পটুয়াখালীর যুবক ক্বারী সাইয়্যেদ মুসতানজিদ বিল্লাহ রব্বানীর কোরআন তেলাওয়াতে মুগ্ধ যুক্তরাষ্ট্রবাসী
ইসলামি সভ্যতা ও সংস্কৃতি বিকাশে বাংলাদেশের অবদান অনস্বীকার্য। এদেশে ইসলামি সংস্কৃতি চর্চার ইতিহাস অনেক প্রাচীন।
স্টাফ রিপোর্টার : ‘আমি বাংলায় কঠা বলটে পারি’ শিশুদের মতোই ভাঙা উচ্চারণে নিজের বাংলা ভাষা শেখার প্রতি আগ্রহের কথা জানালের এ্যানি। ১৩ ফেব্রæয়ারি বাংলা একাডেমির বইমেলায় বাসন্তী শাড়ি পরে ঘুরতে এসেছে ব্রিটিশ নাগরিক এ্যানি। সঙ্গে এক প্রবাসী জানান, এ্যানি বাংলা ভাষা শিখছে। চীনের শিক্ষার্থী ইরা জানান, ভালো লাগা থেকেই বাংলা ভাষা শিখছেন। তবে বাংলাদেশে ব্যবসা ও সামাজিক উন্নয়নমূলক কাজ করার ইচ্ছার কারণেও শিখেছে বলে তিনি জানান। শুধু ব্রিটিশ এ্যানি ও চীনা ইরা নয়; বাংলা ভাষার প্রতি দরদ এবং কর্মজীবনেরর প্রয়োজনে অনেক বিদেশি বাংলা ভাষা শিখছেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আধুনিক ভাষা ইন্সটিটিউট এবং বনানীর ‘লার্ন বাংলা’ নামের প্রতিষ্ঠানে চিন, জাপান, অস্ট্রেলিয়ান, কোরিয়ান, মালয়েশিয়াসহ বিভিন্ন দেশের নাগরিকরা বাংলা ভাষা শিখছেন। অথচ আমরা বাংলা ভাষা শুদ্ধ করে শেখার বদলে মায়ের ভাষাকে অবজ্ঞা করছি।
আ’মরি বাংলা ভাষা। বিশ্বের সবচেয়ে মিষ্টি ভাষা হলো এই বাংলা। ২০১০ সালে ইউনেস্কোর জরিপে বিশ্বের সবচেয়ে ‘মিষ্টি ভাষা’ হিসেবে বাংলা ভাষা নির্বাচিত হয়। ’৫২ সালে আত্মত্যাগের বিনিময়ে অর্জিত রাষ্ট্রভাষা বাংলা আন্তর্জাতিক মাতৃভাষার গৌরব অর্জন করেছে। সেই মায়ের ভাষার শুদ্ধতা এবং সমৃদ্ধশালী করতে আমাদের কোনো গরজ নেই। ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ, ড. কুদরত ই খুদা’র বাংলার সমৃদ্ধিতে অসামান্য অবদান
রাখলেও এখন ভাষাবিদদের শুদ্ধভাষা চর্চা নিয়ে মাথাব্যথা নেই। অথচ বাংলা ভাষার গুরুত্ব বেড়ে যাওয়ায় বিদেশিরা বাংলা ভাষা শিখতে দূর-দূরান্ত থেকে ছুটে আসছে। বাংলা ভাষার প্রতি বিদেশিদের এই আগ্রহ কী আমাদের লজ্জা দেয় না? ফেব্রæয়ারি এলেই বাংলা ভাষা নিয়ে শুরু হয় হৈচৈ। অতঃপর...।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আধুনিক ভাষা ইনস্টিটিউটে প্রতি বছর অসংখ্য বিদেশি শিক্ষার্থী বিভিন্ন কোর্সে ভর্তির জন্য আবেদন করেন। এর মধ্যে বাংলা ভাষা শিখতে চায় এমন শিক্ষার্থীর সংখ্যা বেশি। জাপান, চীন, কোরিয়া, আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়া, রোমানিয়া, হাঙ্গেরী, থাইল্যান্ড, নেপালসহ বেশ কয়েকটি দেশের শিক্ষার্থী ও তরুণ এনজিও কর্মীরাই মূলত বাংলা ভাষা শেখার ক্ষেত্রে বেশি আগ্রহী। তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, কর্মজীবনের প্রয়োজনে তাদের যেমন বাংলা ভাষা দেখা দিতে ঝুঁকতে হচ্ছে; তেমনি কেউ কেউ শুধুমাত্র ভালোবাসার টানে বাংলা ভাষা শিখছেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আধুনিক ভাষা ইনস্টিটিউটের শিক্ষকদের মতে বিশ্বজুড়ে বাংলাদেশের অর্থনীতির অগ্রসরতায় বিদেশিদের অনেকে চাকরি ও ব্যবসার প্রয়োজনে বাংলা শিখছেন। বিদেশি যারা বাংলা ভাষা শিখতে আসেন তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, তারা যখন বাংলা শিখতে পাঠ নেন; তখন বানান ও উচ্চারণ-এর বিভিন্ন সমস্যায় পড়েন। কেউ কেউ আক্ষেপ করে বলেন, তোমরা ভাষার অধিকারের জন্য জীবন দিয়েছো অথচ বাংলা ভাষার উন্নয়নের জন্য কোনো পদক্ষেপ নিচ্ছে না কেন? দুঃখজনক হলেও বিদেশি টিভি স্টার জলসা, স্টার প্লাসের কারণে আমাদের ছেলেমেয়েদের অনেকেই বাংলার চেয়ে ভালো শুদ্ধ হিন্দি বুঝতে পারে। কিন্তু দেশের ভাষাবিদ, গবেষকরা নির্বিকার। হিন্দি ও ইংরেজির বহুল প্রভাব থেকে নতুন প্রজন্মকে বাঁচাতে ভারতের পশ্চিমবঙ্গ সরকার সময়োপযোগী পদক্ষেপ নিয়েছে।
নিজেদের ভাষা সংস্কৃতি ভুলে প্রতিনিয়ত অনেক বাংলাদেশী ইংরেজিসহ অন্যান্য ভাষার পিছনে ছুটছে। তবে আশার কথা হলো, সেই বিদেশিরা এখন শিখছে বাংলা। বাংলাদেশে বিদেশি শিক্ষার্থীদের বাংলা ভাষা শেখায় এমন একটি প্রতিষ্ঠান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আধুনিক ভাষা ইনস্টিটিউট। এখান থেকে প্রতিটি বছর ৪০ জনেরও বেশি বিদেশি শিক্ষার্থী বাংলা ভাষা শিক্ষা নিচ্ছে বলে প্রতিষ্ঠান সূত্রে জানা গেছে। জানা য়ায়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আধুনিক ভাষা ইনস্টিটিউটে প্রতি বছর প্রায় দুই হাজার শিক্ষার্থী বিভিন্ন কোর্সে ভর্তির জন্য আবেদন করেন। এর মধ্যে বাংলা ভাষা শিখতে চায় এমন বিদেশি শিক্ষার্থীর সংখ্যাও কম নয়। সম্প্রতি চীনের শিক্ষার্থীর ভাষা ইনস্টিটিউটে স¤প্রতি ৪ মাসের এক কোর্সে অংশ নেয়। সফলভাবে কোর্সটি সম্পন্ন করার পর তারা সনদপত্রও গ্রহণ করেছে। এ উপলক্ষে ভাষা ইনস্টিটিউট আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে শিক্ষার্থীরা বাংলায় বক্তৃতা দিয়েছে। বাংলা গান গেয়েছে। ভাষা ইনস্টিটিউটের অফিস কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আধুনিক ভাষা ইনস্টিটিউটে জুনিয়র কোর্স, ডিপ্লোমা কোর্স ও সিনিয়র ডিপ্লোমা কোর্স চালু আছে। তবে বর্তমানে ১০ জনের মতো বিদেশি শিক্ষার্থী জুনিয়র কোর্স করেছে। নতুন করে ডিপ্লোমা কোর্সে ভর্তি শুরু হবে বলেও তারা জানিয়েছেন। এছাড়া আধুনিক ভাষা ইনস্টিটিউটের অধীনে চার বছর মেয়াদি অনার্স চালু হচ্ছে বলে জানা গেছে।
আধুনিক ভাষা ইনস্টিটিউটের শিক্ষিকা ড. আয়েশা বেগম বলেন, বর্তমানে বাংলাদেশ অর্থনৈতিকভাবে এগিয়ে যাচ্ছে এ কারণে অনেকে ব্যবসার উদ্দেশ্যে বাংলা ভাষা শিখছে। বিদেশি ছাত্র-ছাত্রী ও এনজিও কর্মীদের মধ্যে বিশেষ করে বাংলা ভাষায় আগ্রহ বেশি তৈরি হয়েছে। অনেক শিক্ষার্থীর কাছে তৃতীয় ভাষা হিসেবে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। এছাড়া বাংলা ভাষা অনেকে ভালোবেসে শিখছে বলেও তিনি জানান।
চীনের শিক্ষার্থী ইরা জানিয়েছেন, বাংলা ভাষা মূলত তিনি ভালো লাগা থেকেই শিখছেন। তবে বাংলাদেশে ব্যবসা ও সামাজিক উন্নয়নমূলক কাজ করার ইচ্ছার কারণেও শিখেছে বলে তিনি জানিয়েছেন। এছাড়া বাংলা ভাষা খুবই মধুর ভাষা বলে তিনি জানান। জাপানের বিদেশি এক শিক্ষার্থী জানান, আমি এ দেশে আসার পর থেকেই বাংলা ভাষা শেখার আগ্রহ তৈরি হয়েছে। ভাষাটি শুনতে ও বলতে খুবই মধুর লাগে।
এদিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে বাংলা শেখা বিদেশি শিক্ষার্থীদের সংখ্যা প্রতি বছরই বাড়ছে। তবে তাদের থাকার মতো যথেষ্ট আবাসন সুবিধা না থাকায় অন্যান্য বিভাগে আগের থেকে এখন বিদেশি শিক্ষার্থীরা অনেক কমে গেছে। তারপরও বিদেশিদের মধ্যে বাংলা শেখার আগ্রহের কারণে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যে কোনো বিভাগ থেকে বাংলা ভাষা কোর্সেই বেশি শিক্ষার্থী ভর্তি হয়। এক সময় এশিয়ার বিভিন্ন দেশ থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম সারি বিভাগে ভর্তি হওয়ার জন্য আসত। তবে এখন তাদের ভালোবাসা বাংলার প্রতি তৈরি হয়েছে।
গত ১০ বছর ধরে বিশ্ববিদ্যালয়টিতে বাংলা ভাষা কোর্স বাদে অন্যান্য বিভাগে বিদেশি শিক্ষার্থী আসার সংখ্যা ক্রমেই কমছে। গত চার সেশনে ভর্তি হয়েছে মাত্র ১২ জন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিদেশি শিক্ষার্থীরা স্যার পি জে হার্টজ আন্তর্জাতিক হলের মাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন। ওই হল কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ২০১৩-১৪ শিক্ষাবর্ষে ভর্তি হয় ৫ জন, ২০১৪-১৫ শিক্ষাবর্ষে ৩ জন, ২০১৫-১৬ বর্ষে ৩ জন এবং সর্বশেষ শিক্ষাবর্ষে ভর্তি হয়েছে মাত্র ১ জন।
পি জে হার্টজ হলের প্রশাসনিক কর্মকর্তা জানান, হলে বর্তমানে ১৩২ জন বিদেশি শিক্ষার্থী রয়েছেন। তাঁদের অধিকাংশই বিভিন্ন মেডিক্যাল ও ভাষা শিক্ষা কোর্সে পড়াশোনা করছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক ভবন সূত্রে জানা যায়, বিদেশি শিক্ষার্থীদের ভর্তির জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো নিজস্ব নীতিমালা নেই। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমেই তাদের ভর্তি হতে হয়। এ ছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক ভবনে বিদেশি শিক্ষার্থীদের জন্য আলাদা কোনো কার্যালয় না থাকায় ভর্তি হতে এসে হয়রানির শিকার হন তারা।
এদিকে দশটি ভাষা শেখাতে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউটে ৩টি ডিজিটাল ল্যাংগুয়েজ ল্যাবরেটরি স্থাপন করা হচ্ছে। ভাষার মাসে নেয়া হয়েছে এ উদ্যোগ। দশটি ভাষার মধ্যে বাংলা ভাষাকে অধিকতর গুরুত্ব দিয়ে শেখানো হবে বলে জানা গেছে। জানা যায়, ‘লার্ন বাংলা’ নামে রাজধানীর বনানীতে ২০১০ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় ভাষাকেন্দ্রিক এই সংগঠন। উদ্দেশ্য বিদেশিদের বাংলা ভাষা শেখানো। শুরু থেকে এখন পর্যন্ত এক হাজারের বেশি বিদেশি নাগরিক এখানে বাংলা ভাষা শিখেছেন। এখনো অনেকে শিখছেন।
শুধু দেশে নয়। বাংলা ভাষার এমন নিবিড় চর্চা চলছে জাপানের বিদেশি ভাষা শেখার অন্যতম বড় বিশ্ববিদ্যালয়, টোকিও ইউনিভার্সিটি অব ফরেন স্টাডিজে। ভিন দেশে বাংলা ভাষা শিখছে এখন ভিন দেশিরা। তাও যেনতেন ভাবে না, রীতিমত চার বছরের স্নাতক কোর্স। এখানে ২৭টি ভাষার মধ্যে আছে বাংলা ভাষায়ও শিক্ষা লাভের সুযোগ। ২০১২ সালে যাত্রা শুরু করে বাংলা বিভাগ। প্রতি বছর যেখানে ভর্তি হন ১০ জন করে শিক্ষার্থী।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।