হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির খড়গ : আসামের এনআরসি এবং বাংলাদেশ
কিশোর শিক্ষার্থীদের নিরাপদ সড়ক দাবীর আন্দোলনে ঢাকাসহ সারাদেশে তীব্র রাজনৈতিক উত্তেজনা ও অনিশ্চয়তা দেখা যাচ্ছিল,
মোহাম্মদ আবদুল গফুর : কয়েকদিন আগে সাবেক সেনাপ্রধান এবং জাতীয় পার্টির প্রতিষ্ঠাতা জেনারেল হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ পার্টির এক সভায় আক্ষেপ করে বলেছিলেন, জনগণ জাতীয় পার্টিকে ভুলে গেছে, ভুলে গেছে এ পার্টির প্রতীক লাঙ্গলকেও। এ বিলম্বিত বোধোদয়ের জন্য জেনারেল এরশাদকে যেমন ধন্যবাদ দিতে হয়, তেমনি জাতীয় পার্টির এ দুরবস্থার পটভূমিরও একটা নৈব্যক্তিক পর্যালোচনা প্রয়োজন জেনারেল এরশাদের রাজনীতির সঠিক মূল্যায়নের স্বার্থে।
রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার অলিন্দে প্রবেশের ঠিক আগে এরশাদ ছিলেন বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর প্রধান। তিনি সে সময় বেশ কয়েকবার দেশ পরিচালনায় সশস্ত্র বাহিনীর একটা ভূমিকা থাকার উপর গুরুত্ব আরোপ করেন। তাঁর এ বক্তব্যের তাৎপর্য কয়েকদিন পরেই জনগণের কাছে প্রকাশ পেয়ে গেল, যখন তিনি এক সামরিক ক্যুয়ের মাধ্যমে একটি নির্বাচিত সরকারকে উৎখাত করে ক্ষমতা দখল করে বসলেন। রাষ্ট্রের মূল ক্ষমতা তাঁর হাতে থাকলেও বিচারপতি আহসানুদ্দিন চৌধুরীকে কিছু দিনের জন্য দেশের প্রেসিডেন্ট করলেন। পরে অবশ্য তিনি নিজেই প্রেসিডেন্ট হয়ে যান।
মজার ব্যাপার এই যে, জেনারেল এরশাদ একটি নির্বাচিত সরকারকে সামরিক ক্যুর মাধ্যমে উৎখাত করে ক্ষমতা দখল করে বসলে তার এই গণতন্ত্রঘাতী ভূমিকাকে প্রকাশ্যে সমর্থন জ্ঞাপন করেন আওয়ামী লীগের সভানেত্রী শেখ হাসিনা, সম্ভবত এই বিবেচনায় যে, উৎখাত হওয়া ঐ নির্বাচিত সরকারের নেতৃত্বে ছিল আওয়ামী লীগের প্রধান রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ বাংলাদেশ ন্যাশনালিষ্ট পার্টি (বিএনপি)। এতে অনেকের মনে হতে পারে যে, জেনারেল এরশাদ ছিলেন আওয়ামী লীগের সমর্থক।
তবে কেউ যাতে ধারণা করতে না পারে, সে জন্য তিনি প্রথম সুযোগেই জানান দিলেন যে, তিনি বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদে বিশ্বাসী । শুধু তাই নয়, তিনি প্রথম দিকে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলাকালে সব সময়ই শহীদ জিয়াউর রহমানের ছবি তার পাশে রাখতেন, যাতে তিনি যে শহীদ জিয়ার ভক্ত তার প্রমাণ হয়। তবে রাজনৈতিক পূর্ব অভিজ্ঞতা না থাকাতে এসব সাংবাদিক সাক্ষাৎকারে মাঝে মাঝে এমন ভুল করে বসতেন, যা তার রাজনীতির অনুকূলে যেত না। একবার এক সাক্ষাৎকারে এক ঝুনা সাংবাদিক তাঁকে প্রশ্ন করেন, বাংলাদেশে রাজনীতি ক্ষেত্রে কোন বড় ঘটনা ঘটলেই ভারতে তার তীব্র প্রতিক্রিয়া হয়, আপনার ক্ষেত্রে এমন কিছু ঘটনার আশংকা নেই তো? তিনি জবাবে বলে ফেলেন’ না, তাদের সঙ্গে আমার আগেই কথা হয়েছে।
জেনারেল এরশাদের রাজনৈতিক জীবন অভিনয় নৈপূণ্যে ভরপুর। তিনি একজন জেনারেল এবং ব্যক্তিগতভাবে যথেষ্ট ধনী হলেও তিনি যে সহজ সরল জীবন ধারায় বিশ্বাসী এটা প্রমাণ করতে ক্ষমতা দখলের পর প্রথম দিকে অনেক দিন অফিস করতেন সাইকেলে চড়ে এবং তাঁর সাইকেলে চড়ে অফিসে যাওয়ার ছবি যথারীতি সাংবাদপত্রে প্রেরিত ও প্রকাশিত হতো। কিন্তু রাজনীতিতে চমক সৃষ্টির উদ্দেশ্যে তাঁরএ অভিনয় প্রবণতা অল্পদিনের মধ্যেই সংশ্লিষ্টদের কাছে ধরা পড়ে যায়। নিজেকে ধার্মিক প্রমাণের লক্ষ্যে মাঝে মধ্যেই হঠাৎ তিনি কোন মফস্বল শহরের কোন মসজিদে গিয়ে জুমার জামাতে হাজির হতেন এবং মুসল্লিদের উদ্দেশ্যে বক্তৃতায় বলতেন, গতরাতে স্বপ্নে দেখি যে, আপনাদের এই মসজিদে নামাজ পড়ছি। তাই আজ চলে এলাম। সাধারণ মুসল্লিরা এতে চমৎকৃত ও খুশি হলেও যে সংশ্লিষ্ট সরকারি কর্মকর্তাদের দুই তিন দিন আগেই এ বিষয়ে অবহিত করা হয়েছিল তাদের কাছে এই অসত্য ভাষণের ব্যাপারটা ধরা পড়ে যেতো। ফলে তাদের কাছে এরশাদের বহুরূপী চেহারা ধরা পড়ে যেতো।
আগেই বলা হয়েছে, জেনারেল এরশাদ সামরিক ক্যুর মাধ্যমে একটি নির্বাচিত সরকারকে উৎখাত করে ক্ষমতা দখল করেন। ঐ নির্বাচিত সরকারের নেতৃত্বে ছিলেন তদানীন্তন বিএনপি নেতা বিচারপতি আবদুস সাত্তার। এটি ছিল ১৯৮২ সালের ২৪ মার্চের ঘটনা। কিন্তু এই সত্যকে চাপা দেয়ার উদ্দেশ্যে জেনারেল এরশাদ প্রচার করতেন যে, বিচারপতি আবদুস সাত্তার রাষ্ট্র চালাতে অসমর্থ হয়ে পড়ে তাকে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা গ্রহণে অনুরোধ জানালে তিনি ক্ষমতা গ্রহণ করেন। বিভিন্ন মাধ্যমে সরকারের অলিখিত নিষেধজ্ঞা থাকায় এই সত্য তখন প্রকাশ পায়নি।
এরপর এরশাদের শাসনামল চলা কালেই বায়তুল মোকাররম মসজিদের দক্ষিণ গেটে বেগম খালেদা জিয়ার সভানেত্রীত্বে এক জনসভা চলাকালে (পূর্ব পরিকল্পনা মোতাবেক) সেখানে আকস্মিকভাবে বিচারপতি আবদুস সাত্তার উপস্থিত হয়ে এরশাদের এতদিনের প্রচারিত বক্তব্য খ-ন করে জানান, আমাকে ক্ষমতা ত্যাগে বাধ্য করা হয়েছিল। আমি রাষ্ট্র চালাতে অসমর্থ হয়ে এরশাদকে ক্ষমতা গ্রহণের অনুরোধ জানিয়েছিলাম বলে যে প্রচার চালানো হচ্ছে, তা আদৌ সত্য নয়। লক্ষ লক্ষ লোকের উপস্থিতিতে জনসভায় বিভিন্ন সংবাদপত্রের প্রতিনিধিদের উপস্থিতিতে এই বক্তব্য দেয়ায় সংশ্লিষ্ট পত্রিকাসমূহ এ খবর প্রকাশের সংকল্প প্রকাশ করে। কিন্তু ঐ নিষেধাজ্ঞার অজুহাত দেখিয়ে এরশাদের সরকার তার অবস্থানে অটল থাকা এর পর দিন দেশে কোন সংবাদপত্র প্রকাশিত হতে পারেনি।
১৯৮২ সালের ২৪ মার্চ থেকে ১৯৯০ সালের ৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত এই ৯ বছর জেনারেল এরশাদ দেশে তাঁর স্বৈরাচারী শাসন চালান। এর পাশাপাশি চলে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির এরশাদবিরোধী আন্দোলন। তবে এই আন্দোলনে বিএনপি চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়া যতটা আন্তরিক ছিলেন, আওয়ামী লীগ নেত্রী শেখ হাসিনা যদি ততটা আন্তরিক থাকতেন তা হলে এরশাদের স্বৈরাচারী শাসন অতটা দীর্ঘস্থায়ী হতে পারতো না। এরশাদবিরোধী আন্দোলনে বেগম খালেদা জিয়া তাঁর নিরপেক্ষ ভূমিকার জন্য জনগণের কাছে আবির্ভূত হন আপোষহীন নেত্রী হিসেবে। তার সুফলও তিনি পান পরবর্তী সাধারণ নির্বাচনে।
ঐ নির্বাচনকে অবাধ ও নিরপেক্ষ করার লক্ষ্যে দেশের দুই প্রধান দলই নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানের ব্যাপারে একমত হন।
বাংলাদেশের তদানীন্তন প্রধান বিচারপতি শাহাবুদ্দিন আহমদের নেতৃত্বে গঠিত হয় বাংলাদেশের ইতিহাসের প্রথম নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার। ঐ সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে নিজ কেন্দ্রে ভোট দানের পর সাংবাদিকদের সাথে আলাপচারিতাকালে এক পর্যায়ে আওয়ামী লীগ নেত্রী শেখ হাসিনা বলেন, আমি সব জেলার খবর নিয়েছি। নির্বাচন অত্যন্ত সুষ্ঠু হয়েছে। আপনারা লক্ষ্য রাখবেন, কেউ যেন নির্বাচনে হেরে গিয়ে এর মধ্যে আবার কারচুপি আবিষ্কার না করেন। পরে যখন ভোট গণনা শেষে দেখা গেল আওয়ামী লীগ নয়, জয়ী হয়েছে বিএনপি,অবলীলাক্রমে তিনি বলে ফেললেন, নির্বাচনে সূক্ষ্ম কারচুপি হয়েছে! আর এরশাদের দল জাতীয় পার্টি জনগণ কর্তৃক প্রায় সম্পূর্ণ প্রত্যাখ্যাত হয়েছে।
অথচ স্বৈরাচারী এরশাদের শাসনামলে যে দু’একবার নির্বাচন হয় তাতে সব সময় এরশাদের দল বিপুল ভোটে বিজয়ী হতো। বাংলাদেশের রাজনীতি ক্ষেত্রে জেনারেল এরশাদের প্রবেশ যেমন ছিল সামরিক ক্যুয়ের মাধ্যমে, তেমনি তার রাজনৈতিক জীবনের প্রতিটি স্তরই ছিল স্বৈরাচার, মিথ্যাচার ও কপটতা আশ্রিত। এ পটভূমিতে বাংলাদেশের মতো গণতান্ত্রিক সচেতন জনগণের দেশে তার রাজনৈতিক জীবনের যে পরিনতি হওয়াছিল স্বাভাবিক ও অবধারিত- তাই ঘটেছে তার প্রতিষ্ঠিত জাতীয় পার্টিতে।
গত মঙ্গলবারের ঢাকার প্রায় সব সংবাদপত্রে জাতীয় পার্টির এই পরিনতির চিত্র ফুটে উঠেছে। নিচে একে একে জাতীয় পার্টির এই পরিনতি সংক্রান্ত খবরের শিরোনামগুলো দেয়া হলো :
(এক) দৈনিক ইনকিলাব-এ এ সম্পর্কে সংখ্যায় প্রতিবেদনের শিরোনাম হলো : এরশাদের জাপা দ্বিখ-িত।
(দুই) প্রথম আলোর প্রতিবেদনের শিরোনাম ছিল : জাপায় আবার ঝড়। জিএম কাদেরকে কো-চেয়ারম্যান করার পরের দিনই রওশনকে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান ঘোষণা।
(তিন) দৈনিক ইত্তেফাক-এর প্রতিবেদনের শিরোনাম : আবারো ভাঙনের আলামত জাপায় : রওশন একাংশের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান। এরশাদ বললেন, অসম্ভব, আমিই চেয়ারম্যান।
(চার) কালের কণ্ঠের প্রতিবেদনের শিরোনাম : রওশনকে জাপার ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান ঘোষণা একাংশের। অবৈধ বললেন এরশাদ।
(পাঁচ) সমকাল-এর প্রতিবেদনের শিরোনাম : ভাঙছে জাতীয় পার্টি। রওশন এরশাদকে দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান ঘোষণা করেছেন তার অনুসারীরা। নতুন কো-চেয়ারম্যান জিএম কাদেরকে অব্যাহতি। ঢাকায় ফিরে ব্যবস্থা নেবেন এরশাদ।
(ছয়) নয়া দিগন্ত এর প্রতিবেদনের শিরোনাম জাপায় বিদ্রোহ, রওশনকে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান ঘোষণা। আমিই চেয়ারম্যান রওশন অবৈধ (এরশাদ)।
অবশ্য পরবর্তীতে জানা গেছে, জোড়াতালির মাধ্যমে আওয়ামী সরকারের সাথে সম্পর্কচ্ছেদ করে এ যাত্রায় জাতীয় পার্টির ভাঙ্গন ঠেকাতে সমর্থ হয়েছেন। তবে দলের ভবিষ্যৎ কী হবে, তা অনিশ্চিতই রয়ে গেছে।
জাতীয় পার্টির প্রতিষ্ঠাতা জেনারেল এরশাদ যে পটভূমিতে যেভাবে রাজনীতিতে প্রবেশ করেন, তাতে তাঁর প্রতিষ্ঠিত জাতীয় পার্টির অন্য কোনরূপ পরিনতি হলে সেটাই হতো অস্বাভাবিক। যে পরিনতি হয়েছে সেটাই হয়েছে স্বাভাবিক নিয়মে এবং অবধারিত হিসেবে। জাতীয় পার্টির প্রতিষ্ঠাতা জেনারেল এরশাদ যেখানে নিজেই স্বীকার করেছেন যে, জাতীয় পার্টীর নাম কেউ নিতে চায় না, ভুলে গেছে পার্টির প্রতীক লাঙ্গলকে সেখানে জনগনের চোখে জাতীয় পার্টি তার ভারসৃর্তি যে সম্পূর্ণ তাতে আর বিস্ময়ের কি আছে। বাংলাদেশের মতো রাজনৈতিক সচেতন জনগণের দেশে এরকম দলের তো কোন অস্তিত্ব থাকার কথা নয়। তবুও যে দলটি এতদিন টিকে আছে, তার কারণ এ ধরনের বহুরুপী দল কারো কারো প্রয়োজন আছে।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।