একুশের চেতনার বাস্তবায়ন ছাড়া প্রকৃত সম্মান প্রদর্শন হয় না
আবদুল আউয়াল ঠাকুর : সাধারণত একুশের কথা উঠলেই আমরা মায়ের ভাষায় কথা বলি। অবশ্যই মায়ের ভাষার প্রতি সম্মান প্রদর্শনকে নিয়েই সব কিছুর সূত্রপাত। তবে এটাই
অধ্যাপক হাসান আবদুল কাউয়ূম : বাংলাভাষা আন্দোলনের স্থপতি সংগঠন তমদ্দুন মজলিস গঠিত হয় ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দের ১৪ আগস্ট পাকিস্তান কায়েম হবার ১৭ দিন পরে ১ সেপ্টেম্বর তারিখে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থ বিজ্ঞানের তরুণ অধ্যাপক আবুল কাসেমের উদ্যোগ ও বলিষ্ঠ নেতৃত্বে। বাংলাভাষার মর্যাদা সমুন্নত করার চেষ্টার সূত্রপাত ঘটে বিংশ শতাব্দীর শুরুতেই। মওলানা আকরাম খাঁ ফুরফুরার পীর মওলানা আবু বকর সিদ্দীকী (রহ.) ডাকার লুৎফর রহমান, মোহাম্মদ ওয়াজেদ আলী, ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ প্রমুখ বাংলা ভাষার পক্ষে বক্তব্য রাখেন। ১৯১৮ খ্রিস্টাব্দে বিশ্বভারতীতে ভারতের জাতীয় ভাষা প্রসঙ্গে কবি রবীন্দ্রনাথের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এক সেমিনারে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ। তিনি ভারতের বিভিন্ন ভাষার চুলচেরা বিশ্লেষণ করে বাংলাভাষাই যে ভারতের জাতীয় ভাষার উপযুক্ত তা তুলে ধরেন। অবশ্য সভাপতির ভাষণে রবীন্দ্রনাথ হিন্দির পক্ষে বক্তব্য রাখেন।
বাংলাভাষার গুরুত্ব সম্পর্কে একাডেমিক আলোচনা অব্যাহত থাকে। কিন্তু তখনও কোনো সাংগঠনিক আন্দোলনের সূত্রপাত ঘটেনি। ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দের জুলাই মাসে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার প্রাক্কালে আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলার ডক্টর জিয়াউদ্দীন আহমদ পাকিস্তানের রাষ্ট্র্রভাষা উর্দু হওয়া উচিত বলে অভিমত ব্যক্ত করেন। তার এই অভিমত খ-ন করে ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা সমস্যা শীর্ষক প্রবন্ধ প্রকাশ করেন ২৯ জুলাই ১৯৪৭। তিনি উক্ত প্রবন্ধে বাংলাভাষাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে গ্রহণ করার জোরালো দাবি উপস্থাপনা করেন। তিনি বলেন : বাংলার পরিবর্তে উর্দু বা হিন্দিকে গ্রহণ করা হইলে ইহা রাজনৈতিক পরাধীনতার নামান্তর হইবে।
তমদ্দুন মজলিস গঠনের ইতিহাস তুলে ধরে এর প্রতিষ্ঠাতা অধ্যাপক আবুল কাসেম বলেছেন : ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর অনুভব করলাম দেশে আদর্শিক, সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে এক বিরাট শূন্যতা ও অনিশ্চয়তা বিরাজ করেছে। একটি স্বাধীন সার্বভৌম দেশের ভবিষ্যৎ গড়ে তোলার জন্য চরিত্রবান আদর্শিক এবং অধিকার সচেতন গড়ে তোলার প্রয়োজন। হৃদয়ের এই একান্ত বিশ্বাস এবং আবেগ থেকেই তমদ্দুন মজলিস গঠনের উদ্যোগ গ্রহণ করি। ’৪৭ সালের ১ সেপ্টেম্বর তমদ্দুন মজলিস গঠন করি। তৎকালীন স্বাধীন পাকিস্তানে তমদ্দুন মজলিসের আত্মপ্রকাশ ছিল প্রতিবাদী আদর্শ কর্মী সৃষ্টির সুদূরপ্রসারী প্রচেষ্ট। (দ্রষ্টব্য ভাষা আন্দোলন : সাতচল্লিশ থেকে বায়ান্ন পৃ : ৪০)
এই তমদ্দুন মজলিস গঠনে অধ্যাপক আবুল কাসেমের পাশে ছিলেন সৈয়দ নজরুল ইসলাম, শামসুল আলম প্রমুখ।
শুরুতেই তমদ্দুন মজলিস লক্ষ্য করে উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার অশুভ পাঁয়তারা চালাচ্ছে। এর প্রতিবাদে তমুদ্দন মজলিস রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই দাবি নিয়ে আন্দোলনের সূত্রপাত ঘটায়। গঠিত হয় প্রথম রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ। এই পরিষদের আহ্বায়ক নির্বাচিত হন তমদ্দুন মজলিসের বিশিষ্ট কর্মী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফলিত ও রসায়ন বিভাগের অধ্যাপক ডক্টর নুরুল হক ভুইয়া। এই সংগ্রাম পরিষদ কেন্দ্রীয় শিক্ষামন্ত্রী ফজলুর রহমানের সঙ্গে বাংলাভাষাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবি নিয়ে সাক্ষাৎ করে। কিন্তু মন্ত্রী ফজলুর রহমান খুবই রুক্ষ্ম আচরণ প্রদর্শন করেন। পরবর্তীকালে পূর্ব পাকিস্তান সরকারের কাছে কয়েক হাজার স্বাক্ষর সম্বলিত এক স্মারকপত্র পেশ করা হয়। তাতে অতিসত্বর বাংলাভাষাকে পূর্ব পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা ও শিক্ষার বাহন হিসেবে গ্রহণ করার অনুরোধ করা হয়।
সম্প্রসারিত সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয় ১৯৪৮ সালের ২ মার্চ। এই পরিষদ তমদ্দুন মজলিস ছাড়া পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্র লীগগণ আজাদী লীগ, গণতান্ত্রিক যুবলীগ, সলিমুল্লাহ মুসলিম হল, ফজলুল হক মুসলিম হল, ইনসাফ পত্রিকা, জিন্দেগী পত্রিকা, দেশের দাবি পত্রিকা প্রতিনিধি ছিলেন। এই সর্বদলীয় আহ্বায়ক করা হয়। তমদ্দুন মজলিসের সক্রিয় কর্মী সলিমুল্লাহ হলের আবাসিক ছাত্র শামসুল আলমকে। এদিকে পাকিস্তান রাষ্ট্রের গভর্নর জেনারেল মুহম্মদ আলী জিন্নাহ ঢাকা সফরে আসবেন এই খবরে ভাষা সংগ্রাম পরিষদ ১১ মার্চ সারা দেশব্যাপী সর্বাত্মক ধর্মঘট আহ্বান করল। ধর্মঘট ঢাকা, যশোর, চট্টগ্রামসহ কয়েকটি জেলায় সর্বাত্মকভাবে পালিত হয়। অনেক নেতাকর্মীকে পুলিশ আটক করে। শেখ মুজিবুর রহমান, ওলী আহাদকেও আটক করা হয়। খাজা নাজিমুদ্দিন আবুল কাসেমকে এক পত্র দ্বারা ভাষা আন্দোলনকারীদের সঙ্গে বৈঠক করার আহ্বান জানান, সেই মতে বৈঠক হলো। সেই বৈঠকে ৭ দফা সম্বলিত এক চুক্তি স্বাক্ষরিত হলো। বন্দিরা মুক্তি পেলেন। ১৯ মার্চ জিন্নাহ সাহেব ঢাকায় এলেন। ২১ মার্চ ঢাকায় রেসকোর্স ময়দানে প্রায় ৩ লাখ লোকের সমাবেশে জিন্নাহ সাহেব পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা উর্দু হবে বলে দৃঢ় প্রত্যয় ব্যক্ত করলেন। জনতা নো নো বলে জোরালো প্রতিবাদ জানালো এরপর কার্জন হলে কনভোকেশন অনুষ্ঠানে জিন্নাহ সাহেব একই কথা বললেন। সেখানেও নো নো ধ্বনি উঠলো। এরপর ভাষার দাবি থেমে যায়। তমদ্দুন মজলিস ১১ মার্চ ভাষা দিবস হিসেবে পালন করতে থাকে। এই দাবি সোচ্চার রাখার জন্য তমদ্দুন মজলিস ১৯৪৮-এর ১৪ নভেম্বর সৈনিক নামে একটি সাপ্তাহিক পত্রিকা প্রকাশ করল। সৈনিকের সর্বশেষ সম্পাদক ছিলেন অধ্যাপক আবদুল গফুর। ১৯৫২ খ্রিস্টাব্দে কাজী গোলাম মাহবুবকে আহ্বায়ক করে এক শক্তিশালী রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়। এর সদস্য ছিলেন অধ্যাপক আবদুল গফুর। ২১ ফেব্রুয়ারি রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই দাবির মিছিলের উপর পুলিশ গুলি চালায়। এতে বরকতসহ কয়েক ছাত্র শহীদ হন। ২২ ফেব্রুয়ারি সৈনিক বিস্তারিত প্রকাশ করে। অধ্যাপক আবুল কাসেম ও আবদুল গফুরের বিরুদ্ধে হুলিয়া জারি হয়। তারা বাধ্য হয়ে আত্মগোপনে চলে যান।
তমদ্দুন মজলিসই ভাষা আন্দোলন সংগঠিত করে। ১৯৪৭ সালের ১৫ নভেম্বর তমদ্দুন মজলিস পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা উর্দু না বাংলা শীর্ষ পুস্তিকা প্রকাশ করে ভাষা আন্দোলনকে জোরদার ভিত্তি দান করেছিল।
লেখক : মুফাসসিরে কুরআন, গবেষক, সাবেক পরিচালক ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।