Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

ভেজাইল্যার স্বাধীনতা

গল্প

| প্রকাশের সময় : ২০ মার্চ, ২০১৭, ১২:০০ এএম

কা জী সু ল তা নু ল আ রে ফি ন
চোখের কোনে অশ্রæর জমাট বাঁধা থাকে সব সময় আমেনা বেগমের। আর নিচের অংশে কালি জমা তো আছেই। ছেলেকে হারিয়েছেন আজ প্রায় ৪৫ বছর হয়ে গেছে। এই ৪৫ বছরেও চোখের সে কালি মুছেনি। উনার বয়সও ৭০ পেরিয়ে গেছে। চোখে একেবারে ঝাপসা দেখেন। স্বামী রবিউল হক মারা গেছেন আজ প্রায় ২০ বছর হল। তিনিও এখন যাওয়ার পথে। কিন্তু মনের আক্ষেপ আর দীর্ঘশ্বাস সময়ে সময়ে জেগে উঠে। ভেজাইল্যার কথা এখনো মনে জেগে উঠে উনার। যুদ্ধের সময় ভেজাইল্যার বয়স হবে ষোল বা সতের মাত্র! ভেজাইল্যা ছিল আমেনা বেগমের অল্প বয়সে বিয়ের প্রথম ছেলে। পরের ছেলেদের ঘরে জন্ম নেয়া নাতী নাতনীরাও আজ অনেক বড় হয়ে গেছে। নাতী নাতনীদের কাছে আমেনা বেগম তাদের বাবা আর কাকাদের বড় ভাই ভেজাইল্যার গল্প করেন মাঝে মাঝে। তারাও খুব আগ্রহ দেখায় শুনার জন্য। তারা মাঝে মাঝে আফসোস করে, ইস! তাদের এই বড় চাচা আজ থাকলে তারা আরও অনেক আদর পেত! আজ দুপুরে খাওয়ার পরে আবারো নাতী নাতনীরা তাদের হারিয়ে যাওয়া বড় চাচা সম্পর্কে জানতে চায়। আমেনা বেগম একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে দিয়ে সে কাহিনী আবারো শুরু করলেন। ভেজাইল্যার ভাল নাম ছিল ‘সলিম’। জন্মের পর থেকে ‘সলিম’ যখন বড় হতে শুরু করে তখন তার সাথে এটা ওটা নিয়ে প্রায়ই অনেকের ভেজাল হতে থাকে। কারনে অকারণে ভেজাল। খেলার সাথীদের সাথে থেকে শুরু করে ঘরে মা বাবার সাথে সে এটা ওটা নিয়ে কারনে অকারনে ভেজাল করে। আজ ওকে এটা কিনে দিতে হবে! ওইটা খেতে দিতে হবে! ইত্যাদি বলে বলে ঘরে ভেজাল করতো সে। খেলার মাঠে খেলার সাথীদের সাথে ভেজাল করতো ‘এভাবে খেললে হবে না! তাকে সবার আগে সব সুবিদা দিতে হবে’! বন্ধুরাও তার উপর যারপরনাই বিরক্ত। ধীরে ধীরে এলাকায় তার নাম সলিম থেকে ‘ভেজাইল্যা’ বলে প্রচার হতে থাকে। এক সময় ঘরের মা বাবাও বিরক্ত হয়ে সলিমকে ‘ভেজাইল্যা’ বলে ডাকা শুরু করে। ভেজাইল্যার বাবা রবিউল হকও ভেজাইল্যার উপর বিরক্ত হতে থাকেন। সময় সময় তিনি তাকে মারার জন্য তেড়ে আসেন। কিন্তু মা আমেনা বেগম ছেলেকে সব সময় নিজের আঁচলের নীচে রাখতে চাইতেন। ভেজাইল্যা মায়ের কথা মত মায়ের কাছে থাকতে চাইত না। সে ঘর থেকে বেরিয়ে বাইরে বাইরে ঘুরে বেড়াতো। ১৯৭১ সালে ২৫ মার্চ কালো রাত্রিতে এদেশে পাক হানাদাররা লুটপাট আর হত্যা শুরু করে। সে খবর ভেজাইল্যাদের গ্রামে আসতেই ভেজাইল্যা খুব ছটফট করতে থাকে। এদিক সেদিক পায়চারী করতে থাকে। ছেলেকে চিন্তিত দেখে আমেনা বেগম বুঝাতে চান। কিন্তু ভেজাইল্যা মাকে উত্তর দিল, ‘এটা মেনে নেয়া যায় না’! আস্তে আস্তে পাক হানাদার পশুরা ভেজাইল্যাদের পাশের গ্রাম অবদি পৌঁছে যায়। এক রাতে গুলির শব্দে ভেজাইল্যার ঘুম ভেঙ্গে যায়। সে ঘুম থেকে উঠে মা বাবাকে ডেকে তুলে তারপর সালাম করে বিদায় নিতে চায়। ভেজাইল্যার মা বাবা জানতে চায়, ‘এত রাতে কই যাচ্ছিস’?
-‘আমি তো ভেজাইল্যা তাই পাক হানাদারের সাথে ভেজাল করতে যাচ্ছি’! ভেজাইল্যা উত্তর দিল।
-‘কার সাথে যাচ্ছিস? কোথায় যাচ্ছিস’? প্রশ্ন করেই আমেনা বেগম হাউ মাউ করে কান্না শুরু করে দিলেন।
-‘মা আমার সাথে মুক্তি বাহিনীর সাথে যোগাযোগ হয়েছে। এসব মেনে নেয়া যায় না। ভেজাল করে আমাদের দেশকে মুক্ত করতে হবে! তোমরা আমাকে আদর করে ভেজাইল্যা বলে ডাক! দেশের এই খারাপ সময়ে আমি যদি ভেজাল না করি তবে কি চলবে?’ বলেই ভেজাইল্যা ঘর থেকে বেরিয়ে আঁধারে হারিয়ে গেল। ভেজাইল্যার মা বাবা পিছন থেকে ডাকার চেষ্টা করলেন না। কারণ ভেজাইল্যাকে কোনোদিন বাধা দিয়ে কোন লাভ হয়নি। আজো হবে না। অবশেষে শত্রæদের হাত থেকে দেশ ফিরেছে। ফিরেছে স্বাধীনতা। কিন্তু ভেজাইল্যা আর ফিরে আসেনি। সেই থেকে আমেনা বেগমের চোখের কোণে অশ্রুরা জমাট বেঁধে থাকে। চোখের পানি ঝরাতে চাইলেও ঝরে পড়ে না।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন