পটুয়াখালীর যুবক ক্বারী সাইয়্যেদ মুসতানজিদ বিল্লাহ রব্বানীর কোরআন তেলাওয়াতে মুগ্ধ যুক্তরাষ্ট্রবাসী
ইসলামি সভ্যতা ও সংস্কৃতি বিকাশে বাংলাদেশের অবদান অনস্বীকার্য। এদেশে ইসলামি সংস্কৃতি চর্চার ইতিহাস অনেক প্রাচীন।
২৪ ঘণ্টার ব্যবধানে সড়কে প্রাণ গেল ৩৭ জনের, রাস্তায় অদক্ষ চালক আর ফিটনেসবিহীন বাস ষ পুলিশ ব্যস্ত চাঁদা আদায়ে : অসহায় মানুষ : নিরাপত্তাহীন সড়ক মহাসড়ক
উমর ফারুক আলহাদী : সড়ক-মহাসড়কে লাশের মিছিল। প্রতিদিনই কোনো না কোনো এলাকায় সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণহানি ঘটছে। দিন দিন এ সংখ্যা আরও বাড়ছে। দেশে প্রতি বছর সড়ক দুর্ঘটনায় গড়ে ১২ হাজার লোক নিহত ও ৩৫ হাজার আহত হচ্ছেন। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) অ্যাক্সিডেন্ট রিসার্চ সেন্টারের (এআরসি) গবেষণায় এ তথ্য জানা গেছে। অন্যদিকে, বিশ্বব্যাংকের পরিসংখ্যান অনুযায়ী সড়ক দুর্ঘটনায় বাংলাদেশে প্রতি ১০ হাজার যানবাহনে মৃত্যুর হার ৮৫ দশমিক ৬। বেসরকারি এক হিসাব বলছে, ২০১৬ সালে সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছে ৪ হাজার ২৬৯ জন। সড়ক দুর্ঘটনা এখন নিয়তি বলেই মনে করছেন সাধারণ যাত্রীরা। রাজধানী ঢাকা ও তার বাইরে সড়ক-মহাসড়কগুলোও বেহাল দশা। অদক্ষ চালক আর ফিটনেসবিহীন বাস প্রতিনিয়তই চলাচল করছে। নেই কোনো নজরদারি। পুলিশ ব্যস্ত চাঁদা আদায়ে। ফলে সড়ক-মহাসড়ক নিরাপত্তাহীন হয়ে পড়ছে বলে মনে করছেন সাধারণ মানুষ। গতকালও নরসিংদী ফরিদপুরসহ বিভিন্ন স্থানে ২৪ ঘণ্টার ব্যবধানে সড়কে প্রাণ গেল ৩৭ জনের। চালকদের বেপরোয়া যান চালানোর কারণে প্রায় প্রতিদিনই প্রাণহানি ঘটছে। সড়ক দুর্ঘটনার এই ভয়াবহ পরিস্থিতি মোকাবেলায় নেই সরকারের কোনো প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ। শুধু মামলা আর গাড়ি জব্দ করাতেই আটকে আছে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী। আবার তদন্তের নামে বছরের পর বছর ফাইলবন্দি হয়ে আছে সড়ক দুর্ঘটনার মামলাগুলো। দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি না হওয়াতে সড়ক দুর্ঘটনায় নিহতের লাশের মিছিল আরো দীর্ঘ হচ্ছে বলে মনে করেন সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা।
নরসিংদীর বেলাবো উপজেলায় যাত্রীবাহী বাস ও মাইক্রোবাসের মধ্যে মুখোমুখি সংঘর্ষে নিহতের সংখ্যা বেড়ে ১২ জন হয়েছে। আহত হয়েছে অন্তত নয়জন। গতকাল রোববার সকালে উপজেলার দড়িকান্দি এলাকায় ঢাকা-সিলেট মহাসড়কে এই দুর্ঘটনা ঘটে। এ ঘটনায় আরো ৬ জন আহত হয়েছেন। নিহত ব্যক্তিদের মধ্যে পাঁচজন পুরুষ, চারজন নারী ও দু’জন শিশু। সবাই মাইক্রোবাসের আরোহী ছিল। তাদের বাড়ি কিশোরগঞ্জের নিকলী উপজেলায় বলে জানা গেছে। পুলিশ ও প্রত্যক্ষদর্শী ব্যক্তিদের ভাষ্য, মাইক্রোবাসটিতে ১৪ জন আরোহী ছিলেন। আরোহীদের এই সংখ্যা মাইক্রোবাসের ধারণক্ষমতার চেয়ে বেশি। মাইক্রোবাসটি দুমড়ে-মুচড়ে গেছে। আর বাসের সামনের দিকে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। সবচেয়ে মর্মান্তিক ঘটনা ঘটেছে ফরিদপুরের নগরকান্দায়। গত শুক্রবার রাতে গ্যাস সিলিন্ডারবাহী কাভার্ড ভ্যানের সঙ্গে বেপরোয়া গতির যাত্রীবাহী বাসের সংঘর্ষের পর আগুন ধরে যায় দুটি গাড়িতেই। এতে পুড়ে মারা গেছেন ১৩ জন। নিহত ব্যক্তিদের মধ্যে দুটি গাড়িরই চালক রয়েছেন। অন্যরা বাস চালকের সহকারী ও ১০ যাত্রী। এ দুর্ঘটনায় দগ্ধ ও আহত হয়েছেন ৩৩ জন।
এ ছাড়া শুক্রবার রাত থেকে গতকাল শনিবার রাত পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টায় মাগুরা, গাজীপুর, নাটোর ও রাজশাহীতে সড়ক দুর্ঘটনায় এক সাবেক সেনাসদস্যসহ আরও ১২ জন নিহত ও ৪২ জন আহত হন।
পুলিশের হিসাবে, গত তিন বছরে গড়ে দুই হাজার মানুষের প্রাণ গেছে সড়ক দুর্ঘটনায়। তবে সড়ক দুর্ঘটনা নিয়ে কাজ করা বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির হিসাবে, ২০১৬ সালেই ৪ হাজার ৩১২টি দুর্ঘটনা ঘটেছে। এসব দুর্ঘটনায় প্রাণ হারান ৬ হাজার ৫৫ জন। আহত হয়েছেন প্রায় ১৬ হাজার মানুষ। এর আগের বছর প্রাণহানি হয় ৮ হাজারের বেশি মানুষের।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের সড়ক দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউটের (এআরআই) পরিচালক অধ্যাপক মোয়াজ্জেম হোসেন বলেন, আপাতদৃষ্টিতে মনে হয়েছে, গত ২৪ ঘণ্টার দুর্ঘটনার মূল অনুষঙ্গ বেপরোয়া গতি। চালকেরা বেপরোয়া গতিতে এবং একের পর এক পাল্লা দিয়ে যান চালানোর কারণেই দুর্ঘটনাগুলো ঘটেছে। বুয়েটের ওই অধ্যাপক আরও বলেন, মহাসড়কে গড়ে প্রতি মিনিট পরপর একটি গাড়ি আরেকটিকে পাশ কাটিয়ে (ওভারটেকিং) এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে। ফলে প্রতি ওভারটেকিংয়ে একটি করে দুর্ঘটনার ঝুঁকি তৈরি হয়। এটি প্রতিরোধে মহাসড়কে কার্যকর কোনো ব্যবস্থা নেই। বেপরোয়া গতি নিয়ন্ত্রণে আনতে মহাসড়কে বিশেষ ক্যামেরা বসাতে হবে। কম খরচেই এটা করে অনেক মানুষের জীবন বাঁচানো সম্ভব।
যশোর-মাগুরা সড়কের শেখপাড়ায় গতকাল একটি মাইক্রোবাস নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে খাদে পড়ে গেলে চারজন নিহত হন। যশোর-মাগুরা সড়কের শেখপাড়া নামক স্থানে গতকাল ভোররাতে সড়ক দুর্ঘটনায় একই পরিবারের তিনজনসহ চার ব্যক্তি নিহত হয়েছেন। আহত হন আরও ১০ জন। রাজবাড়ীর গোয়ালন্দের দৌলতদিয়া ও দেবগ্রাম ইউনিয়নের ১৩ জন একটি মাইক্রোবাসে যশোরের বেনাপোল যাচ্ছিলেন। পথে সেটি নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে খাদে পড়ে যায়। আহত ব্যক্তিদের ফরিদপুর, ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল এবং বিভিন্ন চিকিৎসাকেন্দ্রে ভর্তি করা হয়েছে।
গাজীপুরের রাজেন্দ্রপুর আরপি গেট এলাকায় শুক্রবার রাতে সড়ক দুর্ঘটনায় সাবেক সেনাসদস্যসহ তিনজন নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন অন্তত পাঁচজন। নিহত ব্যক্তিদের মধ্যে প্রতিরক্ষা গোয়েন্দা মহাপরিদপ্তরের (ডিজিএফআই) উচ্চমান সহকারী মো. আবু হানিফ এবং অবসরপ্রাপ্ত সেনাসদস্য মো. আনোয়ার হোসেনের নাম জানা গেছে। পুলিশ জানায়, রাত সাড়ে নয়টার দিকে রাজেন্দ্রপুরগামী একটি ট্রাকের সঙ্গে বিপরীতমুখী যাত্রীবাহী ইজিবাইকের সংঘর্ষে ঘটনাস্থলে এ তিনজন নিহত হন। এলাকাবাসী আহত ব্যক্তিদের উদ্ধার করে স্থানীয় ক্লিনিক এবং শহীদ তাজউদ্দীন আহমদ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে পাঠান। এছাড়া গাজীপুর সিটি করপোরেশনের অধীন চক্রবর্তী এলাকার নবীনগর-চন্দ্রা সড়কে গত শনিবার রাতে যাত্রীবাহী বাস ও ট্রাকের সংঘর্ষে বাসের দুই যাত্রী নিহত এবং কমপক্ষে ২০ জন আহত হন। সংঘর্ষে বাস ও ট্রাক উল্টে পার্শ্ববর্তী খাদে পড়ে যায়।
নাটোরের বড়াইগ্রাম উপজেলার আইড়মারি সেতু এলাকায় বনপাড়া-হাটিকুমরুল মহাসড়কে গতকাল ভোর পাঁচটার দিকে একটি ট্রাক অপর একটি ট্রাককে ধাক্কা দিলে দু’জন নিহত ও সাতজন আহত হন। বনপাড়া হাইওয়ে থানা-পুলিশ জানায়, মহাসড়কের পাশে একটি ট্রাক থেকে কয়েকজন আরোহী নামার সময় অপর একটি ট্রাক পেছন থেকে এসে ট্রাকটিকে ধাক্কা দেয়। এতে পেছনের ট্রাকের দুই আরোহী ঘটনাস্থলে নিহত হন। রাজশাহীর পুঠিয়ায় গতকাল ট্রাকের ধাক্কায় বিদ্যুৎ বিভাগের একজন কর্মকর্তা নিহত হয়েছেন। তাঁর নাম আবদুর রাজ্জাক (৫৯)। বাড়ি সিরাজগঞ্জের পুষ্টিগাছা এলাকায়। তিনি নাটোর পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির অধীন পুঠিয়া কার্যালয়ের সহকারী ব্যবস্থাপক (এজিএম) হিসেবে কর্মরত ছিলেন। রাজশাহীর পবা হাইওয়ে থানা-পুলিশ জানায়, সকাল সাতটার দিকে কাঁঠালবাড়িয়া এলাকায় আবদুর রাজ্জাক ঢাকা-রাজশাহী মহাসড়কের পাশ দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিলেন। এ সময় রাজশাহীগামী একটি ট্রাক তাঁকে চাপা দিলে তিনি গুরুতর আহত হন। পরে স্থানীয় লোকজন উদ্ধার করে রাজশাহী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে পাঠানোর পর চিকিৎসাধীন অবস্থায় বেলা ১১টায় তাঁর মৃত্যু হয়।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, বাংলাদেশে সড়ক দুর্ঘটনায় প্রতিদিন গড়ে ৫৫ ব্যক্তির মৃত্যু ঘটছে। এছাড়া বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সূত্র মতে, এশিয়া প্যাসিফিক অঞ্চলের ১২ দেশের মধ্যে প্রতি ১০ হাজার যানবাহনে বাংলাদেশে নিহতের হার সর্বোচ্চ। এ সংখ্যা ১৬৯ জন। সড়ক দুর্ঘটনায় যে কেবল একটি প্রাণের মৃত্যু হচ্ছে তা নয়, এর ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ দেশের মোট জিডিপির (মোট দেশজ উৎপাদন) ২ শতাংশ। এ ছাড়া বিশ্লেষণে দেখা যায়, দুর্ঘটনায় মোট মৃতের শতকরা ৬০ ভাগ কর্মক্ষম জনগোষ্ঠীর, যাদের বয়স ১৫ থেকে ৪৫ বছরের মধ্যে। দুর্ঘটনায় যিনি মারা যাচ্ছেন তার সঙ্গে তার পুরো পরিবারেও নেমে আসছে অনিশ্চয়তার ঘন ঘোর অন্ধকার।
বুয়েটের দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউটের গবেষকরা বলছেন, মহাসড়কের চার শতাংশ এলাকায় শতকরা ৩৫ ভাগ দুর্ঘটনা ঘটছে। আর দুর্ঘটনার কারণে বছরে আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ ৭ হাজার কোটি টাকা। পাওয়ার অ্যান্ড পার্টিসিপেশন রিসার্চ সেন্টার (পিপিআরসি) ও ব্র্যাকের যৌথ গবেষণা প্রতিবেদনে জানা যায়, দেশে ৬৯ শতাংশ দুর্ঘটনার জন্য দায়ী বাস ও ট্রাক। নিহতদের মধ্যে বাস ও কারের আরোহী ১৯ শতাংশ। তিন চাকার গাড়ির আরোহী ১৬ শতাংশ এবং সাইকেল চালক ৩ শতাংশ। চালকদের ৮১ শতাংশ গাড়ি চালনা শিখছেন অপ্রাতিষ্ঠানিক প্রক্রিয়ায়। আর অদক্ষ চালকের কারণে ২০০০ থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত প্রতি বছর গড়ে ৪ হাজার ১৩৭ জন দুর্ঘটনাস্থলেই মারা যান। গবেষকরা দুর্ঘটনার নয়টি কারণ চিহ্নিত করেন। এগুলো হলো বেপরোয়া যান চালানো, চালকের প্রশিক্ষণের অভাব, ত্রুটিপূর্ণ যানবাহন, মোটর চালিত যান ও ধীরগতির যানের একই সঙ্গে চলাচল, সড়কের ধারে ঝুঁকিপূর্ণ কর্মকা-, সড়কের নকশায় ত্রুটি, ট্রাফিক আইনের দুর্বল প্রয়োগ, সড়ক নিরাপত্তা বিষয়ে সচেতনতার অভাব, পথচারীর ঝুঁকিপূর্ণ আচরণ ও আইনি দুর্বলতা।
জানা যায়, ২০১৬ সালের সড়ক দুর্ঘটনার মধ্যে বাস দুর্ঘটনা ৭১০টি, পণ্যবাহী ট্রাক, কাভার্ড ভ্যান ও লরীর দুর্ঘটনা ঘটেছে ৬৬২টি, প্রাইভেট কার ও মাইক্রোবাসের দুর্ঘটনা ১৯২টি, সিএনজি-অটোরিকশা, ইজিবাইক, লেগুনা, নসিমন, টেম্পো, ভটভটি, আলমসাধু, মহেন্দ্র ইত্যাদি অবৈধ যানবাহনের দুর্ঘটনা ঘটেছে ৩৮৭টি এবং মোটরসাইকেলে ২৪৯টি। এছাড়াও রেললাইন পার হওয়ার সময় রেলক্রসিং-এ বিভিন্ন যানবাহনসহ রেল দুর্ঘটনা ও ট্রেনে কাটা পড়ার মতো দুর্ঘটনা ঘটেছে ১৮৪টি।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।