যের চোরাই কারবার অনেক বেশি রোমাঞ্চকর ও লাভজনক।
উইকিলিক্সের মাধ্যমে মার্কিন সরকারের লাখ লাখ গোপনীয় তথ্য ফাঁস করে দিয়ে জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জ গত ৩ বছর ধরে মার্কিন সরকারের হুলিয়া মাথায় নিয়ে লন্ডনের ইকুয়েডর দূতাবাসে ফেরারী জীবনযাপন করছেন। অ্যাসাঞ্জের আবেদনের প্রেক্ষিতে জাতিসংঘের নির্বতনমূলক আটকাদেশ সম্পর্কিত ওয়ার্কিং গ্রুপের তদন্তের পর সম্প্রতি এই গ্রুপ অ্যাসাঞ্জের আটকাদেশকে অবৈধ ও অযৌক্তিক বলে অভিহিত করেছে। অন্যদিকে তরুণ সাবেক সিআইএ কর্মকর্তা এডোয়ার্ড স্নোডেন মার্কিন সরকার এবং সামরিক গোয়েন্দা দফতরের ইন্টারন্টে ও টেলিফোন-মোবাইলফোন নজরদারি ও আড়িপাতার তথ্য গণমাধ্যমে ফাঁস করে দিয়ে মার্কিন সরকার তথা ওবামা প্রশাসনকেই চরম অস্বস্তিতে ফেলে দিয়েছেন। মার্কিন সরকারের অনৈতিক তথ্য কেলেঙ্কারির তথ্য ফাঁসকারী দুই মার্কিন নাগরিকের মধ্যে অদ্ভুত মিল, সাজুয্য ও সহমর্মিতা লক্ষ্য করা যায়। সেøাডেনের প্রতি অ্যাসাঞ্জের সমর্থন এবং গ্রেফতার এড়িয়ে স্নোডেনের নিরাপদ আশ্রয় নিশ্চিত করতে ইকুয়েডরে রাজনৈতিক আশ্রয়ের বন্দোবস্তও করেছিলেন জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জ। স্নোডেন হংকংয়ে অবস্থানকালে এক পর্যায়ে হংকং সরকার মার্কিন সরকারের চাপের কাছে নতি স্বীকার করে তাকে যুক্তরাষ্ট্রের হাতে তুলে দেয়ার আশঙ্কা দেখা দেয়ায় তিনি ইকোয়েডরে আশ্রয় নেয়ার সিদ্ধান্ত নেন। এই লক্ষ্যে তিনি বিমানেও চড়েছিলন। তবে মস্কো এয়ারপোর্টের ট্রানজিট লাউঞ্জ থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রোষানলে পড়ার ভয়ে ইকোয়েডরগামী কোন বিমান সংস্থা স্নোডেনকে বহন করতে রাজি না হওয়ায় বাধ্য হয়েই তিনি মস্কোতে অবস্থান করছেন। গোয়েন্দা তথ্য ফাঁস করার অপরাধে স্নোডেনের উপর মার্কিন হুলিয়া ঘটনাক্রমে মার্কিন সরকারের জন্য বুমেরাং হয়েছে। মস্কোতে অবস্থানরত স্নোডেনের হাতে রয়েছে তথ্যসমৃদ্ধ সেই ব্যক্তিগত ল্যাপটপ। ধারণা করা হচ্ছে রাজনৈতিক আশ্রয়লাভের বিনিময়ে এই ল্যাপটপের সব তথ্যই রাশিয়ান গোয়েন্দাদের হাতে তুলে দিয়েছেন স্নোডেন। অতএব মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অনেক অপ্রকাশিত-অনুদঘাটিত তথ্য রাশিয়ান গোয়েন্দাদের হাতে। সাম্প্রতিক সময়ে সিরিয়া যুদ্ধে সামরিক হস্তক্ষেপসহ মধ্যপ্রাচ্যে রাশিয়ার সক্রিয় কৌঁশলী ভূমিকার কাছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কৌশলগত পরাজয় নিশ্চিত করেছে। হয়তো মধ্যপ্রাচ্যে পরিবর্তনশীল বাস্তবতায় মার্কিনীদের গোপন পরিকল্পনার তথ্য আগেভাগে জেনে ফেলায় রাশিয়ার পক্ষে দ্রুত সামরিক-রাজনৈতিক সাফল্য পাওয়া সম্ভব হয়েছে। বহুদিন আগে একজন ইসরাইলী সামরিক কর্মকর্তা বিবেকের তাড়নায় ইসরাইলের গোপন পারমানবিক অস্ত্র পরিকল্পনার তথ্য ফাঁস করে দিয়েছিলেন। সেই ভানুনু মরদেচাই ইসরাইলী সেনা পুলিশের হাতে বন্দি হয়ে ১৮ বছর আটক থেকে এখন ইসরাইলে বিশেষ নজরদারির আওতায় জীবনযাপন করছেন। তিনি নিজেই নেগেভ মরুভূমির গভীর বাঙ্কারে গড়ে তোলা ইসরাইলী পারমানবিক অস্ত্র প্রকল্পের সচিত্র তথ্য এবং ইসরাইলের হাতে অন্তত ২শ’টি পারমানবিক ক্ষেপণাস্ত্র মজুদ থাকার বিষয়টি প্রকাশ্যে নিয়ে আসেন। নিউক্লিয়ার প্রলিফারেশন চুক্তিতে সই করাসহ আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষণের আওতায় থাকা সত্ত্বেও মধ্যপ্রাচ্যে ইরানের কথিত পারমানবিক প্রকল্প নিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমাদের অনেক কথা, অনেক চাপ, নিষেধাজ্ঞা ও সামরিক হুমকি অব্যাহত আছে। অথচ ভানুনু মরদেচাইয়ের দেয়া তথ্যসহ বিশ্বের দেড়শতাধিক রাষ্ট্রের দাবি সত্ত্বেও ইসরাইলের পারমানবিক প্রকল্প আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষণের আওতায় আনতে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ব্রিটেনের ভেটোর কারণে ব্যর্থ হচ্ছে। তবে মরদেচাই’র ফাঁস করা তথ্যের কারণেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ব্রিটেনের ভেটো প্রয়োগ সত্বেও ইসরাইলের পারমানবিক প্রকল্পের লাগাম টানতে বিশ্বসম্প্রদায়কে ঐক্যবদ্ধ ভূমিকা পালনে উদ্বুদ্ধ করেছে। আর প্রতিবারই আন্তর্জাতিক সব কনভেনশন এবং বিশ্বসম্প্রদায়ের দাবিকে ইসরাইলের বেপরোয়া উপেক্ষার পেছনে ইঙ্গ-মার্কিনীদের নির্লজ্জ মতলববাজি ধরা পড়েছে।
অনৈতিক পন্থায় বিশ্বকে নিয়ন্ত্রণে পারমানবিক যুদ্ধাস্ত্র এখন অনেকটা সেকেলে হয়ে গেছে। সে স্থলে এখন জায়গা করে নিয়েছে কর্পোরেট মুনাফাবাজির নানা রকম কৌশলগত অ্যাপারেটাস, তথ্য সন্ত্রাস এবং ভয় জাগানিয়া সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধের নাটক। নিজেরাই অর্থ, অস্ত্র, প্রশিক্ষণ দিয়ে ফেইক সন্ত্রাসী গ্রুপের জন্ম দিয়ে মধ্যপ্রাচ্যে রিজাইম চেঞ্জ পরিকল্পনাসহ দীর্ঘস্থায়ী যুদ্ধের নীলনকশা বাস্তবায়নের পশ্চিমা উদ্যোগ সারাবিশ্বের সাধারণ মানুষের কাছে সহজবোধ্য করতে জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জের উইকিলিক্স এবং এডোয়ার্ড স্নোডেনের ‘প্রিজম’সংক্রান্ত তথ্য ফাঁসের ঘটনা অনেক বড় অবদান রেখেছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদি স্বার্থের অনুকূল যে কোন দেশের যে কোন স্থানের যে কেউ মার্কিন গোয়েন্দা তথ্য ও গোয়েন্দা নজরদারির আওতায় আসবে। এটাই হচ্ছে প্রিজম গোয়েন্দা ব্যবস্থার মূলনীতি। স্নোডেনের ফাঁস করা নথি থেকে জানা গেছে, জাতীয় নিরাপত্তার দোহাই দিয়ে এনএসএ, এফবিআই’কে গুগল, অ্যাপল, মাইক্রোসফ্ট, ফেসবুক, ইউটিউব, এওএলসহ ইন্টারনেটে তথ্য ও সেবা প্রদানকারী বিভিন্ন মাধ্যম ব্যবহারকারীদের ব্যক্তিগত তথ্য সংগ্রহের কর্তৃত্ব দেয়া হয়েছে। এনএসএ শুধুমাত্র লাখ লাখ মার্কিন নাগরিকের টেলিফোন রেকর্ডসহ সব রকমের ব্যক্তিগত তথ্যই সংগ্রহ করছে না, তারা সারাবিশ্বের রাষ্ট্রপ্রধানসহ প্রায় সব বিশিষ্ট ও গুরুত্বপূর্ণ নাগরিকের ব্যক্তিগত তথ্যও এসব মাধ্যম থেকে হস্তগত করছে। মার্কিন প্রিজম গোয়েন্দা ব্যবস্থার তথ্য ফাঁস করার সপক্ষে যুক্তি দিয়ে এডোয়ার্ড স্নোডেন বলেন, ‘আমি আশা করি, এ ঘটনা আমাদের কাক্সিক্ষত দুনিয়ার জন্য সারাবিশ্বের নাগরিকদের জাগিয়ে তুলবে। যুক্তরাষ্ট্রের সরকার যেভাবে তার বিশাল গোয়েন্দা বাহিনীর মাধ্যমে সারা বিশ্বের মানুষের ব্যক্তিগত গোপনীয়তা, ইন্টারনেট স্বাধীনতা ও মৌলিক স্বাধীনতার শর্ত ধ্বংস করছে, তাতে আমি সচেতনভাবে এ প্রক্রিয়া সমর্থন করতে পারি না।’ ২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর তথা নাইন-ইলেভেনের সন্ত্রাসী বিমান হামলার পর তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জর্জ ডাব্লিউ বুশ প্রথম মার্কিন নাগরিক ও বিদেশিদের টেলিফোনসহ নানা মাধ্যমে আড়িপাতা ও গোপন তথ্য সংগ্রহের পদক্ষেপ গ্রহণ করলেও ওবামার প্রশাসনও একই গতিতে এই তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছে। মার্কিন জাতীয় গোয়েন্দা প্রধান জেমস ক্ল্যাপার অবশেষে এই বলে স্বীকার করেছেন যে, একটি গোপন আদালতের কর্মকা-ের ওপর নজর রাখার জন্য প্রিজম কর্মসূচির অনুমতি দিয়েছে কংগ্রেস। তবে মার্কিন গোয়েন্দারা অনেক আগে থেকে বিভিন্ন সংস্থা এবং নাগরিকদের ব্যক্তিগত তথ্য সংগ্রহের কাজে বিরামহীনভাবে কাজ করে চলেছে। ইকোনমিস্টে প্রকাশিত সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, পঞ্চাশের দশকেও প্রিজমের অনুরূপ ‘একিলন’ প্রকল্পের আওতায় গোপন তথ্য সংগ্রহের কাজ করেছে মার্কিন গোয়েন্দারা। উইকিলিক্স এবং স্নোডেন সেসব তথ্যের কিছু কিছু বার্তা ফাঁস করেছে মাত্র। জাতীয় নিরাপত্তার কথা বলে দেশের ও বিশ্বের কোটি কোটি মানুষের ব্যক্তিগত গোপনীয়তাও এবং নিরাপত্তাকে হুমকির মুখে ঠেলে দেয়ার প্রয়াস বিশ্বের সব প্রান্তের সচেতন মানুষের প্রত্যাখ্যান ও বিরোধিতার সম্মুখীন হচ্ছে।
তথ্য প্রযুক্তি ও পুঁজিবাদী অর্থনীতির বিশ্বায়নের এই যুগে বিশ্বের প্রতিটি মানুষের গোপন তথ্যসহ সব রকমের নিরাপত্তা ব্যবস্থাকে নিজেদের করায়ত্ব রাখতে সম্ভাব্য সবকিছুই করছে সাম্রাজ্যবাদের শিখ-ি এবং পশ্চিমা কর্পোরেট জায়ান্টরা। বাংলাদেশও এর বাইরে নয়। বাংলাদেশের বর্তমান সরকার ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ রাজনৈতিক শ্লোগান তুললেও ডিজিটায়ন এবং তথ্যপ্রযুক্তি খাতে বিশ্ব র্যাংকিং-এ তো বটেই, প্রতিবেশী দেশগুলো থেকেও ক্রমে পিছিয়ে পড়ছে। তবে জঙ্গিবাদ, সন্ত্রাসবাদ, জাতীয় নিরাপত্তা ইত্যাদি ইস্যুকে সামনে রেখে আমাদের সরকারও যখন তখন নাগরিকদের মৌলিক অধিকার ও স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করছে। টেলিফোন, মোবাইলফোন, স্কাইপি, ইউটিউব, ফেইসবুকসহ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অযাচিত হস্তক্ষেপ করছে, অথবা যখন তখন এসব আন্তর্জাতিক তথ্যপ্রবাহে বাধা সৃষ্টি করছে, সবার্ধিক ব্যবহৃত সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেইসবুক কর্তৃপক্ষের কাছে বাংলাদেশী নাগরিকদের গোপনীয় তথ্য সংগ্রহের চেষ্টা করছে। তথ্য প্রবাহ, তথ্যপ্রযুক্তি এবং নাগরিকদের তথ্য অধিকার গোপনীয়তার নিরাপত্তা সম্পর্কে বেপরোয়া ব্যক্তিদের হাতে এই মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব দেয়ায় রাষ্ট্রের নাগরিকরা প্রায়শ তাদের তুঘলকি কর্মকা-ের শিকার হচ্ছে।
এ কথা অস্বীকার করার উপায় নেই যে, তথ্যপ্রযুক্তি খাত বাংলাদেশের সম্ভাবনাময় খাতগুলোর অন্যতম। দেশ এখনো মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত না হলেও এ দেশের ১৫ কোটি মানুষের মধ্যে প্রায় ১৩ কোটি মোবাইল ফোন সিম সক্রিয় রয়েছে। অর্থাৎ এ দেশের শতকরা ৮০ ভাগ মানুষ তথ্যপ্রযুক্তি খাতে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করছে। এ কারণেই বাংলাদেশের অর্থনীতি, আর্থ-সামাজিক উন্নয়নসহ দুর্নীতি নির্মূল ও শিক্ষা-সংস্কৃতির বিস্তারে মোবাইলফোন ও তথ্য প্রযুক্তি সেবার অসাধারণ সম্ভাবনা রয়েছে। তবে এ খাতের উন্নয়নে আমাদের সরকারের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তোলার অবকাশ রয়েছে। বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক মোবাইল ফোন ও সিমের বায়োমেট্টিক নিবন্ধন পদ্ধতি নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এই প্রশ্ন ক্রমে জোরালো হয়ে উঠতে দেখা যাচ্ছে। আঙ্গুলের ছাপযুক্ত মোবাইলফোন সিম নিবন্ধন কার্যক্রম বেসরকারি ও বহুজাতিক কোম্পানির হাতে তুলে দেয়ায় এই বিতর্ক দেখা দিয়েছে। গত বছরের ডিসেম্বরে শুরু হওয়া বায়োমেট্টিক সিম নিবন্ধন প্রক্রিয়ায় এপ্রিলের মধ্যে ১৩ কোটি সিম নিবন্ধনের টার্গেট নির্ধারণ করা হলেও ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত প্রায় দেড়কোটি সিম এই পদ্ধতিতে নিবন্ধন হয়েছে বলে বিভিন্ন মাধ্যমে প্রকাশিত তথ্যে জানা যায়। ইতিমধ্যেই জনগণের মধ্যে বায়োমেট্টিক বা আঙ্গুলের ছাপ বিতর্ক ক্রমে জোরালো হয়ে উঠতে দেখা যাচ্ছে। এ কথা অস্বীকার করার উপায় নেই যে, ব্যক্তির আঙ্গুলের ছাপ তার একান্ত ব্যক্তিগত সম্পদ। এটি তার নির্ভূল আইডেন্টিফিকেশন এবং নিরাপত্তারও অংশ। নাগরিক অধিকার ও গোপনীয়তার শর্তসহ আনুসাঙ্গিক বিকর্তে না গেলে, নাগরিকদের প্রয়োজনে বিশেষ রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তায় সরকারি ডেটাবেজে নাগরিকদের আঙ্গুলের ছাপ সংরক্ষিত থাকতে পারে বলে স্বীকার করে নেয়া যায়। সেসব শর্ত ও নিরাপত্তা ইস্যুকে পাশ কাটিয়ে আমাদের সরকার বিদেশী মোবাইল কোম্পানির মাধ্যমে বহুজাতিক কোম্পানির সরবরাহকৃত ডিভাইসে বায়োমেট্টিক সিম নিবন্ধনের নামে নাগরিকদের আঙ্গুলের ছাপ সংগ্রহ করছে। বাংলাদেশে বায়োমেট্টিক সিম নিবন্ধন নিয়ে নাগরিকদের সংশয় ও বিতর্কের শুরু এখান থেকেই। পত্রিকায় প্রকাশিত এক রিপোর্টে জনৈক প্রযুক্তিবিদের ব্যক্তিগত মন্তব্যের উদ্ধৃতি দিয়ে বলা হয়েছে, রাষ্ট্র ছাড়া কোন তৃতীয় ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের হাতে নাগরিকদের হাতের আঙ্গুলের ছাপ সংরক্ষিত থাকলে নানাভাবে এর অপব্যবহার হওয়ার আশঙ্কা থাকে। যেখানে এটিএম বুথে বিশেষ নিরাপত্তাব্যবস্থা সম্বলিত ক্রেডিট কার্ড, ডেবিট কার্ড জালিয়াতি করে গ্রাহকদের কোটি কোটি টাকা লোপাট হওয়ার ঘটনা ঘটছে, সেখানে কোটি মানুষের আঙ্গুলের ছাপ নিয়ে তৃতীয় পক্ষের কেউ জাল-জালিয়াতি করে স্বার্থ হাসিলের চেষ্টা করবে না, এমন কোন নিশ্চয়তা পাওয়া যাচ্ছে না। একজন কোটিপতি থেকে একজন ভূমিহীন কৃষক পর্যন্ত আঙ্গুলের ছাপ নিয়ে জাল-জালিয়াতির শিকার হতে পারেন। আঙ্গুলের ছাপ ব্যবহার করে ব্যক্তির অনলাইন আইডি হ্যাক করা থেকে শুরু করে ব্যাংকলোন গ্রহণের মত জালিয়াতি করারও আশঙ্কা করছেন কেউ কেউ।
বিবিসি সূত্রে প্রকাশিত একটি রিপোর্টে জানা যায়, বায়োমেট্টিক সিম নিবন্ধন নিয়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় বিতর্ক তুঙ্গে উঠার পর ১৯ ফেব্রুয়ারি ডাক ও টেলিযোগাযোগ প্রতিমন্ত্রী তারানা হালিম তার ফেইসবুক পোস্টে লিখেছেন, মোবাইল ফোন কোম্পানির কাছে আঙ্গুলের ছাপ সংরক্ষণের কোন প্রযুক্তি নেই। তবে গত ২৩ ফেব্রুয়ারি বিটিআরসি’র পক্ষ থেকে মোবাইলফোন অপারেটরদের কাছে বায়োমেট্টিক তথ্য সংরক্ষণ করা যাবে না মর্মে একটি নির্দেশনা জারি করা হয়েছে বলে প্রকাশিত রিপোর্টে জানা গেছে। ডিসেম্বরে বায়োমেট্টিক পদ্ধতিতে সিম নিবন্ধন শুরু হলেও ফেব্রুয়ারির শেষদিকে কেন বিটিআরসিকে এই নির্দেশনা জারি করতে হল। আর মোবাইলফোন কোম্পানির হাতে আঙ্গুলের ছাপ সংরক্ষণের প্রযুক্তি না থাকলে এই নির্দেশনা জারির হেতু কি? গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে, ইউরোপ-আমেরিকাসহ বিশ্বের শিল্পোন্নত দেশগুলোতে মোবাইলফোন এবং ইন্টারনেট ব্যবহারকারির সংখ্যা এবং সাইবার অপরাধ বেশি হলেও সেসব দেশে বায়োমেট্টিক সিম নিবন্ধনের কোন বাধ্যবাধকতা নেই। বিদেশী মোবাইলফোন অপারেটর কোম্পানিগুলো যদি বাংলাদেশের ১৩ কোটি মানুষের আঙ্গুলের ছাপ সংরক্ষণ করে এবং গোপনে কোন বিদেশী গোয়েন্দা সংস্থার কাছে বিক্রি করে দেয়। অথবা তাদের অসর্তকতায় তৃতীয় কেউ এই বায়োমেট্টিক তথ্য ভা-ার দখলে নিতে পারে। তা হলে এ দেশের ১৩ কোটি মানুষের যে কেউ যখন তখন ব্লাক-মেইলিংয়ের শিকার হতে পারে। এসব আশঙ্কা অগ্রাহ্য বা উড়িয়ে দেয়ার বিষয় নয়। দেশের মোবাইলফোন ব্যবহারকারীদের যথাযথ প্রক্রিয়ায় নিবন্ধনের আওতায় নিয়ে আসার প্রয়োজনীয়তা অস্বীকার করা যায় না। ইতিপূর্বে সরকার এবং নির্বাচন কমিশন জাতীয় পরিচয়পত্র প্রকল্পের মত বিশাল প্রকল্প বাস্তবায়ন করেছে। ন্যাশনাল আইডি’র সেই ডেটাবেজে সব নাগরিকের আঙ্গুলের ছাপসহ প্রয়োজনীয় সব তথ্যই রয়েছে। এখন সেই ডেটাবেজটি কি ভেরিফিকেশনের জন্য বহুজাতিক কোম্পানির হাতে তুলে দেয়া হয়েছে? জাতীয় স্বার্থেই এসব বিষয়ে জনগণের সন্দেহ- সংশয় দূর হওয়া জরুরি।
[email protected]
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।