Inqilab Logo

রোববার, ২৮ এপ্রিল ২০২৪, ১৫ বৈশাখ ১৪৩১, ১৮ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

আইনি জটিলতায় ৮০ ভাগ কিডনি রোগীই প্রতিস্থাপনের বাইরে

| প্রকাশের সময় : ৯ মার্চ, ২০১৭, ১২:০০ এএম

আজ বিশ্ব কিডনি দিবস : জীবন দানে আইন সংশোধনে গুরুত্বারোপ ভুক্তভোগী ও বিশেষজ্ঞদের
হাসান সোহেল : মেহেরুন্নেসা মুবাশ্বির। রাজধানীর একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের বিবিএ শিক্ষার্থী। বয়স ২৫-এর কোঠা অতিক্রম করতে এখনো ঢের বাকি। পিতৃহারা মেহেরুন্নেসা ৫ বোনের মধ্যে তৃতীয়। যে বয়সে তারুণ্যের উচ্ছলতায় বর্ণিল প্রজাপতির মতো উড়ে বেড়ানোর কথা, সেই বয়সেই কঠিন রোগে আক্রান্ত হয়ে প্রায় শয্যাগত মেহেরুন্নেসা। চিকিৎসক জানিয়েছেন, তার দুটি কিডনি বিকল হয়ে পড়েছে।
বেঁচে থাকার জন্য সপ্তাহে ৪ বার ডায়ালাইসিস করতে হচ্ছে। কিন্তু তার পরিবারের পক্ষে এই ব্যয়বহুল চিকিৎসা চালানো এক প্রকার অসম্ভব। চিকিৎসকরা তাই কিডনি প্রতিস্থাপনের পরামর্শ দিয়েছেন। কিন্তু সেখানেই যত প্রতিবন্ধকতা আর অসহায়ত্ব। ইনকিলাবের কাছে অশ্রæসজল চোখে এসব কথা জানান তিনি। মেহেরুন্নেসা জানান, পরীক্ষা-নিরীক্ষায় কিডনি বিকল হওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত হওয়ার পর বরেণ্য চিকিৎসক প্রফেসর ডা. হারুন উর রশীদ ও প্রফেসর ডা. মো. কামরুল ইসলামের কাছে যান।
তারা প্রত্যেকেই তার অবস্থা বিবেচনা করে কিডনি প্রতিস্থাপনের পরামর্শ দেন। প্রতিস্থাপনের পূর্বপর্যন্ত ডায়ালাইসিস চালিয়ে যাওয়ার নির্দেশ দেন। যেখানে প্রতি ডায়ালাইসিসে ৪ থেকে ৬ হাজার টাকা প্রয়োজন সেখানে মাত্র দেড় থেকে দুই লাখ টাকার মধ্যে দেশেই কিডনি প্রতিস্থাপন সম্ভব। তাই ডায়ালাইসিস ব্যয়বহুল হওয়ায় তিনি প্রতিস্থাপনের চেষ্টা শুরু করেন। ৫ বোনের মধ্যে একজনের সঙ্গে রক্তের গ্রæপে মিল থাকলেও বয়সে ছোট হওয়ায় তার কিডনি নেয়া যাচ্ছে না। এই অবস্থায় আপন খালাতো বোন কিডনি দেতে আগ্রহ প্রকাশ করেন। কিন্তু চিকিৎসকরা খালাতো বোনের কিডনি নিতে অস্বীকৃতি জানান। চিকিৎসকরা জানান, মানবদেহের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ সংযোজন আইন ১৯৯৯ অনুযায়ী শুধুমাত্র স্বামী-স্ত্রী, প্রাপ্তবয়স্ক পুত্র কন্যা, পিতা মাতা, প্রাপ্তবয়স্ক ভাই, বোন, রক্ত সম্পর্কিত চাচা, ফুপু, মামা, খালা ছাড়া কারও কিডনি নেয়া যাবে না। এক্ষেত্রে চিকিৎসকরা তাকে দেশে প্রতিস্থাপন না করে বিদেশে যেতে পরামর্শ দেন। পার্শ্ববর্তী দেশে খোঁজ নিয়ে তিনি জানতে পারেন- কিডনি প্রতিস্থাপনে ১৮ থেকে ২০ লাখ টাকা প্রয়োজন। এই টাকা যোগাড় করা তার বা তার পরিবারের পক্ষে একেবারেই অসম্ভব। আর চিন্তায় একপ্রকার কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে অসুস্থ থেকে অসুস্থতর হয়ে পড়ছেন মেহেরুন্নেসা। তার দু’চোখের গহŸরে এখন শুধুই শূন্যতা।  
সূত্র মতে, ঠিক এরকম একটি ঘটনার প্রেক্ষিতে ২০১৫ সালের ফেব্রæয়ারি মাসে মানবদেহে অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ সংযোজন ও প্রতিস্থাপনের দুটি ধারা (আইন) কেন বে-আইনি ও অবৈধ ঘোষণা করা হবে না তা জানতে চেয়ে রুল জারি করেন হাইকোর্ট। আদালতে আবেদনের পক্ষে শুনানি করেন ড. ইউনুছ আলী আকন্দ। অপরদিকে রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন বিশ্বজিত রায়।
শুনানিতে আইনজীবী ইউনুস আলী আকন্দ বলেন, মানবদেহে অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ সংযোজন আইন ১৯৯৯-এর ২(খ) ও (গ)তে বলা আছে রক্ত সম্পর্কীয় পুত্র, কন্যা, পিতা, মাতা, ভাই, বোন ও আপন চাচা, ফুফু, খালা এবং স্বামী-স্ত্রীকে অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ প্রতিস্থাপন করতে পারবে। কিন্তু এ্যাপোলো হাসপাতালে বর্তমানে (তৎকালীন) চিকিৎসাধীন মো. বাবুলকে তার মামাত ভাই এমএ রশিদ কিডনি দান করতে চাইলে হাসপাতাল থেকে সেটি গ্রহণ করতে রাজি হয়নি। কিডনি প্রতিস্থাপন করতে চাইলে আদালতের আদেশ নিয়ে আসতে বলা হয়। তখন এমএ রশিদ হাইকোর্টে (ওই আইনটি চ্যালেঞ্জ করে) এ সংক্রান্ত একটি রিট আবেদন করেন। আইনি জটিলতায় কিডনি রোগীরা প্রতিনিয়ত এভাবে ধুঁকে ধুঁকে মারা যাচ্ছেন।  অন্যথায় ভিটে-বাড়ি বিক্রি করে পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে চিকিৎসা করাচ্ছেন।
জানা গেছে, দেশে কিডনি প্রতিস্থাপন শুরু হওয়ার পর একটি দালালচক্র তৈরি হয়। যারা মিথ্যে বলে অশিক্ষিত, দরিদ্র মানুষদের ভুলিয়ে কখনোবা জোর করে কিডনি নিয়ে বিক্রি করত। একপর্যায়ে কিডনি বেচাকেনা বাণিজ্যে পরিণত হয়। এই পরিস্থিতি প্রকট আকার ধারণ করলে সরকার এই আইন প্রণয়ন করে।
তবে আইনি বাধ্যবাধকতায় দেশে কিডনি প্রতিস্থাপন অস্বাভাবিক হারে হ্রাস পেয়েছে বলে জানিয়েছে সংশ্লিষ্ট চিকিৎসকরা। তারা বিপুলসংখ্যক মানুষের জীবন বাঁচাতে এই আইনের কিছুটা সংশোধনের দাবি জানান। বিশেষজ্ঞরা বলেন, কিডনি প্রতিস্থাপনের চাহিদা অনুযায়ী দেশে যথেষ্ট পরিমাণে সংকট রয়েছে। আইনি জটিলতা, পরিবার ছোট হওয়ায় দাতা না থাকা এবং দান পরবর্তী দাতাদের শারীরিক সমস্যাসহ বিভিন্ন কিডনি রোগীদের প্রতিস্থাপন অনেকটা সঙ্কটাপণ্য। অবস্থার উত্তরণে উন্নত দেশের মতো মৃত ব্যক্তির শরীর থেকে সংগ্রহ করা প্রয়োজন। অন্যথায় বিপুলসংখ্যক কিডনি রোগী বাঁচানো অসম্ভব।
সম্প্রতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) কিডনি প্রতিস্থাপনবিষয়ক এক সংবাদ সম্মেলনে দেশের প্রথম কিডনি প্রতিস্থাপনকারী বিশেষজ্ঞ প্রফেসর এমএ ওয়াহাব, প্রফেসর গোলাম কিবরিয়া, প্রফেসর এ এ সালাম, প্রফেসর এস এ খান, রফিকুল আলম, নেফ্রোলজি বিভাগের চেয়ারম্যান প্রফেসর শহিদুল ইসলাম সেলিম, প্রফেসর ডা. হাবিবুর রহমান দুলাল এ আইনের সংশোধনের মাধ্যমে কিডনি রোগীদের জীবন বাঁচানোর আহŸান জানান।   
তারা বলেন, পৃথিবীব্যাপী ক্রনিক কিডনি রোগের প্রকোপ দিন দিন বাড়ছে। বাংলাদেশে প্রায় দুই কোটি মানুষ কিডনি রোগে আক্রান্ত। গড়ে ৩৫ হাজার রোগীর কিডনি স্থায়ীভাবে অকার্যকর হয়ে পড়ে। এর মধ্যে মাত্র ২০ ভাগ রোগী কিডনি প্রতিস্থাপনের আওতায় আসেন। বাকি ৮০ ভাগই প্রতিস্থাপনের বাইরে থেকে যান। এ রোগ হলে বাঁচার উপায় দুটি, কিডনি নিয়মিত ডায়ালাইসিস এবং প্রতিস্থাপন। ডায়ালাইসিস অত্যন্ত ব্যয়বহুল চিকিৎসা, তাই সবার পক্ষে এই প্রক্রিয়ায় বেঁচে থাকা সম্ভব নয়। কিন্তু প্রচলিত আইনে কিডনি প্রতিস্থাপন বেশ কঠিন হয়ে পড়েছে। এ ক্ষেত্রে বিপুলসংখ্যক কিডনি রোগী বাঁচতে ‘মানব দেহের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ সংযোজন আইন’ সংশোধন করা প্রয়োজন।
এদিকে আজ ৯মার্চ বিশ্ব কিডনী দিবস। দিবসটির এবারের প্রতিপাদ্য ‘স্থ’ূূূলতা কিডনি রোগ বাড়ায়, সুষ্ঠু জীবন-যাপনে সুস্থ কিডনি।’ দিবসটি উপলক্ষে এবং কিডনিকে সুস্থ রাখতে সচেতনতামূলক বিভিন্ন কার্যক্রম হাতে নিয়েছে সামাজিক-সাংস্কৃতিক ও স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন এবং বিভিন্ন মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল। দিবসটি উপলক্ষে প্রেসিডেন্ট মো. আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পৃথক পৃথক বাণী দিয়েছেন। দিবসটি উপলক্ষে আজ বাংলাদেশ রেনাল এসোসিয়েশন, কিডনি ফাউন্ডেশন ও ক্যাম্পস যৌথভাবে র‌্যালি ও আলোচনা সভাসহ বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ করেছে। মাসব্যাপী ফ্রি চিকিৎসা সেবা প্রদান করছে ইনসাফ বারাকাহ কিডনি হাসপাতাল। একই সঙ্গে গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের উদ্যোগে আজ এক জনসচেতনতামূলক সেমিনারের আয়োজন করা হয়েছে। অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রীর সাবেক স্বাস্থ্য উপদেষ্টা প্রফেসর ডা. সৈয়দ মোদাচ্ছের আলী উপস্থিত থাকবেন। এদিকে কর্মীদের স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তার বিষয়টি মাথায় রেখে কিডনি রোগের সচেতনতামূলক ক্যাম্পেইনের আয়োজন করে মোবাইল ফোন অপারেটর রবি। কেএএমপিএস’র (কিডনি অ্যাওয়ারনেস মনিটরিং অ্যান্ড প্রিভেনশন সোসাইটি) খ্যাতিমান কিডনি বিশেষজ্ঞ প্রফেসর ডা. এম.এ. সামাদ সেশনটি পরিচালনা করেন।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: কিডনি

৩ ডিসেম্বর, ২০২১
১১ মার্চ, ২০২১
২৮ ফেব্রুয়ারি, ২০২০
২২ ফেব্রুয়ারি, ২০১৯
২০ ফেব্রুয়ারি, ২০১৯

আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ