Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

একুশের চেতনার বাস্তবায়ন ছাড়া প্রকৃত সম্মান প্রদর্শন হয় না

| প্রকাশের সময় : ২১ ফেব্রুয়ারি, ২০১৭, ১২:০০ এএম

আবদুল আউয়াল ঠাকুর : সাধারণত একুশের কথা উঠলেই আমরা মায়ের ভাষায় কথা বলি। অবশ্যই মায়ের ভাষার প্রতি সম্মান প্রদর্শনকে নিয়েই সব কিছুর সূত্রপাত। তবে এটাই সব বা শেষ কথা নয়। একুশের একটি রাজনৈতিক ভাষা ছিল এবং আছে। অনেকেই হয়ত বলবেন স্বাধীন দেশ প্রতিষ্ঠার পর একুশের রাজনৈতিক ভাষার আর বাকি থাকল কি? একটি স্বাধীন দেশের প্রতিষ্ঠা তথা ভাষাও আঞ্চলিক নির্যাতন নিবর্তনের অবসানে যে একুশ প্রতিবাদের ঝড় তুলেছিল তার অন্তনির্হিত চেতনা ছিল একটি বহুদলীয় গণতান্ত্রিক সমাজ বিনির্মাণ। এই চেতনা ও প্রেরণা ধারণ করেই মূলত সেদিনের ছাত্র-যুবসমাজ একাট্টা হয়েছিল। এখন জনে জনে যে ব্যাখ্যাই দেন না কেন সেদিনে মূল বিষয় ছিল স্বাধীনমত বাঁচতে চাই, নিজের কথা নিজের মত করে বলতে চাই, নিজের ভাবনায় দেশ ও জাতিককে সমৃদ্ধ করতে চাই। অথচ দীর্ঘ সময় ধরে একটি স্বাধীন দেশে একুশ উদযাপন করার পর যে অবস্থা দাঁড়িয়েছে তাহলো আমরা ক্রমশ আমাদের জাতীয় সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্র্যবোধ যেন হারিয়ে ফেলতে বসেছি। চিন্তাচেতনা, মেধা-মননেও এক চরম খড়া চলছে এই দেশে। জাতীয় চিন্তা বিকাশে সহায়তার পরিবর্তে বিদেশি বিশেষ করে ভারতীয় সংস্কৃতির এক রমরমা বাণিজ্যের লিলাভূমিতে পরিণত হয়েছে দেশটি। প্রকাশ্য কেউ কিছু না বললেও মনে হয় এটা গেলানোই যেন একটা অলিখিত বিধানে পরিণত হয়েছে। বিষয়টি নিয়ে কেবল একুশ এলেই ভাবতে হবে এমনটা না হলেও স্মৃতির দিনেই পুরনো কথার পর্যালোচনা হয়। অমরা কি সত্যিই ভুলে যেতে বসেছি যে আমাদের স্বকীয়তা হারাতে বসেছি আমরা? সে কারণেই একুশকে ভাবতে হবে জাতীয় বিকাশের বিবেচনায়। বাস্তবত একুশ এখন পরিণত হয়েছে আনুষ্ঠানিকতায়। পদক নেয়া আর ভাষণ দেয়ায়। সেই ভাবনা থেকেই মূলে ফিরে যাবার চেষ্টা।
আবদুল মতিন, প্রিন্সিপাল আবুল কাশেম, অলি আহাদ, গোলম মাহবুব, অধ্যাপক আবদুল গফুর গাজীউল হাসান, আবদুল গাফফার চৌধুরীদের নাম যখন উচ্চারিত হয় তখন তাদের কোন পরিচয় পরিচিতির প্রয়োজন হয় না। যে কেউ এক বাক্যে স্বীকার করবেন ভাষা অন্দোলনের মহান কর্ণধরদের কথাই বলা হচ্ছে। তেমনিভাবে যখন শহীদ রফিক, শফিক, বরকতদের আলোচনা হয় তখনও বলে দেয়ার প্রয়োজন নেই এরা কোথায় কখন কি কারণে শহীদ হয়েছেন। এক বাক্যে সকলে মিলে বলে উঠবেন মহান ভাষা শহীদদের কথাই বলা হচ্ছে। নিজের অজান্তেই সশ্রদ্ধ চিত্তে মাথা অবনমিত হবে তাদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে। ঠিক তেমনটি ঘটে যখন তমদ্দুন মজলিসের কথা বলা হয়। সকলেই স্বীকার করেন সেই মহান ভাষা আন্দোলনের সংগঠক সংগঠনের কথাই বলা হচ্ছে। এর মূল কারণ ভাষার লড়াই ছিল এদেশের মানুষের প্রাণের দাবি। প্রত্যেকের মন ছুঁয়ে গিয়েছিল। আজো আমরা প্রতি বছর ভাষা আন্দোলনের সেই রক্তঝরা দিনটিকে স্মরণ করি বিন¤্রচিত্তে পরম শ্রদ্ধায় ও ভালবাসায়। দেশের অলিগলি প্রান্তে সর্বত্রই পালিত হয় দিবসটি। কোন সরকারি ফরমানের কারণে নয় বরং নিজের মায়ের ভাষার প্রতি মায়ের প্রতি ভালবাসাও এর চেতনার প্রতি সম্মান প্রদর্শনের নিদর্শন হিসেবেই। এই যে ভালবাসা গভীর শ্রদ্ধাবোধ এর মূলে রয়েছে প্রগাঢ় দেশপ্রেম। আজকের বাস্তবতাতে যদি ভাষা আন্দোলনের চেতনাকে বিশ্লেষণ করা যায় তাহলে মৌলিক কিছু বিষয় উঠতে পারে। সে বিবেচনায় দেখার রয়েছে যে চেতনা নিয়ে ভাষার আন্দোলন হয়েছিল সেই সাংস্কৃতিক চেতনা এবং যে রাজনৈতিক আবহ গড়ে তোলার একান্ত অনুভব-অনুভূতি নিয়ে দেশের তরুণ ছাত্রসমাজ ঝাঁপিয়ে পড়েছিল তার প্রতি কি যথাযথ সম্মান আমরা করছি। একটি সুস্থ সংস্কৃতি রক্ষার লড়াই এখন গুরুতর হয়ে উঠেছে। দেশ বিজাতীয় সংস্কৃতির গড্ডালিকা প্রবাহে ভেসে যাচ্ছে। অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে যেন বিজাতীয়রাই ঠিক করে দিচ্ছে আমাদের পোশাক-আশাক। এমনকি সাংস্কৃতিক চিন্তাচেতনার বিষয়াবলীও। অন্যদিকে রাজনীতি কার্যত রুদ্ধ হয়ে পড়েছে এক ধরনের খামখেয়ালপিনায়।
একুশ ফেব্রুয়ারি বা আট ফাল্গুন আমাদের চেতনায় এমনভাবে মিশে আছে যে, আলাদা করে জানান দেয়ার প্রয়োজন নেই। বছরের দিনপঞ্জিতে যে কয়টা দিন কোন ঘোষণার অপেক্ষা না করেই জাতীয় চেতনায় জাগরিত হয়ে উঠে মহান ভাষা দিবস তার একটি। রক্তের শিরায় শিরায় চেতনার গভীরতম প্রদেশে এই দিনটির অবস্থান বিধায় একে উপড়ে ফেলার কোন সুযোগ নেই। বাংলা আমাদের ভাষা হওয়া সত্ত্বেও একুশ ফেব্রুয়ারিকে বাংলায় পরিণত করার মধ্যদিয়ে সম্ভবত একুশের সংস্কৃতির সাথে পাশ্চাত্য সংস্কৃতির কিছুটা সমন্বয় করা হয়েছে। হয়তো এ বিবেচনায় বলা যায়, পাশ্চাত্যের গণতান্ত্রিক আন্দোলন এবং আমাদের ভাষা আন্দোলন আন্তঃযোগ সূত্রে গ্রোথিত। গণতান্ত্রিক অধিকার বঞ্চনার প্রতিবাদের দাবি আর ভাষার দাবি সূত্রবদ্ধ। বাস্তব হচ্ছে, গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য রক্ত দেয়া হয়েছে এবং হচ্ছে। অন্যদিকে ভাষার লড়াই এখন যতটা রাজপথে তার চেয়ে বোধ, বিশ্বাসের লড়াইয়ে অনেক বেশী চলমান। ভাষা দিবসের ভাষা নিয়ে কথা বলতে গেলে সঙ্গতই গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির প্রশ্ন উঠে আসবে। ব্যাপারটা হয়তো কারো কাছে অস্পষ্ট এবং কারো কাছে স্পষ্ট। যেভাবেই বলা যাক না কেন, আমাদের ভাষা, আমাদের সংস্কৃতি এবং এর অস্তিত্ব রক্ষার লড়াই ঐতিহাসিককাল থেকেই ভিন্ন বাস্তবতায় বিবেচিত হয়ে আসছে। সে কারণেই প্রতিবারই ভাষা দিবসটি নতুন দাবি নিয়ে আমাদের সামনে উপস্থিত হয়। যেভাবে বা যে দাবি নিয়েই একুশ আমাদের কাছে আসুক না কেন, কেবলমাত্র আনুষ্ঠানিকতার বিবেচনায় একুশ পালন যে সঙ্গত নয় তার উল্লেখ না করাই যুক্তিসঙ্গত।
যেহেতু ভাষার ইজ্জত, সম্ভ্রম এবং মর্যাদা রক্ষার প্রয়োজনে মূলত আমাদের আত্মপ্রতিষ্ঠায় পূর্বসূরিরা নিজেদের সর্বোত্তম ভালোবাসার ধন জীবনকে উৎসর্গ করেছেন সে কারণেই আমাদের ভাষার অন্তর্নিহিত শক্তি অনস্বীকার্য। কেবলমাত্র মনের ভাব প্রকাশের যে বৈয়াকরণিক নীতির তার বাইরেও আমাদের ভাষা ভিন্নকিছু। কারণ ভাষার দাবিতে নিজেদের অধিকার প্রতিষ্ঠার লড়াই কোন ব্যাকরণে লিপিবদ্ধ নেই। তবু তা হয়েছে। এই বিধিভঙ্গের মধ্যদিয়ে জাতীয় যে সম্ভাবনা দেখা দিয়েছিল তার ইতিবাচক প্রভাবই আজকের বাস্তবতা। যে ভাষায় আমরা কথা বলি, যে ভাষায় আমরা নিজেদের জাহির করি কার্যত তা টিকে আছে আমাদের মতোই নিরন্তর সংগ্রাম করে। প্রাকৃতজনের এই ভাষা হয়তো হারিয়ে যেত যদি না রাজনৈতিক বিজ্ঞজনদের হাতের ছোঁয়া না পরতো। সে বিবেচনায় ভাষা এবং রাজনীতির মধ্যে সেতুবন্ধন রয়েছে। বৃহত্তর অর্থে এটি হচ্ছে গণতান্ত্রিক। সুতরাং ভাষা এবং গণতন্ত্রকে আমাদের দেশে আলাদা করে ভাবার সুযোগ খুব কম। গণতন্ত্রের অর্থ যদি বহুদলীয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা হয় তাহলে অবশ্যই সেখানে মত প্রকাশের বিষয়টি সর্বাগ্রে বিবেচিত হবে। এটা বলা দরকার, আমাদের ভাষার লড়াই প্রকৃতপক্ষে বহুদলীয় গণতান্ত্রিক চিন্তাচেতনার সাথে মিলে রয়েছে। ভাষার আন্দোলনে বামপন্থীদের সম্পৃক্ততা থাকা সত্ত্বেও এটাই শেষ কথা যে, বহুদলীয় গণতান্ত্রিক লড়াইয়ের অনুকূলেই ভাষার লড়াই বিজয়ী হয়েছে এবং এটাও হয়তো বলা সঙ্গত যে, আমাদের গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া যখনই ব্যাহত হয়েছে, ভাষার চলার পথও আক্রান্ত হয়েছে। বলা যায, যেভাবে অথবা যে প্রত্যাশায় ভর করে গণতন্ত্রের আকাক্সক্ষা উচ্চারিত হয়েছিল কার্যত তা এখন বহাল নেই। এই না থাকার প্রসঙ্গ নানা কথাকে স্মরণ করে দেয়। বর্তমান প্রেক্ষাপটে সকলেই একমত যে, গণতন্ত্রের সঙ্কটকাল চলছে। কিন্তু কেন? ’৫২ সাল থেকে নানা প্রতিবাদের মধ্যদিয়ে এগুতে এগুতে রক্তাক্ত স্বাধীনতা সংগ্রাম শেষে যে স্বাধীন দেশটি প্রতিষ্ঠিত হলো সেখান থেকে অগণতান্ত্রিক আশঙ্কা মুক্ত হচ্ছে না কেন? এর দায় অবশ্যই রাজনীতিকদের উপরই বর্তাবে। কারণ দেশের স্বাধীনতা লড়াইয়ের কৃতিত্ব যেহেতু তারা দাবি করেন নিন্দাবাদও তাদেরই প্রাপ্য। হালকাভাবে দেখার কোন সুযোগ নেই যে, গণতন্ত্র বিপন্ন হলে দেশ বিপন্ন হবে। দেশ বিপন্ন হলে আমাদের ভাষার অস্তিত্ব বিপন্ন হতে পারে। আরও সুনির্দিষ্ট করে বলা যায়, আমাদের ভাষা ও সংস্কৃতির বিরুদ্ধে ঐতিহাসিকভাবে যারা চক্রান্ত করে আসছে কার্যত তারাই আমাদের স্বাধীনতার প্রধান প্রতিপক্ষ। আর এমনটা হলে আমাদের বিকাশের সকল পথই রুদ্ধ হয়ে পড়বে। আজকের প্রেক্ষাপটে কার্যত ভাষা অবরুদ্ধ হয়ে পড়েছে। যে ভাষায় অমরা লড়াই করেছি সে ভাষা বদলে দেয়ার অপচেষ্টা অব্যাহত রয়েছে। সে বিবেচনাতেই বলা যায়, গণতন্ত্র রক্ষার পাশাপাশি ভাষার অস্তিত্ব রক্ষার লড়াই এক ও অভিন্ন সত্ত্বায় পরিণত হয়েছে।
ভাষা আন্দোলনের সেই ঐতিহাসিক সময়ের পর্যালোচনায় বলা যায় রাষ্ট্রীয়ভাবে নাহলেও জনগণের ব্যাপক ভালবাসার পৃষ্ঠপোষকতা ছিল ভাষার অন্দোলনের প্রতি। সে কারণেই সেদিন ভাষার লড়াই বিজয়ী হয়েছিল। আজ সমাজ-রাষ্ট্রে যে বিভাজন নীতি সক্রিয় রয়েছে তার সাথে একুশের কোন সম্পর্ক তো নেইই বরং এটা একুশের চেতনার সাথে সাংঘর্ষিক। এর প্রভাব রয়েছে ভাষাতেও। আমাদের সাংস্কৃতিক চর্চায় শব্দ ব্যবহারে নিত্যদিনের আচারে ভিনদেশি ভাষার ও সংস্কবৃতির আগ্রাসনের অলামত স্পষ্ট। এর বিহিত-বিধানের দায়িত্ব মূলত জনগণের হাতেই। সে বিবেচনাতে বলা যায় দেশে যে ভোটাধিকার অর্জনের অন্দোলন চলছে তার সাথে মূলত ভাষার স্বাতন্ত্রিকতার লড়াইও চলছে। দুটো বিজয়ই এখন পরস্পরের হাত ধরাধরি করে চলছে। এবারে একুশের শিক্ষা হোক জাতীয় স্বাতন্ত্র্য রক্ষা। আমাদের অস্তিত্বের প্রতি যথাযথ সম্মান প্রদর্শন করতে হলে অবশ্যই গণতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিতে হবে। এটা করা গেলেই একুশের প্রতি যথাযথ সম্মান প্রদর্শিত হবে। একুশের চেতনায় যারা নিজেদের মেলাতে চান তাদের সকলের এ ব্যাপারে আন্তরিকতার কোন বিকল্প নেই।
লেখক : সাংবাদিক, কলামিস্ট



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন