Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

কালো শালিক ও স্বাধীনতা

গল্প

| প্রকাশের সময় : ২৭ মার্চ, ২০১৭, ১২:০০ এএম

কা জী সু ল তা নু ল আ রে ফি ন : গ্রামের এক মেঠো পথের ধারে ক্লান্ত হয়ে বসে পড়লাম। সেথা দিয়ে উড়ে যাচ্ছিল এক নিঃসঙ্গ কালো শালিক। উড়ে যাবার সময়ে ঘাড় ফিরিয়ে আমার পানে একবার চাইল। তারপর কিনা কী মনে করে সে পথেরই এক প্রান্তে একটি আম গাছের ডালে সে বসল। অনেকক্ষণ আমাকে পর্যবেক্ষণ করল শালিকটি। আমি তা খেয়াল করলাম। সে যেন আমায় কিছু বলতে চাইল। কিন্তু সম্ভব হয়নি। কারণ সে পাখি আর আমি মানুষ। পাখির ভাষা বোঝার ক্ষমতা এ জাহানের মালিক আমাকে দেননি। তবে এটা বুঝতে পারলাম শালিকটি খুবই বিচলিত এবং মর্মাহত ছিল। কিছুক্ষণ আমার দিকে তাকিয়ে থেকে এরপর শালিকটি আবার উড়ে চলে গেল অজানা উদ্দেশ্যের দিকে। আমি উঠে দাঁড়ালাম। এবার যেতে হবে। অনেক বিশ্রাম নেয়া হলো। কিছু দূর এগোতেই কতগুলো ছেলে ছোকরার হৈচৈ কানে এলো। সে সাথে তাদের বাঁধভাঙা উল্লাস দেখতে পেলাম। তারা যেন বিরাট কিছু জয় করেছে। এগিয়ে গেলাম দেখার জন্য। দেখলাম ছেলে ছোকরাদের হাতে দুটো শালিক ছানা। আর একটা বড় শালিক পায়ে সুতো বাঁধা। শালিকের ছানা দুটো নিয়ে ছোড়াছুড়ি খেলছে ছেলেরা আর বড় শালিকটাকে সুতায় টেনে টেনে খেলছে তারা। একটু আগে সাক্ষাৎ হওয়া শালিকটার কথা মনে পড়ে গেল। ঘটনা কি জানার আগ্রহ জন্মাল। এগিয়ে গেলাম ছেলেদের কাছে। জানতে চাইলাম ঘটনা। তারা প্রথমে আমার দিকে কিছুক্ষণ অপলক তাকিয়ে কী যেন ভাবল। তার পর নেতা গোছের ছেলেটা আমার সামনে এসে বলল, ‘আমরা প্রথমে গাছ থেকে শালিক ছানা দুটো ধরেছি। এর পর খাঁচায় ফাঁদ পেতে ছানা দুটোকে রেখে দূরে দাঁড়িয়ে থেকে বড় একটাকে ধরেছি আরেকটা পালিয়ে গেছে বলেই হা হা হা হা হা করে হাসিতে ফেটে পড়ল।
চুপ কর! মৃদু একটা ধমক দিলাম। ছেলেটা ঢোক গিলল। আমার চাহনি একটু কঠিন করলাম। চাহনি দেখে ছেলেটা ঘাবড়ালো না। কারণ এ যুগের ছেলেমেয়েরা আগের মতো বড়দের ভয় পায় না। আমি অনেকগুলো ছেলেমেয়েকে পড়াই। এদের সম্পর্কে আমার বেশ অভিজ্ঞতা রয়েছে। চাহনি বদলালাম। বড় শালিকটার দিকে একবার তাকালাম। পালানোর কোনো চেষ্টা দেখলাম না। গলা মোলায়েম করে বললাম, ‘তোমরা কি জান যে শালিকটা ধরা পড়েছে সেটা মা শালিক না বাবা শালিক’? ছোট একটা ছেলে পেছন থেকে উত্তর দিল, ‘এটা মা শালিক’।
আমি জানতে চাইলাম, ‘কী করে বুঝলে?’
সে বলল, ‘মা কখনো বাচ্চা রেখে পালায় না! বাচ্চাদের জন্য মায়ের ভালোবাসাই বেশি থাকে’! ছেলেটার কথায় আমি মুগ্ধ হলাম। আমি বললাম, তোমরা কি কাজটা ভালো করেছ? আমার কথা শুনে আরেকটা একরোখা ছেলে বলে উঠল ‘আপনার কি তাতে?’ তার আচরণে চুপসে গেলাম। এ যুগের ছেলেদের আচরণ যা হয় আর কি! মন খারাপ করে আবার হাঁটা ধরলাম গন্তব্যের দিকে। কিছুটা এগিয়েও গেলাম। পেছনে ছেলেদের উল্লাস আবার কানে এলো। পা দুটো নিথর হয়ে আসছে। যেন সামনে যাওয়ার ক্ষমতা হারিয়ে ফেললাম। আবার পেছন ফিরলাম। ‘এই শুন বলে’ ডাকলাম ছেলেদের। ওরা আর আমি আবার মুখোমুখি। আচ্ছা তোমরা এ শালিকগুলো দিয়ে কি করবা? ‘বিকালের দিকে পিকনিক করব’ একজন উত্তর দিল।
আমি বললাম তোমরা সংখ্যায় অনেক এ সামান্য শালিকে তোমাদের ভ‚রিভোজ হবে না। নেতা গোছের ছেলেটা এবার আমার একেবারে সামনে এসে দাঁড়িয়ে বলল, তো?
আমি বললাম, ‘আমি তোমাদের একটা ভালো প্রস্তাব দিতে চাই’। তারা একসাথে বলে উঠল ‘দেন’।
আমি তাদের বললাম, ‘তোমরা এই ছানাসহ শালিকটি আমার কাছে বেচে দাও। তার টাকায় তোমরা মুরগি বা মোরগ কিনে পিকনিক কর। তাহলে সবাই মিলে খেতে পারবে’। আমার কথা শুনে নেতা বলল, কত দিবেন আপনি? আমি সুযোগটি মিস করতে চাইলাম না। সাথে সাথে পকেট থেকে একটা কড়কড়ে পাঁচশত টাকার নোট বের করে তাদের দিকে এগিয়ে দিলাম। নেতা আমার নোটটা চোঁ মেরে নিল তারপর ছানা দুটো আর শালিকের সুতটি আমার হাতে ধরিয়ে দিল। অতঃপর তারা নাচতে নাচতে চলে গেল। আমি ছানা দুটোর দিকে তাকালাম। তারা ভয়ে কুঁকড়ে আছে। তারপর বসে মা শালিকটির সুতোর বাঁধ খুলে মুক্ত করে দিলাম। শালিকটি আমার মাথার আশপাশ ঘেঁষে উড়তে লাগল। আমি ছানা দুটো হাতে করে আবার সে জায়গায় ফিরে এলাম যে জায়গায় আমি প্রথম শালিকটির দেখা পেয়েছিলাম। আবারও সে পূর্বের স্থানে বসে পড়লাম। ছানা দুটো একটু দূরে করে পাশে রাখলাম। কারণ মা শালিকটি আশেপাশেই ঘোরাফেরা করছে। একটু বাদে মা শালিকটি ছানা দুটোর কাছে এসে তাদের খাওয়াতে লাগল। আমি অনড়ভাবে বসে আছি। আমার দৃষ্টি জোড়া দিগন্তের দিকে অপলকভাবে স্থির হয়ে রইল। যে দিগন্তে সে শালিকটি উড়ে চলে গিয়েছিল। সূর্যিমামা ক্রমে ক্রমে লাল আভা ছড়াচ্ছিল ততক্ষণে। কিছুক্ষণ বাদেই বিদায় নিবে দিনের আলো। মা শালিককে কাছে পেয়ে ছানাগুলো কিচিরমিচির করতে লাগল। হঠাৎ আমার গায়ের লোম শিউরে উঠল। আমাকে অবাক আর নির্বাক করে দিয়ে আচমকা প্রথম শালিকটি দিগন্তের সেদিক থেকে ফিরে আসতে লাগল। এসেই প্রথমে সে আম গাছের ডালে বসল। তারপর সোজা ছানাগুলোর কাছে নেমে এলো। সেও কিছুক্ষণ ছানাগুলোকে আদর করল। আমি তাকিয়ে সে দৃশ্য দেখে সুখ অনুভব করলাম। এভাবে কিছুক্ষণ যাওয়ার পর বড় শালিক দুটো এক সাথে আমার সম্মুখে এলো। একেবারে কাছে। যেন কৃতজ্ঞতা জানাবে। এদিকে প্রায় সন্ধ্যে হয়ে আসছে। না আমার ধারণা ভুল। তারা কৃতজ্ঞতা জানাতে নয়, আমার কাছে এসেছে কিছু বলতে আর বিদায় নিতে। আমি যদিও পাখির ভাষা বুঝি না তবুও কালো শালিকটার চোখে চোখ রেখে বোঝার চেষ্টা করলাম। আমার মনে হচ্ছিল আমি তাদের চোখের ভাষা পড়তে পারছি। তারা যেন আমায় বলছে, ‘যে জায়গার মানুষ অন্যের পরিবার ধ্বংস করে আনন্দ পায় সে জায়গায় আমরা আর থাকব না, আমাদের ছানাগুলোকে খেয়াল রাখবেন স্যার, আর আপনি সাবধানে থাকবেন কারণ আপনার মতো পাখিদের ভালোবাসে এমন নগন্য লোকের শত্রæ বেশি, ‘যারা পাখির জীবন নিয়ে ছিনিমিনি খেলতে পারে তারা নিজের স্বজাতীয়দের জীবন নিয়েও ছিনিমিনি খেলতে পারে’। আচমকা দুটো শালিকই এক সাথে উড়াল দিল দিগন্তের দিকে। যেন আজ তারা স্বাধীনতা পেল। এক সময় হারিয়ে গেল দৃষ্টি সীমানার বাইরে। তারা চলে যাবার পর বুঝতে পারলাম আমার ধারণা করা পাখিদের চোখের ভাষা ঠিক ছিল। জায়গার দোষ তো ছিল না! দোষ ছিল জায়গার কিছু বাসিন্দার। আমি মনে মনে পাখিদের উদ্দেশে আওড়াতে লাগলাম। ছানা দুটোর দিকে এক পলক তাকালাম। একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো। ছানা দুটো কোলে তুলে নিয়ে বাড়ির দিকে পা বাড়ালাম। সূর্য প্রায় অস্ত যাওয়ার পথে।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন